ক্রেতা-সুরক্ষা
আইন সংক্রান্ত কিছু কথার সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা

ক্রেতা-সুরক্ষা
আইনের প্রধান উদ্দেশ্য হল স্বল্প ব্যয়ে সহজে ও অল্প সময়ে ক্রেতা
সমস্যার নিäপত্তি। এই আইনটি কি তা ক্রেতা সুরক্ষা আইন পাতায়
মোটামুটি ভাবে দেওয়া হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে এইখানে কিছু শব্দের
অর্থ আরও বিষদ ভাবে দেওয়া হল:
ক্রেতা কারা?
সুরক্ষা আইনের সংজ্ঞা অনুসারে
যদি কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনও মূল্যের (consideration)
বিনিময়ে বা মূল্য দেবেন এই প্রতিশ্রুতিতে বা কিস্তিবন্দীতে কোনও
পণ্য ক্রয় বা সংগ্রহ করেন, তাহলে তিনি ক্রেতা বলে বিবেচিত হবেন।
এই আইনে আরও বলা হয়েছে যে, প্রকৃত ক্রেতা ছাড়াও যে-সব ব্যক্তি
ঐ পণ্য ব্যবহার করবেন, তাঁরাও ক্রেতার মর্যাদা পাবেন। পণ্য ক্রয়
ছাড়াও আরেক ধরণের ক্রয় লোকেরা করে। যেমন, বিভিন্ন ব্যক্তি বা
প্রতিষ্ঠানের পরিষেবা লোকেরা ক্রয় বা ভাড়া করে। রেল, টেলিফোন,
ডাক ও তার ইত্যাদি বিভাগের পরিষেবা অর্থ দিয়ে ক্রয় করতে হয়।
বাড়ি করার সময় টাকা দিয়ে কনট্রাক্টরের পরিষেবা লোকে গ্রহণ করে।
বেসরকারী প্রতিষ্ঠান - নার্সিংহোম, ক্যুরিয়ার সার্ভিস, কার-রেণ্টাল
(ভাড়ার গাড়ি) এজেন্সি, ইত্যাদির পরিষেবা পেতে হলে মূল্য ধরে
দিতে হয়। সুরক্ষা আইনে পরিষেবা গ্রাহকরাও ক্রেতা (consideration)
বলে বিবেচিত হবেন। তবে এ ব্যাপারে দুটি সর্ত মানা হচ্ছে কিনা
দেখতে হবে:
(1) ক্রেতাকে নগদ বা প্রতিশ্রুত মূল্যের বিনিময়ে পণ্য বা পরিষেবা
পেতে হবে।(বিশেষ দ্রষ্টব্য:সরকারী বা দাতব্য চিকিত্সালয়ে যেখানে
বিনা-মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে পরিষেবা পাওয়া যায়, সেই পরিষেবার
গ্রাহকরা ক্রেতা বলে বিবেচিত হবেন না।)
(2) ক্রীত পণ্য বা পরিষেবা কোনও বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে
ব্যবহার করা চলবে না।
পরিষেবা কি?
পরিষেবা (service) কথাটির
অর্থ হল সহায়তা বা সাহায্য এবং পালনীয় কর্তব্য। ক্রেতা সুরক্ষা
আইনে মূল্য বা ভাড়ার বিনিময়ে যে সাহায্য বা সহায়তা পাওয়া যায়,
তাকেই পরিষেবা বলে গণ্য করা হয়। এই পরিষেবা সরকারী বা বেসরকারী
- দুই হতে পারে। তবে 'মূল্যটা' অপর্যাপ্ত হলে (যেমন, সরকারী
বা দাতব্য চিকিত্সালয়ের নামমাত্র ফি), সেই পরিষেবার গ্রাহকদের
ক্ষেত্রে ক্রেতা-সুরক্ষা আইন প্রযোজ্য হবে না।
ত্রুটিপূর্ণ পণ্য বা পরিষেবা বলতে কি
বোঝায়?
