নারী
মার্চ ১, ২০১৫
আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা
নিজের যত্ন (২)
(আগের অংশ)
নিজের শরীর নিয়ে সুখী হওয়া
দেশের জনপ্রিয় সুন্দরীদের মধ্যে কেউ আপনার মত দেখতে নয়? সিনেমা অভিনেত্রী বা পত্রপত্রিকার মডেলদের দিকে না তাকিয়ে নিজের আশেপাশে দেখুন। অনেকেই আপনার মতন দেখতে। আর তা না হলেও মনে রাখবেন বৈচিত্র্যই জীবনকে সুন্দর করে। দেশবিদেশের নেত্রী, বীরাঙ্গনা, আর সমাজে যাঁরা পরিবর্তন এনেছেন তাঁদের জীবন সম্পর্কে জানুন। নিজেকে সহজে স্বীকার করার অনুপ্রেরণা পাবেন।
যদি মনে হয় নিজের সব কিছুই খারাপ, একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখুন তো আপনার মধ্যে কী কী গুণ আছে? আপনি কর্মঠ, সেবাপরায়ণ, চিন্তাশীল, ভাল গান গাইতে পারেন - নিশ্চয়ই কিছু খুঁজে পাবেন। মনে রাখবেন আমরা সবাই দোষে গুণে গড়া।
যদি মনে করেন নিজের চেহারা পাল্টে ফেলা দরকার, কেন তা করতে চাইছেন ভেবে দেখুন। কার জন্যে তা চাইছেন? নিজের জন্যে, না অন্যকে খুশি করার জন্যে?
নিজের শরীর নিয়ে সারাক্ষণ ভাববেন না। সব সময় অপরাধবোধে ভুগলে কেউ সুখী হতে পারে না।
নিজেকে সুস্থ এবং কর্মক্ষম রাখুন। সুন্দর লাগবে বলে রোগা বা মোটা হবেন না।
নিজেকে সুন্দর করতে গিয়ে প্রসাধন ব্যবসায়ের মুনাফা পুষ্ট করবেন না। মনে রাখবেন আপনার অসন্তুষ্টির ভিত্তিতেই ওদের লাভ বাড়ে।
কোনও প্রসাধন এবং পোষাক মেয়েদের ছোট করছে মনে করলে তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলুন। আপনার আশেপাশের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করুন সেটি না কিনতে।
পরিচিত গণ্ডীর মধ্যে সবসময় নিজেকে আটকে রাখবেন না। নতুন কিছু করার সাহস রাখুন। এতে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়ে ।
মনে রাখবেন আপনি সুন্দর, পরিবার ও সমাজের আদরণীয় সদস্য। কাজের মধ্যে দিয়ে নিজেকে উন্নত করুন। আপনার কাজই আপনার পরিচয়।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস
খাদ্যের সঙ্গে আমাদের জীবনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের শরীর খাদ্য নির্ভর। খাওয়া ছাড়া আমাদের বেড়ে ওঠা, সুস্থ থাকা, কাজকর্ম করা - কোনোটাই সম্ভব নয়। আমাদের সামাজিক জীবনেও খাদ্যের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। খাওয়ার মাধ্যমে পরিবার, বন্ধু, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৈরী হয়। খাবার খাইয়ে আমরা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের আদর-আপ্যায়ন করি, আনন্দ-উৎসবে পাড়াপড়শীদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করি। খাদ্য আমাদের মনের আবেগের সঙ্গে যুক্ত; পুষ্টি যোগানের মাধ্যমে খাবার আমাদের মনের আবেগকে পুষ্ট করে। ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে খাবার আমরা প্রিয়জনকে উপহার দিই। বিশেষ স্বাদের সঙ্গে যুক্ত বিশেষ স্মৃতি আমাদের আনন্দ দেয়। আবার খাদ্যকে আমরা শত্রু হিসেবে ভাবতে পারি যা কিনা আমাদের ওজন বাড়িয়ে দেবে। ফলে খাদ্য আমাদের মনের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
