মনে
দাগ কাটা কিছু কথা
- পর্ব ২
১ম পর্বর
লেখা পড়ে আপনাদের কিছু লোকের ভালো লেগেছে জেনে আর এক পর্ব লেখার
সাহস আর উৎসাহ পেয়েছি । তাই আবার একটু কলম ধরছি। যা লিখেছি বা
এবার যা লিখছি – সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে শুধুই রসিকতা মনে হতে
পারে – কিন্তু আমার নিজের কাছে এগুলো আমার নিজের জীবনকে সুন্দর
করতে পথ দেখিয়েছে। কিছু পাঠকের মন্তব্য থেকে জেনে ভাল লাগলো
যে তাদের মনেও এগুলো দাগ কেটেছে।
এটা ধরে নিলে খুব বেশি হয়ে যাবে যে যারা এই লেখা পড়বেন - তারা
সবাই আগের লেখা পড়েছেন। তাই মুখবন্ধতে আর একবার একটু বলি যে
আমি প্রায় ৭০ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু কোথা থেকে জানি না – এই ছেঁড়া
ছেঁড়া মনে দাগ কাটা কথাগুলো লেখার একটা তাগিদ এসেছে। তাই ঝুলির
বাকি রসদ খালি না করে শান্তি পাচ্ছি না। তাই এই ২ য় পর্ব।
১) শুরু করছি একটা অতি
সাধারণ হিন্দী সিনেমার একটা কথা থেকে। সিনেমাটার নাম গুলাম।
বাজারে প্রেম আর মারামারি নিয়ে বহু সংখ্যক যে ধরনের হিন্দী ছবি
চলে - এটা তার ই একটি । এক সমাজসেবী - যে পরের সব বিপদে জীবন
বিপন্ন করে - এটা তার ই একটা উক্তি। তাকে হিরো প্রশ্ন করে -
কেন সে এত ঝুঁকি নিয়ে সকলের বিপদে সাহায্য করতে চেষ্টা করে।
এই সমাজসেবীর উত্তর আমার মনে বিশেষ ভাবে দাগ কেটেছে। সে বলে
- আমি অন্য কাউকে সাহায্য করার জন্যে এটা করি না - করি যাতে
আরশির সামনে দাঁড়ালে নিজেকে দেখে লজ্জা না পাই। আরশির সামনে
শুধু নিজে আর নিজেরই প্রতিবিম্ব - সেখানে কোনো অজুহাত চলে না।
মণি মুক্ত অনেক সময় সব থেকে অপ্রত্যাশিত জায়গাতে পাওয়া যেতে
পারে - শুধু শোনার কান বা দেখার চোখ দরকার - এটা তার ই একটা
প্রমাণ ।
২) এবার একটা নামকরা বাংলা
সিনেমার থেকে একটা কথা লিখছি। সিনেমার নাম অন্তহীন । এক স্বামী
আর স্ত্রী বিশেষ কোনো কারণে আলাদা হয়ে গেছে - কিন্তু দুজন দুজনের
মনের খুব কাছে । স্বামীর জন্মদিনে স্ত্রী একটা উপহার দিয়ে তাতে
যা লেখে তা সেটা একেবারে ঠিক ঠিক মনে নেই - কিন্তু কথাটা হচ্ছে
- 'যত কাছে আস - যত ঝাপসা হয়ে যাও - যত দূর যাও তত স্পষ্ট হয়ে
ওঠো'। আমি আমার জীবনে এটা বিশেষ ভাবে অনুভব করেছি অনেক সময় -
মনে হয় আপনার কেউ কেউ কথন এটা অনুভব করেছেন ।
৩) বিখ্যাত লেখক চাণক্য
সেন এর 'শুধু কথা' মনে হয় অনেকেই পড়েছেন । আমেরিকার বাঙালি -
যারা চাণক্য সেন এর ভাষাতে ইঙ্গলি - তাদের জীবন সাথী র চাহিদার
