প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সেকাল - একাল থেকে দূরবীণে (৭) (সূচী)

বছর যায়, বছর আসে: বসন্ত এল' বুঝি, এলো রে

সরস্বতী পূজো, আমার মনে হয় আমাদের দেশে অঘোষিত Valentine Day। আমাদের সময়ে Valentione Day ব'লে কোন ব্যাপার জানা ছিল না। ব্যাপারটা, ব'লতে গেলে এই বিশেষ নামটা, খুব হালে চালু হয়েছে। মূল ভাবটি আমাদের সময়েও ছিল. কিন্তু প্রকাশ ছিল অন্য রকম। প্রতি বছর এক ঝাঁক নতুন মেয়ে শাড়ী পড়া ধ'রত সরস্বতী পূজোর দিনে আর প্রেম নিবেদনের যোগ্য হ'য়ে উঠত; একটি প্রেমের প্রদীপ শিখা জ্বলে উঠত, আর কিছু নবীন তরুণ পতঙ্গ ছটফট ক'রে উঠত আত্মাহুতি দেবার জন্য। সাধে কি মান্না দে গেয়ে গেছেন, 'যদি ও চোখে রোশনী জ্বালো শুধু একবার, তাতেই পোড়াতে পারি যা কিছু আমার'। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি এখন, হয় তো এখনও ব্যাপারটা সেই রকম আছে, তবে সাজের ধরণটা পালটিয়েছে।

আরও দুটি বিষয় এখানে ব'লতে হয়। প্রথমটি হ'ল-- স্কুল-কলেজে প্রেমে পরা আর তার প্রকাশ হ'ত না, কারণ co-educatinal school বা college ছিল না। আর সর্বজনীন সরস্বতী পূজাও পাড়াতে পাড়াতে ছিল না। কিন্তু ছিল পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরী যেখানে সরস্বতী পূজো হ'ত। সেই পূজো দেখতে মেরাও আসত। কোন বিশেষ মেয়েকে দেখে কোন ছেলের উত্‍‌সাহ বেড়ে যেত ধুনুচী নাচের বা যা কিছু যাতে দৃষ্টি আকর্ষণ ক'রা যায়। আর ছিল বাড়ীতে শাড়ী তৈরী ক'রা। একটি পুরোণো ধুতি পাড়ের দিকে রঙ ক'রা হ'ত, এবং সেটি ছিল বাসন্তী রঙ। স্মৃতি ফেল না মারলে ব'লতে পারি তখন একটি সাবান পাওয়া যেত - নাম ছিল রঞ্জক সাবান। সেই সাবান দিয়ে ধুতিতে রঙ ক'রে শাড়ীর পাড় হ'ত। তো এই ছিল বসন্তের আগমনী।

ফেব্রুয়ারী মাসে ছিল ফুল তথা সবজীর প্রদর্শনী ও ডগ শো। ফুলের প্রদর্শনীর মধ্যে দুটি জায়গার শো খুব মনোরম ও বিখ্যাত ছিল। একটি ছিল আলীপুরের হরটিকালচার গারডেনে, অপরটি ছিল বিধান সভা ভবনে। বিধান সভা ভবনের বিশেষত্ব ছিল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ডলিয়া ও চন্দ্রমল্লিকা। ডগ শো হ'ত পার্ক ষ্ট্রীট-মেয়ো রোডের সংযোগ স্থলে ময়দানে। একজন সারমেয়প্রেমিকের নাম মনে পরে-- দিলীপ ভোস, যিনি ছিলেন বাংলায় স্কাউট আন্দোলনের পুরোধা নৃপেন্দ্র নাথ ভোসের পুত্র। নৃপেন্দ্র নাথ ভোস পেশাগতভাবে ব্যারিষ্টার ছিলেন। তিনি আবার আমাদের স্কুলের, অর্থাত্ সাউথ সুবারব্যান ব্র্যাঞ্চ স্কুলের পরিচালন সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সমিতির সভাপতি ছিলেন জাষ্টিস জ্যোতি প্রকাশ মিত্র। যা হোক, দিলীপ ভোস, তিনি থাকতেন ভবানীপুরের জদুবাবুর বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে, সম্ভবতঃ মোহিনী রোড ছিল রাস্তার নাম, পৈত্রিক প্রাসাদোপম বাড়ীতে। অনেক ডগ শো-তে প্রাইজ পাবার পর তাঁকে বিচারক ক'রে দেওয়া হ'য়েছিল, ফলে তিনি আর প্রতিযোগিতায় নিজের কুকুর দিতে পারতেন না। তাঁর একটি পিকিঙিজ কুকুর একবার রঙ্গমহল থিয়েটার হলের একটি নিয়মিত নাটকের কয়েকটি দৃশ্যে থাকত নায়িকার কোলে।