এক সময়ে বাজারে গেলে আমরা কি ধরনের তরিতরকারি বা শাক সব্জি পাবো, তা নির্ভর করতো বছরের কোন সময়ে বাজার করছি তার ওপর - গ্রীষ্মকালে, বর্ষাকালে না শীতকালে? শীতকালে বাজারে সব্জির সমারোহ - ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, গাজর, ইত্যাদি অনেক কিছু। গ্রীষ্মকালে উচ্ছে, পটল এইসব খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হত। শীতকালে আপেল, কমলালেবু, নাসপাতি, বাতাবি লেবুতে বাজার ছেয়ে যেত। গ্রীäমকালের গরমে আম, জাম, লিচু খেতাম। এখন সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দূর দূর অঞ্চল, এমনকি অনেক সময়ে দেশের বাইরে থেকেও খাবারদাবার আসে। তাই সবকিছুই সব সময়ে পাওয়া যায়। যদিও অসময়ের জিনিস কিনতে দাম দিতে হয় অনেক বেশি।
এই সঙ্গে বাজারে আরেকটি পরিবর্তনও ঘটেছে শাকসব্জি ও ফলের সাইজে। এখনকার বেগুন বা কপির সাইজ আগেকার বেগুন বা কপির থেকে বড়। কারণ এখন চাষে নানা কৃত্রিম পদ্ধতি (জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং) ব্যবহার করা হচ্ছে। এখনকার শাক-সব্জিতে পোকামাকড়ও কম কারণ এতে বহু কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এক দিক থেকে এ সব বাঞ্ছনীয় মনে হলেও এর কুফল যথেষ্ট। প্রথমত সব্জি যদি খুব ভালভাবে না ধুয়ে খাওয়া হয়, তাহলে এর গায়ে লেগে থাকা কীটনাশক ওষুধগুলি পেটে গিয়ে আমাদের শরীরের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া কৃত্রিম উপায়ে বড় করা সব্জি বা ফল খেলে শরীরের উপর কি প্রভাব পড়বে তা এখনও আমরা জানি না।
আজকাল যে সমস্ত নাম করা মুদির (গ্রোসারী) দোকান হয়েছে, সেখানে টাটকা জৈবিক উপায়ে তৈরী খাবার পাওয়া দুষ্কর। একমাত্র কাঁচা শাকসব্জি ও ফলমূলের ছোট দোকান, যা সাধারণত বাইরে বসে, সেখানে হয়তো এমন কিছু ফল ও সব্জি পাওয়া যেতে পারে যা কোন প্রক্রিয়াকরণ বা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় নি। তবে সেখানেও দেখা যাবে যে আপনার পছন্দের আপেলটি হয়তো কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আপনার পাড়ার দোকানে এসে পৌঁছেছে। আবার খোঁজ নিলে জানতে পারবেন খাওয়ার জন্যে যে আটা বা ময়দা কিনছেন, তা হয়তো সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়ায় উত্পাদিত হয়নি। কিন্তু প্যাকেটের গায়ে সেসব লেখা থাকে না বলে আপনি নিরুপায়। যে শস্য বা সব্জি কিনছেন তাতে হয়তো উত্পাদন কালে ছড়ানো কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে গিয়েছে যা আপনার শরীরের ক্ষতি করতে পারে। খাবারে কীটনাশক আছে কিনা সেই পরীক্ষা হয় না বললেই চলে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েও দেখা হয় না। তাই আপনি এবং আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যা খাচ্ছেন তা কতখানি সুরক্ষিত সে বিষয়ে আপনি হয়তো কিছুই জানতে পারছেন না। এই না জানার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াকরণ করা খাদ্যের ঝুড়ি ঝুড়ি বিজ্ঞাপন, স্বাস্থ্যকর খাদ্য সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী তথ্য, এবং ওজন কমিয়ে 'সুশ্রী' থাকার জন্যে সর্বক্ষণের মানসিক চাপ। ফলে নানান রকম ধারনার মধ্যে কোনটা ঠিক, তা ভালমত বোঝা যায় না।
