প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সে যুগের বিদেশী ও আধা-বিদেশী নায়িকারা

নির্বাক যুগের অনেক অভিনেত্রীই ছিলেন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান বা ইউরেশিও সম্প্রদায়ভুক্ত। দুয়েকজন পুরোপুরি বিদেশিনীও - যেমন 'ফিয়ারলেস' নাদিয়া। এঁদের অনেকে ভালো হিন্দী বা বাংলা বলতে পারতেন না। নির্বাক ছবি বলে তাতে অসুবিধা হয় নি। কিন্তু যখন সবাক চিত্রের সূচনা হল, তখন এঁদের অনেকেই বিশেষ অসুবিধায় পড়েছিলেন। অনেককে বিদায়ও নিতে হয়েছিল চিত্রজগত থেকে। নিচে এঁদের কয়েকজনের সম্পর্কে আলোচনা করা হল। এঁরা অবশ্য সবাই বাংলা ছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রে এঁদের দানকে একসঙ্গে স্মরণ করাই মনে হল যুক্তিযুক্ত। এঁরা ছাড়াও এঁদের মত আরও অনেক অভিনেত্রী সে-যুগে ছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের খবর আমরা হারিয়ে ফেলেছি।


পেশেন্স কুপার (১৯০৫ - ?)

পেশেন্স কুপারই (Patience Cooper) বোধহয় একমাত্র অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান নায়িকা যিনি কোনো ভারতীয় নাম না নিয়ে চিত্রজগতে প্রবেশ করেছিলেন। কলকাতার মেয়ে পেশেন্স ইউরেশিয়ান কোম্পানী ব্যাণ্ড মিউজিক্যাল কমেডি-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন - সেখানে নাচতেন। পরে তিনি ম্যাডানের কোম্পানীতে যোগ দেন। ওঁর নির্বাক ছবিগুলির মধ্যে নল দময়ন্তী (১৯২০), ধ্রুব চরিত্র (১৯২১), লায়লা মজনু (১৯২২), রত্নাবলী (১৯২২), ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সেযুগের আধা-বিদেশী অভিনেত্রীদের মধ্যে পেশেন্স অপেক্ষাকৃত সহজে সবাক যুগে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। সবাক-যুগের প্রথম দিকে তাঁর ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, আলিবাবা ও চল্লিশচোর (১৯৩২)। দীর্ঘকাল পেশেন্স কুপার চিত্রজগতে ছিলেন - শেষ ছবিতে অভিনয় করেন ১৯৪৪ সালে। অভিনেত্রীদের মধ্যে ভারতবর্ষে উনিই প্রথম সিনেমায় দ্বৈত-ভূমিকায় অভিনয় করেন। পত্নী প্রতাপ-এ তিনি যমজ বোনের অভিনয় করেছিলেন। পরে কাশ্মীর সুন্দরী-তে মা ও মেয়ের ভূমিকাতে অভিনয় করতেও ওঁকে দেখা যায়।


সুলোচনা (১৯০৭-১৯৮৩)

সুলোচনার আসল নাম ছিল রুবি মায়ার্স (Ruby Meyers)। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পুনাতে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে। কোহিনূর ফিল্মসের মোহন ভাবনানি ওঁকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে আসেন। কিছুদিন সেখানে কাজ করে সুলোচনা বোম্বের ইম্পেরিয়াল স্টুডিওতে যোগ দেন। সেখানেই তিনি খ্যাতির তুঙ্গে ওঠেন। সে যুগের অভিনেত্রীদের মধ্যে সুলোচনার পারিশ্রমিকই ছিল সবচেয়ে বেশী। ইম্পেরিয়াল স্টুডিওতে সে যুগের রোম্যাণ্টিক নায়ক দিনশ বিলমোরিয়ার বিপরীতে অনেকগুলি ছবিতে সুলোচনা অভিনয় করেছিলেন। সবাক যুগে এসে কিছুদিনের জন্য ওঁর কর্ম জীবনে ভাঁটা পড়ে - হিন্দী ভালো বলতে পারতেন না বলে। নিজের অনলস চেষ্টায় তিনি সেই বাধা অতিক্রম করেন এবং আবার ইম্পেরিয়াল স্টুডিও-র সবাক ছবিগুলিতে ওঁকে দেখা যায়।

