খ্রীশ্চানদের
বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ - কিছু তথ্য

ভারতবর্ষ
যখন ইংরজদের শাসনে ছিল, তখন যেসব পারিবারিক আইন খ্রীশ্চানদের
জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল সেগুলি অপরিবর্তিত
অবস্থায় ২০০১ সাল পর্যন্ত বলবত্ ছিল। সমাজের পরিবর্তনের
সঙ্গে আইনের যেসব সংস্কার হওয়ার দরকার ছিল, বিশেষকরে
লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে - তা করা হয় নি। এটা শুধু খ্রীশ্চান
পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রেই নয় মুসলিম আইনগুলির ক্ষেত্রেও
সত্য - যার কোনও সংস্কারই হয় নি। শুধু হিন্দু পারিবারিক
আইনের বেশ কিছু পরিবর্তন স্বাধীনতা পাওয়ার পর করা হয়েছে।
২০০১ সালে খ্রীশ্চানদের জন্য প্রযোজ্য দ্য ইণ্ডিয়ান
ডিভোর্স এক্ট ১৮৬৯-এর কিছু সংশোধনী হয়েছে যার ফলে পুরনো
আইনের কিছু সুস্পষ্ট লিঙ্গ-বৈষম্য দূর হয়েছে। নিচে সংক্ষেপে
খ্রীশ্চান ম্যারেজ অzাক্ট ১৮৭২ এবং ইণ্ডিয়ান ডিভোর্স
অzাক্ট ১৮৬৯ (সংশোধনী সহ) আলোচনা করা হল:
খ্রীশ্চান বিবাহ আইন:
পাত্রপাত্রীর মধ্যে
অন্ততঃ একজন খ্রীশ্চান হলে তারা খ্রীশ্চান আইন অনুসারে
বিয়ে করতে পারবে। তবে এই আইন মেনে বিয়ে করতে হবে তার
কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ভারতীয়রা সবাই জাতধর্ম-নির্বিশেষে
স্পেশাল ম্যারেজ এক্ট অনুসারে বিয়ে করতে পারে। তবে খ্রীশ্চান
মতে কেউ যদি বিয়ে করতে চায় তাহলে এই আইন তাকে অনুসরণ
করতে হবে, নইলে বিয়েটি অসিদ্ধ (Void) বলে গণ্য করা হবে।
এই আইন অনুযায়ী
গীর্জায় সম্পাদিত খ্রীশ্চানমতে সব বিয়েই আইন সঙ্গত যদি
আইনের অন্যান্য শর্তগুলি মানা হয়। এছাড়া সরকারী লাইসেন্সপ্রাপ্ত
যে কোনো ধর্মীয় যাজক বা খ্রীশ্চান ম্যারেজ রেজিস্ট্রার
এই বিয়ে সম্পাদন করতে পারেন।
বিয়ের আগে ক্ষেত্রবিশেষে
শুধু দুই পরিবারের সম্মতি নয়, যদি পাত্রপাত্রী দুটি
বিভিন্ন চার্চের সদস্য হয়, তাহলে দুটি চার্চকেই এই বিয়েতে
সম্মতি জানাতে হবে। অন্যথায় এই বিয়ে খ্রীশ্চান ধর্মমতে
করা যাবে না।
বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর
মধ্যে একজনকে একটি নোটিস যিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য
করবেন তাঁর কাছে জমা দিতে হবে । এই নোটিসে নিচের তথ্যগুলি
থাকবে:
পাত্র ও পাত্রীর পুরো নাম, পাত্র ও পাত্রীর বর্তমান
বাসস্থান; কতদিন সেই বাসস্থানে পাত্র ও পাত্রী রয়েছে
এবং কোথায় বিয়েটা সুসম্পন্ন হবে।
এই বিয়ে যদি কোনো
গীর্জায় হওয়ার কথা থাকে, তাহলে সেই গীর্জার একটি প্রকাশ্য
জায়গায় নোটিসটি টাঙিয়ে রাখতে হবে। যদি বিয়েটা চার্চ
ছাড়া অন্য কোথাও করা ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে সেই জায়গার
ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে নোটিসটি প্রদর্শিত হবে।
নোটিসপ্রাপ্তির
পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যিনি বিয়ে দেবেন তিনি