সাধারণত খাদ্যশস্য কৃষকের কাছ থেকে ব্যবসায়ীর কাছে যায়, সেখান থেকে পৌঁছয় প্রক্রিয়াকারকের কাছে। প্রক্রিয়াকরণের পর পাইকারী বিক্রেতার হাত ঘুরে খুচরো বিক্রেতার মাধ্যমে তা পৌঁছায় আপনার পাতে। এই বহুবিধ চালাচালির ফলে খাদ্য উত্পাদন বিষয়টি থেকে আমাদের মানসিক এবং শারীরিক দূরত্ব বেশ অনেকটা। তাই চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো ধারণা আমাদের নেই বললেও চলে। আজকের দিনে চাষের কাজে বিশাল পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ছোট ছোট চাষী পরিবারের জায়গায় উত্পাদনে ঢুকছে বড়ো বড়ো কোম্পানীর মালিকানাধীন কৃষি খামার। বড়ো বড়ো কোম্পানী এলে অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জমির কর্মীরা হন শোষণের শিকার। আর এই কর্মকাণ্ডের আশেপাশে যে সমস্ত মানুষ বাস করেন, তাদের স্বাস্থ্যও বিপন্ন হয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে খাদ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ খাদ্য উৎপাদন বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অস্বচ্ছ ও সীমিত।
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়-বাণিজ্যের বাড়-বাড়ন্তের ফলে অনেক খাদ্যদ্রব্য আমরা বিদেশ থেকে আমদানী করি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ওয়ার্লড ট্রেড অর্গানাইজেশন) মত কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের আরোপিত শর্তের ফলে আমদানী করা খাদ্যদ্রব্য বিভিন্ন গুণমানের হয়, কারণ অনেক সময় নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক পরীক্ষা বিধি মানা হয় না। এই সমস্ত পরীক্ষার নিয়ম অনেক ক্ষেত্রে করা হয়েছে দূষিত খাদ্য চিহ্নিত করে তা বর্জন করার জন্যে। কিন্তু এই পরীক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার ফলে আমদানী করা খাদ্যে কীটনাশক উপস্থিতির নিষেধ বিধি, মাংস ও মুর্গী উৎপাদনের জন্যে পশুপালনে ব্যবহৃত হর্মোনের পরিমাপ সংক্রান্ত নিয়ম, এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক জিনিষের হাত থেকে মানুষকে সুরক্ষিত রাখার নিয়মাবলী কাজে লাগানো হচ্ছে না।
সুষম আহার
শরীর বৃদ্ধি অর্থাত্ শরীরের বিভিন্ন কোষের সৃষ্টি, বৃদ্ধি, এবং কার্যক্ষমতার জন্য প্রয়োজন শর্করা, প্রোটিন, স্নেহ বা ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ লবণ জাতীয় উপাদান। এবং অবশ্যই তার সঙ্গে বিশুদ্ধ পানীয় জল। সুস্থ সবল শরীর একটা পাকা বাড়ির মত। পাকা বাড়ি বানাতে পরিমাণ মত ইট, বালি, সিমেণ্ট, লোহা ইত্যাদির প্রয়োজন। একটাও উপকরণ বাদ পড়লে পোক্ত বাড়ি বানানো যায় না। শরীরের ক্ষেত্রেও সেটা সত্যি। পরিমাণ মত শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট, ইত্যাদি না পেলে শরীরের পূর্ণ বৃদ্ধি হয় না। সঠিক পরিমাণে এই উপাদানগুলি যে খাবারে থাকে তাকে সুষম খাদ্য বলা হয়।
সুষম খাদ্য সম্পর্কে জানলেও অনেক সময় সেই খাদ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ্য আমাদের থাকে না। অথবা পুষ্টিকর খাদ্য হয়তো খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। সীমিত আয়ের পরিবারে অনেকে ভাবেন সুষম খাদ্য প্রতিদিন খাওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। ফলে তাঁরা তা বাদ দিয়ে পেট ভরানোর জন্যে অল্প পুষ্টির খাবার খান এবং সকলকে পরিবেশন করেন। এছাড়া যে সমস্ত পরিবারে মা এবং বাবা দুজনকেই দিনের অনেকটা সময় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, তাঁদের পক্ষে কম দামে পুষ্টিকর খাদ্যের খোঁজ করা বিষম বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার খেতে যে অনেক অর্থের প্রয়োজন তা ঠিক নয়। আদর্শ সুষম খাবারে শাকসব্জি ও ফল যেমন থাকবে, সেরকম মাছ, মাংস, বা ডিম থাকবে, এবং থাকবে ভাত বা স্টার্চ জাতীয় খাবার।
ঠিক না ভুল?
