পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইন,
২০০৫ কি এবং কেন?

মহিলাদের
প্রতি নির্যাতন রোধে বিভিন্ন আইন প্রচলিত থাকা সত্বেও তাঁদের
সুরক্ষার জন্যে এই নতুন পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইন (ডোমেস্টিক
ভায়োলেন্স অ্যাক্ট) প্রবর্তনের কি কোন প্রয়োজন ছিল?
এতদিন বিভিন্ন কারণে,
যেমন খোরপোশের অর্থ, সন্তানের হেফাজত, অত্যাচার নিবারণ, সম্পত্তি
নষ্ট হওয়ার জন্যে ক্ষতিপূরণ, উচ্ছেদ প্রতিরোধ, এ সমস্ত কিছুর
জন্যেই মহিলাদের পৃথক পৃথক মামলা দায়ের করতে হত। এতে সময় ও
অর্থ, দুই-ই বেশি লাগত। এই আইনে সমস্ত অভিযোগ একটিমাত্র অভিযোগ
পত্রের মাধ্যমে জানানো যাবে। ফলে প্রতিকার দ্রুত হবে।
কি ধরণের অত্যাচার এই
নতুন পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইনের (ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স
অ্যাক্ট) আওতায় পড়ে?
উত্তর: শারীরিক ও মানসিক
নির্যাতন তো বটেই, এছাড়া যৌন, মৌখিক, ও আর্থিক নির্যাতন এই
আইনের চোখে দণ্ডনীয়। কোন মহিলাকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর
করে বিয়ে দেওয়া বা তাঁর পছন্দের মানুষকে বিয়ে না করতে দেওয়া,
কোন মহিলাকে অশালীন ভাষায় গালাগালি করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা,
পুত্রসন্তান না হওয়ার জন্যে বা কন্যাসন্তান হওয়ার জন্যে তাঁকে
গঞ্জনা দেওয়া, সন্তান না হওয়ার জন্যে অপমান করা, বাপের বাড়ি
থেকে পণ দেওয়া হয় নি বা কম দেওয়া হয়েছে বলে মারধর, গালিগালাজ
করা, এ সব কিছুই শারীরিক, মানসিক, মৌখিক, বা আবেগগত নির্যাতন
হিসেবে ধরা হবে।
কোন মহিলাকে গৃহচু্যত
করার জন্যে ভাড়া বাড়িতে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করা, তাঁকে চাকরি
বা কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা, তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব না নেওয়া,
বাড়িতে থাকা সত্বেও খাবার, ওষুধপত্র, জামাকাপড়, ইত্যাদি থেকে
বঞ্চিত করা, মহিলাটির অমতে তাঁর উপার্জন ছিনিয়ে নেওয়া, এসব
আর্থিক অত্যাচার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
কোন মহিলার প্রিয় শিশু
বা তাঁর আদরের অন্য কাউকে শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দেওয়া,
শিশুদের জোর করে স্কুল বা কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া, তাদের যৌন
নির্যাতন করা, বা মহিলাটিকে সন্তানসহ জোর করে বাড়িতে আটক করা,
এসব পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইনের আওতায় পড়ে।
এই আইনের
এক্তিয়ার (জুরিসডিকশন) কি?
প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল
ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ
জানাতে হবে। নিচে লেখা স্থানগুলিতে অভিযোগ জানানো চলবে:
(ক) যে এলাকায় নির্যাতিতা
মহিলা স্থায়ী বসবাস করেন, সাময়িক ভাবে বসবাস করছেন, বা কোন
চাকরি বা ব্যবসা করছেন সেখানকার এলাকাবর্তী আদালতে;
বা
(খ) যেখানে অপরপক্ষ (নির্যাতনকারী)
বসবাস করেন বা যেখানে তিনি চাকরি বা ব্যবসা করেন;
বা
(গ) যেখানে নির্যাতনের
ঘটনাগুলি ঘটেছে।
এই আইনে মহিলারা কি মহিলাদের
বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারবেন?
না। এই আইনে অন্য কোন
মহিলার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ জানানো যাবে না। একমাত্র পরিবারের
পুরুষ সদস্যদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ জানানো চলবে।
ভারতীয় দণ্ডবিধি ৪৯৮-এ-র
(ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড) সঙ্গে এই আইনের কি পার্থক্য আছে?
