সেকাল
- একাল থেকে দূরবীনে (৪)
(সূচী)
একটি সপ্তাহ-- রবিবার, সে কেন মা গো এমন
দেরী করে!
[2002 সালে সবেতন কর্মজীবন
থেকে অবসর নিয়েছিলাম| প্রথম প্রথম একটু সময় ফাঁকা ব'লে মনে হ'ত;
পরে ক্রমে সেটা সয়ে গেল| একটা অসুবিধা কিন্তু খুবই বুঝতাম| সপ্তাহ
কবে শুরু আর কবে শেষ হচ্ছে বুঝতে অফিস টাইমে, অর্থাত্ সকাল নটা
আর বিকেল ছটা রাস্তায় না বেরুলে বোঝার উপায় নেই অথচ রস্তায় বেরুনোর
কোন প্রয়োজন নেই, আর ইন্জিনীয়ারিং কলেজ জীবনে পড়া Theory of
least energy-- এর আমি নিবেদিতপ্রাণ ভক্ত| ফলে কবে রবিবার বোঝার
উপায় ছিল না|]
সোম, মঙ্গল, বুধ এরা
সব আসে তাড়াতাড়ি-
এদের ঘরে আছে বুঝি মস্ত হাওয়াগাড়ী|
রবিবার, সে কেন মা গো এমন দেরী করে?
ধীরে ধীরে পৌঁছোয় সে সকল বারের পরে|
একালের সপ্তাহ আর সেকালের সপ্তাহের মধ্যে দুটি পার্থক্য আমার
মনে হয়| এক-- এখন বাইবেলের বাণী মেনে সপ্তাহ শুরু ক্যালেণ্ডারে
সোমবার দেখানো হয় এবং সপ্তাহের শেষদিন রবিবার| কিন্তু সেকালে
ক্যালেণ্ডারে সপ্তাহের শুরু রবিবার দেখান হ'ত| দ্বিতীয় বিষয়টি
হ'ল-- এখন আমার মনে হয় একালে সপ্তাহের দুটি ভাগ' এক সোম থেকে
শুক্র আর দুই, শনি-রবি| সেকালে সপ্তাহের পাঁচটি ভাগ বোঝা যেত|
এক সোম, মঙ্গল, বুধ-- এই তিনটি দিনে কোন তফাত্ ছিল না, গতানুগতিক
একইরকম| (তবে বিদ্যামন্দিরে আই এস সি পড়ার সময় প্রতিদিন সকালটা
আরম্ভ হ'ত প্রার্থনা মন্দিরে ভিন্ন ভিন্ন গান দিয়ে|)
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুইবার
শাঁখের আওয়াজ শোনা যেত| প্রথমবার সন্ধ্যা হ'লেই-- প্রাত্যহিক;
দ্বিতীয়টি ছিল কিছুটা পরে যখন অন্ধকার নেমে এসেছে| কুলুঙ্গীতে
অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবীর সপ্তাহিক পূজা-- শেষ হ'লে তিনবার শঙ্খধ্বনি
আর তার পরেই বাতাসা| তার আগে মায়েদের লক্ষ্মীদেবির পাঁচালী পাঠ|
বিকাল পাঁচটায় সাপ্তাহিক বেতার অনুষ্ঠান ছিল 'গল্পদাদুর আসর--
পরিচালনায় জয়ন্ত চৌধুরী|
শুক্রবার
দুপুর দুটোয় ছিল বেতার অনুষ্ঠান 'মহিলা মহল'-- পরিচালনায় শ্রীমতী
বেলা দে| শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার খবরের পর সাপ্তাহিক বেতার
নাটক হ'ত এক ঘণ্টার| এই অনুষ্ঠানে তত্কালীন প্রথিতযশা শিল্পীরা
প্রায সকলেই অংশ নিয়েছেন-- বিকাশ রায়, জহর গাংগুলি, বীরেন্দ্র
কৃষ্ণ ভদ্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, তরুন রায়, মলিনা দেবী, সরজুবালা
প্রভৃতি| 'বহুরূপী' গোষ্ঠীর বেশ কিছু নাটক হ'য়েছে রেডিয়োতে;
এছাড়া 'মুখোশ' নাট্যদলের নাটকও নিয়মিত হ'ত| খুবই জনপ্রিয় ছিল
