রক্তপরীক্ষা
- কিছু তথ্য
রক্তপরীক্ষা রোগনিনর্ণয়ের
জন্য একটা ভাল হাতিয়ার। শরীরের রক্ত হল নানান ধরণের কোষের সমষ্টি,
আর অন্যান্য যৌগিক বস্তু, যেমন, বিভিন্ন ধরণের লবন, প্রোটিন,
ইত্যাদিও থাকে। এগুলির প্রত্যেকটিরই প্রয়োজনীয়তা আছে, এবং এদের
স্বল্পতা বা আধিক্য সমস্যা নির্দেশ করে। রক্তের তরল অংশকে বলা
হয় প্লাজ্মা (plasma)। যখন শরীরের বাইরে রক্ত জমে যায়, তখন রক্তের
কোষগুলি এবং কিছু কিছু প্রোটিন শক্ত হয়ে যায়। যে তরল পড়ে থাকে
- সেটাকে বলা হয় সিরাম (serum)। এই সিরামও নানা পরীক্ষায় ব্যবহার
করা হয়।
নানান ভাবে রক্ত পরীক্ষা
করা হয়। কতটা রক্ত লাগবে বা তার কোন অংশ লাগবে - সেটা নির্ভর
করছে কি পরীক্ষা তা দিয়ে করা হবে তার উপরে। ডায়েবিটিস রোগীদের
রক্ত-শর্করা (blood sugar) মাপার জন্য কয়েক ফোঁটা রক্ত আঙুলের
ডগায় ছুঁচ ফুটিয়ে নিলেই যথেষ্ট। আবার সম্পূর্ণ রক্ত পরীক্ষার
জন্য বেশ কিছুটা রক্তের প্রয়োজন হয় - যা সাধারণতঃ হাতের কনুইয়ের
সামনের ভাঁজের শিরা থেকে নেওযা হয়।
সম্পূর্ণ রক্ত পরীক্ষা
(complete blood count বা CBC ) থেকে রক্তের বিভিন্ন সেল বা
কণিকা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। এই পরীক্ষার ফলাফল
থেকে যার রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে মোটামুটি
একটা ধারণা করা যায়। তার কোনো রোগ হয়ে থাকলে বা কোনও উপসর্গ
থাকলে সেগুলির কারণ কি - তা বহুক্ষেত্রেই বার করা যায়।
আমাদের রক্তে নানান রকমের
কণিকা থাকে, যেমন, শ্বেতকণিকা, লোহিতকণিকা ও প্ল্যাটেলেট। এদের
প্রত্যকেই আমাদের দেহকে সুস্থ রাখতে নানা ভাবে সাহায্য করে।
সম্পূর্ণ রক্ত পরীক্ষায় সাধারণতঃ তাদের সম্পর্কে এই তথ্যগুলি
থাকে:
(১) রক্তে শ্বেতকণিকার
(WBC - white blood cell) সংখ্যা। শ্বেতকণিকা আমাদের শরীরকে
অসুখ বিশুখের হাত থেকে রক্ষা করে। যদি দেহে কোনও
রোগের সংক্রমণ হয়, তাহলে দেহের শ্বেতকণিকা সেই সংক্রমণের জন্য
দায়ী জীবাণু, ভাইরাস, ইত্যাদিকে আক্রমণ করে ধবংস করে। আকৃতিতে
শ্বেতকণিকা লোহিতকণিকার (red blood cell) থেকে বড় হয় এবং সংখ্যাতেও
তারা কম হয়। দেহে যদি কোনও ব্যাক্টেরিয়া-সংক্রমণ হয়, তাহলে শ্বেতকণিকার
সংখ্যা খুব বেড়ে যায়। শ্বেতকণিকার সংখ্যা থেকে সংক্রমণের অস্তিত্ব
ধরা পড়ে। সময় বিশেষে এগুলি অন্যান্য তথ্যও চিকিৎসককে দেয়। যেমন,
ক্যান্সারের চিকিৎসার সময়ে এর সংখ্যা থেকে চিকিৎসার কার্যকারিতা
আঁচ করা যায়।
(২) শ্বেতকণিকার রকমভেদ
(WBC differential): বিভিন্ন ধরণের শ্বেতকণিকা আমাদের রক্তের
মধ্যে রয়েছে। এদের মধ্যে নিউট্রোফিল্ (neutrophils), লিম্ফোসাইট্