ভারতীয় দণ্ডবিধি ৪৯৮-এ
ধারার থেকে এই আইনের পরিধি অনেক বেশি বিস্তৃত। স্বামী বা শ্বশুরবাড়ীর
সদস্যদের হাতে পণের জন্যে বিবাহিত মহিলাদের শারীরিক বা মানসিক
নির্যাতন রুখতে ভারতীয় দণ্ডবিধি ৪৯৮-এ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু
এই ফৌজদারী আইনে সব মহিলাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব
নয়। এই নতুন আইনে বধূরা তো বটেই এছাড়া মা, অবিবাহিতা বোন,
বিধবা বৌদি, সকলেই সুরক্ষা পাবেন। শুধু তাই নয়, বিয়ে না করেও
যে মহিলারা প্রেমিকের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকেন তাঁরাও নিরাপত্তা
পাবেন। এ ক্ষেত্রে পুরুষ সঙ্গী বা প্রেমিক যদি নির্যাতন করেন,
তাঁর শাস্তি হবে।
এই আইনের
ফলে অভিযোগ কতদিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে?
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে
লিখিত আবেদন করার পরে অভিযোগপত্র পাওয়ার দিন থেকে তিনদিনের
মধ্যে প্রথম শুনানির দিন ধার্য করা হবে। আবেদনকারী মহিলা যে
বিষয়ে সুরাহা চান সেটি প্রথম শুনানির দিন থেকে ষাট দিনের মধ্যে
সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আইনগত আদেশ (অর্ডার) দিয়ে নিষ্পত্তি
করার চেষ্টা করবেন।
এই আইনে
অপরাধীর কি ধরনের শাস্তির বিধান আছে?
প্রথমেই মনে রাখা দরকার
যে এই আইন শাস্তিমূলক আইন নয়। নির্যাতনকারীকে শাস্তি দেওয়া
বা দমন করাই এর মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। এতে নির্যাতিত মহিলার যে
মানবিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে সেই অধিকারগুলি তাঁকে ফিরিয়ে
দেওয়া এবং তাঁর নিয়মিত সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই আইনটি
একটি দেওয়ানী আইন। যদি নির্যাতনকারী ব্যক্তি ম্যাজিস্ট্রেটের
দেওয়া সুরক্ষা আজ্ঞা অগ্রাহ্য করে এবং নির্যাতন চালিয়ে যায়,
তবে এই আইনের চোখে তা ফৌজদারী অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেই অপরাধ
জামিন অযোগ্য হবে এবং গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়াই (কগ্নাইজেবল
- cognizable) পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারবে। ম্যাজিস্ট্রেটের
জারি করা সুরক্ষা নির্দেশ (protection order) অগ্রাহ্য করলে
সেই ফৌজদারী অপরাধের জন্যে নির্যাতনকারীর এক বছর পর্যন্ত কারাবাস
ও সর্বাধিক কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।
সুরক্ষা
নির্দেশ (protection order) কি?
নির্যাতিতা মহিলার অভিযোগ
পাওয়ার পরে ম্যাজিস্ট্রেট অপরপক্ষকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্যে
নোটিশ দেবেন। অপরপক্ষ এলে দুপক্ষের শুনানির পরে যদি তিনি প্রাথমিকভাবে
নিশ্চিত হন যে পারিবারিক নির্যাতন ঘটেছে তাহলে নির্যাতিত মহিলার
সুরক্ষার জন্যে তিনি নির্দেশ জারি করতে পারেন। এই নির্দেশে
আজ্ঞা থাকবে যে নির্যাতনকারী -
ক) আর
কোন পারিবারিক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাবেন না;
খ) পারিবারিক হিংসার ব্যাপারে কাউকে সাহায্য করবেন না বা উত্সাহ
দেবেন না;
গ) নির্যাতিত মহিলার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবেন না। অর্থাত্
নির্যাতিত মহিলাকে চিঠি লেখা, টেলিফোন করা, বা কথা বলা চলবে
না;
ঘ) নির্যাতিত মহিলার কোন সম্পত্তি বিক্রি করবেন না, কোন যৌথ
ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্ট বা লকার থেকে লেনদেন করবেন না, মহিলার
স্ত্রীধন কিংবা যৌথ মালিকানার কোন সম্পত্তি ম্যাজিস্ট্রেটের
অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর করবেন না;
ঙ) নির্যতিত মহিলা যদি কর্মরতা হন, তাহলে নির্যাতনকারীর তাঁর
কর্মস্থলে যাওয়া নিষিদ্ধ হতে পরে। কোন শিশুকে নির্যাতন করা
হলে তার স্কুলে যাওয়ার ওপরও ম্যাজিস্ট্রেট নিষেধাজ্ঞা জারি
করতে পারেন;
চ) নির্যাতিত মহিলার ওপর নির্ভরশীল কোন ব্যক্তি, শিশু, বা
মহিলাকে পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধে সাহায্য করেছেন এমন কোন
ব্যক্তির ওপর অত্যাচার করতে পারবেন না;
ছ) এছাড়া সুরক্ষা নির্দেশে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর বিবেচনা অনুযায়ী
নির্যাতনকারীর অন্যান্য ব্যবহার ও ক্রিয়াকর্মও নিষিদ্ধ করতে
পারেন।
সুরক্ষা
নির্দেশ (অর্ডার) পাওয়ার জন্যে কি করতে হবে?