একটা ফর্দ লেখক দিয়েছেন । এটা একটু বড় - কিন্তু ছোট করতে গেলে
রসভঙ্গ হবে । তাই সবটাই লিখছি। তাদের মনের মত পাত্রীকে হতে হবে
" ৪০ পার্সেন্ট বাঙ্গালী, ২০ পার্সেন্ট ইংরেজ , ১৫ পার্সেন্ট
ভারতীয় , ৫ পার্সেন্ট আমেরিকান।" এটা লেখক বিশদ ভাবে ও
বুঝিয়েছেন । "মেয়েটিকে স্বভাবে , শিক্ষা দীক্ষা তে , কালচারে
"বাঙ্গালী" হতেই হবে। অর্থাৎ সে নম্র হবে , লাজুক
থাকবে , বেহায়াপনা করবে না , এগিয়ে এসে কথা বলবে না , নিজের
থেকে টেলিফোনে করবে না , আগ্রহ দেখাবে না। রামায়ণ মহাভারত তার
পড়া থাকা চাই, রবি ঠাকুরের কবিতা থাকা চাই মুখস্থ এবং রবীন্দ্র
সঙ্গীত কণ্ঠস্থ । " পরে আবার লিখেছেন "অথচ মেয়েটিকে
হতে হবে স্মার্ট , চালচলনে , বেশ বাসে , কথা বার্তায় ; বিলিতি
অ্যাকসেণ্ট এ সহজ ভাবে ইংরেজি বলতে হবে , পশ্চিমের পপ মিউজিক
জানতে হবে , নাচ জানলে আরও ভালো। Picasso র ছবি দেখে ক্যাবলা
মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবে না" । তার ওপর "তাকে মাছের
ঝোল চচ্চড়ি লাউ চিংড়ি রাঁধতে জানতে হবে আবার সঙ্গে সঙ্গে turkey
steak barbeque এবং চিকেন রোস্ট । "
সোনার পাথর বাটি কথাটা শুনেছিলাম - এটা পড়ে তার যথার্থ মানে
বুঝলাম ।
৪) আগের পর্বে লিখেছিলাম,
ঘুম আর খিদে পাওয়ার মত প্রকৃতির কাছে এলে আমার গান পায়। তখন
সঙ্গীদের ওপর অত্যাচার না করে আমি দূরে গিয়ে গান করি। নিজের
গানের সুর আর গলার মধুরিমার সম্যক জ্ঞান যে কথা থেকে হয়েছিল
- সেটাই এখন লিখছি।
আমার কলেজ জীবনে এক বন্ধু আর তার দাদার পরিচিতদের সাথে হিমাচল
বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাদের দলে দু জন মহিলা অধ্যাপিকা ছিলেন ।
তাদের একজন অবসরের দোর গোড়াতে। আমরা রিসার্ভ বাস এ ঘুরতাম। আমি
আর আমার বন্ধু বাস চালু হলেই গান শুরু করতাম। বেশিরভাগ ই রবীন্দ্র
সঙ্গীত।
ফিরে আসার পরে সেই দু জন মহিলা অধ্যাপিকা আমাদের একদিন খেতে
ডাকলেন। খুব ভালো খেলাম - অনেক পদ আর দারুণ টেস্ট। আসার আগে
তাদের মধ্যে যিনি বড় - তিনি বললেন "বিজন - তোমরা সাথে থাকাতে
বেড়িয়ে খুব আনন্দ পেয়েছি। শুধু ফিরে এসে একটা মুস্কিল এ পড়েছি।
আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত খুব ভালোবাসি । কিন্তু এবার ফিরে গান শোনা
বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। সুচিত্রা মিত্র , কণিকা - যার ই গান
শুনি - মনে হয় ভুল সুরে গাইছে " । আপনারাই বলুন - এর পরে
গান পেলে দূরে গিয়ে একা গান করা ছাড়া কি উপায় ???