খাদ্য থেকে সমস্ত ফ্যাট বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ বাদ দিলে আমি সুস্থ থাকব।
ভুল। ফ্যাটের ব্যাপারে আমাদের দেশে কেউ কেউ মাথা ঘামান কারণ এতে মেদ বৃদ্ধি হয়। স্নেহ জাতীয় পদার্থ আমাদের পুষ্টির পক্ষে একটি প্রয়োজনীয় উপাদন। শরীরে ভিটামিন সংগ্রহ, স্নায়ুর সুস্থতা, হর্মোনের সমতা, আর পরিশ্রম করার ক্ষমতার জন্যে স্নেহ জাতীয় পদার্থ দরকার। কিন্তু ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নামে এক ধরণের স্নেহ পদার্থ শরীরের পক্ষে ভাল নয়। কোন খাবারে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে তা আমরা বুঝতে পারি খাবারের প্যাকেটে লেখা উপাদানগুলি দেখে। যদি তেল বা অন্য খাদ্যের উপাদানের তালিকায় হাইড্রোজেনেটেড বা স্বল্প হাইড্রোজেনেটেড স্নেহ জাতীয় পদার্থ রয়েছে লেখা থাকে তাহলে জানবেন সেটিতে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড আছে।
পৃথিবী ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বাড়ছে মানুষের কর্মব্যস্ততা। জীবিকা-নির্বাহের জন্য আরও বেশি সময় দিতে হচ্ছে সকলকেই। বাজার করা, রান্না করা, এমনকি খাওয়ার জন্য সময় কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। আমরা অনেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে, পথ চলতে চলতে, খেয়ে নিচ্ছি বাইরে তৈরী করা খাবার, চট-জলদি খাবার (ফাস্ট ফুড), বা যন্ত্রের সাহায্যে তৈরী করা খাবার। আমাদের এই কর্মব্যস্ত জীবনযাত্রার প্রভাব পড়ছে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ডায়াবেটিস (বহুমূত্র রোগ) রোগী রয়েছে সে রকম দশটি দেশের মধ্যে ভারতই শীর্ষস্থানীয়। ১৯৮৩ সালে ভারতের জনসংখ্যার ৫.২ শতাংশ লোক ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন, ১৯৮৯ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ৮.২ শতাংশ, এবং ১৯৯৫ সালে ১১.৬ শতাংশ। ২০০০ সালে আমাদের দেশে তিন কোটি সতেরো লক্ষের বেশি লোক ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে এর প্রধান কারণ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের জনপ্রিয়তা আর শারীরিক পরিশ্রম না করা। এছাড়া আমরা হয়তো পরিমাণে বেশি খাচ্ছি কিন্তু সে খাবারের গুণগত মান এতই কম যে সেগুলি আমাদের শরীরে প্রয়োজন মত পুষ্টি যোগাচ্ছে না। এ ছাড়া আয়ের অঙ্ক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মধ্য এবং উচ্চ বিত্ত সমাজে মানুষ শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে দিয়েছে। ফলে স্থূলাঙ্গতা বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিসও।
শরীর সুরক্ষিত রাখার জন্যে আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজন সময়, শক্তি, সঙ্গতি এবং সে বিষয়ে জ্ঞান। তবেই আমরা সঠিক খাদ্য বেছে নিতে পারবো।
হাসি বক্সী
আমার বয়স এখন নব্বইয়ের কাছাকাছি। শরীর ভালো রাখার জন্যে আমি বেশ সাবধানেই খাওয়া দাওয়া করি। প্রচুর সব্জী খাই কিন্তু শাক বা কপি জাতীয় সব্জী আমার খাদ্য তলিকায় কম রাখি। ভাজাভুজি একদম না। ফল খেতে ভালো লাগে আর গোটা ফল খেলে শরীরও ভালো থাকে। তাই ফলের রসের বদলে আঁশযুক্ত ফল খাই। আজকাল দুধ হজম করতে পারি না, তাই খাই না। তবে খাবারে প্রোটিন যাতে বেশি থাকে সেদিকে সজাগ থাকি।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য তালিকা কি রকম হওয়া উচিত?