১৯২৭ সালের 'ওয়াইল্ড ক্যাট অফ বোম্বে' ছবিতে উনি আনায়াস দক্ষতায় একসঙ্গে ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। উপরোক্ত ছবি ছাড়াও ওঁর বহু নির্বাক ছবি, যেমন, মাধুরী (১৯২৮), আনারকলি (১৯২৮), ইন্দিরা বি এ (১৯২৯) - পরে সবাক যুগে সুলোচনাকে নায়িকা করেই ইম্পেরিয়াল স্টুডিও আবার নতুন করে তোলে। ৩০ দশকে সুলোচনা ছবির পর্দা থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যান। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে দেখা গেছে। ১৯২৮ সালে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালীন যে ছবির তিনি নায়িকা ছিলেন, সেই ছবির গল্প নিয়ে ১৯৫৩ সালে আবার নতুন করে তৈরী হল আনারকলি। তাতে তিনি একটি ছোট্ট পার্ট পেয়েছিলেন। সেটাই ছবিতে তাঁর শেষ অভিনয়। তাঁর জীবনে আরেকটি স্মরণীয় দিন এসেছিলো ১৯৭৪ সালে - যে বছর তিনি দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার পান। জীবনের শেষ দিকটা কেটেছে নিঃসঙ্গতায়। মৃত্যু ১৯৮৩ সালে।


প্রমিলা (১৯১১ - ?)

কলকাতার ইহুদী মেয়ে এস্থার ভিক্টোরিয়া এব্রাহাম (Esther Victoria Abraham) প্রমিলা নাম নিয়ে সিনেমায় নেমেছিলেন। সিনিয়র কেমব্রিজে অনার্স পাওয়া মেয়ে এস্থার লণ্ডনে গিয়ে আর্ট ডিপ্লোমা পান। ফিরে এসে তালমুদ তোরা জুইশ বয়েজ স্কুলে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কাজ করতেন। ওঁর বোন সোফি (চলচ্চিত্র জগতের রোমিলা) ১৯৩৫ সালে ওঁকে একদিন ইম্পেরিয়াল স্টুডিওতে নিয়ে যান। স্টুডিও দেখে উনি ঠিক করেন যে, উনিও সিনেমায় নামবেন । ইম্পিরিয়ালের জাঙ্গল কিং, আওয়ার ডার্লিং ডটার, মহামায়া, বসন্ত ইত্যাদি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। ভারতসুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিজয়িনী প্রমিলা কিছুদিন মডেলিংও করেছিলেন। সে যুগের তারকা কুমারকে বিয়ে করে দুজনে মিলে সিলভার ফিল্ম প্রতিষ্ঠা করে বেশ কয়েকটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। পার্টিশনের সময় কুমার পাকিস্তানে চলে যান, প্রমিলা সন্তানদের নিয়ে ভারতেই থেকে যান।


নাদিয়া (১৯১০ - ১৯৯৬)

'ফিয়ারলেস' নাদিয়ার জন্ম অস্ট্রেলিয়ার পার্থে। জন্ম নাম ছিল মেরি ইভান্স (Mary Evans)। মা ছিলেন গ্রীক বাবা ইংরেজ - ওয়েলশের লোক। স্টেনো টাইপিস্ট হয়ে কর্মজীবনের শুরু। সেই চাকরি ছেড়ে জ্যাকোর রাশিয়ান সার্কাসে যোগ দিয়ে নানা রকমের দুঃসাহসিক খেলা দেখাতে শেখেন। পরে নৃত্যশিক্ষা করে ম্যডাম অ্যাস্ত্রোভার ব্যালে গ্রুপে যোগ দেন। অ্যাস্ত্রোভার দলের সঙ্গে নাদিয়া যখন ভারতবর্ষের নানান জায়গায় ঘুরছেন, তখনই মেরি নিজের নাম পাল্টে নাদিয়া (Nadia) রাখেন। বোম্বে ফিল্ম জগতের ওয়াদিয়া ভাইদের বড় ভাই, যিনি জেবিএইচ বলে পরিচিত। তিনি নাদিয়াকে ছবিতে পার্ট দেবার সময়ে নাম পাল্টে দেবী দিয়ে একটি নাম রাখতে বলেন। কথাবার্তায় তুখর নাদিয়া তাতে আপত্তি জানিয়ে বলেন, "কখনোই না। নাদিয়া আমার পয়মন্ত নাম। তাছাড়া ওয়াদিয়া নাদিয়া দিব্বি মেলে!"

