প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সেকাল - একাল থেকে দূরবীণে (৩) (সূচী)

একদিন-প্রতিদিন (সন্ধ্যা হ'ল গো ও মা)

[একটা বিষয় এইখানে খোলসা ক'রে নেওয়া দরকার। এই ক্রমপর্যায়ের রচনা (যদি একে আদৌ রচনা ব'লে মনে হয়) আমার আত্মজীবনী নয়। আত্মজীবনী লেখার কোন বাসনা আমার নেই, আর সেটা পড়ার আগ্রহও কারও থাকবে না জানি। এটা মোটামুটি ভাবে যে পরিসর এবং কালের মধ্য দিয়ে আমি জীবন কাটিয়েছি কলকাতায়, তা কয়েকটি শব্দগুচ্ছে ধ'রে রাখার দুঃসাহস। সময়টা মোটামুটি ভাবে ইংরাজী ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৭২ সাল; এর মাঝেও আবার মাঝের সাতটি বছর, যে সময়টা আমি বেলুড় মঠ ও শিবপুরে কাটিয়েছি, খালি বাত্সরিক অবকাসগুলিতে বাড়ীতে আসতাম এবং সপ্তাহান্তে বাড়ী আসা তো ছিলই; তাই সেই সময়ের কলকাতার চিত্র খুব ঘন নয়। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৮ সালের প্রায় শেষ পর্যন্ত সাত বছরে আমি কর্তব্যোপলক্ষে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি (অবশ্যই মাঝে মাঝে কলকাতায় এসেছি); ফিরে স্থায়ী ভাবে এসেছি ১৯৭৮ সালের শেষে। তখন কলকাতার চেহারা প্রায় যুদ্ধবিধস্তের ম'ত। 'কাটছে মাটি দেখবি আয়' (ছংধা), ছংঢশা এবং মেট্রো রেলের পুরষ্কারহীন প্রতিযোগিতায়। এর মাঝে ছোটখাটো টুর্ণামেন্টের ম'ত ছিল ছশিছ, ছঅলচতেতঅ থএলএপহওনএস-- এদের অবদানও ছিল মাঝেমাঝে। তবে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনিবার্যভাবেই এসেছে; আমি তো আর একটির বেশী স্কুল বা কালেজে পড়ি নি। আর পাড়াও দুই বা তিনটির বেশী নয় যা আমার বাসস্থান বা স্কুল এবং আসা যাওয়ার পথে ছিল। তাই দেখার পরিসর বড় নয়।]

অলিখিত নিয়ম ছিল সন্ধ্যা বেলার গ্যাসের বতি জ্বললেই ঘরে ফিরতে হবে। প্রত্যেক পাড়াতেই গ্যাসবাতির পোস্ট ছিল তিনশ' ফুট অন্তর। এই গ্যাসবাতি ছিল একটা আবেগের ব্যাপার। গ্যাস জ্বালাতে ওঠা থেকে জ্বালানোর পর আলো ছড়িয়ে পড়া পর্যন্ত। একটি আট-ন' ফুটের মই নিয়ে বাতিওয়ালা আসত, আর আমরা তার পিছে পিছে যেতাম। দেশলাই দিয়ে গ্যাসের বাতিটি জ্বালিয়ে দিলে একটা স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে যেত। আর গ্যাসের জালটা যখন বদলান হ'ত, সেটা একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। একটি পিজবোর্ডের বাকস থেকে ম্যান্টলটা বার করে বাক্সটি ফেলে দিত, আর আমাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পরে যেত কে পাবে তাই নিয়ে। সেইটি দিয়ে একটি টেলিফোনের নকল বানানো হ'ত। হায়, সেই সব মোহময় জিনিষ হারিয়ে গেছে ক'লকাতা শহর থেকে। একই সময়ে বেজে উঠত শাঁখ; তিনবার বাজিয়ে, বাড়ীর মায়েরা কপালে নমস্কার করতেন। সেটাও ছিল আর একটি মোহময় ব্যাপার। এখন আর পাওয়া যায় না।