আজকের দিনে স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। যদিও ব্যক্তি বিশেষের খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করবে তার স্বাস্থ্য, বিপাকীয়তা, এবং জন্মসূত্রে পাওয়া শারীরিক গড়নের ওপর, তবুও কোনটি পুষ্টিকর খাদ্য এবং কোনটি পুষ্টিকর নয় তা বোঝার জন্য কতকগুলি মৌলিক সূচক আছে।
১) পূর্ণাঙ্গ খাবার খান। শস্য বা প্রাণীজ যে সমস্ত খাবারের প্রাকৃতিক রূপ প্রায় অবিকৃত রয়ে গিয়েছে তাই হল পূর্ণাঙ্গ খাবার। এই খাবারের কোনও প্রক্রিয়াকরণ বা শুদ্ধিকরণ না হওয়ার দরুণ এগুলির পুষ্টিগুণ কারখানায় তৈরী খাবারের চেয়ে অনেক বেশি। এর উদাহরণ হল তাজা আর কারখানায় তৈরী ফলের রসের পার্থক্য। তাজা ফলে শরীরের উপযোগী যে আঁশ আছে তা কারখানায় তৈরী ফলের রসে থাকে না। দুধের সরে যত ক্যালসিয়াম আছে তা পনিরে নেই।
পূর্ণাঙ্গ এবং প্রক্রিয়াকরণের পর খাদ্যের তফাতের আর একটি দৃষ্টান্ত হল মোটা লাল আটা আর সাদা ধবধবে ময়দার মধ্যে পার্থক্য। পাঁউরুটি জাতীয় খাদ্য তৈরী করার জন্যে যে ময়দা লাগে তা তৈরী হয় অনেকগুলি ধাপে গম পরিস্রুত করে। পরিস্রুত করতে প্রথমে গমের খোসা ভুষি করে আলাদা করে নেওয়া হয় যার ফলে আঁশ, ভিটামিন-বি, এবং আরও কিছু পুষ্টিকর খাদ্যগুণ বাদ চলে যায়। তারপরে গমের অবশিষ্টাংশ যার পুষ্টিগুণ প্রায় নেই বললেই চলে, তা মেশিনে গুঁড়ো করে ময়দা তৈরী করা হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে খাদ্যগুণ আরও কমে যায়। মানুষের শরীরে এই বাদ পড়ে যাওয়া পুষ্টিগুলির প্রয়োজনীয়তা আছে। এগুলি খাবার হজম করতে এবং শরীরকে ভিটামিন ও অন্যান্য খনিজগুণ শোষণ করতে সাহায্য করে। খাদ্যের মধ্যে এগুলি না পেলে তা যোগায় আমাদের শরীরের মধ্যে আগে থেকে সঞ্চিত পুষ্টির ভাণ্ডার।
আমাদের অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগের কারণ শরীরে কয়েকটি ভিটামিন বি-র অপ্রতুলতা। তাই পাশ্চাত্যে ময়দা প্রস্তুতকারীরা কৃত্রিম উপায়ে তৈরী কিছু পুষ্টি, যেমন থায়ামিন (ভিটামিন বি-১), রিবোফ্লাবিন (ভিটামিন বি-২), এবং ফলিক অ্যাসিড ময়দার মধ্যে যোগ করে দেন। কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্রুত খাবারে এই উপাদানগুলি বাদই থেকে যায়। দিনের পর দিন অপুষ্টির ফলে আমাদের শরীরের মধ্যে সঞ্চিত ভাণ্ডারগুলি নিঃশেষিত হয়ে যেতে থাকে।
পূর্ণাঙ্গ খাবারের একটি জরুরী উপাদান হল পটাসিয়াম নামে একটি খনিজ লবণ যা আরেকটি খনিজ, সোডিয়ামের সঙ্গে মিলে আমাদের শরীরের কোষের মধ্যে থাকা জলীয় পদার্থের সাযুজ্য বজায় রাখে। এই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে চালানোর জন্যে আমাদের শরীরে সোডিয়ামের চাইতে দুই থেকে ছয়গুণ বেশি পটাসিয়াম থাকা প্রয়োজন। অবশ্য এই অনুপাত নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। সব তাজা ফল ও শাকসব্জিতে যথেষ্ট পরিমাণে পটাসিয়াম রয়েছে। প্রায় সমস্ত পূর্ণাঙ্গ খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাসিয়াম আছে বলে আমাদের শরীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা সংগ্রহ করে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ খাবারে সোডিয়াম নেই বললেই চলে। প্রক্রিয়াকরণের ফলে খাবারে সোডিয়াম বেড়ে যায় ও পটাসিয়াম কমে যায়। তাই প্রক্রিয়াকরণ করা বা পরিস্রুত খাবার বেশি খেলে আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় সোডিয়াম ও পটাসিয়ামের সঠিক অনুপাত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