ঋতুরাজ বসন্তের আগমন বার্তার সঙ্গে আরো একটি বসন্তের প্রস্তুতি চ'লত, তবে সেটি অভ্যর্থনার নয়, প্রতিসেধকের। পাড়ায় পাড়ায়, স্কুল-কলেজে বসন্তের টিকা দেওয়ার পালা শুরু হ'ত। টিকা দু'রকমের ছিল। দুটি প্রথাতেই টিকা থাকত একটি কাঁচের ক্যাপিলারী, অর্থাত্ সরু একটি নলে। হাতের ফোরআর্ম বা ট্রাইসেপস পেশীর উপর দু' ইঞ্চি তফাতে দুটি ফোঁটা তরল প্রতিসেধক ঢেলে দেওয়া হ'ত। তার পর একটি ছোট ছুরীর ডগা দিয়ে দুটি- দু'টি দাগ দিয়ে চিরে দেওয়া হ'ত এবং প্রতিষেধকটিকে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হ'ত। আর একরকম যন্ত্র ছিল টিকে দেওয়ার-- যেটি একটি গোল নলাকার হ্যাণ্ডেল যার মাথায় চারটি তীক্ষ্ণ পিন থাকত। সেটি দিয়ে ঘুরিয়ে প্রতিষেধকটি শরীরে ঢোকান হ'ত। এই প্রথাটি বেশ বিভীষিকাময় ছিল কচি-কাঁচাদের কাছে। ঐ টিকে নিয়ে কারুর কারুর জ্বর হ'ত, এবং মহানন্দে স্কুল কামাই ক'রত। এতে হয়ত স্মল পকস থেকে রেহাই পাওয়া যেত, কিন্তু যাকে জলবসন্ত অর্থাৎ chicken pox ব'লত তা প্রায় প্রতি বাড়ীতেই প্রায় সকলের জীবনে হয়েছে একবার, কারুর বেলায় দু'বার। এখন সে সব বসন্ত ইতিহাস-রূপকথা হ'য়ে গেছে।

সরস্বতী পূজার কম বেশী ৪০ দিন পরে আসে দোল। এখনকার আর তখনকার দোলের মধ্যে মূল তফাত বিশেষ কিছু নেই। তবে তখন মেয়েরা রাস্তায় বেরুত না, যেমনটি এখন দেখতে পাওয়া যায়। তবে একটা প্রথা আগে যা ছিল, এখন বাঙালীদের মধ্যে আর দেখা যয় না। দোলের আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় কোন মাঠে জড়ো হ'য়ে পুরানো কাপড়, কাঠের টুকরা, বাঁশ ইত্যাদি পোড়ানো হ'ত। ব্যাপারটাকে 'ম্যাড়া পোড়া' ব'লা হ'ত। একটি ছড়া চেঁচিয়ে ব'লত সকলে, 'আজ আমাদের ম্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল'। সবটা এখন মনে নেই, তখনও যে সবটা বুঝতে পারতাম, তা নয়। প্রথাটির সঙ্গে একটি পৌরাণিক কাহিনী জড়িয়ে আছে হিরণ্যকশিপু ও প্রহ্লাদকে নিয়ে। এখন বাঙালী আর 'ম্যাড়া পোড়া' পালন ক'রে না। কিন্তু অবাঙালীদের মধ্যে প্রথাটি এখনও চালু আছে। দোলের দিন অনেক বাড়ীতেই সিদ্ধি বানানো হ'ত, সেটিও আজকাল চলে না।

