হিন্দু
বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ: কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর
(হিন্দু-ম্যারেজ
এক্ট:১৯৫৫-এর ওপর আরও কিছু আলোচনা দেখতে চাইলে এইখানে
ক্লিক করুন।)
সামাজিক নানা ধরণের
সমস্যায় আমরা বিপর্যস্ত। এর মধ্যে বিবাহ সংক্রান্ত সমস্যা
ও বিবাহ-বিচ্ছেদ সুস্থ সমাজ চেতনার পথে অন্যতম বাধা।
প্রকৃত আইন না জানার জন্য অনেকেই এই সমস্যায় খুবই বিব্রত
হয়ে পড়েন। এই বিভ্রান্তি দূর করতে হিন্দু বিবাহ ও বিবাহের
বিচ্ছেদ নিয়ে কিছু আইনী পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
প্রশ্ন: হিন্দু
বিবাহ আইন কবে পাশ হল?
উত্তর: ১৯৫৫ সালের মে মাসে এই আইন চালু হয়।
প্রশ্ন: সাধারণত
এই আইন কাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
উত্তর: হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, ব্রাহ্ম ও আর্য সমাজভুক্ত
সম্প্রদায়ের মানুষের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য।
প্রশ্ন: হিন্দুমতে
বিবাহ অনুষ্ঠানের কোনও অপরিহার্য অঙ্গ আছে কি?
উত্তর: বিবাহের জন্য প্রচলিত রীতিনীতি পালন করাটা আবশ্যক।
সাধারণত হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী এই বিবাহের অনুষ্ঠান
শুরু হয়; অগ্নিসাক্ষী রেখে সপ্তপদী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে
বিবাহ শেষ হয়।
প্রশ্ন: হিন্দু
বিবাহ আইন অনুযায়ী বিয়ের দুপক্ষকেই (পাত্র ও পাত্রী)
কি হিন্দু হতে হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী উভয় পক্ষকেই,
অর্থাত্ পাত্র ও পাত্রীকে অবশ্যই হিন্দু ধর্মাবলম্বী
হতে হয়।
প্রশ্ন: হিন্দু
মতে বিবাহের জন্য রেজিস্ট্রি (Registry) করা কি অবশ্যই
প্রয়োজন?
উত্তর: না, রেজিস্ট্রি না হলেও বিবাহ অসিদ্ধ হয় না।
তবে রেজিস্ট্রেশনটা হয়ে থাকলে পরে অনেক ক্ষেত্রে তা
কাজে লাগে। যেমন, ভারতবর্ষের বাইরে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক
স্থাপনের জন্য রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটের দরকার হয়।
হিন্দুমতে বিবাহটি রেজিস্ট্রি করার উদ্দেশ্য হল, হিন্দুমতে
যে বিবাহটা হয়েছে - তা পরে প্রমাণ করার জন্য নথিভুক্ত
করা।
প্রশ্ন: যখন দুপক্ষই
হিন্দু-ধর্মাবলম্বী হয়, সেক্ষেত্রে অন্য কোনও আইন অনুযায়ী
কি বিবাহ সম্ভব?
উত্তর: স্পেশাল ম্যারেজ এক্ট অনুযায়ী এই বিবাহ হতে পারে।
আবার হিন্দুমতে বিবাহটা স্পেশাল ম্যারেজ এক্টের আইনে
রেজিস্ট্রি করা যেতে পারে। তবে এই স্পেশাল ম্যারেজ এক্টে
বিবাহ করতে হলে বিবাহের অন্তত ২ মাস আগে লাইসেন্স প্রাপ্ত
বিবাহ-রেজিস্ট্রারের কাছে নির্দিষ্ট একটি ফর্ম ভর্তি
করে আবেদনপত্র সহ সেটি জমা করতে হয়।
প্রশ্ন: হিন্দুমতে
বিবাহ করতে বয়সের কি কিছু বিধি নিষেধ আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, এই আইনে সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে যে, পুরুষদের
ক্ষেত্রে বিবাহযোগ্য বয়স হল একুশ (২১) বছর এবং মহিলাদের
ক্ষেত্রে আঠারো (১৮) বছর। যেহেতু এই বয়সে পুরুষ ও মহিলা
সাবালক ও সাবালিকা হয়ে যাচ্ছেন, তাই বিবাহের জন্য ওঁদের
বাবা-মা বা অভিভাবকদের অনুমতির কোনও প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন: হিন্দুমতে
বিবাহের পরে যদি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মতের মিল না
হয়, কিংবা একসঙ্গে তাঁদের পক্ষে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে
বসবাস করা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে আইনত তাঁরা কি করতে
পারেন?