২) বেশি করে ফল ও সব্জি খান। ফল ও সব্জিতে জারণ-বিরোধী (অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট) উপাদানের পরিমাণ বেশি। এতে অ্যাণ্টি-অক্সিডেণ্ট বলে একটা পুষ্টি আছে যা আমাদের শরীরে বিষাক্ত রস বা টক্সিনগুলি নষ্ট করতে সাহায্য করে। সাধারণত রঙীন ফল ও সব্জিগুলিতে জারণ বিরোধী উপাদান বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ হলুদ, কমলা, ও গাঢ়-সবুজ রঙের সব্জি, বিভিন্ন রকমের লেবু, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই জারণ-বিরোধী উপাদানগুলি খাদ্যের পরিপূরক হিসেবেও খাওয়া যায় কিন্তু খাবারের মধ্যে থাকলে এর শক্তি অনেক বেশি হয়।
ফল ও সব্জিতে আরও অনেক ভিটামিন ও খনিজের উপস্থিতির হার যথেষ্ট। যেমন জাম, কমলা, মুসাম্বি, ও ক্যাপসিকামে প্রচুর ভিটামিন-সি আছে যা আমাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। গাজর ও রাঙা-আলু বেটা-ক্যারোটিনে সমৃদ্ধ যা আমাদের দৃষ্টিশক্তির পক্ষে উপকারী। সবুজ পাতাওয়ালা সব্জিতে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ও ভিটামিন-কে আছে যা আমাদের দাঁত ও হাড় মজবুত করে।
ফল ও সব্জি আমাদের রোগের হাত থেকে সুরক্ষা করার সাথে সাথে আমাদের শরীরের প্রাত্যাহিক প্রক্রিয়াগুলিকেও ভালভাবে চলতে সাহায্য করে। ফল, সব্জি ও দানা-শস্যের আঁশ খাবার হজম করতে ও তা শরীরের ভিতরের অন্ত্রের মধ্য দিয়ে চলাচল করতে সাহায্য করে। খাবার খাওয়া এবং পরে সেটি মলদ্বার দিয়ে বিষ্ঠা হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়কে 'বাওয়েল ট্রান্সিট টাইম' বলে। এই সময় নির্দিষ্টভাবে কতক্ষণ হওয়া উচিত তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও সাধারণত আঠারো থেকে তিরিশ ঘন্টা হল নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত সময়। এই চলাচলের সময় খুব কম হলে আমাদের শরীর খাবারের থেকে যথেষ্ট পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে না। আবার এই সময় খুব বেশি হলে জৈবিক পাচন প্রক্রিয়ায় উত্পন্ন বিষাক্ত পদার্থ ও ব্যবহৃত হর্মোন, যা বর্জন হওয়া দরকার, সেগুলি শরীর আবার শুষে নেয়। এই বর্জ্য পদার্থগুলি রক্তের সঙ্গে মিশে গেলে নানান সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেমন গাঁটে এবং পেশীতে ব্যথা এবং শরীরে হর্মোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। দিনে এক থেকে তিনবার মলত্যাগ করা স্বাভাবিক। কিন্তু দিনে অন্তত একবার পায়খানা না হলে উপরে উল্লেখিত আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খান। তবে দিনে তিনবারের বেশি পায়খানা হলে ধরে নিতে হবে তা অস্বাভাবিক এবং ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
একটি প্রয়োজনীয় নির্দেশ
রোজ দুই থেকে চার টুকরো তাজা ফল খান। দিনে বা রাতে যা খান তার অর্ধেক যেন সব্জি হয়।
সুষম খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ও তার পরিমাপের ছবি নীচে দেওয়া হল।
৩) যে পরিমাণ এবং ধরণের পূর্ণাঙ্গ খাবার আপনাকে সতেজ রাখে তাই খান। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস বিভিন্ন রকমের হতে পারে। আপনার যদি বেশি প্রোটিন যুক্ত খাবার এবং তার সঙ্গে প্রচুর শ্বেতসারহীন সব্জি ও কম কার্বোহাইড্রেট খেতে ভালো লাগে, তাহলে তাই আপনার পক্ষে সঠিক খাদ্য হতে পারে। আবার আপনি যদি যথেষ্ট শস্য, সব্জি এবং বীন জাতীয় খাবার খেয়ে সুস্থ থাকেন, তাহলে তাই আপনার পক্ষে ঠিক খাদ্য।
