সেকাল
- একাল থেকে দূরবীণে (৫)
(সূচী)
বছর যায়, বছর আসে: শীতকালে খাই শাঁকালু
আগে লিখেছি 'বেতন নিবারক' (কথাটা শিব্রাম চক্রবর্ত্তীর 'মণ্টুর
মাষ্টার' গল্প থেকে নেওয়া) অবসর নেবার পর সপ্তাহান্ত বুঝতে অসুবিধা
হ'ত। আর একটি অসুবিধা বহু আগে থেকেই টের পেয়েছিলাম। সেটি হ'ল
বছর কখন শুরু আর কখন শেষ। স্কুলে পড়ার সময় সুনির্দ্দিষ্ট ভাবে
বুঝতাম একটি বছর শেষ হয়ে একটি নতুন বছর আরম্ভ হছে, যেটি শুধুমাত্র
প্রথম দিনের পর হারিয়ে যাচ্ছে না। স্কুলের গণ্ডী পার হবার পর
দেখলাম বছর শেষ হবার ব্যাপারটা শুধু তারিখের শেষ চারটি সংখ্যা
বদলান। বাকী গতানুগতিক। কিন্ত্তু স্কুলের ক্ষেত্রে একটি নতুন
অধ্যায় শুরু হচ্ছে পুরাতন অধ্যায় শেষ হয়ে।
স্কুলজীবনে আমাদের কাছে বছর শুরু শেষ থেকে-- অর্থাত্ বড়দিনের
এক বা দু'দিন আগে থেকে। পরীক্ষার রেজাল্ট
বেড়ুত। কেউ, খুবই অল্প ফেল, বাকীরা পাশ, আবার তাদের মধ্যেও কেউ
কেউ উপরের দিকে। সঙ্গে থাকত নতুন বছরের জন্য বইয়ের লিষ্ট।
আমাদের
স্কুলের জন্য বই পাওয়া যেত হাজরা মোড়ের উপরে, হাজরা পার্কের
বিপরীতে দুটি দোকানে। তার একটির নাম আজও মনে আছে-- ফরোয়ার্ড
পাবলিশারস। দোকান দুটির পরেই, অর্থাত্ উত্তর দিকে একটি রেষ্টুরেণ্ট
ছিল-- নাম Cafe। ভারী সুন্দর চা পাওয়া যেত আর তার সাথে চপ, ফ্রাই,
কাটলেট ইত্যাদি। জানি না দোকান দুটি আজও
আছে কি না, বহুকাল সে অঞ্চলে যাই না।*
আর একটু উত্তরে গেলেই উল্টদিকে আশুতোষ কলেজ।
বই
কিনে প্রথম কাজ ব্রাউন রঙের মলাট দেওয়া। তার পর নিজের নাম, স্কুলের
নাম, ক্লাশ, সেকশন, রোল নম্বর ইত্যাদি লেখা একটি কাগজের টুকরা
মলাটে সাঁটিয়ে দেওয়া। সেটির জন্য কাগজের টুকরাগুলি বইয়ের দোকান
থেকেই দেওয়া হ'ত শুধু আবশ্যকীয় তথ্য স্বহস্তে লিখতে হ'ত। কয়েকজনের
আবার শখ ছিল লেখা 'আমার নাম জানিতে হইলে ৫৫ পৃষ্ঠায় দেখুন'।
৫৫ পাতায় পৌঁছে দেখা যেত সেখানে লেখা-- 'আমার নাম জানিতে হইলে
৩৩ পাতায় দেখুন'; ৩৩ পাতায় গেলে আর একটি পাতায় খোঁজার নির্দেশ--
অনেকটা 'হ-জ-ব-র-ল' বইয়ের গেছোদাদার ঠিকানা পাওয়ার ব্যাপার।
যাই হোক, এখন অপেক্ষায় থাকা নতুন ক্লাশ শুরু হওয়ার জন্য-- সেটি
হ'ত নতুন খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসের ২ তারিখ থেকে। আর হ্যাঁ,
পয়লা জানুয়ারী সব অফিস, স্কুল, কলেজ, কোর্ট-কাছারী বন্ধ থাকত।
কবে জানি সেই সুন্দর প্রথা বন্ধ হ'য়ে গেল। সেই নতুন বছর শুরু
ক'রতে গেলে প্রথমেই আমাদের বারো মাসের তেরো পার্বণের কথা।
বছরের পার্বণের মোটামুটি চারটি মরশুম ছিল। প্রথম শীতের মরশুম
যেটি ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহতে শুরু হ'য়ে সরস্বতী পূজায় শেষ।
এর পরে ছিল মোটামুটি বসন্ত এবং গ্রীষ্ম দোল দিয়ে শুরু আর শেষ
স্কুলের গরমের ছুটির আরম্ভে। এর পর বর্ষা রথ, ষান্মাসিক পরীক্ষা
ইত্যাদি পার ক'রে বিশ্বকর্মা পূজায় সমাপ্ত। ঘাড়ে এসে প'রত পূজা
মরশুম মহালয়া দিয়ে শুরু ক'রে জগদ্ধাত্রী পূজ পার ক'রে বাত্সরিক
পরীক্ষা পূজা দিয়ে শেষ।
শীতের মরশুমের শুরু বড়দিন দিয়ে। বহু ছোট বয়সে গানের কথা প্রচলিত
ছিল-- 'যীশুর কৃপায় দাড়ি গজায়, শীতকালে