স্কুলগুলিতে এই সময় আর একটি উৎসব চলত, বি টি টিচার উৎসব। ত্খন যেটি 'বি টি' নামে চালু ছিল, সেটি এখন বি এড ব'লে পরিচিত, তবে এখন প্রায় সব শিক্ষকই বি এড ক'রে নেন, তখন সে রকম ছিল না। রিচি রোডে সেণ্ট লরেন্স স্কুলের কাছে ছিল ডেভিড হেয়ার টিচারস ট্রেনিং কলেজ, যেখানে এটি পড়ানো হ'ত। আমাদের স্কুলের একজন শিক্ষক, নাম ছিল গোলক বিহারী পাণ্ডা, কয়েক বছর ছুটি নিয়ে পড়েছিলেন, এবং পাশ ক'রার যোগ্যতা নিয়ে আমাদের স্কুলে আবার যোগ দিয়ে ছিলেন। কেন জানি না স্কুলের যে সকল শিক্ষক, যাঁরা এটি নিতেন না, খুব অপছন্দ ক'রতেন এই শিক্ষাক্রমটিকে। শিক্ষাক্রমটির শেষভাগে কোন একটি স্কুলে প্র্যাক্টিকাল ট্রেনিং, ফাইনাল প্র্যক্টিক্যাল পরীক্ষা সমেত, নিতে হ'ত। ছাত্রদের ছিল পোয়া বারো। কোন বকুনী নেই, কোন শাস্তি নেই (হয় তো ছাত্ররাও তখন বাঁদরামি যথাসম্ভব কম ক'রত) অধিকন্তু ম্যাপ, রঙীন চক, পেনসিল ইত্যাদি পাওয়া যেত। স্কুলের শিক্ষকরা সবেতন ছুটি উপভোগ ক'রতেন, যদিও হাজিরা দিতে হ'ত। কিন্তু ছাত্রদের এই লাই দেওয়াটা ঘোরতর অপছন্দ ক'রতেন এবং যথাসম্ভব অসহযোগিতা ক'রতেন বি টি পরীক্ষার্থী শিক্ষকদের সঙ্গে। যতদূর মনে পড়ছে, বি টি টিচাররা ক্লাশ ফাইভ, সিক্স সেভেন ও এইট পর্যন্ত পড়াতেন।

এই ভাবে এগিয়ে যেতাম গরমের ছুটির দিকে। মে মাসে মাস দেড়েকের মত ছুটি থাকত। শেষ দিকে, দু' বা তিন সপ্তাহের ম্ত, ক্লাশ হ'ত সকাল বেলা সতটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে একদিন শিক্ষক আর ছাত্রদের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ হ'ত। শিক্ষকরা দু'বার আউট হ'লে, তবেই প্রস্থান ক'রতেন। কলেরার প্রকোপ লেগে যত প্রায়ই। স্কুলে স্কুলে কলেরার ইনজেকশন দেওয়া হ'ত এবং ফলতঃ কেউ কেউ জ্বরে পড়ত। গরমের ছুটি আরম্ভ হ'বার আগের দিন ক্লাশে কোন পড়াশুনা হ'য না। পরিবর্তে ছিল চাঁদা তুলে মাষ্টারমশাইদের খাওয়ানো। ক্লাশরুমের দরজায় দেবদারু পাতা আর ফুল দিয়ে তোরনের ম'ত ক'রে সাজানো হ'ত। মালা পড়িয়ে শিক্ষকদের এক একজনকে আলাদা ক'রে অভ্যর্থনা ক'রে উপহারও দেওয়া হ'ত।

পুষ্পেন্দু সুন্দর মুখোপাধ্যায়

(চলবে)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।