অশ্লীলতা
আইন

আমাদের
দেশের অধিকাংশ আইনই এসেছে ব্রিটিশ আইন থেকে। অশ্লীলতার
আইন তার ব্যতিক্রম নয়। ১৭১৭ সালের আগে ইংল্যাণ্ডে অশ্লীলতার
বিচার হত ধর্মীয় আদালতে। কোনো বই অশ্লীল - সেটা ঠিক করতো
ইংল্যাণ্ডের চার্চ। ১৭১৭ সাল থেকে স্থির হয় যে অশ্লীলতার
বিচার হবে সাধারণ আদালতে। ১৮৬৮ সালে হিকলিনস মামলায় অশ্লীলতার
যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, মোটামুটি ভাবে তারই উপর ভিত্তি
করে ভারতের অশ্লীলতা আইনগুলি রচিত। অশ্লীলতা নিরোধের জন্য
বহু আইন ভারতে রয়েছে। এর প্রথম আইনটি হল ভারতীয় দণ্ডবিধির
২৯২ ও ২৯৩ ধারা (Indian Penal Code, 1860, section 292
and 293)। এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৮৭ সালে পাশ করা হয় নারীর
অশোভন উপস্থাপন (নিরোধ) আইন (Indecent Representation
of Women (Prohibition) Act, 1987)। এ ছাড়া, সিনেমাটোগ্রাফি
আইন, ১৯৫২ ( Cinematography Act 1952), ইনফরমেশন টেকনোলোজি
আইন, ২০০০ (Information Technology Act, 2000) ও অন্যান্য
মিডিয়া বিষয়ক আইনেও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সংস্থান আছে।
১৮৬০ সালের ভারতীয়
পেনাল কোডের ২৯২ ধারায় রয়েছে:
পিনাল কোডের ২৯৩
ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি পূর্বোল্লিখিত অশ্লীল বস্তু ২০
বছরের কম বয়সী কাউকে বিক্রি করা হয়, ভাড়া দেওয়া হয়, প্রদর্শন
করা হয় বা বিতরণ করা হয়, তাহলে শাস্তির পরিমান বেড়ে প্রথম
অপরাধের জন্য কারাবাস ৩ বছর পর্যন্ত ও জরিমানার পরিমান
২ হাজার টাকা পর্যন্ত হবে। দ্বিতীয় বা পরের অপরাধের জন্য
কারাবাস ৭ বছর পর্যন্ত এবং জরিমানার পরিমান ৫ হাজার টাকা
পর্যন্ত হবে।
১৯৬৯ সালের এক সংশোধনীতে শাস্তির পরিমান আরও বাড়ানো হয়েছে।
ইণ্টারনেটে প্রচারিত
অশ্লীলতা রোধ করার জন্য ইনফর্মেশন টেকনোলজি অ্যাক্টের
৬৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, ইলেকট্রনিক উপায়ে যদি কোনো বস্তু
পাঠানো হয় যা লাম্পট্যজনক বা যা কামপ্রবৃত্তিকে আকৃষ্ট
করে, অথবা যার ফল, যদি সামগ্রিক ভাবে বিচার করা যায়, লোকের
মনকে কলুষিত (deprave) ও নৈতিক ভাবে অধঃপাতিত (corrupt)
করতে পারে - সেটি হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রথম অপরাধের জন্য
৫ বছর পর্যন্ত কারাবাস ও ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা;
পরবর্তী অপরাধের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত কারাবাস ও ২ লাখ
টাকা পর্যন্ত জরিমানা।
নারীর অশোভন উপস্থাপন
(নিরোধ) আইনে নারীর অশালীন উপস্থাপনার অর্থ বলা হয়েছে
নারীর শরীরকে - তার আকার, দেহ বা দেহাংশকে এমন ভাবে দেখানো
যেটি অশালীন, নারীদের প্রতি অপমানসূচক বা নারীকে ছোট করা
হচ্ছে, অথবা যা মানুষের নীতিবোধকে দূষিত, অধঃপাতিত বা
আহত করবে।
এই আইনে বলা হয়েছে কোনো বিজ্ঞাপনে নারীদের অশালীন ভাবে
দেখানো চলবে না। এখানে বিজ্ঞাপন বলতে ধরা হয়েছে যে কোনো
বিজ্ঞপ্তি, সার্কুলার, মোড়ক বা অন্য কোনো কাগজপত্র। এগুলি
ছাড়া আলো, শব্দ, ধোঁয়া বা গ্যাসের মাধ্যমে কোনো দর্শনযোগ্য
উপস্থাপনাও এই আওতায় পড়বে।
এছাড়া কোনো বই, পুস্তিকা, কাগজ, ফিল্ম, স্লাইড, লেখা,
আঁকা, চিত্র, ফটোগ্রাফ, বা কোনো আকৃতি যাতে নারীকে অশালীন
ভাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে তার প্রকাশনা করা, বিক্রি করা,
বিতরণ করা চলবে না। তবে এ ব্যাপারে কতগুলি ব্যতিক্রম আছে।
যেমন, এগুলি যদি বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প-চর্চা বা শিক্ষা-চর্চায়
সহায়তা করে - তাহলে এতে অন্যায় হবে না। পিনাল কোডের ২৯২
ধারার মত এখানেও বলা হয়েছে যে, ধর্মীয় কারণে - মন্দিরে,
পুরনো মনুমেণ্টের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না।
কিন্তু অশ্লীলতা
কি? ভারতীয় পিনাল কোডে বলা হয়েছে, বই, পুস্তিকা, কাগজ,
