মুসলিম বিবাহ আইন (শরিয়ত) সম্পর্কে
কিছু তথ্য

ভারতবর্ষে
মুসলিম আইন সৃষ্টি হয়েছে মূলতঃ কোরানের নির্দেশ থেকে। তবে
নির্দেশগুলি সংশোধিত হয়েছে বিধানসভা ও লোকসভায় গৃহীত বিল
এবং কোর্টের বিভিন্ন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে।
মুসলিম আইন (শরিয়ত)
অনুসারে বিবাহ বা নিকা হল পরস্পরের উপভোগের জন্য এবং বৈধ
সন্তান উত্পাদনের জন্য স্বেচ্ছায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া। এর প্রধান
বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
মুসলিম বিবাহ হতে গেলে
এক পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাব (ইজাব) আসতে হবে এবং অন্য
পক্ষকে তাতে সন্মতি (কবুল) জানাতে হবে। সন্মতি ছাড়া বিবাহ
বৈধ হবে না এবং এই সন্মতি কোনও শর্ত-সাপেক্ষ হওয়া চলবে না।
উপরোন্তু এই সন্মতি আদায় করার জন্য কোনও রকম চাপ সৃষ্টি,
মিথ্যার প্রশ্রয় নেওয়া বা কোনোরূপ প্রভাব খাটানো চলবে না।
একই বৈঠকে প্রস্তাব ও সন্মতিদান সম্পন্ন করতে হবে এবং এগুলি
করতে হবে সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে। সাক্ষী থাকবে দুই জন
পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুই জন নারী (সুন্নি আইন অনুসারে)।
নারীসাক্ষীদের ক্ষেত্রে সাক্ষীদের হতে হবে প্রাপ্তবয়স্ক,
সুস্থমনা ও মুসলিম। শিয়া আইনে বিবাহের সময় সাক্ষীর প্রয়োজনীয়তা
নেই।
মুসলিম বিবাহ আইনে নাবালক ও অসুস্থমনা ব্যক্তিদের বিবাহ
হওয়া সম্ভব, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে অভিভাবক বা কোনও প্রতিনিধি
কর্তৃক এই বিবাহ-চুক্তি সম্পাদিত হবে। নাবালকরা প্রাপ্ত-বয়স্ক
হবার পর চাইলে এই চুক্তি বাতিল করতে পারবে।
এই বিবাহের অধিকার ও দায়ের মধ্যে রয়েছে বিবাহের আগে, বিবাহের
সময়ে অথবা বিবাহের পরে উভয়পক্ষের মধ্যে যে বোঝাপড়া (শর্ত)
হবে, তা যদি মুসলিম আইন বা সাধারণ নীতির পরিপন্থী না হয়,
তাহলে সেই শর্ত বাধ্যতামূলক হবে।
মুসলিম বিবাহ আইনে দেনমোহরের ব্যবস্থা আছে। দেনমোহরে একটি
অর্থের পরিমান নির্দিষ্ট করা হয়, যেই পরিমান অর্থ স্ত্রীকে
দিতে স্বামী বাধ্য থাকবে। বিবাহের সময়ে বা পূর্বে এই দেনমোহর
স্থির হয়। অবশ্য পরেও করা যেতে পারে। দেনমোহরকে বিবাহ-চুক্তির
মূল্য বা শর্ত বলা চলে না (মুসলিম বিবাহে কোনও শর্ত থাকে
না)। লাহোর ও এলাহাবাদ হাইকোর্ট দেনমোহরকে স্ত্রীর মর্যাদাস্বরূপ
বলে বিচার করেছেন - অর্থাত্ এটি হল আইনগত স্ত্রীর প্রাপ্য
মার্যাদা। বিবাহ-চুক্তিতে যদি লেখাও থাকে দেনমোহর দিতে হবে
না - সেক্ষেত্রেও দেনমোহর স্ত্রীর প্রাপ্য। অন্যপক্ষে কলকাতা
হাইকোর্টের মতে, দেনমোহর হল সম্পত্তির মূল্য।
মুসলিম বিবাহ আইনে নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ।
সেই আত্মীয়তা রক্ত-সম্পর্কিত হতে পারে (যেমন, পুরুষের ক্ষেত্রে
তার মাতা, মাতামহী, কন্যা, পৌত্রী, ইত্যাদি), কিংবা অন্য
কোন নিকট আত্মীয় হতে পারে (যেমন, পুরুষের ক্ষেত্রে শাশুড়ি,
স্ত্রীর পূর্ববিবাহজাত কন্যা, বিমাতা, ইত্যাদি)।
এই আইন অনুসারে পুরুষরা একসঙ্গে চারটি বিবাহ করতে পারে।
কিন্তু নারীদের পক্ষে একই সঙ্গে একাধিক স্বামী থাকা নিষিদ্ধ।
মুসলিম বিবাহ আইনে অনেক অবৈধ বিবাহ বৈধ হয়ে যায় যখন অবৈধতার
কারণ লুপ্ত হয়। যেমন, চারটি স্ত্রী বর্তমান থাকলেও কেউ যদি
আবার বিবাহ করে, তাহলে সেই বিবাহ অবৈধ। কিন্তু সে যদি একজন