একটি সার্টিফিকেট দেবেন। সেই সার্টিফিকেট দেবার দুমাসের
মধ্যে বিয়েটা সম্পাদন করতে হবে।
সরকারের নির্ধারিত
বিয়ের নিম্নতম বয়ঃসীমা সাধারণভাবে চার্চের বিয়ের ক্ষেত্রেও
প্রযোজ্য। অর্থাত্ পাত্রের বয়স অন্ততঃ ২১ বছর ও পাত্রীর
বয়স ১৮ বা তার উর্ধে হতে হবে। খ্রীশ্চানমতে গীর্জায়
বিবাহ সকাল ৬ থেকে বিকাল ৭টার মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে হবে।
তবে পরিস্থিতি বিশেষে অন্য সময়েও হওয়া সম্ভব।
বিয়ের দিন পাত্রপাত্রীকে সামনে রেখে বিয়েতে যিনি পৌরোহিত্য
করছেন তিনি গীর্জায় উপস্থিত সকলকে বলবেন যে, এই বিয়েতে
কারো যদি কোনো আপত্তি থাকে তাহলে সেটা তখনই ব্যক্ত করতে।
কারো কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলে পাত্রপাত্রী উপস্থিত
সবার সামনে দুজনে দুজনের কাছে এই প্রতিজ্ঞা করবে:
আমি, (নিজের নাম), সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সামনে এবং প্রভু
যিশুখ্রীষ্টের নামে, তোমাকে (অন্যের নাম) আমার (স্বামী
বা পত্নী) হিসেবে গ্রহণ করছি। আমি এই প্রতিজ্ঞা করছি
যে সুখে-দুঃখে, ধনে-দারিদ্রে, স্বাস্থে-অস্বাস্থ্যে
আমি আজীবন তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, তোমাকে ভালোবাসবো
ও সম্মান করে চলব।
বিয়ে শেষ হবার
পর সেটা গীর্জার রেজিস্টারে রেজিস্ট্রি করতে হবে। যিনি
বিয়েতে পৌরোহিত্য করলেন, যাদের বিয়ে হল এবং আর দুজন
সাক্ষীকে সেই রেজিস্ট্রিতে সই করতে হবে। এই বিয়ের সার্টিফিকেট
রেজিস্ট্রিতে নাম ওঠার পরপরই নতুন স্বামীস্ত্রীকে দেওয়া
হবে।
খ্রীশ্চান বিবাহ
আইনে বিয়ের উদ্দেশ্যে মিথ্যা উক্তি, নোটিস, সার্টিফিকেট
ইত্যাদি দাখিল করলে তার জন্য দণ্ডবিধানের সংস্থান আছে।
তার বিস্তৃত আলোচনা এই আইনে দেওয়া আছে।
ইণ্ডিয়ান ডিভোর্স এক্ট ১৮৬৯
যদিও খ্রীশ্চান
বিয়েতে পাত্রপাত্রী পরস্পরের কাছে অঙ্গীকার করে যে সারাজীবন
একজন অন্যজনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, কিন্তু বাস্তবে
সেই অঙ্গীকার পালন অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। বিবাহ-বিচ্ছেদের
জন্য খ্রীশ্চানরা ইণ্ডিয়ান ডিভোর্স এক্টের সাহায্য নিতে
পরে। ১৮৬৯ সালে রচিত এই আইন নারীদের স্বার্থ রক্ষা করে
রচিত হয় নি। নারীদের যে পণ্য হিসেবে দেখা হত তার নজিরও
এই আইনের এক আধ জায়গায় চোখে পড়ে। এগুলি দূর করতে কিছুদিন
আগে ২০০১ সালে আইনটি সংশোধিত হয়েছে - এর কিছু অংশ বাদও
দেওয়া হয়েছে।
এই আইনের দশম অনুচ্ছেদ
অনুসারে বিয়ে ভেঙ্গে দেবার জন্য স্বামীকে ডিস্ট্রিক্ট
কোর্ট বা হাইকোর্টে শুধু এই মর্মে আবেদন করতে হত যে
বিয়ের পর স্ত্রী ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে
কিন্তু শুধু ব্যভিচারের অভিযোগ আনলে চলতো না। তাদের
বিবাহ-বিচ্ছেদ চাইতে হলে আরও অনেক কিছু প্রয়োজন হত।
যেমন, বিয়ের পরে স্বামী অন্য ধর্ম নিয়েছে এবং অন্য কাউকে