খাই শাঁকালু, মোদের যীশু পরম দয়ালু।' প্রভুর দয়া কেন খালি শাঁকালু
আর দাড়ির মধ্যে সীমিত থাকে বুঝতাম না, কিন্ত্তু মরশুমী ফল বাজারে
ঢুকত প্রচূর। বাজার আলো ক'রে আসত কমলা লেবু। আসত ঝাঁকে ঝাঁকে
পরিযায়ী পাখি সুদূর মেরু অঞ্চল, রাশিয়া প্রভৃতি জায়গা থেকে চিড়িয়াখানার
চোট ছোট জলাশয়ের মধ্যে দ্বীপগুলিতে বসত তারা। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০
সালের মধ্যে যখন আলিপুরের বেলভেডিয়র এষ্টেটে সরকারী আবাসনে থাকতাম
তখন প্রায়ই যেতাম হাঁটা দূরত্বের চিড়িয়াখানা দেখতে শীতকালে।
এখন আর অত পাখী আসে না, গগন ঝারু দেওয়া অট্টালিকার প্রাচুর্যের
কারণে। সেই অর্থে বড়দিন উৎসব তেমন লক্ষ করি নি। তবে যখন বেলেভেডিয়র
এষ্টেটে থাকতাম বড়দিনের আগের মাঝরাত্রে স্থানীয় দুটি মিশনারী
স্কুল ও চার্চ থেকে ক্যারল গীতি গাইতে ছেলে-মেয়েরা আসত-- বড়
ভালো লাগত শুনতে (ভীষণ ভালো লাগত না, কারণ ব্যাপারটা ভয় পাওয়ার
ব্যাপার নয়)।
বড়দিনের
হাত ধ'রে, ঠিক হাত ধ'রে নয় সাত দিন পরে নতুন বছর। যেমন মহালয়ার
সতদিন পরে আসে দুর্গাপূজা। তবে ঐ যে আগেই লিখেছি, বড়দিন এবং
তার উত্তরসুরী নতুন বছর শুধু একটি দিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত।
উত্সব ব্যাপারটা থাকত চার্চে এবং এংলো-ইণ্ডিয়ান পাড়ায়। সাতদিন
ধ'রেই আলোর বাতি, গান, নাচ ও তাদের উত্সব। আমরা ব্যাপারটা বুঝতাম
৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটায়। তখন হুগলী নদী অনেক বেশী নাব্য থাকত
এবং কলকাতা বন্দরের ডকে জাহাজ অনেক বেশী সংখ্যায় ভিড়ে থাকত।
ডকে সব জাহাজের স্থান সংকুলান হ'ত না, তারা নোঙোর ক'রে থাকত
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডক এলাকার বাইরে উত্তরে প্রায় হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত।
রাত বারোটায় সব কটি জাহাজ একিসঙ্গে হুইসিল বাজাত দশ-পনের মিনিট
ধ'রে যা অনেক দূর পযন্ত শোনা যেত। মনে পড়ে, ১৯৫৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর
মাঝরাতে, তখন আমি শিবপুর বি ই কলেজে পড়ি প্রথম বর্ষে, কলেজের
শতবর্ষ উত্সব চলছে; কিছু আগে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী ধরেছেন ভজন--
হরি ওম তত্সত্। রাত বারোটায় জাহাজের হুইসিল শুরু হ'ল, উস্তাদ
কিছুটা বিস্ময়ে, কিছুটা অপ্রস্তুতিত অবস্থায় গান থামালেন। জাহাজের
বাঁশী শেষ হ'লে প্রশ্ন ক'রলেন ব্যাপারটা কি এবং উত্তর শুনে কুর্ণিশ
ক'রে ব'ললেন-- নয়ে সাল সব কোইকো মুবারক হো এবং আবার গান ধ'রলেন
ঠিক যেখানে থেমেছিলেন।
তবে বড়দিন বা নতুন বছর নয়, প্রকৃত মরশুমি পরব ছিল ক্রিকেটের
যা বড়দিনের এক বা দুইদিন পরে আরম্ভ হ'ত। তখন ক'লকাতায় ক্রিকেটের
জোউলুশ অনেক বেশী ছিল এখনকার চেয়ে। এখন ক'লকাতায় বড় দরের ক্রিকেট
খেলার আসর প্রায় বসেই না এবং ব'সলেও কোন নির্দ্দিষ্ট দিন নেই।
তখন দুটি, কখনও বা তিনটি ক্রিকেট ম্যাচ থাকত সফরকারী বিদেশী
দলটির সঙ্গে। প্রথমে একটি বা দুটি তিন দিন ক'রে ম্যাচ, সব শেষে
পাঁচদিনের টেষ্ট। তিনটি ম্যাচ হ'লে প্রথমটি হ'ত ভারতবর্ষের সব