অনুষ্ঠানটি; বাড়ীর সকলে একজোট হ'য়ে শুনত|
শুক্রবার সন্ধ্যায় আরও
একটি ব্যাপার ছিল| তবে সেটি মেস পাড়ায়; হয় তো এখনও আছে| আমহার্ষ্ট
স্ট্রীট (এখন নাম রাজা রামমোহন সরণী), হ্যারিসন রোড (এখন নাম
মহাত্মা গান্ধী রোড), মির্জাপুর স্ট্রীট (এখন নাম সূর্য সেন
স্ট্রীট) আর লোয়ার সার্কুলার রোড (এখন নাম আচার্য জগদীশ চন্দ্র
বোসে রোড) দিয়ে ঘেরা কলকাতার এক ফালি জায়গায় এই মেস বোর্ডিংগুলি|
এখনও মেস বোর্ডিংগুলি আছে| যাঁদের চাকরীর প্রয়োজনে দেশের বাড়ী
ছেড়ে কলকাতায় আসতে হয়, এবং রোজ ট্রেন করে (ডেইলি প্যাসেন্জার)
কলকাতা আসা ও ফিরে যাওয়া করতে চান না বা দূরত্ব খুবই বেশী তাঁরাই
এই মেসগুলিতে থাকতেন| শনিবার অফিস শেষে তাঁরা দেশের বাড়ী চলে
যান আর সোমবার সকালে বা রবিবার রাত্রে ফেরেন| এঁরা অফিসে সহকর্মীদের
কাছে 'হপ্তাবাবু' নামে পরিচিত ছিলেন| এঁদের কারণে শুক্রবার রাতে
ভাল-মন্দ খাওয়া অর্থাত্ ফিষ্টি হ'ত প্রতি শুক্রবার রাতে| বড়
ভাল খাওয়া ছিল| পরে হষ্টেল থাকাকালীন আমি কয়েকবার এই রকম ফিষ্টি
উপভোগ করেছি| আর রহস্য এই যে সব রকমের রুচির সাথে মেসগুলির রান্না
মিলে যেত| এই রকম মেস দেখান হয়েছে 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছায়াছবিতে|
এই মেসগুলি এখনও আছে, হয় তো শুক্রবারের ফিষ্ট এখনও আছে|
শনিবার তফাতটা আরম্ভ হ'ত
দুপুর একটা থেকে| স্কুল, কলেজ, অফিস- সব মোটামুটি একট- দেড়টায়
বন্ধ হ'ত| কিন্তু অফিস থেকে ফেরার যাত্রীদের অভিমুখ তিন রকমের
ছিল| একটি দল বাড়ীর দিকে, একটি দল হাওড়া বা শিয়ালদহ (ষ্টেশন)
অভিমুখে মফস্বলের বাড়ীর দিকে এবং একটি দল রেসকোর্সের দিকে| বিকেল
তিনটে-চারটের সময় আরও একটি জনস্রোত দুই বা তিনটি গোষ্ঠীতে ভাগ
হ'য়ে ছুটত ময়দানের তিনটি ঘেরা মাঠের দিকে-- প্রিয় দলের ম্যাচ
দেখতে|
শনিবার দুপুরে রেডিয়োতে
কুড়ি মিনিটের একটি অনুষ্ঠান ছিল-- কৌতুক নক্সা ও কৌতুক গান|
এই অনুষ্ঠানের অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন নবদ্বীপ হালদার|
হাজরা রোড-হরীশ মুখার্জীরোডের মোড়ে সেখানে দমকলের একটি ডিপোর
টিক বিপরীতে একটি বাড়িতে নবদ্বীপ হালদার থকতেন| বাড়ীতে কমেডী
শিক্ষার একটি স্কুলও তিনি পরিচালনা করতেন| তাঁর বেশ কয়েকটি কৌতুক
নক্সা রেকর্ডে প্রকাশিত| সেগুলি এখন দুস্প্রাপ্য| একটি কৌতুক
নক্সার সংলাপ, সাক্ষী ও উকিলের মধ্যে জবানবন্দী 'কমলাকান্তের
জবানবন্দীর চেয়ে কম নয়| সেটি মোটামুটি এইরকম:
- তোমার সেই বোয়ালমাড়ি
না ভেটকিমাড়ির চর যেতে কতক্ষণ লাগে?