নির্যাতিত মহিলা নিজে,
সুরক্ষা অফিসার (রওতএচতেওন ফফচেএর) , অথবা কোন স্বেচ্ছাসেবী
সংস্থা মহিলার হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ পত্র পেশ করতে
পারেন। অভিযোগপত্রে মহিলা কি ধরনের বা কি কি সুরাহা চাইছেন
লেখা থাকবে। অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম শুনানির
দিনটি ধার্য করবেন, সাধারণভাবে প্রথম শুনানির দিনটি অভিযোগপত্র
দায়ের করার তিনদিনের মধ্যে ধার্য করা হবে।
এই আইনে
সুরক্ষা (প্রোটেকশন) অফিসার বলতে কি বোঝানো হচ্ছে?
রাজ্য সরকার প্রতিটি
জেলায় প্রয়োজন অনুযায়ী মহিলাদের সাহায্যের জন্যে সুরক্ষা (প্রোটেকশন)
অফিসার নিযুক্ত করবেন। এঁরা মহিলাদের সুরক্ষার কাজ করবেন এবং
এই আইনটি বলবত্ করার উদ্দেশ্যে ম্যাজিস্ট্রেটকে সাহায্য করবেন।
সুরক্ষা
(প্রোটেকশন) অফিসারের কি কি দায়িত্ব আছে?
সুরক্ষা অফিসারের প্রধান
কাজ ম্যাজিস্ট্রেটকে সহায়তা করবেন। তিনি একটি পারিবারিক হিংসা
রিপোর্ট (ডোমেস্টিক ইনসিডেন্ট রিপোর্ট) তৈরী করে ম্যাজিস্ট্রেটকে
দেবেন। এই রিপোর্টের এক কপি তিনি সংশ্লিষ্ট এলাকার থানাতে
দাখিল করবেন এবং এক কপি ঐ অঞ্চলের পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাকে
(সার্ভিস প্রোভাইডার) পাঠাবেন। আমাদের দেশে অধিকাংশ মহিলাদের
আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তাঁরা সাধারণত মামলার খরচ বহন করতে
পারেন না। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক আইনগত সাহায্য আইন ১৯৮৭ (দি
লিগাল সার্ভিসেস অথরিটিস অ্যাক্ট ১৯৮৭) অনুসারে সব মহিলারা
বিনা খরচে আইনজীবির সাহায্য ও মামলা চালানোর খরচ পেতে পারেন।
তাই সুরক্ষা অফিসার মহিলাদের এই আইন সম্পর্কে জানাবেন এবং
প্রয়োজন মতো বিনা খরচে অভিযোগপত্র দায়ের করার ব্যবস্থা করে
দেবেন।
এছাড়া নির্যাতিতা মহিলার
অঞ্চলে কি কি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা রয়েছে এবং তারা কি
ধরনের পরিষেবা দেন তার একটি তালিকাও সুরক্ষা অফিসার রাখবেন।
মহিলার যদি আশ্রয় আবাসের প্রয়োজন হয় তাহলে সুরক্ষা অফিসার
সেই ব্যবস্থাও করে দেবেন। নির্যাতনের ফলে মহিলার যদি ডাক্তারী
পরীক্ষা এবং চিকিত্সার প্রয়োজন হয় তাহলে সে ব্যবস্থাও সুরক্ষা
অফিসার করে দেবেন।
নির্যাতিত মহিলা আর্থিক
সুরাহার (যেমন ক্ষতিপূরণ বা খোরপোশ) নির্দেশ পেলে সেই আদেশ
যথাযথ পালিত হচ্ছে কিনা অর্থাত্ মহিলা টাকা পয়সা ঠিকমত পাচ্ছেন
কিনা সেও সুরক্ষা অফিসার দেখবেন।
পারিবারিক নির্যাতন রিপোর্ট
(ডোমেস্টিক ইন্সিডেণ্ট রিপোর্ট) বলতে কি বোঝায়?
