প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

এন.আর.আই-দের পরিত্যক্তা স্ত্রী

বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের (এন.আর.আই) সঙ্গে বাড়ির মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা বাঙালীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে। পাঞ্জাব এবং গুজরাতে অবশ্য এটা ঘটছে অনেক বেশি মাত্রায়। বিদেশে বসবাসকারী পাত্র বহু টাকা রোজগার করে, মেয়েকে সে সুখে রাখবে - এই ধারণাই এই প্রবণতার পেছনে কাজ করছে। পরে মেয়ে নিজে বিদেশের নাগরিক হলে নিজের ভাই বোনদেরও সে বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে - এই চিন্তাও কোনও কোনও বাবা-মা করেন। দুর্ভাগ্যবশত:, এন.আর.আই-দের সঙ্গে এই বিয়ের পরিণতি সবক্ষেত্রে সুখের হয় না।

এই ধরণের বিয়েতে যে সমস্যার সম্মুখীন বহু মহিলারা হচ্ছেন - সেটা হল abandonment অর্থাৎ স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা হওয়া। বধূ-নির্যাতনের দৈহিক ভয়াবহতা এই সমস্যায় নেই ঠিকই, কিন্তু আর্থিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে এটি মহিলাদের জীবনকে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকায় দক্ষিণ এশিয় নারী সংস্থায় যেসব মহিলারা এই সমস্যা নিয়ে আসেন, তাঁদের একটা বড় অংশই এন.আর.আইদের দেশে গিয়ে বিয়ে করে আনা স্ত্রী। এছাড়া বহু মহিলা আছেন, যাঁরা এন.আর.আই-দের সঙ্গে বিয়ে হওয়া সত্যেও দেশেই পড়ে আছেন। স্বামীরা বিয়ের পর কিছুদিন তাঁদের সঙ্গে কাটিয়ে ভিসার কাগজপত্র পাঠাবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশে ফিরে গেছেন। কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর পাঠান নি; অনেক সময়ে কোনও যোগাযোগই রাখেন নি স্ত্রীর সঙ্গে। কেউ কেউ দেশে স্ত্রীকে এইভাবে পরিত্যাগ করে বিদেশে ফিরে এসে আবার অন্য কাউকে বিয়েও করেছেন। এইভাবে পরিত্যক্তা মহিলাদের সংখ্যা পাঞ্জাবেই প্রায় ১৫,০০০; গুজরাতে সংখ্যাটা ১২,০০০ বলে ভারত সরকারের অনুমান। কোনটাই উপেক্ষণীয় নয়।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর থেকে ও নারী-সংস্থায় যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, অনেক ক্ষেত্রেই:

  • এই সব স্বামীরা বিয়ের পর কিছুদিন একসঙ্গে থেকে তারপর অদৃশ্য হয়েছেন।
  • বহু ক্ষেত্রেই পণ হিসেবে ভালো রকমের টাকা সোনাদানা পাত্রপক্ষকে দেওয়া হয়েছে এবং পাত্রপক্ষ আরও টাকার দাবী করছেন। তা না হলে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করবেন বলে ভয় দেখাচ্ছেন।
  • স্ত্রী কোনও রকম আর্থিক সাহায্য পাচ্ছেন না।
  • অনেক সময় বিদেশের আদালতে স্ত্রীর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিবাহ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
  • অনেককে বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হচ্ছে কারণ বাবা-মা তাঁদের বাড়িতে রাখতে নারাজ।।
  • অনেকেই বিদেশে তাঁর স্বামীর ঠিকানা বা ফোন নম্বর জানেন না।
  • এঁদের প্রায় সবাই স্বামী কোথায় আছে জানতে চান। কেন তাঁদের পরিত্যাগ করা হল জানতে চান। কি ভাবে স্বামীর কাছে গিয়ে ঘরসংসার করতে পারবেন - সেই চিন্তা করেন। তা সম্ভব না হলে নিজের বা ছেলেপুলে থাকলে তাদের ভরণপোষণের জন্য আর্থিক সাহায্য আশা করেন। আর কোনও মেয়ে যেন তাঁদের মত বিপদে না পড়েন সে ব্যাপারে সকলকে সতর্কীকরণ করতে চান।

স্ত্রীকে পরিত্যাগ এন.আর.আই-রা বেশি করছে তা হয়তো নয়, তবে এন.আর.আইদের ক্ষেত্রে খোরপোষ ইত্যাদির ব্যাপারে ভারতীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়াটা অপেক্ষাকৃত কঠিন - যেহেতু তাঁরা দেশের বাইরে থাকেন এবং দেশের আইনের আওতার পড়েন না।। দেশের আদালতে মামলা দায়ের করা যায় ঠিকই, কিন্তু অভিযুক্তরা যদি দেশে না ফেরেন, তাহলে কি করা যেতে পারে! বিদেশে গিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ এবং সামর্থ্য অনেক মহিলা বা তাঁর পরিবারের থাকে না। ফলে ব্যাপারটা আরও মর্মস্পর্শী হয়ে দাঁড়ায়।

