ভারতবর্ষে
দত্তক নেবার অধিকার - কিছু তথ্য

ভারতবর্ষে
দত্তক একমাত্র হিন্দুরাই নিতে পারে। হিন্দু এডপশন ও মেণ্টিনেন্স
এক্ট, 1956, (Hindu Adoption and Maintenance Act of 1956) অনুযায়ী
হিন্দুদের দত্তক নেবার অধিকার রয়েছে। ভারতবর্ষের মুসলমান, খ্রীশ্চান,
পার্শি ও ইহুদী নাগরিকরা গার্জেন এণ্ড ওয়ার্ডস এক্ট, 1890, (Guardians
and Wards Act [GAWA] of 1890) অনুসারে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর
অভিভাকত্ব পেতে পারেন, কিন্তু তাকে দত্তক সন্তান হিসেবে গ্রহণ
করতে পারেন না। এবং এই অভিভাকত্ব নিরঙ্কুশ নয় - বিশেষ বিশেষ
ক্ষেত্রে তা নাকচ হয়ে যাবার সম্ভবনা থাকে। শুধু তাই নয়, শিশুটি
সবালক অর্থাত্ তার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবার পর সেই অভিভাবকের সঙ্গে
তার আইনগত কোনো সম্পর্ক আর থাকে না।
যদিও ভারতবর্ষের সংবিধানের
১৪ অনুচ্ছেদে সব নাগরিককেই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু
বাস্তবক্ষেত্রে ইউনিফর্ম সিভিল কোড-এর অভাবে পারিবারিক আইনের
ক্ষেত্রে নানা রকমের বৈষম্য রয়ে গেছে। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়
এবং বাস্তবিকই সেটা একটা সমস্যা। দত্তক সম্পর্কীত আইনের বৈষম্য
দূর করার জন্যে 2000 সালে জুভেনাইল জাস্টিস (কেয়ার এণ্ড প্রোটেকশন
অফ চিল্ড্রেন) এক্ট, 2000 , গৃহীত হয়। খ্রীশ্চান, ইহুদী, প্রভৃতি
সম্প্রদায়ও যাতে দত্তক নেবার অধিকার পায় এই আইনের সেটাই ছিল
উদ্দেশ্য। কিন্তু এ ব্যাপারে দত্তক দেওয়ার এজেন্সি, জুভেনাইল
জাস্টিস বোর্ডের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে ধোঁয়াসা থেকে যাওয়ায় এটি
কার্যকরি করা সম্ভব হয় নি।
জুভেনাইল জাস্টিস এক্টের
41(3) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডকে
শিশুদের দত্তক দেবার অধিকার দেওয়া হবে। যার অর্থ সেই অধিকার
তাদের নেই এবং রাজ্য সরকারগুলি সেই অধিকার তাদের দেবে। কিন্তু
রাজ্যসরকারগুলি সেই অধিকার দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় নি। ফলে
এর মাধ্যমে এখনও কোনো দত্তকগ্রহণ সম্ভব হয় নি। যাঁরা শিশুর অভিভাবকত্বের
দায়িত্ব পেয়ে ভেবেছিলেন শিশুটিকে এবার দত্তক হিসেবে পাবেন -
সেই আশা এখনও তাঁদের পূর্ণ হয় নি।
দত্তক নিতে পাবার অধিকার
নিয়ে ভারতবর্ষের অহিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যেই একটা অসন্তোষের
সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে মুসলমান, খ্রীশ্চান, পার্সি
বা ইহুদীদের শিশুরা কি দোষ করেছে যার জন্য তারা দত্তকপুত্র বা
কন্যা হবার অধিকার পাচ্ছে না? ধর্মের ব্যাপারে যদি এতে কোনো
বাধাও থাকে - সেটাও অনেকের কাছে অবান্তর। যারা জীবনের প্রতি
পদে ধর্ম মেনে চলতে চায়, তারা দত্তক না নিলেই পারে; কিন্তু যারা
নিতে চায় তাদের এ ব্যাপারে বাধা দেওয়া হবে কেন?