কোন মহিলা যদি পারিবারিক
হিংসার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তাহলে এই আইন অনুযায়ী
তিনি কি ধরনের পারিবারিক হিংসার শিকার হয়েছেন তার বিস্তারিত
বিবরণ লিখতে হবে। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত বয়ানে এবং নির্দিষ্ট
ভাবে এই বিবরণ তৈরী করতে হয়। একে বলে পারিবারিক নির্যাতন রিপোর্ট
(ডোমেস্টিক ইন্সিডেণ্ট রিপোর্ট)।
পরিষেবা
প্রদানকারী (সার্ভিস প্রোভাইডার) বলতে কি বোঝায়?
পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলিকে
সংস্থা রেজিস্ট্রেশন আইন (সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট)
অনুযায়ী স্বীকৃত হতে হবে। কোন সংগঠন কোম্পানীজ অ্যাক্ট-এ স্বীকৃত
হলেও পরিষেবা দিতে পারেন।
পরিষেবা
প্রদানকারী সংস্থাগুলির ভূমিলা কি?
এঁদের কাজ:
ক) অত্যাচারিত
মহিলাদের আইনানুগ পদ্ধতিতে সুরক্ষা দেওয়া ও তাঁদের অধিকার
এবং স্বার্থ রক্ষা করা। মহিলাদের আইনি সাহায্য, ডাক্তারি সাহায্য,
আশ্রয়, ইত্যাদির ব্যাপারে সহায়তা করা;
খ) পারিবারিক নির্যাতন রিপোর্ট (ডোমেস্টিক ইন্সিডেণ্ট রিপোর্ট)
তৈরি করে সেই রিপোর্টের কপি এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট এবং সুরক্ষা
অফিসারের কাছে পাঠানো;
গ) নির্যাতিত মহিলার প্রয়োজন হলে তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়ে
তার রিপোর্টের কপি সেই এলাকার সুরক্ষা অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট
থানায় পাঠানো;
ঘ) যদি প্রয়োজন হয় তাহলে মহিলাটিকে আশ্রয় আবাসে থাকার ব্যবস্থা
করে দেওয়া। নির্যাতিত মহিলার আশ্রয় আবাসে থাকার বিষয়টি যে
এলাকায় পারিবারিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে সেই এলাকার থানায় জানিয়ে
রাখা।
এই আইনে
শেয়ার্ড হাউসহোল্ড - (Shared household) বলতে কি বোঝায়?
এর মানে যে বাড়ীতে নির্যাতিতা
মহিলা বাস করেন; নির্যাতনকারীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন কোন
সময়ে বসবাস করেছেন; নির্যাতনকারীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন
কোন সময়ে একা বাস করেছেন; মালিক কিম্বা ভাড়াটে হিসেবে যৌথ
বা এককভাবে নির্যাতনকারীর সঙ্গে বসবাস করেন; অথবা যে বাড়ি
যৌথ পরিবারের মালিকানাধীন এবং নির্যাতনকারী সেই যৌথ পরিবারের
সদস্য।
এই আইনে
বসবাসের নির্দেশ (রেসিডেন্স অর্ডার) বলতে কি বোঝায়?
