প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বইয়ের খবর: রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ - জিয়াউদ্দীন তারেক আলী

২০১১ সালে বাংলাদেশের কয়েকজন রবীন্দ্রপ্রেমী এক সভায় মিলিত হয়ে স্থির করেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে ১৫১টি বইয়ের একটি গ্রন্থমালা প্রকাশ করবেন। এই বইটি তার অন্যতম।

রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা ও সাহিত্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিলো - তার একটা চমৎকার চিত্র বইটিতে পাওয়া যাবে। মোট পাঁচটি প্রবন্ধ বইটিতে স্থান পেয়েছে (১)বাঙালীর চিন্তাজগতে রবীন্দ্রনাথ, (২) পাকিস্তান সৃষ্টির ঐতিহাসিক কারণ, (৩) বাঙালী সংস্কৃতির উপর পাকিস্তানী আগ্রাসন, (৪) বাঙালীর সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এবং (৫) একাত্তরে রবীন্দ্রনাথ।

প্রথম প্রবন্ধ ‘বাঙালীর চিন্তাজগতে রবীন্দ্রনাথ’-এ এক জায়গায় তারেক আলী লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের মানবধর্মী উপলব্ধি পূর্ণতা পেয়েছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহে মাটির কাছাকাছি বাস করা সাধারণ মানুষের মেলামেশার ভেতর দিয়ে। হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে যে সংকীর্ণতা ছিলো এবং এখনো বিদ্যমান, তার ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। অথচ ‘এই সহজ সত্যটা খানিকটা হারিয়ে গিয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কূটচালে। তাঁর ধর্ম, পশ্চিমবঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠা, কলকাতায় তাঁর কর্মক্ষেত্র এবং সর্বোপরি আমাদের নিজেদের চিন্তার সাম্প্রদায়িকতার কারণে কেউ-কেউ তাঁকে ভারতীয় হিসেবে গণ্য করেই বেশী স্বস্তি পাই।’ কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই তারেক আলী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে...যে বিশাল গণঅভ্যুত্থান দেখা দিয়েছিল, তার আদর্শগত ধারণার পেছনে ... রবীন্দ্রনাথ-সৃষ্ট সমাজভাবনা, গণতন্ত্রমনস্কটা এবং মানবধর্মী চিন্তা প্রবলভাবে উপস্থিত।’ রবীন্দ্রনাথ কেবল ভারতীয় নন, শুধু বাংলাভাষীও নন, তিনি বাংলাদেশেরও।

'বাঙালী সংস্কৃতির উপর পাকিস্তানী আগ্রাসন'-এ তারেক আলী লিখেছেন ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের এক মাস বাদেই কলকাতায় জাস্টিস মাসুদের বাসায় একটা ঘরোয়া বৈঠক হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শহীদুল্লা কায়সর, মোয়াজ্জেম চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, পাকিস্তান তো হুজুগের মাথায় সৃষ্টি হল, কিন্তু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে এদের সঙ্গে ঘর করা যাবে কিনা। ১৯৪৮ সালে যখন শহীদ ধীরেন্দ্রলাল দত্ত পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তোলেন, তখন লিয়াকত আলী খানের তির্যক কটূক্তি তিনি হিন্দু ভারতের দালালি করছেন! শুধু তাই নয়, ‘বাঙালীর সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ’ প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্ভট প্রস্তাব। পরে অর্থব্যয়ের অঙ্কটা মাথায় আসায় সেটা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হয় নি। তবে বাঙলার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটা নতুন পরিচিতি দেবার জন্যে অনেক মুসলিম কবি সাহিত্যিক উঠে পড়ে লেগেছিলেন। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের আদর্শলিপির কবিতার মুসলিম সংস্করণ করা হয়েছিল –

ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি
সারাদিন আমি যেন নেক হয়ে চলি
হুকুম করেন যাহা মোর বুজুর্গানে
আমি যেন সেই কাম করি দিলে জানে।

১৯৫১ সালে সৈয়দ আলী আফসান সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার এবং জাতীয় সংহতির জন্যে রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করা যেতে পারে মন্তব্য করছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, নজরুলের কাব্যে যেসব ‘অবাঞ্ছিত অংশ’ আছে, সেগুলোও বাদ দেবার কথা উঠেছিলো। ১৯৫৮ সালের পরে গানের বাণীতে ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ – যেমন 'পূজা', এমন কি 'জননী' থাকলে সে গান রেডিওতে গাওয়া যেত না।

এই রকম যখন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি, তখন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিট্যুটে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন হয়। আয়োজকরা খবর পেয়েছিলেন মুসলিম লীগ ও এন.এস.এফ-এর গুণ্ডারা এসে হামলা করবে। তবে ওয়াহিদুল হক এবং আতিকুল রহমানের সাহসী অবস্থানের জন্যে সেটি ঘটে নি। এর পর রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ‘বাঙালির প্রতিদিনের প্রতিবাদমুখর কর্মযজ্ঞের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে’ প্রতিষ্ঠিত হয়। জন্ম নেয় এক দল সাহসী অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন সংস্কৃতিকর্মী। এদেরই উদ্যোগে অসাম্প্রদায়িকতা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার।

শেষ প্রবন্ধ ‘একাত্তরে রবীন্দ্রনাথ’-এ স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে লেখকের মুক্তিযুদ্ধে বেরিয়ে পড়ার কাহিনী। কলকাতায় এসে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা-র সভ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে গিয়ে একটি গীতি-আলেখ্যর মাধ্যমে রিফিউজিদের মনোরঞ্জন ও তাদের মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার সচিত্র বিবরণ। গীতি-আলেখ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আবার সেই রবীন্দ্রনাথ।

এ বইটি আমাদের সবার পড়া উচিত। সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা একটা নিরন্তর যুদ্ধ, এতে ঢিলেমির কোনও অবকাশ নেই। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের অধিকার রক্ষা করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব – তার জন্যেই লড়াই। লেখক তারেক আলী আজীবন এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বলেই এই বইটি আমাদের উপহার দিতে পেরেছেন।

বইটির মূল্য ১২০ টাকা। প্রকাশক মূর্ধন্য, ২৫৩-২৫৪ এলিফ্যাণ্ট রোড, ঢাকা।

সুজন দাশগুপ্ত

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।