প্রসঙ্গতঃ যদিও কোনো বিধিবদ্ধ
আইন এ ব্যাপারে নেই, কেরালা, মহারাষ্ট্র ও গোয়াতে যেসব খ্রীশ্চানরা
শিশুদের অভিভাকত্ব নিয়েছেন তাঁদের কোর্টে সেই সব শিশুদের দত্তক
হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আবেদন দাখিল করতে দেওয়া হচ্ছে। 1999
সালে কেরালা হাইকোর্ট এ ব্যাপারে কোনো আইন না থাকা সত্বেও একজন
খ্রীশ্চান দম্পতির দত্তক নেওয়া ও সম্পত্তির উপর সেই দত্তক সন্তানের
উত্তরাধিকারের দাবী মেনে নিয়েছেন। একই বছরে আরেকজন বিচারক রায়
দিয়েছেন যেহেতু খ্রীশ্চান ধর্মে দত্তক নেবার বিপক্ষে কোনো বিধান
নেই, সুতরাং তারা দত্তক নিতে পারে।
বিদেশীরাও ভারতীয় শিশুকে
দত্তক নিতে পারে, কিন্তু সোজাসুজি পারে না। প্রথমে গার্জেন এণ্ড
ওয়ার্ডস এক্ট, 1890,-এর বলে অভিভাকত্ব নিতে হয়। পরে নিজের দেশে
গিয়ে সেই দেশের আইন অনুযায়ী শিশুটিকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করতে
হয়। সাধারণভাবে বিদেশীদের ভারতীয়শিশুদের দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার
ব্যাপারে অনেকের আপত্তি রয়েছে। এমনিতেই দত্তক নেওয়ার চল আমাদের
দেশে খুব একটা নেই। মাত্র হাজার পাঁচেক শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়।
তার ওপর পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে খবর বেরোয় যে, বিদেশে শিশু পাচার
করা হচ্ছে, অনেক ব্যবসায়িক লেনদেন হচ্ছে, দত্তক হিসেবে নিয়ে
গিয়ে সেখানে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাদের যৌনব্যবসায়ে
লাগানো হচ্ছে, তাদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে, ইত্যাদি। এগুলো
যে সব মিথ্যে তা নয়, তবে এও সত্য যে, বহু শিশুই বিদেশে গিয়ে
নতুন বাবা-মাকে পেয়ে পরম সুখে রয়েছে। তবে একটি শিশুই বা অত্যাচারিত
হবে কেন? দত্তক নেবার ব্যাপারটা একটা ব্যবসায়ে পরিণত হবে কেন?
এইসব বিবেচনা করেই সুপ্রিম কোর্ট বিদেশীদের ভারতীয় শিশুর অভিভাকত্ব
নেবার ব্যাপারে বেশ কিছু নির্দেশ জারি করেছে। ফলে বিদেশীদের
ভারতীয় শিশুকে দত্তক নেওয়াটা এখন খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। আশাকরা
যায়, এর ফলে অবৈধ শিশু-পাচার ও শিশুনির্যাতন কমবে। তবে যাঁরা
ভারতীয় শিশুদের দত্তক নিতে আগ্রহী, তাঁরা এর ফলে নিরুত্সাহিত
হয়ে পড়লেও মুশকিল। ভারতবর্ষে প্রায় 12 মিলিয়ন অনাথ শিশু এবং
44 মিলিয়ন অতি-দুস্থ শিশু অনুজ্জ্বল ভবিষ্যত্ নিয়ে বড় হচ্ছে
- তাদের পক্ষে সেটা শুভ হবে না।
[আইন বিষয়ক যে-সব আলোচনা
অবসর-এ রয়েছে তার উদ্দেশ্য সাধারণ ভাবে আইনের ব্যাপারে
পাঠকদের অবহিত করা। এই আলোচনা কোনও ভাবেই উকিলের পরামর্শের
বিকল্প নয়। কারোর আইন সংক্রান্ত কোনও সমস্যা থাকলে,
তাঁর উচিত সরাসরি কোনও আইনজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।]