এতদিন যাঁরা নীরবে অত্যাচার
সহ্য করেছেন বা সন্তানদের মুখ চেয়ে চুপ করে থেকেছেন এই ভয়ে
যে প্রতিবাদ করলে সন্তানসহ তাঁদের বাস্তুচু্যত করা হবে, তাঁরা
এই বসবাসের নির্দেশের মাধ্যমে (রেসিডেন্স অর্ডার) সুরাহা পাবেন।
এই আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে যে নির্যাতিত মহিলা যেখানেই থাকুন,
সেই সম্পত্তিতে তাঁর মালিকানা থাকুক বা না থাকুক জোর করে রাতারাতি
তাঁকে রাস্তায় বের করে দেওয়া যাবে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আদালত
নির্যাতনকারীকে অন্য কোথাও সরে যাবার বিশেষ আদেশ দিতে পারেন।
নির্যাতনকারী বাড়িটি বিক্রি বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তরিত যাতে
না করতে পারেন - তার আদেশ হতে পরে। প্রয়োজনে নির্যাতিত মহিলাকে
অন্য কোন বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া বা তাঁর বাড়ি ভাড়া
দেওয়ার দায়িত্ব ম্যাজিস্ট্রেট নির্যাতনকারীর ওপর ন্যস্ত করার
আদেশ দিতে পারেন।
এই আইনে
ক্ষতিপূরণ আদেশ (কম্পেনসেশন অর্ডার) বলতে কি বোঝায়?
পারিবারিক হিংসার কারণে
কোন মহিলার শারীরিক ক্ষতি হলে, তাঁর কোন মানসিক আঘাত লাগলে,
বা আবেগজনিত কারণে ক্ষতি হলে ম্যাজিস্ট্রেট নির্যাতনকারীকে
ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য
বিষয়ে আদেশের ওপর অতিরিক্তভাবেও ম্যাজিস্ট্রেট এই আদেশ দিতে
পারেন।
এই আইনে
কি অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কি?
যদি পারিবারিক হিংসার
ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগপত্র পাওয়ার পরে ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন
যে প্রাথমিকভাবে কোন পারিবারিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে বা নির্যাতনকারী
কোন হিংসাত্মক আচরণ করবে এমন আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে তিনি নির্যাতিত
মহিলার হলফনামার ভিত্তিতে অন্তবর্তী আদেশ দিতে পারেন।
এই আইনে
যে আদেশ দেওয়া হবে তার বিরুদ্ধে আপিলের কোন সুযোগ আছে কি?
ম্যাজিস্ট্রেট নির্দেশ
দেওয়ার পরে সেই আদেশ পাওয়ার দিন থেকে ত্রিশ দিনের মধ্যে অভিযোগকারী
মহিলা বা নির্যাতনকারী উচ্চতর আদালতে (সেশন্স কোর্ট) আপিল
করতে পারেন।
এই আইনে
কি একতরফা আদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে?
অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে
ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন যে নির্যাতনকারী বা অপরপক্ষ পারিবারিক
হিংসার ঘটনা ঘটাচ্ছেন, পারিবারিক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, অথবা
ঘটবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে তিনি অভিযোগকারিনী মহিলার
হলফনামা স্বীকার করে নিয়ে সুরক্ষা, বাসগৃহ, সন্তানের হেফাজত,
ইত্যাদি সম্পর্কে একতরফা আদেশ জারি করতে পারেন।
যদি
কোন মহিলা অন্যান্য প্রচলিত আইন অনুযায়ী নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে
মামলা করে থাকেন তাহলে কি তিনি এই আইনের সাহায্য নিতে পারেন?
অবশ্যই। যদি কোন মহিলা
অন্যান্য প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করে
থাকেন তাহলে সেই মামলা চলাকালীন অবস্থায় তিনি যদি পারিবারিক
হিংসা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হন তাহলে তিনি অবশ্যই এই আইনের সাহায্য
নিতে পারেন।
আমাদের
দেশে অধিকাংশ মহিলারা আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হন না। তাহলে তাঁরা
কি ভাবে আইনের সাহায্য নেবেন? মামলার কোন খরচই বা চালাবেন
কি করে?
অনেক মহিলার মুখ বুজে
অত্যাচার সহ্য করার প্রধান কারণ যে তাঁরা আর্থিকভাবে দুর্বল
এবং স্বনির্ভর নন।
যাঁদের আর্থিক সামর্থ
নেই তাঁদের বিনা খরচে আইনি সাহায্য দেবর জন্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক
আইনগত সাহায্য আইন ১৯৮৭ (দি লিগাল সার্ভিসেস অথরিটিস অ্যাক্ট
১৯৮৭)। এই আইনে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে বিনা খরচে আইনি সাহায্য
কারা পাবেন এবং কী পদ্ধতিতে এই আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। এই
আইনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রত্যেক মহিলা, তাঁর
নিজস্ব রোজগার থাক বা না থাক অথবা তাঁর সামাজিক অবস্থান যেমনই
হোক তিনি সবসময় বিনা খরচে আইনি সাহায্য পাবেন। যদি কোন নির্যাতিত
মহিলার আদালতে গিয়ে মামলা চালানোর প্রয়োজন হয় তবে তিনি অবশ্যই
আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সাহায্য নিতে পারেন।
এই আইন
অনুসারে একজন পুলিশ অফিসারের কর্তব্যগুলি কি?