পণ্য যদি সঠিক গুণমানের
(quality and standard) না হয়, যদি ওজনে কম থাকে কিংবা ভেজাল
হয় - তবে সেই পণ্য ত্রুটিপূর্ণ। সঠিক গুণমান বলতে বোঝায় যে,
সাধারণভাবে সেই পণ্যে লোকেরা যে গুণগত উত্কর্ষতা আশা করে। যেমন,
রঙিন টিভিতে ছবির রঙ ভালোভাবে আসা, ফ্রিজ ঠিকমত ঠাণ্ডা হওয়া,
বা ফ্যান চলতে গিয়ে ভীষণ আওয়াজ না করা, ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, পণ্যের
গুণমান নির্ধারণে সরকারী অনুমোদিত পরীক্ষাগারের মতামতই চূড়ান্ত
বলে গণ্য হবে।
পরিষেবার ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ
বলতে বোঝাবে গুণগত, পরিমানগত বা মানগত অসম্পূর্ণতা বা অপ্রতুলতা।
কেউ জরুরি টেলিগ্রাম পাঠালে সেটি যদি বহু দিন বাদে গিয়ে পৌঁছয়,
তাহলে সেই পরিষেবা 'মানের' বিচারে অবশ্যই অপ্রতুল, এবং এই পরিষেবার
গ্রাহক হিসেবে ক্ষতিপূরণ চাইবার অধিকার আপনার রয়েছে। ইলেকট্রিকের
কোম্পানী যদি কোন কারণ ছাড়া বে-আইনী ভাবে আপনার লাইন কেটে দেয়,
তাহলে পরিষেবার ঘাটতির জন্য আপনি ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারেন।
কিন্তু যুক্তিসঙ্গত কারণে যদি পরিষেবা অপ্রতুল হয়, তাহলে তার
জন্য ক্ষতিপূরণ দাবী করা যায় না। যেমন, রেল-অবরোধের জন্য ট্রেনের
দেরি হলে, বা বন্যার জন্য টেলিগ্রাম পৌঁছতে বিলম্ব ঘটলে - তার
জন্য কোনও অভিযোগ গ্রাহ্য হবে না। অর্থাত্ পরিষেবায় অপ্রতুলতা
থাকলেই চলবে না, সেখানে প্রমাণ করতে হবে যে, সেটি অবহেলার জন্য
ঘটেছে কিনা।
অবহেলা কি?
সাধারণভাবে অবহেলা বলতে
বোঝাচ্ছে যে কোনও বিষয়ে যথেষ্ঠ যত্ন বা সাবধানতা অবলম্বনে ব্যর্থতা।
আবার 'অবহেলা' আর 'ইচ্ছাকৃত অবহেলা'-র মধ্যে পার্থক্য আছে। সাধারণ
বোধ-বিবেচনা যুক্ত কোনও ব্যক্তি যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার
সুযোগ থাকা সত্বেও সেটি না নেন এবং তার জন্য কেউ ভুক্তোভোগী
হন, তাহলে ইচ্ছাকৃত অবহেলার দায়ে প্রথম জন অভিযুক্ত হবেন।
কোথায়
অভিযোগ করা যায়:
ক্রেতা-সুরক্ষা আইনে ক্রেতাদের
অভিযোগ নিষ্পত্তি করার জন্য ত্রি-স্তরীয় ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাথমিক
স্তরে রয়েছে জেলা ফোরাম (District Forum)। দ্বিতীয় বা মধ্য স্তরে
রয়েছে স্টেট কমিশন (State Commission)। তৃতীয় স্তরে রয়েছে জাতীয়
কমিশন (National Commission)।
জেলা স্তরে যে ফোরাম আছে তার সদস্য সংখ্যা তিনজন। কোন প্রাক্তন
জেলা স্তরের বিচারপতি বা বিচারপতি হবার যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি
এর সভাপতি হন। তিন-ব্যক্তি সম্পন্ন রাজ্য কমিশনের সভাপতি হন
কোনও অবসর-প্রাপ্ত হাই কোর্টের বিচারপতি। পাঁচ ব্যক্তি নিয়ে
গঠিত জাতীয় কমিশনের সভাপতি হন সুপ্রিম কোর্টের কোনও কর্মরত বা
অবসর-প্রাপ্ত বিচাপতি।
এই তিনটি জায়গার মধ্যে কোথায় অভিযোগ দায়ের করা যায় জানতে হলে
কতগুলি জিনিস পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে - যেমন, এই ফোরাম বা কমিশন
দুটির অধিকারক্ষেত্র (jurisdiction), ঘটনার স্থান ও সময়, বিবাদের
স্বরূপ, এবং বিবাদের বিষয়টি অন্য কোন আদালতের বিচারাধীন কিনা।
ফোরাম বা কমিশনের অধিকারক্ষেত্র বা এক্তিয়ার
(jurisdiction):
অধিকারক্ষেত্র বলতে বিচারালয়ের
বিবাদ নিäপত্তি করার ক্ষমতা, অধিকার ও কর্তৃত্বের সীমা বোঝায়।
অধিকারক্ষেত্র তিন ধরণের হয়: (1) সীমানাগত (territorial), (2)
আর্থিক (pecuniary), এবং (3) বিষয়-অধিকার (subject matter)।
সীমানাগত: জেলা ফোরাম বা
রাজ্য কমিশন স্ব-স্ব জেলায় বা রাজ্যে সংঘটিত বিবাদের নিäপত্তি
