পাণ্ডু ও কুন্তির তৃতীয় পুত্র। দ্রুপদ-রাজের কন্যা কৃষ্ণা (দ্রৌপদী, যিনি পঞ্চপাণ্ডবের সবারই ভার্যা ছিলেন) ছাড়াও অর্জুনের আরও তিনজনকে বিবাহ করেছিলেন। এঁরা হলেন - কৌরব্যনাগের কন্যা উলুপী (ইনি পূর্ব-বিবাহিতা ছিলেন), মণিপুররাজ চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রাঙ্গদা এবং কৃষ্ণ ভগিনী সুভদ্রা। ওঁর চার পুত্রের নাম শ্রুতকীর্তি (কৃষ্ণার গর্ভজাত),ইরাবান্ (উলুপীর গর্ভজাত), বভ্রুবাহন (চিত্রাঙ্গদার গর্ভজাত) ও অভিমন্যু (সুভদ্রার গর্ভজাত)। কিন্দম মুনির শাপে পাণ্ডুর পক্ষে পিতা হওয়া সম্ভব ছিল না। কুন্তির কাছে পাণ্ডু যখন জানতে পারলেন যে,দুর্বাসা মুনির বরে কুন্তি যে-কোনও দেবতাকে আহবান করে তাঁর পুত্র ধারণ করতে পারেন,তিনি কুন্তিকে প্রথমে ধর্ম ও পরে বায়ুদেবকে আহবান করতে বললেন। এইভাবেই যুধিষ্ঠির ও ভীমের জন্ম হল। কিন্তু দুই পুত্র লাভ করেও পাণ্ডু তৃপ্ত হলেন না। তখন পাণ্ডুর ইচ্ছায় কুন্তি দেবরাজ ইন্দ্রকে আহবান করেন এবং অর্জুনের জন্ম হয়। অর্জুনের জন্মনাম ছিল কৃষ্ণ। শুভ-কর্মে তাঁর রুচি ছিল বলে পরে তিনি অর্জুন নামে পরিচিত হন। অর্জুনের আরও অনেকগুলি নাম ছিল। পৃথার (কুন্তির জন্মনাম) পুত্র বলে তিনি ওঁকে অনেকে পার্থ বলে সম্বোধন করতেন। ওঁর অন্য নামগুলি হল - ধনঞ্জয়, বিজয়, শ্বেতবাহন, ফাল্গুন, কিরীটী, বিভৎসু, সব্যসাচী্‌, জিষ্ণু ও গুড়াকেশ। অর্জুন ছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের প্রিয়তম শিষ্য। গুরুদক্ষিণা স্বরূপ দ্রোণাচার্য যখন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের বন্দিত্ব চান,তখন মূলত অর্জুনের বীরত্বতেই তা সম্ভব হয়। ওঁদের শৌর্যবীর্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্ররা ওঁদের হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন জেনে পাণ্ডবরা বেশ কিছুদিন ছদ্মবেশে ছিলেন। এই সময় ব্রাহ্মণবেশে অর্জুন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের যজ্ঞবেদিসম্ভূত কন্যা কৃষ্ণার (দ্রৌপদী) স্বয়ংবর সভায় লক্ষ্যভেদ করে তাঁর বরমাল্য পান। পুত্র ঘরে কি এনেছে না দেখে মাতা কুন্তি, সবাই মিলিত ভাবে ভোগ কর, বলায় পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গেই দ্রৌপদীর বিবাহ হয়। দেবর্ষি নারদের উপদেশে পাণ্ডবরা নিয়ম করেছিলেন যে, কৃষ্ণা যে সময়ে এক ভ্রাতার সঙ্গে থাকছেন, সেই সময় অন্য কোনও ভ্রাতা তাঁদের শয়ন-গৃহে প্রবেশ করতে পারবেন না। করলে তাঁকে বারো বৎসর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে বনবাস করতে হবে। ঘটনাচক্রে এক ব্রাহ্মণের গোধন রক্ষা করার জন্য অস্ত্র আনতে অর্জুন যুধিষ্ঠির ও কৃষ্ণার শয়ন-গৃহে ঢুকতে বাধ্য হলেন। যুধিষ্ঠির এতে নিয়ম ভঙ্গ হয় নি বললেও, অর্জুন বনবাসে চলে যান। বাস্তবে অবশ্য বনবাস বা ব্রহ্মচর্য - কোনওটাই পরিপূর্ণভাবে তিনি পালন করেন নি। এই সময়কালে একে একে উলুপী, চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং চিত্রঙ্গদা ও সুভদ্রাকে উনি বিবাহ করেন। উলুপীর আমন্ত্রণে ওঁর সঙ্গে সহবাস করলেও পূর্ব-বিবাহিতা বলে অর্জুন প্রথমে ওঁকে বিবাহ করেন নি। পরে