সেকাল
- একাল থেকে দূরবীনে (৬)
(সূচী)
বছর
যায়, বছর আসে: শীতের শেষ
শীতের আর একটি বড় পরব ছিল, বিভিন্ন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন
। তখন এই কটি আসর খুব প্রসিদ্ধ ছিল-- অল ইণ্ডিয়া মিউসিক কন্ফারেন্স,
সদারঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন, ইত্যাদি । সঠিক মনে পড়ছে না, বোধ হয়
তানসেন মিউসিক কন্ফারেন্স বলেও একটি ছিল । দক্ষিণ ক'লকাতায় ইন্দিরা
ও ভারতী সিনেমা হলে দিন সতেক ধ'রে চলত, মহাজাতি সদনেও হ'ত ।
বস্তুত সশরীরে আমি একমাত্র মহাজাতি সদনেই গিয়েছি, ১৯৬২ ও ১৯৬৩
সালে । বাকী সময় রেডিয়ো তে শুনেছি । অল ইণ্ডিআ রেডিয়ো রিলে ক'রতেন
। ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন, যা এখন সব চেয়ে
প্রসিদ্ধ, তখন সে রকম প্রসিদ্ধি পায় নি, অথবা আমি জানতাম না
। শেষ দু' দিন সারা রাত্রি ধ'রে চলত । হলের বাইরেও বহু শ্রোতা
ব'সে- দাঁড়িয়ে শুনতেন । ভারতের সব খ্যাতিমান শিল্পীরাই এই আসরে
ভাগ নিয়েছেন । পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত বিনায়ক রাও পট্বর্ধন,
উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি, উস্তাদ আমীর খান, বিদুষী হীরাবাই বরোদেকর,
বিদুষী গাঙ্গুবাই হাঙ্গল, উস্তাদ নজাকত আলি-সলামত আলী ভ্রাতৃদ্বয়,
পণ্ডিত ভীমসেন জোশী, উস্তাদ আলাউদ্দীন খান, উস্তাদ আলী আকবর
খান, উস্তাদ বিলায়েত খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত শামতা প্রসাদ,
উস্তাদ আহ্মেদ জান থিরাকুয়া, পণ্ডিত কণ্ঠে মহারাজ, রোশন কুমারী,
আরও কত নাম ক'রব, সকলেই অংশ নিয়েছেন ক'লকাতার এই সব সম্মেলন
গুলিতে । বস্তুতঃ ক'লকাতার শ্রোতাদের রসজ্ঞ সমঝদার হিসাবে এতই
প্রসিদ্ধি ছিল সে সময়ে যে এখানে স্বীকৃতি পাওয়াটা সব শিল্পীই
চাইতেন এবং অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ক'লকাতায় পরিবেশন ক'রতেন ।
ক'লকাতার আসরগুলিতে তারিফ পেলে তা সারা ভারতে শ্রেষ্ঠ শিরোপা
ব'লে ধরা হ'ত । প্রামাণিকতা হিসাবে সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমী (ইণ্ডিয়া
টোবাকো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, যেটি টালিগঞ্জ মেট্রো ষ্টেশনের কাছে
অবস্থিত) দ্বারা লিখিত ও প্রকাশিত 'KheYaal GharaaNaas' পুস্তিকা
থেকে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান সম্বন্ধে লেখার অংশ বিশেষ তুলে
দিচ্ছি-- "Countrywise publicity came to him (Ustad Bade
Ghulaam Ali) after his debut concert in Kolkata in 1940. By
the mid-40s he was in great demand as a performer all over
the country."
শীতকালের বিশেষ রূপ বাজারে দেখা যেত । সব্জীর মেলা, মরশুমি ফুলের
মেলা, খেজুর গুড় ইত্যাদি । সকাল বেলা ফিরিওয়ালা মাথায় কলসী ভরা
খেজুড় রস নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত । পাটালী, ঝোলা-- সব রকম খেজুড়
গুড় বাড়ীতে বসেই পাওয়া যেত, বাজারে তো পাওয়া যেতই । বাজারে আসত
হরেক রকমের মাছ- খয়রা, ফোলুই, ভেটকী, পায়রা চাঁদা --গায়ে কালো
টিপ থাকত, আজকাল আর দেখি না । সব চেয়ে আকর্ষণীয় ছিল শীতের রোদ্দুর
আর সেই রোদ্দুরে গায়ে সরষের তেল মেখে স্নান । আর একটি বিশেষ
ব্যাপার ছিল সর-ময়দা গায়ে ঘষে ময়লা তোলা । দুধের সরে অল্প সরষের
তেল দিয়ে একটু ময়দা মিশিয়ে ছোট ছোট মণ্ডের মত করে গায়ে ঘষা ।
ময়লা তোলা ছাড়াও উপকারিতা ছিল ত্বককে আর্দ্র-তেলালো রাখা । তখন
moisturiser- এর বদলে এটির ব্যবহার ছিল । কলকাতার শীত সম্বন্ধে