করার অধিকারী। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে নিজের ভৌগলিক সীমানার
বাইরের বিবাদের নিäপত্তি তারা করতে পারে। যেমন, বিবাদের উত্পত্তি
যেখানেই হোক না কেন, যাঁর বা যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে,
তাঁদের এক বা একাধিক ব্যক্তি যেখানে বসবাস করেন বা কাজ করেন
অথবা ব্যবসা করেন, সেই স্থান যে জেলা বা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
- সেই জেলা বা রাজ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা যায়।
আর্থিক: দাবীর পরিমানের
ওপর নির্ভর করছে কোথায় অভিযোগ দায়ের করা যাবে।
বিষয়-অধিকার: কেবল পণ্য
বা পরিষেবার ত্রুটি সংক্রান্ত বিষয়েই এই ফোরাম বা কমিশনের বিচারের
বিষয়বস্তু হবে।
যে-সব বিষয়ে অভিযোগ গ্রাহ্য হবে না:
(1) ক্রেতা বা গ্রাহীতা
যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোন ঝুঁকি নেন এবং তার জন্য আঘাতপ্রাপ্ত
হন বা তাঁর স্বার্থহানি ঘটে।
(2) ক্রীত পণ্যের ব্যবহার-পদ্ধতি না মেনে তাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার
করার পর সেই পণ্যে কোনও ত্রুটি দেখা দেয়।
(3) অভিযোগকারীর অভিযোগ জানানোর অধিকার না থাকে।
(4) অভিযোগ যদি কোনও জটিল আইন সংক্রান্ত হয়।
(5) অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত-পক্ষের উল্লেখ না থাকে এবং অভিযুক্ত-পক্ষকে
অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত না করা হয়।
অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি:
- ক্রেতা নিজে বা তাঁর
মনোনিত কোনও ব্যক্তি বা আইনজীবির মারফত্ অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
- অভিযোগ দায়ের করার আগে ক্রেতার দায়িত্ব হল যে, অভিযুক্ত-পক্ষকে
অভিযোগ সম্পর্কে জানানো। অভিযুক্ত-পক্ষ যদি তা সত্বেও তার প্রতিকার
করতে অসমর্থ হয়, তাহলেই অভিযোগ দায়ের করা চলবে।
- অভিযোগ জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভিযোগপত্র তৈরী করে
জমা দিতে হবে (জেলা ফোরাম বা রাজ্য কমিশনের জন্য তিনটি করে কপি;
জাতীয় কমিশনের জন্যে পাঁচটি কপি)
- কোনও স্ট্যাম্প ডিউটি বা কোর্ট ফি-র প্রয়োজন নেই।
- অভিযোগপত্রে ঘটনাগুলি কালক্রমে সাজিয়ে লিখে তারপর অভিযোগ পেশ
করতে হবে। অভিযোগ পত্রে মোট দাবীর পরিমান জানাতে হবে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি কি অভিযোগ জানাতে
পারেন?
যে কোনও স্বীকৃত কনসিউমার
এসোসিয়েশন এক বা একাধিক ক্রেতাদের হয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে অভিযোগ
দায়ের করতে পারেন. তবে এই এসোসিয়েশনকে 1956 সালের কোম্পনি এক্ট
(Company Act) বা অন্য কোনও সংস্থা সম্পর্কীত আইনে রেজিস্ট্রিকৃত
হতে হবে।
সতর্কতা:
অভিযোগ ভ্রান্ত প্রমাণিত
হলে বা হয়রাণি করার উদ্দেশ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে প্রতিপন্ন
হলে ফোরাম বা কমিশন অভিযোগকারীর জরিমানা করতে পারেন। এর জন্য
অভিযুক্ত-পক্ষের যা খরচা হয়েছে (দশ হাজার টাকা পর্যন্ত) তা দেবার
জন্য ফোরাম বা কমিশন অভিযোগকারীকে নির্দেশ দিতে পারেন।
এ বিষয়ে আরও বিশদভাবে জানতে হলে নিম্নলিখিত
ঠিকানায় যোগাযোগ করুন:
ক্রেতা বিষয়ক দপ্তর, 11
মির্জা গালিব স্ট্রিট, কলকাতা 700087, ফোন 2252-2304 ও 2252-0053
[আইন বিষয়ক যে-সব আলোচনা
অবসর-এ রয়েছে তার উদ্দেশ্য সাধারণ ভাবে আইনের ব্যাপারে
পাঠকদের অবহিত করা। এই আলোচনা কোনও ভাবেই উকিলের পরামর্শের
বিকল্প নয়। কারোর আইন সংক্রান্ত কোনও সমস্যা থাকলে,
তাঁর উচিত সরাসরি কোনও আইনজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।]