ওয়াদিয়া মুভিটোনের বহু স্টাণ্ট ছবিতে নাদিয়া অভিনয় করেছেন। নিজেই তিনি স্টাণ্টে অংশ নিতেন। তারজন্য অপরিসীম পরিশ্রম করতেন দিনের পর দিন ট্রেনিং-এ। লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দৌড়নো, পুরুষদের কাঁধে তুলে নিয়ে ছোটা, ঝুলন্ত বাতি ধরে দোলা, সিংহের সঙ্গে খেলা - সব কিছুই করেছেন। করতে গিয়ে এক আধ সময়ে আঘাতও পেয়েছেন। তবে নাদিয়ার বক্তব্য অনুসারে স্টাণ্টের থেকে ওঁর পক্ষে বেশি কষ্টকর ছিল হিন্দী বলা। তার জন্য ওঁকে অনেক খাটতে হত।

১৯৩৫ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে নাদিয়া অনেকগুলি স্টাণ্ট ছবি করেন - হাণ্টারওয়ালী (১৯৩৫), মিস ফ্রণ্টিয়ার মেইল (১৯৩৬), হ্যারিকেন হানসা (১৯৩৭), ডায়মণ্ড কুইন (১৯৪০), জাঙ্গল প্রিন্সেস, ইত্যাদি। ১৯৪১ সালে ওয়াদিয়া মুভিটোন বন্ধ হয়ে যায় - দুই ওয়াদিয়া ভাই আলাদা হয়ে যান । ১৯৪২ সালে ছোট ভাই হোমি ওয়াদিয়া বসন্ত স্টুডিও শুরু করেন। সেখানে নাদিয়া হাণ্টারওয়ালী কি বেটি (১৯৪২) ছবি দিয়ে শুরু করে কার্নিভাল কুইন, দিলেয়ার ডাকু, ইত্যাদি আরও দশটি স্টাণ্ট ছবি করেন। নাদিয়ার শেষ স্টাণ্ট ছবি ১৯৫৯ সালের সার্কাস কুইন। সেই বছরের শেষে (মতান্তরে ১৯৬০ সালে) কর্ম-জীবনের বহু বছরের সঙ্গী হোমি ওয়াদিয়ার সঙ্গে নদিয়ার বিয়ে হয়। ১৯৯৩ সালে ওঁর পৌত্র রিয়াড ভিন্স ওয়াদিয়া নাদিয়ার উপর একটি ডকুমেণ্টারি করেন। ডকুমেণ্টারিটির নাম ছিল, 'ফিয়ারলেস - দ্য হাণ্টারওয়ালী স্টোরি'।


সীতা দেবী (১৯১২ - ?)

জন্মনাম রেনী স্মিথ (Renee Smith)। সীতা দেবী নাম নিয়ে চলচ্চিত্র জগতে প্রথম প্রবেশ হিমাংশু রাইয়ের বিখ্যাত ছবি লাইট অফ এশিয়া-তে অভিনয় করে। হিমাংশু রাই নিজে ছিলেন লাইট অফ এশিয়ার মুখ্য-চরিত্রে - তিনিই রেনী স্মিথের জন্য সীতা দেবী নামটি বেছে ছিলেন। পরে সীতা দেবী হিমাংশু রাইয়ের শিরাজ (১৯২৮), প্রপঞ্চ পাশ (১৯২৯), ইত্যাদি আর কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন। ওঁর এক বোন পার্সি স্মিথ ও অভিনয় করতেন।


সহায়িকা:
১) Ashish Rajadhyaksha and Paul Willeman, Encyclopedia of Indian cinema (London: British Film Institute and Oxford University Press, 1994
২) A Pictorial History of Indian Cinema, Firoz Rangoonwalla, The Hamlyn Publising Group, London, 1979
৩) 70 Years of Indian Cinema, T.M.Ramachandran and S. Rukmini, Cinema India-International, Bombay, 1985
৪) ইণ্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।