স্ত্রীকে তালাক দেয় (বা পরিত্যাগ করে), তাহলে তার অবৈধ বিবাহটি
বৈধ হয়ে যায়। কোনও নারীর ইদ্দতের সময়কালে তাকে বিবাহ করলে
সেই বিবাহ অবৈধ, আবার ইদ্দতের সময়ে পার হয়ে গেলেই সেটি বৈধ
বলে গণ্য হবে।
(ইদ্দত: স্বামীর মৃত্যুর পর বা বিবাহ-বিচ্ছেদের পর মুসলিম
নারী যে-সময়ের জন্য [মোটামুটিভাবে তিনমাস বা তার অধিক] একা
থাকে)।
সুন্নি পুরুষ যদি কোনও মুসলিম নারী বা কিতাবিয়াকে (অর্থাত্,
যে-ধর্মে ঈশ্বর-প্রদত্ত বাণী পুস্তকাকারে [বাইবেল, কোরান,
ইত্যাদি] আছে - সেই ধর্মাবলম্বীকে) বিবাহ করে - তাহলে সুন্নি
আইন অনুসারে সেটি বৈধ হবে। কিন্তু যে ধর্মে পৌত্তলিকতা আছে
(যেমন, হিন্দু ধর্ম) - সেই ধর্মাবলম্বী নারীকে বিবাহ করতে
পারে না। করলে, সেটিকে নিয়ম-বহির্ভূত বা অনিয়মিত বলে গণ্য
করা হবে। শিয়া আইনে এটি শুধু অনিয়মিত নয়, এটি হবে অবৈধ।
সুন্নি ও শিয়া - কোন আইনেই মুসলিম নারী কোনও অমুসলিম পুরুষকে
(সে কিতাবিয়া হলেও) বৈধভাবে বিবাহ করতে পারে না। সুন্নি
আইন অনুসারে সেটি হবে নিয়ম-বহির্ভূত বিবাহ। শিয়া আইন অনুসারে
সেটি হবে অবৈধ।
যদিও কোরান ও হদিথে এ-বিষয়ে সমর্থন নেই, তবুও অন্যান্য চুক্তির
মত বিবাহ-চুক্তিও যাতে ভঙ্গ করা যায় - তার ব্যবস্থা ভারতবর্ষের
মুসলিম আইনে রয়েছে। The Dissolution of Muslim Marriage
Act, ১৯৩৯ অনুসারে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে নারীর পক্ষে
বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতে যাবার কয়েকটি শর্ত আছে:
১) চার বছর ধরে স্বামী নিখোঁজ;
২) দুই বছর ধরে স্বামী তাকে অবহেলা করছে বা ভরণপোষণ দেয়
নি;
৩) স্বামী সাত বছর বা তার অধিক কালের জন্য কারাদণ্ড পেয়েছে;
৪) তিন বছর ধরে কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া দাম্পত্য কর্তব্য
করে নি;
৫)দুই বছর ধরে স্বামীর মাথা খারাপ কিংবা কুষ্ঠরোগগ্রস্থ
বা বাজে যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত;
৬) বিবাহের সময় স্বামী অক্ষম ছিল এবং এখনও আছে;
৭) ১৫ বছর বয়স হবার আগে যে বিবাহ হয়েছিল, ১৮ বছর বয়সের আগেই
সে বিবাহকে স্বামী অস্বীকার করেছে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক
ঘটে নি;
৮) স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করছে, যেমন, তাকে প্রহার করছে বা
মানসিক ভাবে পীড়ন করছে, অসত্রমণীর সঙ্গে সংসর্গ করছে, স্ত্রীকে
জোর করে অসামাজিক অবৈধ জীবনযাপন করতে বাধ্য করছে, ধর্মীয়
আচরণে হস্তক্ষেপ করছে, স্ত্রীর আইনসঙ্গত অধিকারে বাধা দিচ্ছে,
কোরানের অনুশাসন অনুযায়ী সকল স্ত্রীদের সঙ্গে সম-আচরণ করছে
না, ইত্যাদি।
পুরুষদের ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের একক ইচ্ছার আইন আছে।
যে কোনও পুরুষ তিনবার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীকে পরিত্যাগ
করতে পারে। যার উদ্দেশ্যে তালাক দেওয়া হল, সে সেখানে না
থাকলেও এই বিচ্ছেদ স্বীকৃতি পাবে। তবে তালাক দেওয়া স্ত্রীকে
সেই পুরুষ আবার বিবাহ করতে পারবে না। তালাক-প্রাপ্তা সেই
মুসলিম নারী যদি অন্য কোনও পুরুষকে বিবাহ করে এবং সেই বিবাহ
ভেঙ্গে যায়, তখনই আবার তাকে বিবাহ করা যাবে।
শরিয়ত আইনে স্ত্রীকে
বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া হয়েছে দুটি ক্ষেত্রে। এক হল
জিহার, অর্থাত্ স্বামী যদি নিষিদ্ধ সম্পর্কের কোনও স্ত্রীর
প্রতি আসক্ত হয় এবং তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি না