নকল টেলিফোন আরও একরকমের ছিল| একটি দেশলাই বাক্সের কাঠি রাখার অংশটিতে একটি পিন দিয়ে ফুটো ক'রে তার মধ্য দিয়ে সুতো চালান করে দিয়ে সুতোর যে অংশটি বাক্সের ভিতরে শেষ হচ্ছে সেখানে একটি ঝাঁটার কাঠির ছোট টুকরো বেঁধে দেওয়া হ'ত; সুতোর অপর প্রান্ত থাকত আর একটি দেশলাই বাক্সে ঠিক একই ভাবে| কানে লাগিয়ে শোনা আর মুখের সামনে ধ'রে কথা বলা, যদিও যথাসাধ্য উচ্চস্বরে কথা বলা হ'ত যাতে অপর প্রান্তের শ্রোতা শুনতে পারে| কলিং টোনের ব্যাপার ছিল ঐ ঝাঁটার কাঠি টেনে ছেড়ে দিয়ে| এই ব্যাপারটিই আরও কারিগরীভাবে উন্নত ক'রে প্রয়োগ করা হ'ত উত্তরকালে দেশলাই বাক্সর বদলে টিনের কৌটো ব্যবহার ক'রে, ঠিক যেমনটি 'ওরা থাকে ওধারে' ছায়াছবিতে দেখান হয়েছিল|নকল টেলিফোন আরও একরকমের ছিল যেটি 'ওরা থাকে ওধারে' চলচিত্রে দেখান হয়েছিল।

গলির মধ্যে বাড়ীতে বাড়ীতে অবিবাহিত মেয়েদের কণ্ঠে গান বা গানের প্রচেষ্টা কানে আসত; কোনও বাড়ী থেকে কানে আসত গানের মাষ্টার শেখাচ্ছেন-- এই কি গো শেষ দান (কে জানে তার মধ্যে কোনও ঈশারা আছে কি না); আবার কোনও বাড়ীতে মধ্য শীতকালে হয়তো শেখান হচ্ছে-- আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়। তা, অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ের কনে দেখার ইন্টারভিউ পাশ করাতে হ'লে কনে দেখার আলোই যথেষ্ট ছিল না; সংসারের কাজকর্ম ছাড়া গানেও রপ্ত হ'তে হ'ত। আর শুধু রবিঠাকুরের গান নয়, অন্য ঠাকুর-দেবতার গানও প্রয়োজন হ'ত। তবে বাড়ীতে বেকার যুবক গানের রেওয়াজ সাধারণতঃ সকাল বেলাতেই ক'রত। পাশের বাড়ী থেকে ভেসে আসত পরীক্ষার প্রস্তুতির আওয়াজ-- 'আকবরের রাজত্বকালে, উঁ উঁ আকবরের রাজত্বকালে' বা-- 'বাংলার কৃষি মৌসুমী জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল', ইত্যাদি, ইত্যাদি। গৃহশিক্ষকের আসার সময়ও ছিল সন্ধ্যাবেলা।
এই গৃহশিক্ষকেরা স্কুলের টিচার ছিলেন অথবা বি এ তথা এম এ পাশ করা বেকার যুবক।

বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝে আরও একটি হাজিরা দেবার ব্যাপার ছিল কারও কারও ক্ষেত্রে। সেটি হলো পাঠাগার যা অল্পবিস্তর সব পাড়াতেই ছিল। এগুলি চালাত কিছু তরুন আর যুবকেরা, যারা খেলাধুলায় খুব আগ্রহী ছিল না। পাঠাগারগুলি চলত পাড়ার কিছু সম্পন্ন গৃহস্থের অর্থানুকুল্যে। বাড়ীতে নিয়ে যাবার জন্য বই থাকত আর থাকত একটি বা দুটি দৈনিক পত্রিকা। বেশীর ভাগ গল্প ও উপন্যাস থাকত, রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই থাকত। সাময়িক পত্রিকা দেখি নি, হয়ত সেদিকে নজর দেবার ইচ্ছা চিল না ব'লে সেই স্কুলে পড়ার বয়সে। পাঠাগারগুলির বাত্সরিক অনুষ্ঠান বলতে থাকত সরস্বতী পুজা আর গরমের ছুটির আগে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। এ ছাড়াও নেতাজীর জন্মদিন, স্বাধীনতা দিবস এসবও থাকত। বৈশাখের প্রথম দিনে প্রভাত ফেরী থাকত।