৪) সম্ভব হলে জৈব উপায়ে তৈরী (অর্গানিক) স্থানীয় ঋতুকালীন খাবার খান। আপনার এলাকায় কি জৈব খাবার সহজলভ্য এবং তার দাম কত তা নির্ভর করবে আপনি কোথায় থাকেন। সকলের পক্ষে এ ধরণের খাওয়া জোগাড় করা খুব সহজ নয়। কিন্তু যদি জৈব পদ্ধতিতে তৈরী খাবার পাওয়া যায় তাহলে সেগুলিই সবচাইতে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য। যাঁরা জৈব পদ্ধতিতে চাষ করেন তাঁরা জমির স্বাস্থ্যরক্ষা এবং শস্যের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবার জন্যে জৈব সার ব্যবহার করেন, ক্ষতিকারক রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। ফলে উৎপাদিত ফল ও সব্জির পুষ্টিগুণ বেশি হয়। স্থানীয় চাষীর কাছ থেকে ঋতুকালীন ফল ও সব্জি কেনা সব সময়েই শ্রেয়। এর অনেক সুবিধে আছে। আপনি যে পয়সা খরচ করছেন তা স্থানীয় কৃষক পাচ্ছে এবং স্থানীয় অর্থনীতি মজবুত হচ্ছে। তাছাড়া যেহেতু আপনি জানেন যা খাচ্ছেন তা কোথায় উত্পাদিত হচ্ছে এবং কিভাবে তার চাষ হচ্ছে, আপনি নিশ্চিত থাকছেন যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত খাবার খাচ্ছেন। আবার স্থানীয় চাষীরা যেহেতু ঠিক সময়ে ফল, সব্জি ও শস্য ঘরে তোলেন তা শুধু পুষ্টিকর হয় না, খেতেও হয় সুস্বাদু।
ঘাস এবং অন্যান্য জৈব খাবার খাওয়া প্রাণী সাধারণত অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যবান হয়। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে সমস্ত শিশুরা জৈব খাবার খেয়ে বেড়ে ওঠে তাদের শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি প্রথাগত খাবার খেয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের তুলনায় অনেক কম।
আমাদের দেশে আগে চাষীরা জৈব প্রথায় ফলমূল, শস্য, সব্জি উত্পাদন করতেন। এখন বেশি উৎপাদনের তাগিদে ধীরে ধীরে সেই নিয়ম থেকে তাঁরা সরে আসছেন। যদি আপনার সব জৈব খাবার কিনতে আর্থিক সমস্যা থাকে তাহলে জৈব উপায়ে তৈরী সহজলভ্য মাংস, ডিম, দুধ আর স্নেহজাতীয় খাবার খান। এগুলিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ রয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি, তাই সাধারণ পদ্ধতিতে তৈরী হলে বিষাক্ত কীটনাশক শরীরে যেতে পারে।
অধিকাংশ কীটনাশক তৈরী হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। পেট্রোলিয়াম এক ধরণের তেল যা সহজেই স্নেহজাতীয় পদার্থে মিশে যায়। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে আপেল, আঙুর, নাসপাতি, আলু ইত্যাদি ফল ও সব্জিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি বেশি কিন্তু কলা, ফুলকপি, আম, পেঁয়াজ, পেঁপে এবং আনারসে তুলনামূলকভাবে কম।
(পরের অংশ)
২০০৯ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের অনুদানে শমীতা দাশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় 'মানবী' ও 'সংলাপ'-এর যৌথ উদ্যোগে 'আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা' বইটি প্রকাশিত হয়। অনুবাদে সহযোগিতা করেন সুজন দাশগুপ্ত ও অলোক গোস্বামী, আলোকচিত্রে সুবীণ দাশ ও চিত্রাঙ্কনে সাগরিকা দত্ত । ১৫০০ কপি ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন এনজিও-র মাধ্যমে বিনামূল্যে বিতরণের জন্যে, এখন এটি দুষ্প্রাপ্য। বইটিতে অবসর-এ পূর্ব-প্রকাশিত কিছু কিছু লেখাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বইটি প্রকাশ করার অনুমতি আমরা পেয়েছি। এর আগে মেয়েদের যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক অলোচনার একাংশ প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংখ্যা থেকে পুরো বইটিই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।