৫) ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার
পরে আমার বিলেত গিয়ে উচ্চ শিক্কা নেবার একটা কথা হয়েছিল (শেষ
পর্যন্ত সেটা অবশ্য হয় নি )। তখন আমি প্রায় "দুধ না খেলে
- হবে না ভালো ছেলে " গোত্রে পরি । তাই চিন্তা হলো - বিলেতের
হস্টেলে গরুর মাংস দিলে কি করব। না খেলে অন্য কিছু খাবার খরচ
- খেলে সাংঘাতিক পাপ। তার ওপর আমি আবার পৈতে পরা বামুন তাই পাপ
এর মাত্রা আরও বেশী।
আমার এক নিকট আত্মীয় অনেক দিন বিলেতে ছিলেন - তার শরণাপন্ন হলাম।
তার উপদেশে আমার সব চিন্তার উপশম হলো। তিনি বললেন " তুমি
কি হিন্দু শাস্ত্র ঠিক করে পড়েছ?" উত্তর দিলাম "একেবারেই
না। " তখন বললেন " শাস্ত্রে আছে হিন্দু গরু খেতে নেই
। বিলেতে সব খৃষ্টান গরু - তাতে পাপ নেই - প্রাণ ভরে খাবে ।
" এর পর থেকে বিদেশে গেলে গরুর মাংস খেতে কোনো অসুবিধা
হয় নি।
৬) এবার যেটা বলব - সেটা
যার কাছ থেকে শুনেছিলাম - সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। Income
tax এর অ্যানুয়াল রিটার্ন দেবার সময় একজন উপদেশ দিয়েছিল - প্রাপ্য
tax এর সামান্য কিছু কম tax দিয়ে retrun জমা দিতে। ওরা এইগুলো
আগে দেখে আর বাকি tax চেয়ে চিঠি লেখে । বাকি tax জমা দিয়ে তার
রশিদ আর এই চিঠি এক সাথে রেখে দিলে সেই বছরের tax clearnce এর
কাজ করে।
এই ভাবেই কিছু বছর জমা দি। আশামত ফলও পাই। কিন্তু এক বছর জমা
দিতে গিয়ে বলে বাকি টাকা আগে জমা দিয়ে তার চালান লাগিয়ে দিলে
তবে জমা নেবে। অনেক অনুরোধ করি জমা নিতে। অনেক পরে জমা নেবার
লোকটি বলে "আপনি ওখানে চা খান - আমি আসছি।" স্বাভাবিক
ভাবে আমি ভেবে নিলাম - কিছু দক্ষিণা দিতে হবে । কিন্তু লোকটি
এসে যা বলল তাতে আমি একেবারে অবাক হয়ে গেলাম । বলল " আপনি
কি কখন অঙ্ক ভুল করেন নি? এই অতি সাধারণ জমা দেবার রাস্তা টা
আপনার মাথাতে এলো না ?? যোগ এ ভুল তো হতে পারে? আপনি প্রাপ্য
আর জমা tax এর পরিমাণ মিলিয়ে দিন - জমা নেবার সময় যোগ ফল চেক
করি না। এই ভাবে মিলিয়ে দিয়ে আমার কাছে আসুন - জমা নিয়ে নেব।
" কোনো দক্ষিণার কথা বলল না।
শেষ করার আগে কিছু কথা
বলতে চাই । এই ঠাকুরদার ঝুলিতে মনে দাগ কাটা কথার রসদ আপাতত
খালি । তাই পর্ব ৩ লেখা এখন সম্ভব নয় আমার দ্বারা । তবে ভবিষ্যতে
আরও কথা মনে দাগ কাটতে পারে । তখন আবার চেষ্টা করে দেখব ।
আগের বার ও অনুরোধ করেছি আপনাদের কাছে - আবার অনুরোধ করছি -
এই পর্ব টা আপনারা সবাই মিলে চালিয়ে যান না - আপনাদের মনে দাগ
কাটা কথা লিখে?
লিখে বেশ আনন্দ পাচ্ছি, তাই খুঁজে দেখব আর কি নিয়ে পরের বার
লিখতে পারি। সোজা কথাতে - আমার লেখা পড়ার হাত থেকে আপনারা মুক্তি
পাবার আশা করবেন না।
আজ আসি
বিজন
বন্দ্যোপাধ্যায়
ডিসেম্বর ৬, ২০১১
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)