টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট
থেকে জানা গেল, ন্যাশেনাল কমিশন ফর উইমেন-এর চেয়ারপার্সন মমতা
শর্মা্র একটা উক্তির প্রতিবাদে বিভিন্ন নারী-সংস্থা সরব হয়েছে।
মমতা শর্মার বক্তব্য হল, মেয়েদের সতর্কতার সঙ্গে পোষাক পরিচ্ছদ
পরা উচিত যাতে তারা উৎপীড়নের শিকার না হয়।
এই ধরণের মন্তব্য অবশ্য
অনেকেই করে থাকেন। এঁদের মতে মেয়েরা ধর্ষিতা হয় কারণ তারা
‘যৌন-উত্তেজক’ পরিচ্ছদ পরে অথবা স্বল্প পোষাকে চলাফেরার করে
বলে। আজকের যুগে হিন্দু
মেয়েদের ঘরের চার দেয়ালে আটকে রাখা বা ঘোমটা দিয়ে চলাফেরা
করানোর চল উঠে গেছে। পোষাক-পরিচ্ছদে শালীনতার কথাটার সংজ্ঞাটা
কি – সেটা অস্পষ্ট। দেহের কতটা অংশ আবৃত থাকলে সেটা রুচিশীল
হবে, কতটা লো-কাট ব্লাউজ রুচির পরিচয় দেবে, স্লিভলেস চলবে
কিনা, শাড়ীর বদলে সালোয়ার কামিজ কিংবা জিনস ও টপ কতটা অশোভন
- এ নিয়ে মাঝে মাঝেই শিক্ষিকাদের সঙ্গে স্কুল-কর্তৃপক্ষের
সংঘাতের খবর পত্র পত্রিকায় চোখে পড়ে। শিক্ষকদের পোষাক নিয়ে
হৈ চৈ হবার খবর কিন্তু চোখে পড়ে না। কে ধুতি পরছে, কে প্যাণ্ট
পরছে, কে জিনস আর টি-শার্ট পরে স্কুলে আসছে – সে নিয়ে বিশেষ
কারোর মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু কিন্তু শিক্ষিকার পরিচ্ছদ নিয়ে
চিন্তা-ভাবনার অন্ত নেই। শিক্ষিকার পোষাক দেখে ছাত্রীরা শিখবে,
নিজেরাও সে ধরণের পোষাক পরতে চাইবে – সেটাই হল এই ধরণের সংঘাতের
কারণ। ‘অশালীন’ পোষাক পরা শুধু কুরুচির পরিচয় নয়, মেয়েদের
দৈহিক বিপদের একট কারণ। শোভন পরিচ্ছদ মেয়েদের রক্ষাকবচ। মেয়েরা
যদি পোষাকপরিচ্ছদে শালীনতা মেনে চলে, তাহলে শ্লীলতাহানি বা
ধর্ষণের ঘটনা তেমন ঘটবে না।
যাঁরা এ ধরণের মত পোষণ
করেন সংখ্যায় তাঁরা কম নন। জনগণের সুরক্ষা যাদের দায়িত্ব,
সেই পুলিশ প্রশাসনের কর্তারাও এর ব্যাতিক্রম নয়।। ২০১১-র ডিসেম্বর
মাসে অন্ধ্র প্রদেশের ডি আই জি দীনেশ রেড্ডী বলেছেন, "It (rise
in rape cases) cannot to be attributed to failure of the
police. One of the factors (for rape cases) is that the
accused are getting provoked as women are getting fashionable,
even in rural areas." [এটা (ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া)
শুধু পুলিশের অকৃতকার্যতা নয়। একটা বড় কারণ - মেয়েদের এই ফ্যাশেনেবল
হয়ে যাওয়াটা, এমন কি গাঁয়ের মেয়েদেরও - এটা অভিযুক্তদের উত্তেজিত
করছে।] (টাইমস অফ ইন্ডিয়া,
জুলাই ১০, ২০১২)
কিন্তু সেই দলে যে মমতা শর্মা পড়বেন, যাঁর ওপর বিশেষ দায়িত্ব
ন্যাস্ত করা হয়েছে মেয়েদের ওপর কোনও অপরাধ ঘটলে তার সুবিচারের
ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া, সেটা বাস্তবিকই দুশ্চিন্তার কথা। গৌহাটির
রেস্টুরেন্টের সামনে নারী-নিপীড়ন প্রসঙ্গে মমতা
শর্মার বক্তব্য, পাশ্চাত্যকে অন্ধ-অনুকরণ না করা, কারণ
এতে আমাদের সংস্কৃতির অবক্ষয় হয় এবং এই ধরণের অপরাধ সংঘটিত
হয়।
বহু নারী সংস্থা এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে, ‘নিগৃহীতার
প্রতি সহানুভূতি ও উদ্বেগ না দেখিয়ে ‘পোষাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে
মেয়েদের সাবধান হওয়া উচিত’ বলাটা নিতান্তই সংবেদনশীলতার অভাব।
এতে নিগৃহীতাকেই দায়ী করা হচ্ছে – আক্রমণকারীদের দোষ না দিয়ে।‘
বহুবছর আগে কোথাও পড়েছিলাম
মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। মমতা শর্মা একা নন। এই মানসিকতা আরও
অনেক নারীর মধ্যে রয়েছে। একটা কারণ পুরুষশাসিত সমাজে
বহু নারীর চিন্তাভাবনা পুরুষদের প্রভাবে গড়ে উঠেছে। এখনো অনেকে
ধর্ষণের ব্যাপারে, ধর্ষিতাকে দোষ দিতে দ্বিধা করেন না। একটা
কিছু মেয়েটা নিশ্চয় করেছে, নইলে এটা হবে কেন। যেমন দেন, স্বামী
