প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

মনে দাগ কাটা কিছু কথা

আমার বয়েস প্রায় ৭০ ছুঁই ছুঁই অনেক কথাই আজকাল ভুলে যাই। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া মনে দাগ কাটা কথা - যেগুলো একেবারে যোগ সূত্রহীন - কি করে কিছুতেই ভুলি না। এগুলোকে আমার স্মৃতির ভাণ্ডারের মণি মুক্ত , অন্তত আমার নিজের কাছে। যদি এরপরে ভুলে যাই - তাই মনে হলো কথা গুলো লিখে রাখি। স্বীকার করে নিচ্ছি শুরুতেই যে এর কোনটাই আমার লেখা বা ভাবা না। কিছু কথা পড়া। কোনটা বা কারুর কাছে শোনা । এরকম লেখার কোনো মানে আছে কিনা জানি না - কেউ পড়ে আনন্দ পাবে কিনা তাও জানি না। কিন্তু তবুও লিখছি - কারণ আমার মন লিখতে চাইছে। না লিখে আমার শান্তি নেই। তাই এই অত্যাচারটা পাঠক (যদি কেউ থাকে) - তাকে মেনে নিতে হবে।

১) শুরু করছি Bertraand Russel এর Marriage and Morals ১৬ পাতাতে লেখা একটা লাইনে থেকে। "Love as a relation between men and women was ruined by the desire to make sure of the legitimacy of children"। নিজের বুকে হাত দিয়ে আর খোলা মনে ভাবুন। সন্তান এর প্রতি এই বড় বেশী "আমার" এর দাবি আর মালিকানার দুর্গন্ধ কি আসল প্রেমকে অপবিত্র করে তোলে না?

২) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর দিবারাত্রির কাব্য অনেকেরই পড়া। তারই বিশেষ একটা লাইন পড়ে মনে হয়েছিল - প্রচণ্ড বৃষ্টির এ রকম তুলনা কি করে কেউ ভাবতে পারে? চিন্তাই করতে পারি না!
মালতির খুব সরল মনের মেয়ে আনন্দ! আনন্দ সমুদ্রে প্রবল বৃষ্টি দেখে বলেছিল 'কি বৃষ্টি নেমেছে! সমুদ্রটা পর্যন্ত ভিজে যাবে' । যে সমুদ্র সীমাহীন জলের আধার - সেটা ভিজে যাবে !!!

৩ ) এটা আমার এক বিশেষ বন্ধুর কথা। তার নাম করতে চাই না - তবে সে এখন নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ বিখ্যাত ব্যক্তি। এককালে BE College এর ছাত্র ছিল আর কথার শুরুতে "গুরু" বলা ছিল তার স্বভাব। ওর কথাতে বলি " গুরু - খবরদার নিজের কোনো ভালো image তৈরী করবে না। শালা সারা জীবন ওই image কে বাঁচিয়ে রাখতে রাখতে নিজেকে আর খুঁজে পাবে না। নিজের মত করে বাঁচতেও পারবে না। শালা নিজের image তা যত পারো খারাপ কর। কেউ তোমার কাছে কিছু আশা করবে না - আরামে নিজের ইচ্ছা মত বাঁচতে পারবে"। হালকা সুরে বলা এই কথাটার মূল্য এই বয়সে সে উপলব্ধি করছি। সত্যি যদি ওর কথা শুনতাম ?

৪ ) একই বন্ধুর আর একটা মন্তব্যও মনে পড়ছে। আমার বয়স তখন ৩০ এর অল্প কম - এই বন্ধু আরও একটু ছোট। বোম্বেতে আমাদের ঘরোয়া গানের আসর বসেছিল! আমাদের এক বন্ধু পত্নী বেগম আখতার এর "জোছনা করেছে আড়ি " গাইছিল। সুর ঠিক , গলাও সুন্দর কিন্তু তবু গান ঠিক জমছিল না! কিসের অভাব কেউ ঠিক বুঝতে পারছিল না! এই বন্ধু তখন এসে গানটা শুনলো! এক মিনিটে বলে দিল অভাবটা কিসের। বলল - এটা বেগম আখতার এর ঠুমরী - ভজন না । এত পবিত্র করে গাইলে হবে না - গানে একটু পাপ দাও। এর পরে গান অন্য মাত্রা পেল।

৫ ) এটা আর এক বন্ধুর কথা। কথাটা খুবই সহজ। মানতে পারলে জীবন অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে! ওর মতে শান্তি কে খোঁজা পাগলামো! শান্তি আমাদের নিশ্বাস এর মত! নিশ্বাস সব সময় নি - সেটা আমাদের মনেই থাকে না! কিন্তু দম বন্ধ হলে বুঝি - তার অভাবে কি কষ্ট!
শান্তি কে খুঁজে লাভ নেই - সেটা আছে আমাদের নিশ্বাস এর মত! সত্যি অশান্তি যখন আসবে - সেটা দম বন্ধ হবার মত ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দেবে! তাই বিশ্বাস করা উচিত - আমরা সাধারণ ভাবে শান্তিতেই আছি - ওর পেছনে দৌড় করা মানে সাধ করে অশান্তি ডেকে আনা !