উত্তর: যদি এমন হয় যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের মিল
হচ্ছে না বা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার অসুবিধা হচ্ছে,
সেক্ষেত্রে তাঁরা জুডিশিয়াল সেপারেশনের জন্য আদালতের
কাছে আবেদন করতে পারেন। আদালত ওঁদের এই আবেদন যথোপযুক্ত
ও যুক্তিসংগত মনে করলে, বিবাহ-বিচ্ছেদ না করেও আদালতের
মাধ্যমে দুপক্ষের আলাদা হয়ে থাকার বিধান আছে। অনেক সময়ে
দেখা যায় যে, দু-পক্ষ আলাদা থাকার ফলে নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো
বুঝতে পেরে আবার একসাথে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস
করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু যদি দেখা যায় যে, এক
বছর আলাদা থাকা সত্বেও স্বামী-স্ত্রীর মতপার্থক্য কমছে
না ও তার মীমাংসার কোনও সম্ভাবনা নেই, সে ক্ষেত্রে যে-কোনও
পক্ষ আদালতের কাছে বিবাহ-বিচ্ছেদের (ডিভোর্স) জন্য আবেদন
করতে পারেন।
প্রশ্ন: জুডিশিয়াল
সেপারেশন হয়ে যাবার পর কি কোনও পক্ষ আবার বিবাহ করতে
পারেন?
উত্তর: জুডিশিয়াল সেপারেশন চলাকালীন কেউ বিবাহ করতে
পারেন না, কারণ আইনের চোখে তখনও তাঁরা স্বামী ও স্ত্রী।
সেপারেশন হবার পর এক বছরের মধ্যেও যদি দুপক্ষের মিল
না হয়, তাহলে আদালতের কাছে বিবাহ-বিচ্ছেদের (ডিভোর্স)
জন্য আবেদন করা যায়। আদালত তা মঞ্জুর করলে, তার পর বিবাহ
করার কোনও বাধা থাকে না।
প্রশ্ন: আইনের
ভাষায় অসিদ্ধ বিবাহ বলতে কি বোঝায়?
উত্তর : যে সব বিবাহ আইনানুযায়ী হয় নি, তাই অসিদ্ধ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যদি পাত্র বা পাত্রীর
মধ্যে কেউ বিবাহিত হন এবং তাঁর স্বামী বা স্ত্রী জীবিত
অবস্থায় থাকেন, তাহলে তার নতুন বিবাহটা অসিদ্ধ বলে গণ্য
করা হবে। আরেকটা উদাহরণ, সম্পর্কের বিচারে পাত্র ও পাত্রী
যদি সপিণ্ড হন বা অন্য কোনও নিষিদ্ধ সম্পর্কের (প্রহিবিটেড
রিলেশনশিপ) আওতায় পরেন, তাহলে সেই বিয়ে অসিদ্ধ বলে গণ্য
করা হবে।
প্রশ্ন: সপিণ্ড
ও নিষিদ্ধ সম্বন্ধ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলুন।
উত্তর : নিষিদ্ধ সম্পর্ক বলতে বোঝায় মামা, পিসি, বিমাতা,
ঠাকুমা, ইত্যাদি। এই রকমের আত্মীয়দের মধ্যে যদি বিবাহ
হয়, তাহলে তা অসিদ্ধ হবে। সপিণ্ডর সাধারণ অর্থ হল যেক্ষেত্রে
দুজনে একই পূর্ব-পুরুষকে পিণ্ড দান করেন। তবে ঠিক কারা
সপিণ্ড সম্পর্কের মধ্যে পড়েন আইনে সেটি পরিষ্কার ভাবে
উল্লেখিত হয়েছে।
প্রশ্ন: বিবাহ-বিচ্ছেদের
কতদিন পরে আবার বিবাহ করা যায়?
উত্তর :সাধারণভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদ মঞ্জুর হবার পর আপীল
দায়ের করার সময় পেরিয়ে গেলেই যে কোনও পক্ষ আবার বিবাহ
করতে পারেন।
প্রশ্ন: স্বামী
এবং স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেলে কি তাঁরা
আবার নতুন করে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী হতে পারেন?
উত্তর : হ্যাঁ, পারেন।
প্রশ্ন: বিবাহ
বিচ্ছেদের পর মহিলারা বা সন্তানরা কি স্বামীর পদবী ব্যবহার
করতে পারেন?
উত্তর : বিবাহ-বিচ্ছেদকারিণী মহিলা চাইলে তাঁর বাবার
পদবী ব্যবহার করতে পারেন। মহিলার সন্তানরা তাদের বাবার
পদবী ব্যবহার করতে পারবে।
প্রশ্ন: যদি কোনও
স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদ চান, সেক্ষেত্রে তিনি কি তাঁর
স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে বা তাঁকে খোরপোষ দিতে বাধ্য?