(lymphocytes), মনোসাইট্ (monocytes), ইয়েসোনোফিল্ (eosinophils)
এবং ব্যাসোফিল্ (basophils) হল প্রধান। অপরিণত নিউট্রোফিল, যাকে
ব্যাণ্ড নিউট্রোফিল বলা হয়, সেগুলোকেও পরীক্ষার সময়ে গোনা হয়।
শরীর রক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের শ্বেতকণিকার বিভিন্ন ভূমিকা
আছে। তাই এদের সংখ্যাগুলি শরীরের প্রতিরোধ-ব্যবস্থা* সম্পর্কে
প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়। বিভিন্ন শ্বেতকণিকার কমা বা বাড়ার উপর নির্ভর
করে কি জাতিয় সংক্রমণ, বোঝা যায় এটি অ্যালার্জি বা টক্সিন-জনিত
প্রতিক্রিয়া না লিউকোমিয়া, ইত্যাদি।
(৩) রক্তের লোহিতকণিকা
(RBC)- সংখ্যা। রক্তে লোহিতকণিকার কাজ হল ফুসফুস থেকে অক্সিজেন
বহন করে শরীরের সমস্ত জায়গায় পৌঁছে দেওয়া এবং সেখান
থেকে কার্বন ডায়ক্সাইড সংগ্রহ করে ফুসফুসে নিয়ে আসা, যাতে করে
ফুসফুস সেগুলো দেহ থেকে বার করে দিতে পারে। লোহিতকণিকার সংখ্যা
কম হওয়া অ্যানেমিয়ার লক্ষণ, এর অর্থ শরীর পরয়োজন মত অক্সিজেন
পাচ্ছে না। লোহিতকণিকার সংখ্যা যদি বেশি বেড়ে যায়, তাহলে ভয়
থাকে সেগুলি একসঙ্গে জমাট বেঁধে উপশিরাগুলির (capillaries) ভেতরকার
পথ বন্ধ করে দিতে পারে।
(৪) হেমাটোক্রিট (HCT,
packed cell volume, PCV): লোহিতকণিকা রক্তের কতটা অংশ (ঘনায়তন
বা volume -এর মাপে) জুড়ে আছে সেটি বোঝাতে এটি ব্যবহার করা হয়।
এটি মাপা হয় শতাংশ বা পার্সেণ্টেজ হিসেবে। যদি হেমাটোক্রিট ৪০
বলা হয়, তারমানে রক্তের ঘনায়তনের একশোভাগের ৪০ ভাগ লহিতকণিকা-পূর্ণ।
(৫) হিমোগ্লোবিন (Hgb):
লোহিতকণিকার একটি প্রয়োজনীয় অংশ হল হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিনই
অক্সিজেনকে বহন করে এবং লোহিতকণিকার রক্তবর্ণের জন্য দায়ী। পরীক্ষায়
হিমোগ্লোবিনের পরিমান সাধারণভাবে নির্দেশ করে দেহ কতটা অক্সিজেন
পাচ্ছে।
(৬) লোহিতকণিকা নির্দেশিকা
(Red blood cell indices): লোহিতকণিকার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়ার
জন্য তিন রকম নির্দেশিকা ব্যবহার করা হয়। গড় কণিকাকার ঘনায়তন
(mean corpuscular volume বা MCV), গড় কণিকাকার হিমোগ্লোবিন
(mean corpuscular hemoglobin HPA MCH), এবং গড় কণিকাকার হিমোগ্লোবিনের
গাঢ়ীকরণ (mean corpuscular hemoglobin HPA MCH)। এগুলি একটি
যন্ত্রের সাহায্যে এবং অন্যান্য পর্যবেক্ষণ থেকে মাপা হয়। MCV
থেকে লোহিতকণিকার আয়তন কি বোঝা যায়। MCH থেকে একটা লোহিতকণিকায়
হিমোগ্লোবিনের পরিমান বোঝা যায়। MCHC নির্দেশ করে হিমোগ্লোবিন
লোহিতকণিকায় কতটা ঘণিভূত অবস্থায় রয়েছে। এই তথ্যগুলি থেকে কি
ধরণের অ্যানিমিয়ায়ে লোকে ভুগছে - সেটা বোঝা যায়। লোহিতকণিকাগুলির