- এজ্ঞে কিসে যাবেন, হেঁটে না লৌকায়?
- ধর, নৌকায়?
- গণে না বেগণে?
- ধর বেগণে?
- উজানে না ভাটিতে?
- ধর ভাটি তে?
- দিবসে না রজনী তে?
- ধর, রজনীতে?
- তাহলে, আমি কেন আমার বাবাও লিয়ে যেতে পারবেন না|
কয়কটি কয়েকটি কৌতুক গানের রেকর্ড ছিল নবদ্বীপ হ্হলদারের, তাঁর
সেই ট্রেডমার্ক কণ্ঠে| যথা, শরীরটা আজ বেজায় খারাপ, আর খেতে
পারি না মাগো ইত্যাদি| যশোদাদুলাল মণ্ডলের বেশ কয়েকটি হাসির
গানের রেকর্ড ছিল যা প্রায়ই এই অনুষ্ঠানে বাজানো হ'ত| যথা, আমি
ডেলি প্যাসেন্জার, ক্যালকাটা নাইনটিন ফর্টি-থ্রী অক্টোবর, তাহলে
আসি ভাই প্রভৃতি| কিছু গান একনও you tube ওয়েবসাইটে পাওা যায়|
১৯৬৮ সালে, তখন রাজ্যপাল ধর্মবীরের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির শাসন
চলছে, ময়দানে কনক বিল্ডিং- বিপরীতে প্রতি শনিবার 'মুক্তমেলা'
বলে একটি জমায়েত বসত| কারা এই জমায়েত প্রবর্ত্তন করেছিলেন, জানি
না, কয়েকমাস চলার পর, বিশেষ রাজনৈতিক দলের উপদ্রবে আসরটি ভেঙে
যায়| সেই আসরে একজন নিয়মিত ছিলেন এই ডক্টর যশোদাদুলাল মণ্ডল
তাঁর কৌতুক গানের পশরা নিয়ে|
কৌতুক
নক্সার পর হ'ত 'অনুরোধের আসর'| খুবই জনপ্রিয় ছিল এই রেকর্ড সঙ্গীতের
আসরটি| তত্কালীন প্রথিতযশা শিল্পীদের গান বাজান হ'ত| সেই যুগটি
ছিল বাংলা গানের, বিশেষ ক'রে আধুনিক বাংলা গানের, স্বর্ণ যুগ|
কোন কোন শনিবারে বিকেল
পাঁচটায় থাকত মোহনবাগান ও ইষ্টবেঙ্গল- এই দুটি ফুটবল টীমের মধ্যে
ফার্স্ট ডিভিসন লীগ বা আই-এফ-এ শীল্ডের চ্যারিটি ম্যাচ| দুপুর
থেকে জনস্রোত ছুটত ময়দানের দিকে ম্যাচ দেখতে| যারা ময়দানে যেত
না, তারা ম্যাচের ধারা বিবরণী শুনতে বসত পারিবারিক বা ক্লাবের
রেডিয়োতে| তখন রেডিয়ো সেটগুলি ছিল বড়| একটি রেডিয়োর সামনে আট-দশজন
ঘিরে বসত শুনত| বিবরণী দিতেন বেরী সর্বাধিকারী ও পিয়ারসন সুরিটা|
ম্যাচের কিছুদিন আগে থেকেই দুই দল সমর্থকের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক
ধীরে ধীরে উত্তেজনার মাত্রা চড়ত| ম্যাচ শেষের পর উত্তেজনা স্তিমিত
হয়ে যেত| আবার দুই বিবদমান গোষ্টী গলায়-গলায় ভাবে জমে উঠত| 'ওরা
থাকে ওধারে ছয়াছবিতে এটি বড় সুন্দর পরিবেশিত হয়েছে|
রবিবার যে অন্য দিনগুলির
চেয়ে আলাদা, তা সকাল থেকেই টের পাওয়া যেত| বড়রা ঘুম থেকে উঠত
একটু দেরী ক'রে| জলখাবারে একটু বৈচিত্র্য থাকত কোন কোন রবিবারে|
পাড়ার মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে সিঙারা, রসোগোল্লা, জিলীপি আসত|