অর্জুন উলুপীকেও ভার্যার সন্মান দেন। অগ্নিদেবের হিতার্থে খাণ্ডব অরণ্য যাতে কৃষ্ণ ও অর্জুন দহনে করতে পারেন,তারজন্য বরুণদেব অর্জুনকে একটি রথ আর সেই সঙ্গে বিখ্যাত গাণ্ডীবধনু ও অক্ষয় তূণ দিয়েছিলেন। এই অস্ত্র পেয়ে অর্জুন বিশেষভাবে বলশালী হন। দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা যখন বনবাস করছিলেন, তখন যুধিষ্ঠিরের আদেশে দিব্যাস্ত্রলাভের জন্য অর্জুন ইন্দ্রলোকে যান। ইন্দ্র তাঁকে মহাদেবের আরাধনা করতে বলেন। তাই করে অর্জুন মহাদেবের কাছ থেকে পাশুপত অস্ত্র পান। এরপর ইন্দ্র নিজেও অর্জুনকে নানাবিধ দিব্যাস্ত্রে শিক্ষা দেন। ইন্দ্রের নির্দেশে ইন্দ্রসখা চিত্রসেন অর্জুনকে গীত ও নৃত্যে পারদর্শী করেন। সেইখানে নৃত্যরতা অপ্সরাদের মধ্যে উর্বশীর দিকে অর্জুন বারংবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন দেখে, ইন্দ্র উর্বশীকে অর্জুনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অর্জুন কামনা বসে ওঁর দিকে তাকান নি, উর্বশীকে পুরু বংশের জননী হিসেবে দেখছিলেন। কিন্তু অর্জুন ওঁকে প্রত্যাখ্যান করায় উর্বশী অপমানিত হয়ে অর্জুনকে অভিশাপ দিলেন যে, অর্জুনকে নর্তকরূপে স্ত্রীলোকদের মধ্যে নপুংশক হয়ে থাকবেন। উর্বশীর এই অভিশাপ পাণ্ডবরা যখন বিরাটরাজের সভায় অজ্ঞাতবাস করছিলেন,তখন খুব কাজে লেগেছিল। সেখানে অর্জুন বৃহন্নলা সেজে বিরাটরাজের অন্তঃপুরচারিণীগনকে নৃত্য, গীত ইত্যাদি শিক্ষা দিয়েছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়ের অন্যতম কারণ হল অর্জুনের রণনৈপুন্য। কৌরবদের বহু বীর যুদ্ধকালে ওঁর হস্তে নিহত হয়েছেন। সন্মুখ সমরে ভগদত্ত, জয়দ্রথ, কর্ণকে তিনি বধ করেছেন। কিন্তু ভীষ্মকে শরশয্যায় নিপাতিত করতে তাঁকে শিখণ্ডীকে সামনে রাখতে হয়েছে। এই অন্যায় যুদ্ধের জন্য বসু দেবতাগণ অর্জুনকে নরকবাসের অভিশাপ দিয়েছিলেন। পরে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় যজ্ঞিয় অশ্বকে নিয়ে বহুদেশ জয় করে যখন মণিপুরে পোঁছলেন,তখন নিজপুত্র বভ্রুবাহনের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অর্জুন এই শাপমুক্ত হন। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর অর্জুন তাঁর শক্তি হারাতে শুরু করলেন। একদল গোপালক দস্যুরা যখন যাদববিধবাদের হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁদের রক্ষা করার জন্য বহু চেষ্টা করেও দিব্যাস্ত্রের প্রয়োগ পদ্ধতি অর্জুন স্মরণ করতে পারলেন না। দস্যুরা সফলকাম হল। অর্জুন যখন ব্যাসদেবকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, তখন অর্জুনকে তিনি বললেন দুঃখ না পেতে। অর্জুনদের কাজ শেষ হয়েছে, এখন মহাপ্রস্থানের সময় আসছে। মহাপ্রস্থানের পথে কৃষ্ণা,সহদেব ও নকুলের পরে অর্জুনের পতন হয়। ভীম যুধিষ্ঠিরকে তার কারণ জানতে চাইলে যুধিষ্ঠির বলেন যে, অহঙ্কার ও প্রতিজ্ঞা পালনে অক্ষমতাই অর্জুনের পতনের কারণ। অর্জুনের অহঙ্কার ছিল যে, তিনিই সর্বশেষ্ঠ ধনুর্ধর। আর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে তিনি বলেছিলেন যে, এক দিনে শত্রুবর্গ নিঃশেষ করবেন - যে কথা অবশ্যই তিনি রাখতে পারেন নি।