ইউনিভারসিটি থেকে ছাত্র বাচাই ক'রে একটি দল গড়া হ'ত বিদেশী টীমের
সঙ্গে তিন দিনের একটি ম্যাচ খেলার জন্য। এই রকম খেলা থেকেই সেন্চুরী
ক'রে রুসী মোদী ও পঙ্কজ রায় টেস্ট দলে এসেছিলেন। এর পরের ম্যাচটি
হ'ত গভরনরস ইলেভেন বা পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে। এই ব্যাপরটা নিয়মিত
ছিল প্রায় ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত, তার পরে ক'লকাতার গরিমা হ্রাস পেতে
থাকে।
ক্রিকেট খেলা দেখতে যাওয়া এবং তার প্রস্তুতি একটা দেখার ব্যাপার
ছিল। পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ম্যাচ পাঁচ দিন ধ'রে দেখা সে এক
এলাহী ব্যাপার। টিফিন কেরিয়ার ভর্তী খাবার, সাথের ব্যাগে ডিম
সেদ্ধ, মিষ্টি, কমলা লেবু আর জলের বোতল। মাঠে কেউ এ সব ছুঁড়ত
না। আমি একজনের কথা জানি; তিনি প্রতিটি বিশ্রামের আলাদা আলাদা
রসদ রাখতেন এবং বিকেলী চা-য়ের ব্রেক শেষ হ;লেই মাঠ থেকে বেড়িয়ে
বাড়ী চ'লে আসতেন। চা বা লেমোনেড ইত্যাদী ছাড়া কোন খাবার পাওয়া
যেত না। সব চেয়ে চিত্তাকর্ষক ব্যাপার ছিল টিপ্পনীগুলি। হয় ত
মাথায় পড়েছে লেবুর টুকরো বা চায়ের ভাঁর, যার উপর পড়েছে সে হয়
ত প্রশ্ন ক'রার মতো ব'লল- কে, সঙ্গে সঙ্গে অব্যর্থ উত্তর আসত--
'তোর বাপ'। এ ছাড়া ছিল হরেক রকমের স্লোগান। বোলার তার দৌড় শুরু
ক'রলে একজন উচ্চগ্রামে ব'লত. "ও বাবা তারকনাথের চরণে সেবা
লাগে"-- আর সমস্বরে ধুয়া পড়ত- "ম--হা--দে--এ--এ--ব"।
বোলারের গতির এবং পদক্ষেপের সনয়গে তাল রেখে এই মহাদেব স্লোগানটি
নিক্ষিপ্ত হ'ত ঠিক যখ্ন বোলার তার বলটি ছেড়েছে। বেশ কিছু রিহারসল
দেওয়া হ'ত নিশ্চয়। তবে দর্শকরা খুবই রসিক ছিল এবং বিদেশী দলের
ভালো খেলার তারিফও ক'রত। জাতীয়তাবাদ খেলার মাঠে খুব উগ্র ছিল
না। সত্যি কথা ব'লতে কি বিদেশী দলের সঙ্গে খেলায় ভারতীয় দলের
প্রদর্শনী প্রায়ই শোচনীয় মানের হ'ত। তার মাঝে কখনও দেখার মত
খেলা হ'ত কোনও বিজয় হাজারের।
ক্রিকেটের
উত্সব শেষ হ'ত আর শুরু হ'ত নতুন শিক্ষা বছর।নতুন ক্লাশ, নতুন
বই, নতুন বিষয় এবং সর্বোপরি নতুন মাষ্টার মশাই, হয় তো ক্লাশ
টীচারের বেলায়। তিনি কেমন লোক, জানার উপায় ছিল না। ব্যবহারেই
পরিচয় পাওয়া যেত। ক্লাশ টীচার কিন্ত্তু সহশিক্ষকদের কাছ থেকে
ছাত্রদের গুণাবলীর অগ্রিম খবর পেয়ে যেতেন এবং কোন ছাত্রকে কি
ভাবে দুরস্ত রাখতে হ'বে আগেই ঠিক ক'রে ফেলতেন। উপরের ক্লাশের
দাদাদের কাছ থেকে কোন রকম অগ্রিম পরিচিতি পাওয়া যেত না; বস্তুত
দাদাদের সঙ্গে কোন রকন যোগাযোগই ছিল না কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া।
একেবারে উপরের ক্লাশের ছাত্ররা স্কুলের সব রকম পাঠক্রমের অতিরিক্ত
কাজগুলির দায়িত্ব নিত-- সরস্বতী পূজা, খেলাধুলায় স্কুলের হয়ে
অংশ নেওয়া, স্কুলের ম্যাগাজিনের প্রকাশনা, প্রাইজ ডিষ্ট্রিবিউশন
ইত্যাদি।
পুষ্পেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
(চলবে)
*
অবসর-এ লেখাটি প্রকাশিত হবার পর পুষ্পেন্দুবাবু
জেনেছেন দোকান দুটি এখনও আছে। ছবি দুটি ওঁরই তোলা। অন্যান্য
ছবিগুলি ইণ্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।