ভারতের ধর্ষণ
আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়ে অনেকেই, বিশেষকরে নারী সংস্থাগুলি
আদৌ সন্তুষ্ট নয়। এই আইনে পুরুষাঙ্গ স্ত্রী-যৌনাঙ্গের
ভেতরে প্রবেশ না করলে সেটি ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে
না। অথচ বহু ভাবেই পুরুষ নারীর ওপর যৌন-অত্যাচার (sexual
assault) করতে পরে - দুর্ভাগ্যবশতঃ ধর্ষণ আইনের আওতায়
সেগুলি পড়বে না। অন্যান্য যৌন-অত্যাচারের ঘটনা বাদ
দিয়েও ভারত সরকারের হিসেব অনুযায়ী প্রতি ঘণ্টায় দেশে
একজন করে নারী ধর্ষিতা হচ্ছে। তবে অনুমান করতে অসুবিধা
হয় না যে, বাস্তবে এই সংখ্যাটি অনেক বেশি। ধর্ষণের
বহু ঘটনাই সরকারের হিসেবের মধ্যে আসে না, কারণ পুলিশকে
সেগুলি জানানো হয় না। আমাদের সমাজের অতি-রক্ষণশীলতা
এবং পারিবারিক সমস্যাকে গোপন রাখার চেষ্টা ধর্ষণকারীদের
শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। শুধু তাই নয়,
আমাদের পুরুষ-শাসিত সমাজের মানসিকতার দরুণ অনেক সময়ে
ঘটনার জন্য দোষও চাপানো হয় পীড়িতা নারীর উপর। কেন
রাতে বেরিয়েছিলো, কেন এত সাজে, কেন একা গিয়েছিলো,
ইত্যাদি প্রায়ই শোনা যায়।
যেক্ষেত্রে নারী
ও তার পরিবার সাহস করে এগিয়ে আসে, সেখানেও ধর্ষণ প্রমাণ
করা সহজ ব্যাপার নয়। মথুরা মামলার কথা হয়তো অনেকেই
জানেন। ১৯৭২ সালে ১৬ বছরের আদিবাসী মেয়ে মথুরাকে তার
ভাই ও অন্যান্য কয়েকজন আত্মীয় মহারাষ্ট্রের একটি পুলিশ
চৌকিতে নিয়ে আসে। তাদের চিন্তা যে, মথুরা কম বয়সী,
কিন্তু তাও তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাবার চেষ্টা
করছে। যে দুজন পুলিশ ডিউটিতে ছিলো, তারা ওর ভাই ও
আত্মীয়দের বলে যে, মথুরার জবানবন্দী ওর কাছ থেকে আলাদা
ভাবে নিতে হবে। ভাই ও আত্মীয়রা যখন বাইরে অপেক্ষা
করছে, তখন দুই পুলিশ থানার ভেতরে মথুরাকে ধর্ষণ করে।
দুজন পুলিশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনা হয়। সেশন আদালত
আসামীদের মুক্তি দেয়, কারণ আদালতকে বলা হয় যে, মথুরা
মিথ্যাবাদী এবং যেহেতু সে যৌনসঙ্গমে অভ্যস্থা, সুতরাং
তার সন্মতি ছিল বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। অর্থাত্
শুধু যৌন-মিলন হয়েছে প্রমাণ করা যাবে, কিন্তু ধর্ষণ
প্রমাণ করা যাবে না। মুম্বাই হাইকোর্ট পরে সেশন আদালতের
এই রায় বাতিল করে এবং দুই আসামীর একজনকে ৫ বছর ও অন্যজনকে
১ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। হাইকোর্ট
রায় দেয় যে, ভয় দেখিয়ে সন্মতি আদায় করা আর স্বেচ্ছায়
যৌনমিলনে সন্মতি দেওয়া এক নয়। কিন্তু পরে ভারতের সুপ্রিম
কোর্ট আসামীদের মুক্তি দেয়। রায়ে বলা হয় যে, মথুরা
চঁ্যাচামেচি করে নি এবং ওর দেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন
পাওয়া যায় নি, অতএব সে বাধা দেবার চেষ্টা করে নি।
ভয় পেয়ে বাধা
না দেওয়া আর স্বেচ্ছায় সন্মতি দেওয়া দুটো এক নয় -
মথুরা মামলা নিয়ে প্রচুর হৈচৈ সে সময়ে হয়। তারই ফলে
১৯৮৩ সালে ভারতীয় সাক্ষ্য আইনে আর একটি অনুচ্ছেদ ঢোকানো
হয়। সেখানে বলা হয় যে, যদি কোনো নারী থানায়, কারাগারে,
হাসপাতালে বা অন্যকোনো সরকারী সংস্থার তত্বাবধানে
থাকাকালীন সংস্থার কোনো কর্মচারী বা কর্তৃপক্ষের কারোর
কাছে ধর্ষিতা হয়েছে বলে (custodial rape) অভিযোগ করে
এবং প্রমাণিত হয় যে অভিযুক্ত সেই নারীর সঙ্গে যৌন-সংসর্গ
করেছে, তাহলে আদালত ধরে নেবে যে, তাতে নারীটির সন্মতি
ছিলো না। শুধু তাই নয় সাজার ক্ষেত্রেও তত্বাবধানে
থাকালীন ধর্ষণের (custodial rape) শাস্তি অপেক্ষাকৃত
কঠোর হবে। সাধারণভাবে ধর্ষণ ঘটেছে প্রমাণিত হলে, তার
সাজা অন্ততঃ ৭ বছরের কারাবাস - যা দশ বছরও হতে পারে।
যদি ধর্ষিতা নারী গর্ভবতী থাকে বা তার বয়স ১২ বছরের