কোন নির্যতিত মহিলা যদি
পুলিশ অফিসারকে অভিযোগ জানান যে তিনি পরিবারের কোন পুরুষ সদস্য
বা একাধিক সদস্যদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাহলে
পুলিশ অফিসার মহিলাকে এই আইনটি সম্বন্ধে জানাবেন। এই আইনটি
নতুন চালু হয়েছে ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও এ বিষয়ে ভাল
জানেন না।
তাঁর কর্তব্য মহিলাকে
জানানো যে এই আইন অনুযায়ী তিনি সুরক্ষা পেতে পারেন। দ্বিতীয়ত,
সেই অঞ্চলের পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার তালিকা তিনি মহিলাকে
জানাবেন। তৃতীয়ত, মহিলা যে বিনা খরচে আইনী পরিষেবা পেতে পারেন
তা জানাবেন। মহিলা যে অভিযোগ করছেন সেই অভিযোগ যদি ভারতীয়
দণ্ডবিধি ৪৯৮-এ বর্ণিত অপরাধ হয় তাহলে মহিলাকে পুলিশ অফিসার
তা জানাবেন এবং সেই অভিযোগপত্র দাখিল করার অধিকার যে রয়েছে
তা জানাবেন।
এই অনুযায়ী
মহিলারা কি আর্থিক সুরাহা সংক্রান্ত আদেশ পেতে পারেন?
এই আইন অনুযায়ী একজন
মহিলা আদালত থেকে নিম্নলিখিত বিষয়ে 'আদেশ' পেতে পারেন:
ক) তিনি
নিজের জন্যে ও সন্তানের/সন্তানদের জন্যে খোরপোশ পেতে পারেন;
খ) নির্যাতনকারী যদি তাঁর কোন শারীরিক ক্ষতি করে থাকেন, তাহলে
সেই ক্ষতির জন্যে তিনি ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন;
গ) মানসিক অত্যাচারের দরুণ এবং আবেগজনিত বিপর্যয়ের জন্যে ক্ষতিপূরণ
পেতে পারেন;
ঘ) তাঁর রোজগারের ক্ষতি হওয়ার দরুণ ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন;
ঙ) তাঁর কোন সম্পত্তি নষ্ট, ক্ষতিগ্রস্ত বা স্থানান্তরিত হওয়ার
জন্যে ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।
মধুপূর্ণা
ঘোষ
সূত্র:
'সুতানুটির সখ্য' প্রকাশিত ও আইনজীবি মধুপূর্ণা ঘোষ সম্পাদিত
'পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইন, ২০০৫' পুস্তিকা।
[নারী ও শিশুদের স্বাভাবিক
বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ লিঙ্গ বৈষম্য নির্মূল করতে
উৎসর্গীকৃত সংস্থা হল 'সুতানুটির সখ্য'। এই সংস্থার বিভিন্ন
কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে: মহিলা ও বরিষ্ঠ নাগরিকদের বিনা খরচে
আইনী পরামর্শ প্রদান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ
করা, মানবী শাস্ত্র বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করা, সামাজিক সচেতনতা
ও জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম। এই সংস্থার সঙ্গে
যোগাযোগের ঠিকানা: ই-মেইল: sutanutisakhya@yahoo.com; চলভাষ:
৯৮৩০৭৫৩৬৭৮]
[আইন বিষয়ক যে-সব আলোচনা
অবসর-এ রয়েছে তার উদ্দেশ্য সাধারণ ভাবে আইনের ব্যাপারে
পাঠকদের অবহিত করা। এই আলোচনা কোনও ভাবেই উকিলের পরামর্শের
বিকল্প নয়। কারোর আইন সংক্রান্ত কোনও সমস্যা থাকলে,
তাঁর উচিত সরাসরি কোনও আইনজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।]