সে সব আসত শালপাতার ঠোঙা, চেঙারি, ভাঁর ইত্যাদিতে| সেগুলি এখন
দেখা যায় না| আর দেখা যায় না আকাশ থেকে নেমে আসা চিলের ছোঁ মেরে
তুলে নেওয়া| চিল কলকাতা শহরে আর আছে কি? আর এক রকম জলখাবার ছিল
ছোট কচুরী, যাকে গুটকা কচুরী বলা হ'ত, আর হালুয়া| আগের দিনের
বেঁচে যাওয়া রসোগোল্লা-পান্তুয়ার রস দিয়ে এই হালুয়ার মিষ্টি
স্বাদ দেওয়া হ'ত| বাজারে মংসর দোকানে ভীড় জমত লাইন ক'রে| ছোটরা
যেত বড়দের সঙ্গে বাজারে| এর পর আসত নাপিত আসার পালা| এর জন্য
পরামাণিককে আগে থেকে খবর দিয়ে রাখতে হ'ত| তবে বড়রা পাড়ার সালুনে
যেত, যেখানে ছোটদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল| একটি পুরানো খবরের কাগজের
পাতার মাঝখানে গোল ক'রে কাটা হ'ত মাথা গলানর জন্য| কাটার ষ্টাইল
ছিল বাটি ছাঁট ব কদম ফুল| অপেক্ষাকৃত বয়স্করাও নাপিতের হাতে
প্রসাধন সারত|
সকাল
নটায় রেডিয়োতে থাকত পঙ্কজ মল্লিকের পরিচালনায় সঙ্গীত শিক্ষার
আসর| প্রথমে থাকত একটি সংস্কৃত স্লোক| তার পর নতুন গানের বাণে
শ্রুতিলিখন ক'রে নিতে বলতেন পঙ্কজ ন্মল্লিক| এবার গানটি শেখানর
পালা| এক-একটি গান শেখান হ'ত তিন বা চারটি অধিবেশনে| সাহে নটায়
আরম্ভ হ'ত ইন্দিরা দির পরিচালনায় 'শিশুমহল' 'তোমাদের ইন্দিরা
দি ব'লছি, ভাল আছো ত' সব?- আর বিভিন্ন স্কেলে কলস্বরে উত্তর
শোনা যেত-- হ্যাঁ-আ-আ-আ| সাড়ে দশটায় সিনেমা হলগুলিতে মরনিং শো
থাকত, যাতে ইংরাজী ছায়াছবি থাকত| সাড়ে বারোটায় আরম্ভ হ'ত 'Calling
All Children'|
দুপুরের খাবারের মেনুতে
একটি-দুটি পদ বেশী থাকত, যথা শুকত, চাটনী ইত্যাদি| এ ছাড়াও মাছের
ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য থাকত-- কোই, চিতল, চাঁদা প্রভৃতি মাছ হ'ত
মাঝে মাঝে| কখনও বা আসত গলদা বা বাগদা চিংরী, বা ইলিশ| বেশীর
ভাগ পরিবারে মাংস হ'ত দুপুরে| মাংস ছিল পাঁটা বা খাসীর| মুরগীর
মাংস বাঙ্গালীর বাড়ীতে এসেছিল অনেক পরে| যেমন ষাটের দশকের আগে
দিন ও রাত দুই বেলাতেই ভাত হ'ত| ষাটের দশকে এল রুটি খাওয়ার চল|
অভিভাকেরা দিবানিদ্রা সারতেন| মহিলারা বসতেন রেডিয়ো ঘিরে| ছোটরাও
সেই আসরে থাকত| পরের দিকে শণিবার ছাড়াও রবিবার দুপুরে 'অনুরোধের
আসর যোগ হ'য়েছিল| এর পরে থাকত বেতার নাটক|
শেষ হ'ত একটি সপ্তাহ আর গভীর দুঃখের সঙ্গে রাতের ঘুম, আবার ছ'
দিনের নৈমিত্তিক ঘানি টানা|
পুষ্পেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
(চলবে)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।