কম হয়, অথবা সে গণধর্ষণের (gang rape) শিকার হয়, কিংবা
তত্বাবধানে থাকালীন ধর্ষিতা হয় (custodial rape),
সেক্ষেত্রে শাস্তি হবে কমপক্ষে ১০ বছরের কারাবাস।
বিশেষ কারণ থাকলে আদালত অবশ্য শাস্তির পরিমান কমাতে
পারে।
তবে আইনের এই
সংশোধনে নারীরা কতটা উপকৃত হচ্ছে - সে নিয়ে অনেকেরই
প্রশ্ন আছে। বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে,
আইনের কিছু অদল-বদলে পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টাচ্ছে
না। ধর্ষণের মতো একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরেও সেই লাঞ্ছিতা
নারীকে শারীরিক কষ্ট ও লজ্জার বাধা অতিক্রম করে ঈঋ*
করতে হবে, পুলিশকে ঘটনাগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানাতে
হবে, অভিযুক্তদের সনাক্ত করতে হবে, ডাক্তারী পরীক্ষার
মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এগুলি সবই করতে হবে দ্রুত গতিতে
- পারলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই (যা অনেক ক্ষেত্রেই পরিকাঠামোগত,
প্রশাসনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বা ব্যক্তিগত কারণে
সম্ভব হয় না)। পরে কোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই কথার
পুনরাবৃত্তি করতে হবে হাজার প্রশ্নের উত্তরে। আগে
বিরোধীপক্ষের উকিল সেই সময়ে নারীর চরিত্র নিয়েও নানা
প্রশ্ন তুলতো - সে একজন ভ্রষ্টা নারী প্রমাণ করার
চেষ্টা করতো। ভাগ্যক্রমে, সেটি এখন আর করা যায় না।**
(প্রমাণের উদ্দেশ্য, একজন ভ্রষ্টা নারীর যে যৌনমিলনে
সন্মতি থাকবে - এতো স্বতঃসিদ্ধ! ভাবতে অবাক লাগে যে,
কোনো নারী বহুগামিনী হলেও, সে যে পৃথিবীর সব পুরুষকে
কামনা নাও করতে পারে - এই সামান্য সত্যটাও এক এক সময়ে
আদালতের চোখ এড়িয়েছে!)
ধর্ষণ আইনের
সংস্কার নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই নানান আলোচনা চলছে।
সুপ্রিম কোর্টের নিযুক্ত আইন কমিশন তাদের ২০০০ সালে
পেশ করা ১৭২তম রিপোর্টে শুধু ধর্ষণ নিয়ে চিন্তা না
করে সমস্যাটি আরও ব্যাপক ভাবে - sexual assaul বা
যৌন-অত্যাচার হিসেবে বিবেচনা করেছে। বর্তমান আইনের
বহু পরিবর্তনের প্রস্তাব এই রিপোর্টে করা হয়েছে। কিন্তু
এখন পর্যন্ত এই কমিশনের দেওয়া বিভিন্ন প্রস্তাবগুলির
মধ্যে ২০০২ সালে লোকসভায় শুধু একটিই গৃহীত হয়েছে।
তবে শুধু আইনের পরিবর্তনই সমস্যার সমাধান নয়। আইনের
সুপ্রয়োগ তখনই সম্ভব হবে, যখন তার ধারক ও বাহকদের
মধ্যে পূর্ণভাবে সমাজ-সচেতনতা আসবে - চিন্তাধারার
মধ্যে জাত, ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণী, ইত্যাদির ভেদাভেদ
লুপ্ত হবে। এক্ষেত্রে তারা হল পুলিশ, ডাক্তার, সরকারী
উকিল, প্রভৃতি - যাদের শীর্ষে রয়েছে বিচারক। বিচারক
কৃষ্ণ আয়ার একটি ধর্ষণ-মামলায় রায় দিতে গিয়ে বলেছিলেন,
পুরুষদের বলকাত্কার রোধ করার জন্য শ্রেষ্ঠ বর্ম আইনের
গোলমেলে লম্বা লম্বা বিধি-নিষেধ নয়, সেই বর্ম হল একজন
সমাজ-সচেতন বিচারক।
*এফ.আই.আর.
(F.I.R): এটি ফাস্র্ট ইন্ফরমেশন রিপোর্ট-এর সংক্ষিপ্ত
রূপ। কোন অপরাধ সংঘটিত হবার পর উত্পীড়িত ব্যক্তি বা
অন্য কেউ সেই সম্পর্কে থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে
অভিযোগ জানালে - অফিসারের দায়িত্ব সেটিকে নথিভুক্ত
করা। সেই লিখিত রিপোর্টটি হল এফ.আই.আর। এর ভিত্তিতে
পুলিশের তার অনুসন্ধান শুরু করে।
**২০০২ সালে ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের (Indian Evidence
Act) একটি অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে, যার ফলে এখন কোনো
ধর্ষণের মামলায়, নারীকে তার চরিত্রের পবিত্রতা ও যৌনজীবন
সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না।