বিস্মৃত
শিল্পী বদল খাঁ (১৮৩৩ ? - ১৯৩৭ খ্রী)
এযুগে
বদল খাঁ তেমন একটা পরিচিত নাম নয়, যদিও এক কালে সত্তরোত্তীর্ণ
বৃদ্ধ বদল খাঁ-র কলকাতায় আগমন শহরের উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আবহাওয়াকে
প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। ওস্তাদের নাম বাদল না বদল? না, বর্ষার
কথা ভেবে ওঁর এই নাম হয় নি। বদল খাঁ নামটি এসেছিল বদল বা বদলে
যাওয়া থেকে। উনি যখন জন্মেছিলেন তখন সবাই নাকি ভেবেছিল একটি মেয়ে
জন্মেছে। পরে যখন পুরুষ সন্তানের চিþ প্রকাশ পায়, তখন সবার ধারণা
হয় মেয়ে বদলে ছেলে হয়ে গেছে! সেই থেকে ছেলেটির বদল নামটাই বহাল
রইলো।
বদল খাঁ সম্পর্কে বহু তথ্যই
হারিয়ে গিয়েছে। সৌভাগ্যবশতঃ সুরেশ চক্রবর্তী তাঁর সুধাসাগর তীরে
বইটিতে বদল খাঁ-র কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন। বদল খাঁ জন্মেছিলেন
সম্ভবতঃ ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে; সেক্ষেত্রে ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুকালে
তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। বদল খাঁ-র চাচা (কাকা) ছিলেন বিখ্যাত
সারেঙ্গীবাদক হৈদত্ খাঁ। তাঁর কাছেই বদল খাঁ সঙ্গীতশিক্ষার তালিম
নেন। ৪০ বছর পর্যন্ত বদল খাঁ নিভৃতে সঙ্গীত চর্চা করেছেন - গুরুর
আদেশে বাইরে গান নি বা বা বাজান নি। অন্যকারো ক্ষেত্রে সেটা যতটা
কষ্টদায়ক হত, বদল খাঁর ক্ষেত্রে তা হয় নি, কারণ তিনি ছিলেন বিশেষভাবেই
আত্মপ্রচারবিমুখ, অন্তর্মুখ ব্যক্তিত্ব। জলসায় বা বাইরে উনি কতটা
অংশগ্রহণ করেছেন, সেটার সঠিক খবর কোথাও নেই - যেটা জানা যায়, সেটা
হল সেকালের বড় বড় গায়ক ও বাদকদের তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার কথা।
কলকাতায় বদল খাঁ-র কাছে তালিম
নিয়েছিলেন অনেক প্রখ্যাত শিল্পী; প্রথমেই বলতে হয় ভীäমদেব চট্টোপাধ্যায়ের
কথা। এছাড়া গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী বাদল খানের কাছে খেয়াল শিক্ষা
করেছিলেন। অমিয়নাথ সান্যাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, শৈলেশ দত্তগুপ্ত,
জমেরুদ্দীন খাঁ - আরও অনেক বিখ্যাত শিল্পী বাদল খাঁ-র কাছে তালিম
নিয়েছিলেন। ভীäমদেব ছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য। বাদল খাঁ নাকি ছ'মাস
ধরে ভীäমদেবকে শুধু মালকোষ শিখিয়েছিলেন! তাতে ভীäমদেবের পিতা একটু
অসন্তুষ্ট হয়েই ভীäমদেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, এতদিন লাগছে কেন একটা
রাগ শিখতে? দৈবাত্ সেটা শুনতে পেয়ে বদল খাঁ নাকি বলেছিলেন, ছ'মাস
কেন মালকোষ ছ'জিন্দেগীতেও সম্পূর্ণ আয়ত্ত করা যায় না। তবে আর কিছুদিন
সময় পেলে উনি ভীäমদেবের সঙ্গীতের ভিত এমন প্রস্তুত করে দেবেন যে,
অতি দ্রুত গতিতে নির্ভুলভাবে গানের সুর আর তানের পঁzাচ গলায় এসে
যাবে। ভীäমদেবের ক্ষেত্রে এটা নির্ভুল ভাবে প্রমাণিত হয়েছিল।
সুরেশ চক্রবর্তী আরেকটি ঘটনার
কথা উল্লেখ করেছেন যা থেকে বোঝা যায়, বদল খাঁ-কে সমসাময়িক শিল্পীরা
কোন দৃষ্টিতে দেখতেন। বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে গাইতে আসছেন বিখ্যাত
গায়ক আব্দুল করিম খাঁ । সেই শুনে বদল খাঁ সঙ্গীতানুষ্ঠানে যেতে
আগ্রহ প্রকাশ করলেন। যুবক সুরেশ চক্রবর্তী চেষ্টাচরিত্র করে টিকিট
সংগ্রহ করে বদল খাঁকে নিয়ে গেলেন। উদ্যোক্তরা ওস্তাদকে চিনতে পেরে
তাঁকে প্রথম সারিতে বসিয়ে দিলেন। রাত এগারোটায় আব্দুল করিম খাঁ
গাইতে বসে হঠাত্ দেখতে পেলেন, বদল খাঁ বসে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি
উঠে এসে বাদল খাঁর পা স্পর্শ করে বললেন যে, আগে জানলে তিনি নিজে
ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। তারপর বদল খাঁ-র আশীর্বাদ নিয়ে গাইবার
আগে বললেন, -- আজ যে আপনারা আমার সঙ্গীত শ্রবণে উত্সুক যয়েছেন,
তাঁর মূলে আছেন এই আমার বুর্জুগ ও খলিফা বদল খাঁ সাহেব, যিনি অত্যন্ত
কৃপা করে আমার গান শুনে আমাকে কৃতার্থ করতে এসেছেন। ইনি তাঁর সঙ্গীত
শিক্ষার মণিরত্নগুলি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে অকুণ্ঠভাবে দান করেছেন,
যার ফলে আস্লি সঙ্গীত, সুর-সুষমায় সম্বৃদ্ধ রাগের ধ্যানারতির রূপে
স্নি±ধ হয়ে আপনাদের রসচেতনাকে উদ্ভুদ্ধ করেছে --।
অর্থের প্রতি বদল খাঁ-র মোহ
ছিল না। একটা অন্ধকার দুর্গন্ধময় ছোট্ট ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে
তিনি সঙ্গীতচর্চা করে গেছেন। সেই ঘরেই সেকালের বড় বড় সঙ্গীতশিল্পী
ও -প্রেমীর এসে তাঁর সঙ্গীতের রস আস্বাদন করেছেন। সুধাসাগর তীর-এর
লেখক সঙ্গীতশিল্পী সুরেশ চক্রবর্তীও তাঁদের একজন। সেযুগের সঙ্গীতপিপাসু
বাঙালী চিত্তকে বদল খাঁ যে কি ভাবে আলোড়িত করেছিলেন, সেটি সুরেশ
চক্রবর্তীর লেখায় ধরা পড়ে।'বদল খাঁ-র আগমনে আমরা যথার্থ উচ্চ-সঙ্গীতের
রহস্যের চাবিকাঠি খুঁজে পেলাম। ---- আমাদের সঙ্গীতধারা যেন থমকে
দাঁড়ালো - ধ্রুপদ-খেয়ালের লয়কারি, বাঁট, তিহাই-এর শৃঙ্খল থেকে
মুক্তি পেয়ে সুর-রসের সন্ধানে ব্যাকুল হল।'
তথ্যসূত্র:
সুধাসাগর তীরে - সুরেশ চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড.
কলকাতা, ১৯৮৫।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)