৬ ) আমি তখন বম্বেতে এক অফিসে কাজ করি। আমাদের অফিসে তখন কাজ কম। তাই মাঝে মাঝে আড্ডা দিতাম - সেই আড্ডা তে এক সহকর্মী একদিন জিজ্ঞাসা করলো "Please" এর বাংলা কি? অনেক আলোচনা হলো কিছু দিন ধরে। এক দিন এই সহকর্মী খুব উত্তেজিত হয়ে সকালে অফিসে এসেই বলল "পেয়ে গেছি"। আমার সবাই জানতে চাইলাম - "Please" এর কি বাংলা ও পেল। ও বলল "একটু"। সবাই বললাম একটু মানে তো অল্প - তার সাথে "Please" এর কোনো মিলই নেই। ও বলল "বাংলা তে একই কথার অনেক মানে হতে পারে। ভেবে দেখো- "দাদা দেশলাই টা একটু দেবেন "- "দাদা একটু পাশ দেবেন" - এই সব ক্ষেত্রে "please" এর মানে কি একটু না। " আমরা সবাই মেনে নিলাম । বুঝলাম অনুবাদ করার সময় ভাবটাকে ঠিক রাখতে হবে - অভিধান এ লেখা অনুবাদ না।

৭ ) এবার একটু হালকা দিকে আসি! খুব বেশী তাত্ত্বিক হয়ে গেছে লেখাটা !
অনেক ছোট বেলা তে পড়া একটা কবিতা - বা ছড়া কোনো কারণ ছাড়া আজ ও মনে আছে। এটা আনন্দ বাজার-এর রবিবাসরীয় সংকলন-এ ছিল।
গ্রামের এক বৃদ্ধ বাড়িতে বউকে ১৬ টা কই মাছ দিয়ে পুকুরে স্নান করতে গেছে। ফিরে দেখে - বউ তার ভাত বেড়ে রেখেছে - সাথে শুধু একটা কই মাছ।
এবার কবিতার শুরু -

"১৬ কই শুলিয়ে (মানে গুনে নিয়েছিলে)?
২ গেল পালিয়ে
তবু থাকে ১৪?
২ তো নিল বামুন বৈদ্য
তবু থাকে ১২?
পাড়া পড়শীর কিছু ধার ও
তবু থাকে ১০?
২ তো তে এলো ঝাল রস
তবু থাকে ৮?
২ তে এলো খর কাঠ
তবু খাকে ৬?
(মাপ চাইতে হচ্ছে - এটা ঠিক মনে নেই)
তবু থাকে 8?
২ তে শোধ হলো নাপিত এর ধার
তবু থাকে ২?
একটা নিল হুই (হুই মানে চিল )
তবু থাকে ১ ?
চোখের মাথা খেয়ে দেখ
আমি হই ভালো মানুষের ঝি
তাই একে একে এত হিসাব দি
তুই যদি হস ভালো মানুষের পো
তো মাথা খান খা - মাছ খান আমার জন্যে থো"

চাকরি থেকে অবসর এর পরে আমাদের ভাগ্যতেও কি এই লেখা আছে???

শেষে কয়েকটা কথা যোগ করতে চাই । সকলেরই কোনো সময় ঘুম পায় , কোনো সময় খিদে পায় বা কোনো সময় তেষ্টা পায় । আমার এর ওপর এক এক সময় গান পায় - বিশেষ করে যখন প্রকৃতির অনেক কাছে চলে যাই । কিন্তু আমার গান খুবই বেসুরো - স্বরও একেবারেই মধুর না । তাই আমি গান পেলে সকলের ওপর অত্যাচার না করে দূরে সরে গিয়ে একা গান করি । আশ্চর্য হচ্ছে এই যে সে গান আমার কানে অতি সুমধুর শোনায় । মন তখন বেসুরো গলার বাধা মানে না - অনুমানে সব ফাঁক ভরিয়ে হৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে ।
এ কথাটা এই জন্যে বললাম যে এই বয়সে হঠাৎ কলম ধরে নিজের লেখাটা নিজের ভালই লাগছে । শুধু চিন্তা হয় - আমার বেসুরো গান-এর মত এটাও একমাত্র আমারই ভালো লাগছে কি না । তাই পাঠকদের কাছে বিশেষ অনুরোধ - সত্যি এটা কেমন লাগলো - একটু জানাবেন । কোনো নতুন suggestion থাকলে - তাও জানাবেন । এই ঠাকুরদাদার ঝুলি তে এ রকম আরও কিছু রসদ আছে - আপনাদের উৎসাহ পেলে আবার লিখব। কথা দিচ্ছি - ভালো না লাগলে এ অত্যাচার আর করব না ।

আর একটা অনুরোধ । আপনাদের মনেও নিশ্চয় কিছু "মনে দাগ কাটা কথা " আছে । লিখে ফেলুন না ? অনেক আশা নিয়ে আপনাদের লেখার জন্যে অপেক্ষা করব।

আজ এই অবধি। আসি -

বিজন বন্দ্যোপাধ্যায়
নভেম্বর ২০, ২০১১

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।