স্ত্রীকে মারধোর করলে। মেয়েটাও ঢ্যাঁটা, অন্যায় করলে একটু
শাস্তি পেতে হয়, ইত্যাদি। এই মনোভাব ধীরে ধীরে কমছে, কিন্তু
নিজের দেহ ও মনের উপর নারীর যে পূর্ণ অধিকার আছে, সেই বোধটা
সমাজব্যবস্থার চাপে বহু নারীর মধ্যে আসে নি।
মমতা শর্মার এই মন্তব্যের
বিরুদ্ধে বহু নারী সরব হয়েছেন। সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এর
ডিরেক্টর রঞ্জনা কুমারী বলেছেন দেশে ও বিদেশে এ নিয়ে যত গবেষণা
হয়েছে, তাতে মেয়েদের পোষাক-পরিচ্ছদের সঙ্গে যৌন-নিপীড়নের কোনও
সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় নি। তিন বছরের কন্যাও ধর্ষিতা হচ্ছে
– কি করে তার ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে?
যে সত্যটা এখন নানান গবেষণার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, সেটা হল ধর্ষণ
বা শ্লীলতাহানি যৌন-আনন্দের জন্যে পুরুষরা করে না, করে অত্যাচার
বা নির্যাতন করার জন্যে। সেখানে কমবয়সী, বৃদ্ধা বা যুবতীর
মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই, যেমন নেই কে বোরখা পরে আছে বা বিকিনি
পরে আছে – তাদের মধ্যে। আমরা অন্তত আশা করব, এই সত্যটা মহিলা
কমিশনে যাঁরা আছেন – তাঁরা জানবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
হেলথ এন্ড হিউমান সার্ভিস sexual assault প্রসঙ্গে একটি নির্দেশিকা
জারি করেছে। এটি নানান গবেষণার প্রতিফলন। এতে যে ১৭-টি
বিষয়ে মেয়েদের সাবধান করা হয়েছে,
তার একটিতেও পরিচ্ছদের কথা উল্লেখ করা হয় নি। মমতা শর্মার কথা
শুনে প্রশ্ন জাগে, এই সব কমিশনে যাঁদের বসানো হয়েছে, তাঁরা
কি সত্যিই নারীদের সমস্যা ও স্বার্থ বোঝেন, না এঁরা বসেছেন
নিজেদের রাজনৈতিক যোগাযোগের সুবাদে! যখনই মেয়েদের কোনও বড়
সমস্যা নিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়, তখন কি এঁদের কাজ প্রশাসনের হয়ে
‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’?
গৌহাটির রেস্টুরেন্টের
সামনে নারী-নিপীড়ন প্রসঙ্গে আরও একটি খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
বেরিয়েছে, যেটা ভাবার বিষয়। অলকা লাম্বা - যাঁর ওপর দায়িত্ব
দেওয়া হয়েছিল গৌহাটির রেস্টুরেন্টের সামনে নারী-নিপীড়নের সত্য-উদঘাটন
করতে, তিনি প্রথমেই উৎপীড়িত নারীর নামটি প্রকাশ করে দিয়েছেন!
তাঁকে অবশ্য সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সামাজিক বিবেচনায় ও নিপীড়িতার
স্বার্থে এইভাবে নামধাম যে মিডিয়া ও সংবাদপত্রকে জানিয়ে দেওয়া
বাঞ্ছনীয় নয় – এটুকু বোঝার ক্ষমতা যাঁদের নেই, তাঁদের এই কাজ
দেওয়া কেন? রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকাই যদি এঁদের যোগ্যতার
পরিমাপ হয় – সেটা সত্যিই আফশোসের কথা।
গৌহাটির ক্ষেত্রে ঘটনাটা
ধর্ষণ নয়। অলকা লাম্বার দিক থেকে সেটাই বাঁচোয়া। ধর্ষিতা নারীর
নাম-ধাম প্রকাশ করা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ২২৮-এ অনুসারে শাস্তিযোগ্য
অপরাধ – যার জন্যে দু বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে। ২০০৮
সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে কোর্টের কাগজেও ধর্ষিতার নাম
প্রকাশ করতে বারণ করা হয়েছে।* তবে কাগজে কলমে আইন থাকলেও কটা
আইনই বা কার্যকারী করা হচ্ছে!
*“But
keeping in view social object of preventing social victimisation
or ostricism of the victim of a sexual offence for which
section 228-A has been enacted, it would be appropriate
that in the judgements, be it of this court , High Court
or lower court, the name of the victim should not be indicated,”
[Bench comprising Justices Arijit Pasayat and M K Sharma]
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)