হয়। সেক্ষেত্রে স্ত্রী আবেদন করলে আদালত বিবাহবিচ্ছেদের
আদেশ দেবে।
স্ত্রী স্বামীকে মুক্তিমূল্য
(স্বামীর শর্ত অনুযায়ী খুলা) দিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ করিয়ে নিতে
পারে। স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সন্মতিতেই বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়,
একে বলা হয় মুবারাত।
মহম্মদ আহমেদ খান ও
শাহবানো বেগমের মামলায় সুপ্রীম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, বিবাহ
বিচ্ছেদের পরে যদি মুসলিম নারী নিজের ভরণপোষণ চালাতে পারে,
তাহলে পুরুষের দায়িত্ব ইদ্দতের পরেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু
সেই নারী যদি নিজের ভরণপোষণ চালাতে সক্ষম না হয়, তাহলে ক্রিমিনাল
কোডের ১২৫ ধারা অনুযায়ী তার ভরণপোষণের দায়িত্ব থাকবে প্রাক্তন
স্বামীর। এর পর মুসলিম স্বামীদের প্রাক্তন স্ত্রীর দায়িত্ব
নিয়ে নানান বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়। মুসলিম নারী (বিবাহবিচ্ছেদের
পর অধিকার রক্ষা আইন), ১৯৮৬ পাশ করানো হয় সুপ্রীম কোর্টের
এই রায়ের প্রযোজ্যতা সীমিত করার জন্য। সাধারণভাবে ফৌজদারী
আইনের ১২৫ ধারা মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না,
যদি না সেই নারী ও তার প্রাক্তন স্বামী যৌথভাবে বা আলাদা
ভাবে কোর্টে ঘোষণা করে বা স্বীকৃতি দেয় যে তারা ফৌজদারী
আইনের ১২৫ থেকে ১২৮ ধারা মেনে চলবে।
এই আইনে স্বামীর দায়িত্ব
থাকলো:
(১) শুধু ইদ্দতকাল পর্যন্ত। ইদ্দতকাল হল বিবাহ বিচ্ছেদের
পর তিনটি ঋতুকালের পর্যন্ত আর যদি ঋতুর অবস্থা না থাকে তাহলে
তিনটি চান্দ্রমাস পর্যন্ত। যদি সন্তান সম্ভবা অবস্থায় বিবাহবিচ্ছেদ
হয় তাহলে সন্তানের জন্ম বা গর্ভপাতের সময়ের মধ্যে স্বামীর
কাছ থেকে ন্যায্য ও উপযুক্ত ব্যবস্থা ও খোরপোষ পাবে।
(২) যদি বিবাহবিচ্ছেদের আগে বা পরে জাত সন্তানের ভরণপোষণ
সে নিজেই বহন করে, তাহলে তার প্রাক্তন স্বামী সন্তান জন্মের
দুবছর পর্যন্ত ভরণপোষণ দেবে।
(৩) দেন মোহরের দেয় সমান অর্থ দেবে।
(৪) বিয়ের সময় আগে বা পরে স্বামী, আত্মীয় বা বন্ধুদের দেওয়া
সমস্ত সম্পত্তি স্বামী দিয়ে দেবে।
উল্লেখিত সমস্ত দেয়
সম্পত্তি না দিলে বিবাহবিচ্ছিন্না স্ত্রী ম্যাজিস্ট্রেটের
কাছে আবেদন জানাবে এবং ম্যাজিস্ট্রেট একমাসের মধ্যে তার
রায় দেবে।
এই আইন অনুসারে ইদ্দতকালের দেয় অর্থের পর যে স্ত্রী নিজের
ভরণপোষণ চালাতে না পারে, তার আত্মীয়স্বজন (যারা তার সম্পত্তির
অধিকারী) তারা দায়িত্ব নেবে। তারাও যদি অক্ষম হয়, তাহলে
রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ ১২৫ ধারার
প্রযোজ্যতা সম্পর্কে বিতর্ক এখনও শেষ হয় নি। কলকাতা হাইকোর্ট
২০০১ সালে রায় দিয়েছে যে, মুসলিম মেয়েদের ১২৫ ধারায় আবেদনের
পথ খোলাই রয়েছে, কারণ ১২৫ ধারা একটি ধর্ম নিরপেক্ষ আইন।
তাঁরা ইচ্ছে করলে এই আইনের সুযোগ নিতে পারবেন। ১২৫ ধারা
বেশ কঠোর আইন। এই ধারায় টাকা দেবার আদেশ দেওয়া হলে, সেই
টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না দিলে, ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ারেণ্ট
জারি করতে পারবে। সময়মত টাকা না দিলে একমাসের বা যতদিন টাকা
না দেওয়া হচ্ছে ততদিন কারাদণ্ডের আদেশ দিতে পারবে।
দ্র:
নারীর অধিকার ও আইন - মঞ্জরী গুপ্ত, কলকাতা, ২০০২