বিদেশের প্রাচুর্যপূর্ণ জীবনযাত্রার কথা জানলেও, বহু বাবা-মাই জানেন না যে, বিয়ের পর তাঁদের পড়াশুনো জানা মেয়ে বিদেশে গিয়ে কতটা স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবে। সেটা নির্ভর করছে, মেয়েটির এন.আর.আই স্বামীর নাগরিকত্ব ও ভিসা-র শ্রেণী বা টাইপের উপর। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু এন.আর.আই কাজ করছেন এইচ-১ বি অথবা এল-১ ভিসা নিয়ে। এঁদের স্ত্রীদের আমেরিকায় কাজ করার কোনো অধিকার নেই। সুতরাং বিয়ের পর স্বামী যদি স্ত্রীকে আমেরিকায় নিয়ে আসেন, স্বামীর উপর তাঁকে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। এই পরম নির্ভরশীলতার সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ স্ত্রীদের উপর শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার চালাতে দ্বিধা করেন না। স্ত্রীদের পরিত্যাগ করাও এঁদের পক্ষে সহজ - বেড়াতে নিয়ে যাবার ছলে তাঁকে দেশে রেখে এলেই চলবে। চাইলেও স্ত্রীর পক্ষে আমেরিকাতে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। কারণ তাঁর ডিপেণ্ডেণ্ট ভিসা (এইচ-৪ অথবা এল-২) স্বামীর কাগজপত্র ছাড়া অকেজো। স্বামী যদি আমেরিকাতে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন, তাহলেও তাঁকে দেশে ফিরতে হবে। প্রসঙ্গত: এন.আর.আই স্বামী মার্কিন নাগরিক বা স্থায়ী ভিসার অধিকারী হলেও বিবাহিতা স্ত্রীকে আমেরিকায় থাকার যে ছাড়পত্র দেওয়া হয় তা শর্তাধীন। সেক্ষেত্রে কাজ করার অধিকার স্ত্রীর থাকে, কিন্তু বিয়ের দুবছরের মধ্যে স্বামী পরিত্যাগ করলে, স্ত্রীকে নিজের দেশে ফিরে যেতে হয়। তবে এই সময়ের মধ্যে স্ত্রী নির্যাতিতা হলে তাঁর পক্ষে আইনানুগ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভবপর হয়; যেমন, self-petitioning।

পাঞ্জাব, গুজরাত এবং আরও কিছু কিছু জায়গায় এন.আর.আই-পরিত্যক্ত স্ত্রীদের সমস্যা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, অনেকেই বলছেন এন.আর.আইদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগে তাদের ভিসা, অবিবাহিত হওয়ার এফিডেভিট, তাদের সোশাল সিকিউরিটি নম্বর, আয়কর বিভাগের সার্টিফিকেট, ইত্যাদি পরীক্ষা করা উচিত! এগুলি রেজিস্ট্রেশনের আগে জমা না পড়লে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করা যাবে না।!

১৯৯৪ সালে নীরজা সরফ বনাম জয়ন্ত সরফ-এর মামলায় সুপ্রিম কোর্ট নারীদের প্রতিরক্ষার জন্য কতগুলি আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন । যেমন,

(১) যদি কোনো এন.আর.আইয়ের সঙ্গে ভারতীয় মেয়ের বিয়ে ভারতবর্ষে হয়, তাহলে বিদেশী আদালতে সে বিয়ে বাতিল করতে পারবে না।
(২) বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে যে খোরপোষ দেওয়া হবে সেটা নির্ভর করবে স্বামীর দেশ ও বিদেশের সম্পত্তির উপর।
(৩) এ ব্যাপারে ভারতীয় আদালতের আদেশকে যাতে বিদেশের আদালতও স্বীকৃতি দেয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পারস্পরিক বোঝাপড়া হওয়া দরকার।

এই রকম আইন কখনো হবে কিনা, বা হলেও সেটা কতটা বলবৎ করা যাবে তা প্রশ্ন। তবে এই সমস্যাটা যে ক্রম-বর্ধমান তা পাত্রীপক্ষের অভিভাবকেরা যত বেশি জানেন - ততই ভালো।

অবসর, ২০০৪ *

*আজ ২০১৪ সালেও এই অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় নি।

[আইন বিষয়ক যে-সব আলোচনা অবসর-এ রয়েছে তার উদ্দেশ্য সাধারণ ভাবে আইনের ব্যাপারে পাঠকদের অবহিত করা। এই আলোচনা কোনও ভাবেই উকিলের পরামর্শের বিকল্প নয়। কারোর আইন সংক্রান্ত কোনও সমস্যা থাকলে, তাঁর উচিত সরাসরি কোনও আইনজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।]

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।


Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।