সন্ধ্যার ফিরিওয়ালা, যতদূর মনে পড়ছে, দুটি সময়ে আসত। প্রথম আসত সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। 'বে-ই-ল ফুল' ইত্যাদি ডাক দিয়ে, এবন্দ সেটা গরমের সময়। মরশুমি ফুলের, বিশেষ ক'রে শীতকালের, কথা মনে পড়ে না। খুব সম্ভব দেখি নি। রাত্রি দশটার সময় আসত, প্রায় লুই আর্মস্ট্রং-এর গলায় 'মালাই বরফ, কুলফী মালাই' ইত্যাদি ব'লে। ততক্ষণে পথঘাটের শব্দ অনেক কমে গেছ, ফলে অনেক দূর পর্যন্ত সেই ডাক শোনা যেত।

সাড়ে সাতটার সময় আরম্ভ হ'ত-- অল ইণ্ডিয়া রেডিও, খবর পড়ছি বেচু বন্দ্যোপাধ্যায়, বা বিভুতি দাশ বা নিলীমা সান্যাল। স্থানীয় সংবাদ বহূ পরে যোগ হয়, ততদিনে নাম হয়েছে আকাশবাণী কলকাতা আর স্থানীয় সংবাদ পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। দুটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান খুবই জনপ্রিয় ছিল-- বুধবার রেডিও সিলোনের 'বিনাকা গীতমালা' যেটি সঞ্চালনা ক'রতেন অমীর সাহানী তাঁর কণ্ঠসম্পদ দিয়ে। সে রকম কণ্ঠ আমি আর শুনি নি (কে জানে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটি গান-- 'এমন মধুরধবনি আর শুনি নি' এই স্মৃতিতেই কি না)। শুক্রবারে হ'ত বেতার নাটক। খুবই জনপ্রিয় ছিল এই সান্ধ্য নিয়মিত অনুষ্ঠানটি, যা পরিবারের সকলে একসঙ্গে উপভোগ ক'রতেন। বেতার নাটকে প্রায় সব প্রথিতযশা শিল্পীই অংশ নিয়েছেন, অবশ্যই সেই সময়ের। বাংলা খবরের পর আধুনিক বাংলা গানের অনুষ্ঠান ছিল, যাতে নামী দামী শিল্পীরা গাইতেন। তবে এই সব অনুষ্ঠানের আগে মায়েরা, কোন যাদুবলে কে জানে, রাতের রান্নাটা সেরে রাখতেন টাইম ম্যানেজমেণ্টের উৎকর্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন রেখে। ধন্যি তাঁদের কৃতিত্বের। সেই মায়েরাও এখন দুস্প্রাপ্য।

খাওয়ার পর কেউ কেউ বেড়িয়ে পড়তেন ট্রামে ক'রে ঘুরতে, বিশেষ করে যাদের মন্থলি টিকিট থাকত। তখন ট্রামের ট্র্যাক, কোচ সবই উন্নত মানের ছিল। ট্রামে ক'রে এসপ্লানেড যাওয়া খুব উপভোগ্য ছিল। রেসকোর্স থেকে এসপ্লানেড ট্রাম যেত অল্প দুলুনি দিয়ে যাতে ঘুম এসে যেত। পাড়ার মাতালরা ফিরতেন এর বেশ কিছু পরে। কেউ কেউ এই সময় বই পড়তেন, কেউ আবার লিখতেন-- চিঠি, ডায়েরী, সাহিত্যরচনা, সংসার খরচের হিসেব-- যা হোক। দূরে এমন কি কাছেও রাম ধুন, কীর্তন ইত্যাদি কানে আসত যসি রাত দশটার পর জেগে থাকতাম। কোন শিশুর ঘুম ভেঙে কান্না বা ক্ষিধের কান্না। আর একটু আগেই যা বলেছি-- 'মা-লা-ই ব-র-ফ' বা কুলফী বিক্রেতার আহবান। পরদিন সকালে ওঠার জন্য ঘুমাও বাছারা।

পুষ্পেন্দু সুন্দর মুখোপাধ্যায়

(চলবে)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।