লেখা, আঁকা, ছবি, বর্ণনা, মূর্তি বা অন্য কোনো বস্তু অশ্লীল
বলে বিবেচিত হবে যদি এটি লাম্পট্যজনক হয় (lascivious)
বা এটি কামপ্রবৃত্তিকে আকর্ষণ করে (appeals to the pruriest
interest) অথবা সামগ্রিক বিচারে এটি লোকের মনকে কলুষিত
(deprave) ও নৈতিক ভাবে অধঃপাতিত (corrupt) করে।
ভারতীয় পিনাল কোডের
২৯২ ধারায় অশ্লীলতার কোনো পরিষ্কার সংজ্ঞা নেই বলে অনেকে
দাবী করেন। যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে - সেটা বোঝার পক্ষে
যথেষ্ট নয়। শ্লীলতা অশ্লীলতা অনেকটাই ব্যক্তি-নির্ভর।
একজনের কাছে যা অশ্লীল, আরেকজনের কাছে তা নাও হতে পারে।
অশ্লীলতার ব্যাখ্যাই যেখানে অস্পষ্ট, তার উপর ভিত্তি করে
শাস্তি আরোপ করা যায় কি? রণজিত ডি উদেশী বনাম মহারাষ্ট্র
সরকার মামলায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারার সাংবিধানিক বৈধতাকেই
চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিলো। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য সেটাকে নাকচ
করে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের মত যে, অশ্লীলতা শব্দটি
মোটেই অস্পষ্ট নয়। (১) এটি অনুভূতিপ্রবণ মনকে কলুষিত করে
ও নৈতিক অধঃপতন ঘটায়; (২) এটি নোংরা ও লাম্পট্য চিন্তা
মাথায় আনে; (৩) এটা অকৃত্রিম পর্নোগ্রাফি; (৪) এটি কাম
উদ্রেককারী; (৫) এটি যৌন-বিষয়ক কুচিন্তা মনের মধ্যে আনে;
(৬) সমাজিক ভাবে গ্রাহ্য যে সীমারেখা - তা ছাড়িয়ে যায়।
তবুও কোন বই বা ছবি
অশ্লীল আর কোনটে নয় - সে নিয়ে বাদ বিবাদ চলবেই। প্রসঙ্গতঃ
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে শারদীয়া (১৩৭৪) দেশে প্রকাশিত
সমরেশ বসুর বিখ্যাত উপন্যাস 'প্রজাপতি' অশ্লীলতার দায়ে
বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো। ১৯৬৮ সালে উপন্যাসটি অশ্লীল বলে
নিষিদ্ধ হোক বলে মামলা করেন অমল মিত্র বলে একজন অ্যাডভোকেট।
সরকার পক্ষও তাঁকে সমর্থন করে। প্রথমে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে
চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এর বিচার হয়।
কোর্ট রায় দেয় উপন্যাসটি অশ্লীল এবং লেখক ও প্রকাশকের
২০১ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে দুমাস কারাদণ্ড। আপিলের
মেয়াদ পার হয়ে গেলে দেশ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার ১৭৪
থেকে ২২৬ পাতা পৃষ্টা নষ্ট করে ফেলারও বিধান কোর্ট দেয়।
এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে
আপিল করা হয়। হাইকোর্ট ব্যাঙ্কশাল কোর্টের রায় বহাল রাখে।
কিন্তু এর মধ্যে চার বছর পার হয়ে গেছে। প্রজাপতি বই হিসেবে
বেরিয়ে আট সংস্করণ বিক্রি হয়ে গেছে। সমরেশ বসু ও দেশ কর্তৃপক্ষ
সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে চাইলে হাইকোর্ট তা অগ্রাহ্য
করে। পরে সংবিধানের ১৩৬ অনুচ্ছেদের সাহায্য নিয়ে এই কেসটি
সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি ছিলো বারো
বছর। সুপ্রিম কোর্টের রায় বলা হয় যে*, উপন্যাসে কিছু স্ল্যাং
শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, মেয়েদের শরীরের বর্ণনা আছে, দৈহিক
সম্পর্কের বিষয় এসেছে বলেই প্রজাপতিকে অশ্লীল বলা যাবে
না।.... লেখক উপন্যাসটি লিখেছেন সর্বশ্রেণীর সব বয়সের
লোকের জন্য ....কোনো বইয়ে দৈহিক সম্পর্কের কথা থাকলেই
তাকে যদি অশ্লীল বলে পরিগণিত করতে হয় এবং উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের
কাছে তা পাঠযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হয়, তাহলেতো ঐসব ছেলেমেয়ে
বিশুদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারবে না।....
কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত এবং হাইকোর্ট
এই উপন্যাসটিকে অশ্লীল বলে ঠিক করেন নি।
*প্রজাপতির
বিচার - বিধান সিংহ, সমরেশ বসুর 'প্রজাপতি', আনন্দ পাবলিশার্স,
১৩৯২।