উত্তর : স্ত্রীর নিজস্ব রোজগার না থাকলে, আদালতে আবেদন
করে তিনি খোরপোষ পেতে পারেন। কিন্তু স্ত্রীর পর্যাপ্ত
পরিমানে নিজস্ব রোজাগার থাকলে কিংবা তিনি আইনের চোখে
দুশ্চরিত্রা বলে প্রমাণিত হলে, স্বামী ভরণপোষণ দিতে
বাধ্য হবেন না। একই আইন পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই
প্রযোজ্য। অর্থাত্, স্বামীর রোজগার না থাকলে, তিনি তাঁর
রোজগেরে স্ত্রীর কাছ থেকে ভরণপোষণের জন্য আদালতে আবেদন
করতে পারেন।
প্রশ্ন: স্বামী
ও স্ত্রীর যদি শিশু সন্তান এবং সাবালক সন্তান থাকে,
সেক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর সন্তানরা কার কাছে থাকবে?
উত্তর : বাচ্চারা বাবা অথবা মা - যে-কোনও একজনের কাছে
থাকতে পারে। এ ব্যাপারে দু-পক্ষের মধ্যে যদি মতান্তর
হয়, তাহলে আদালত এই ব্যাপারে রায় দেবে। আইনের বিধানে
সাধারণত ছয় বছর পর্যন্ত বাচ্চারা মায়ের কাছে থাকতে পারে।
কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে শিশু-সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণের
ভার বাবাকেও দেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষ বলতে মায়ের পুনর্বিবাহ-ঘটিত
সমস্যা বা তাঁর চরিত্রহীনতা, অথবা মাতৃগৃহের পরিবেশ
শিশুদের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হওয়া, ইত্যাদি, বোঝাচ্ছে।
প্রশ্ন: যাদি সন্তানরা
মায়ের কাছে থাকেন, সেক্ষেত্রে বাবা কি বাচ্চাদের ভরণপোষণের
জন্য টাকা দিতে বাধ্য? দিতে হলে, কতদিন পর্যন্ত তিনি
তা দেবেন?
উত্তর : হ্যাঁ, বাবা সন্তানদের জন্য খরচ দিতে বাধ্য।
সাধারণত ছেলেদের ক্ষেত্রে এই ভরণপোষণ চলবে তারা সাবালক
না হওয়া পর্যন্ত। মেয়েদের ক্ষেত্রে তাদের বিবাহ না হওয়া
পর্যন্ত।
প্রশ্ন: বিবাহ-বিচ্ছেদের
মামলা কি কি কারণে করা যায়?
উত্তর: অনেক কারণেই বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য মামলা করা
যায়। যেমন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের দুর্ব্যবহার
অভিযোগ থাকলে, অথবা দুবছরের বেশি অন্য পক্ষ কর্তৃক পরিত্যক্ত
অবস্থায় থাকলে, বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য মামলা আনা যেতে
পারে। তবে এ দুটি ছাড়াও আরও অনেক কারণের ভিত্তিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের
মামলা আনা যেতে পারে।
প্রশ্ন: বিবাহ-বিচ্ছেদ
মামলা কোন আদালতে আনা যায়?
উত্তর: বিবাহ-বিচ্ছেদের সংক্রান্ত মামলা ডিস্ট্রিক্ট
জজ-এর কাছে দায়ের করা যায়। বর্তমানে পারিবারিক আদালতে
এই ধরণের মামলা দায়ের করতে হয়।
প্রশ্ন: মিউচিয়াল
কনসেণ্ট বলতে কি বোঝায়?
উত্তর : যখন স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মতের এতো অমিল যে,
তাঁদের পক্ষে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একসঙ্গে বসবাস করা
সম্ভব হচ্ছে না, তখন দুজনে মিলিত ভাবে আদালতের কাছে
আবেদন করতে পারেন বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য। তবে বিবাহের
এক বছরের মধ্যে এই আবেদন করা যায় না।
রত্না
দাশগুপ্ত (এডভোকেট)
[আইন বিষয়ক যে-সব আলোচনা
অবসর-এ রয়েছে তার উদ্দেশ্য সাধারণ ভাবে আইনের ব্যাপারে
পাঠকদের অবহিত করা। এই আলোচনা কোনও ভাবেই উকিলের পরামর্শের
বিকল্প নয়। কারোর আইন সংক্রান্ত কোনও সমস্যা থাকলে,
তাঁর উচিত সরাসরি কোনও আইনজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।]