আয়তন সব এক হয় না, কম-বেশি থাকে। সেটি দেখানোর জন্য অনেক সময়
লোহিতকণিকার ব্যাপ্তি বণ্টন (Red cell distribution width বা
RDW)-এর উল্লেখও রিপোর্টে থাকে।
(৭) প্ল্যাটেলেট বা থ্রম্বোসাইট-এর
(Platelet বা thrombocyte) সংখ্যা। এগুলি হল রক্তের ক্ষুদ্রতম
কণিকা। রক্ত জমাট বাঁধার ব্যাপারে এগুলির মস্ত ভূমিকা আছে। যখন
কেটে রক্ত ঝরতে থাকে, তখন এই প্ল্যাটেলেট আকারে বৃদ্ধি পেয়ে
একসঙ্গে জমাট বেঁধে একটা আঠার মত পদার্থে পরিণত হয়। সেটাই কাটা
জায়গায় আটকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। প্ল্যাটেলেট খুব কম থাকলে,
রক্ত পড়তে শুরু করলে, সেটা বন্ধ হতে চাইবে না। আবার যদি খুব
বেশি প্ল্যাটেলেট থাকে, তাহলে দেহের রক্ত-বাহী নালীগুলিতে জমে
রক্তচলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।
(৮) রক্ত লেপন (Blood smear)
পরীক্ষা: এতে এক ফোঁটা রক্ত কাচের স্লাইডে ফেলে সেটিকে আরেকটা
স্লাইড দিয়ে ঘষে চারিদকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর একধরণের বিশেষ
রঙ দিয়ে সেটিকে রঞ্জিত করা হয়। মাইক্রস্কোপ দিয়ে এই রঞ্জিত স্লাইডটি
পরীক্ষা করলে রক্তকণিকার অস্বাভাবিক গঠন, আয়তন ইত্যাদি ধরা পড়ে।
তা থেকে ম্যালেরিয়া, সিক্ল সেল অ্যানিমিয়া, ইত্যাদি নানা রোগ
নির্ণয় করা সম্ভব।
*শরীরের
প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে অ্যাণ্টিবডি (antibodies), শ্বেতকণিকা
ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ এবং প্রোটিনের সাহায্যে। যখনই এরা
মনে করে দেহে বাইরের কোনো কিছু এসে বাসা বাঁধতে চেষ্টা করছে
(তা ব্যাক্টিরিয়াই হোক, বা ভাইরাসই বা অন্যকিছু হোক) এরা গিয়ে
তাদের আক্রমণ করে। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্যেই আবার অ্যালার্জি
হয়। সেটা ঘটে যখন এরা ভুল করে পোলেন, ওষুধ, রাসায়নিক পদার্থ,
ইত্যাদিকে দেহের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে ধরে নেয়। মাঝেমধ্যে এই
প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলকরে শরীরের নিজস্ব কোষগুলোকেই আক্রমণ করতে
শুরু করে। এটাও এক ধরণের জটিল অসুস্থতা, যাকে বলা হয় অটো-ইমিউন
ডিজিজ।
[স্বাস্থ্য
বিষয়ক যে-সব আলোচনা অবসর-এ রয়েছে তার উদ্দেশ্য সাধারণ ভাবে স্বাস্থ্য
ও বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা। এই আলোচনা কোনও ভাবেই
ডাক্তারের পরামর্শের বিকল্প নয়। কারোর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও
সমস্যা থাকলে, তাঁর উচিত সরাসরি কোনও ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ
করা।]