কথিত আছে "in Calcutta, we observe winter, don't feel
it." । কলকাতার শীত কখনই সে রকম প্রবল ছিল না, এখন তো নয়ই
। তবে তখন, শীতকাল, যা মোটমুটি বড়দিনে আসত, দিন সাতেক কাটিয়ে
উধাও হ'য়ে যেত । আবার পৌষ সংক্রান্তি অর্থাৎ জানুয়ারীর মাঝামাঝি
হঠাৎ ফিরে আসত এবং বেশ জাঁকিয়ে । এখনও মোটের উপর সেই রকমই তবে
মাত্রাটা আগের চেয়ে কম লাগে । তখন কলকাতা অনেক ফাঁকা
ছিল, এখনকার তুলনায় । উনানের পাড়ে আগুনের উষ্ণতা হাতের তালুতে
বেশ আরামপ্রদ ছিল । মুখ থেকে বাষ্পর ম'ত হাওয়া ছাড়া যেত এবং
বেশ মজাই লাগত । সঙ্গীত সম্মেলন শেষ হ'লে পরের অঙ্ক ছিল পৌষ
সংক্রান্তি ও গঙ্গাসাগর মেলা । পৌষ সংক্র্রন্তি মানেই পিঠের
পার্বণ । সব বাড়ীতেই পিঠের উত্সব । তিন চার রকমের পিঠে, পাটি
সাপটা, সরু চাকলি আর পায়েস । এখনকার ম'ত দোকান থেকে কেনা হ'ত
না, গৃহশিল্প ছিল ।
এর
পরে আসত 'বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ', অর্থাৎ সরস্বতী পূজা । তবে তার
আগে আর একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান ছিল নেতাজী জন্মদিন । আমরা নেতাজীকে
মারা যেতে দিই নি । কারণ, তিনি আমাদের কিছু লোকের কাছে ঋণী ।
ঐ যে নেতাজী বলেছিলেন, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা
এনে দেব' । এখন এঁরা মনে করেন, দেশ এখনও স্বাধীনতা পায় নি, কিন্ত্তু
রক্ত তো কিছু গেছে, তা তাঁরা নাই বা দিয়ে থাকলেন; অতএব নেতাজী
মরেন নি, তিনি আছেন পৃথিবীর কোথাও-- কখনও শৌলমারীর সাধুর বেশে,
কখনও বা লৌহযবনিকার আড়ালে । খুঁজে তাঁকে বা'র ক'রতে হবে । যা
হো'ক, চপলতা থাকুক, আসল কথায় আসি । তখনও নেতাজীর কোন বড় মূর্ত্তি
এ শহরে বসে নি, যেমনটি এখন আছে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে আর
রাজভবনের দক্ষিনে । দুটি জায়গা ছিল, যেখানে নেতাজীর জন্মদিন
পালন ক'রা হ'ত । সকালে প্রভাত ফেরী ছিল সাধারণতঃ দুটি গান দিয়ে--
'হে বিজয়ী বীর, ফিরে এসো, এসো এসো ফিরে' আর 'তোমার আসন শূন্য
আজি, হে বীর পূর্ণ ক'র' । সন্ধ্যায় থাকত আলো আর বাজীর উৎসব হাজরা
পার্ক আর অক্টারলোনি মনুমেণ্টের পাদদেশে । খুবই অনুপম দৃশ্য
ছিল-- আলোর ঝরণা, রকেট (আকাশে উড়ে গিয়ে নেতাজী সম্বন্ধে কিছু
একটা স্তুতি মালা ক'রে ঝুলত কিছুক্ষণ), তোপের মতন শব্দবাজী ছাড়া
হ'ত নেতাজীর বয়স অনুযায়ী । যতদূর মনে আছে কোন রাজনৈতিক দলের
হাত ছিল না ।
সর্বজনীন সরস্বতী পূজা তখন ছিল না, পূজা হ'ত বাড়ীতে যদি কোন
স্কুল বা কলেজগামী থাকে, আর স্কুল বা কালেজগুলিতে । আর কেন জানি
না বাঙালী সিনেমা হলগুলিতে সরস্বতী পূজা হ'ত । এখন তো সেই সব
সিনেমাহলগুলি বেশীর ভাগ বন্ধ হ'য়ে গেছে । বাড়ীতে পূজা ক'রতেন
গৃহশিক্ষক বা বাবা-কাকা,মামা এঁরা কেউ । স্কুলগুলিতে সচরাচর
সংস্কৃতের শিক্ষক এই দায়িত্ব পেতেন । সজ্জার একটি অবশ্য অঙ্গ
ছিল পাতলা রঙীন কাগজের শিকলি । বাড়ীর পূজা তাড়াতাড়ি সেরে স্কুলে
ছোটা । তখন তো স্কুল হাঁটা দূরত্বের মধ্যেই থাকত কাজেই সময়ের
অকুলান হ'ত না । স্কুলে পূজার পর খাওয়া থাকত । স্কুল ছিল একমাত্র
জায়গা যেখানে মাটিতে না ব'সে বেঞ্চিতে খাওয়ান হ'ত । লুচি, ডাল,
একটি বা দুটি তরকারী, চাটনী ও মিষ্টি ।
পুষ্পেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
(চলবে)
*
অবসর-এ লেখাটি প্রকাশিত হবার পর পুষ্পেন্দুবাবু
জেনেছেন দোকান দুটি এখনও আছে। ছবি দুটি ওঁরই তোলা। অন্যান্য
ছবিগুলি ইণ্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।