বিয়ে করেছে; অথবা স্বামী নিকট-আত্মীয়ার সঙ্গে ব্যভিচারে
লিপ্ত আছে; অথবা বহুবিবাহ করে ব্যভিচারে লিপ্ত; অথবা
ধর্ষণ ও অন্যান্য পাশবিক অনাচারে লিপ্ত; অথবা ব্যভিচার
ছাড়াও এমন অত্যাচার করছে যে শুধু তার ভিত্তিতেই বিবাহ-বিচ্ছেদ
সম্ভব; অথবা ব্যভিচার ছাড়াও স্বামী স্ত্রীকে দুবছরের
অধিক কাল কোনো সঙ্গতঃ কারণ ছাড়া পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখেছে।
২০০১ সালে সংশোধনীতে দশম অনুচ্ছেদের এই লিঙ্গ-বৈষম্য
দূর করা হয়েছে।
এছাড়া ডিভোর্স
এক্টের ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে
ব্যভিচারে যুক্ত পুরুষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবী করতে
পারত (এক্ষেত্রে স্ত্রীকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়েছে; ভাবটা
আমার জিনিস তুমি নিয়েছো, তারজন্য খেসারত্ দাও)। সেইজন্যেই
এই আইনে স্বামী ব্যভিচার করলে স্ত্রী ব্যভিচারের জন্য
কারো কাছে কোনো ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারত না। এই অনুচ্ছেদটিই
সংশোধনীতে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিবাহ বাতিল ঘোষণা
করার শর্তগুলি রয়েছে ১৯ অনুচ্ছেদে। সেগুলি হল:
• যদি স্বামী বা
স্ত্রী শারীরিক কারণে যৌনমিলনে অক্ষম হয়;
• যদি স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের সম্পর্ক 'নিষিদ্ধ আত্মীয়'*
সম্পর্কের মধ্যে পড়ে।
• যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একজন উন্মাদ বা জড়বুদ্ধি
সম্পন্ন হয়।
• পাত্রপাত্রীর কেউ বিবাহিত হলে এবং তাদের কারোর স্ত্রী
বা স্বামী বর্তমান থাকলে দ্বিতীয় বিবাহ বাতিল হয়ে যাবে।
• এগুলি ছাড়াও যদি প্রমাণিত হয় পাত্র বা পাত্রীর একজনের
উপর জোর করে বিবাহে সম্মতি আদায় করা হয়েছে, তাহলেও বিবাহ
বাতিল ঘোষণা করা হবে।
২০০১ সালের সংশোধনীতে
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে (mutual consent) বিবাহ-বিচ্ছেদের
সংস্থান রাখা হয়েছে। এটা করা হয়েছে হিন্দু বিবাহ আইন
ও স্পেশাল ম্যারেজ আইনের অনুরূপ সংস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে।
* নিষিদ্ধ আত্মীয়তা
সাধারণতঃ রক্তসম্পর্কের, যেমন, কোনো পুরুষ তার রক্তসম্পর্কের
ভাইয়ের মেয়েকে (নারীর ক্ষেত্রে তার ভাইয়ের ছেলেকে) বিয়ে
করতে পারবে না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈবাহিক সূত্রে
হওয়াও সম্ভব, যেমন, কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর মৃত্যুর
পর স্ত্রীর মাকে (স্ত্রীর ক্ষেত্রে মৃত স্বামীর বাবাকে)
বিয়ে করতে পারবে না।
[আইন বিষয়ক যে-সব আলোচনা
অবসর-এ রয়েছে তার উদ্দেশ্য সাধারণ ভাবে আইনের ব্যাপারে
পাঠকদের অবহিত করা। এই আলোচনা কোনও ভাবেই উকিলের পরামর্শের
বিকল্প নয়। কারোর আইন সংক্রান্ত কোনও সমস্যা থাকলে,
তাঁর উচিত সরাসরি কোনও আইনজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা।]