নটী
বিনোদিনী (১৮৬৩--১৯৪২)
নটী বিনোদিনীকে
ফিরে দেখা তাঁর জন্মের দেড়শত বত্সর বাদে - এক
আশ্চর্য প্রতিভার নাম নটী বিনোদিনী। সে যুগে
নারীদের আলাদা কোনো অস্তিত্ব স্বীকার করতনা
পরিবার সমাজ এমনকি দেশের শাসককুলও, সে সময়ে
দাঁড়িয়ে নিজের অভিনয় প্রতিভার জোরে বিনোদিনী
নিজেকে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শুধু অভিনয়
জগতে নয় সংস্কৃতমনস্ক অভিজাত লোকেদের সভাতেও
যেখানে আলোচিত হত বাংলা, ইংরেজী সাহিত্য। সম্পূর্ণ
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেসব আলোচনায় যোগ দিতেন
এই অসামান্যা প্রতিভাময়ী সুন্দরী নারী, যদিও
তাঁর প্রথাগত শিক্ষা ছিল সামান্যই ।
১৮৬৩ সালে
তাঁর জন্ম ঠিকানা ছিল ১৫৪ নং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট।
মা, দিদিমার তত্ত্বাবধানে বড় হওয়া। অত্যন্ত
গরীব অবস্থা ছিলো তাঁদের। খোলার চালের বাড়ী
তারই দু একটি ঘর আবার ভাড়া দেওয়া অন্নসংস্থানের
জন্য। পুঁটি নামে ডাকত সবাই ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটিকে।
মা ভাই আর দিদিমাকে নিয়ে সংসার। ঘর ভাড়া আর
মা, দিদিমার সামান্য অলংকার এই ছিলো আয়ের পথ।
খুবই দরিদ্র জীবন
দিদিমা
তারই মধ্যে বিয়ে দিয়ে দিলেন পুঁটির তাঁরই খেলার
সাথীর সঙ্গে কিন্তু সে বিয়ে স্থায়ী হলনা। পুঁটির
স্বামীকে তার বাড়ীর লোকেরা নিয়ে চলে গেল। ভাইয়ের
এক সময়ে বিয়ে হল, কিন্তু ভাই-বৌ থাকলনা শ্বশুরবাড়ী।
পুঁটি একেবারে একা হয়ে গেল। তখন তাঁকে ভর্তি
করা হল কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের অবৈতনিক স্কুলে
-- নাম লেখান হল বিনোদিনী দাসী
পুঁটি
থেকে বিনোদিনীতে রূপান্তরিত হওয়া শুরু হল সেই
মুহূর্ত থেকে। পড়াশুনাতে তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া
এক আশ্চর্য কথাই! পরিবেশ তো অনুকূল ছিলনা। গানের
গলাও ছিল অদ্ভুত রকমের ভাল। বিনোদিনীর বাড়ীতে
গঙ্গাবাঈ নামে এক গায়িকা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন
মাঝে মাঝে। বয়সে বিনোদিনীর থেকে অনেক বড়। তাও
বিনোদিনী তার সাথে সই পাতালেন, গোলাপফুল বলে
ডাকতেন তাকে। দারিদ্রের সঙ্গে যুঝতে না পেরে
বিনোদিনীর মা দিদিমা এই গঙ্গাবাঈয়ের কাছেই গান
শিখতে দিলেন তাঁকে। আশ্চর্য দরদভরা কণ্ঠ সুর
লয় তালের জ্ঞান যেন এই মেয়ের সহজাত ক্ষমতা।
তাই অল্প কদিনেই সে আয়ত্ত করে নিল সুমধুর সব
গান। এদিকে গঙ্গাঈের ঘরে গানের আসর বসত প্রায়ই।
আসতেন তখনকার সমাজের গানের সমঝদার জ্ঞানীগুণীরা।
বিনোদিনীর এই গান গাইবার ক্ষমতা পালটে দিল তাঁর
জীবন। যদিও দারিদ্রদোষ তাঁর জীবন পরিবর্ত্তনের
অন্যতম কারণ। আর কারণ- গঙ্গাবাঈ নিজে। তিনি
বিনোদিনীকে নামিয়ে দিলেন বারাঙ্গনার ভূমিকায়।
তখনকার সমাজে আসরে গান গাইতেন এরাই। গঙ্গাবাঈয়ের
আসরে আসতেন পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর ব্রজনাথ
শেঠ। তাঁরা বিনোদিনীকে ভর্তি করে দিলেন 'গ্রেট
ন্যাশনাল থিয়েটারে'-দশ টাকা বেতনে। মহেন্দ্রলাল
বসুর উপর তাঁকে শেখানোর ভার পড়ল। পরে অর্ধেন্দুশেখর
মুস্তাফী, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় -নাট্যজগতের
এইসব দিকপালেরা তাঁর শিক্ষার ভার নিলেন। ১৮৭৪
সালের ১২ই ডিসেম্বর মাত্র ১১ বছর বয়সে দু'চারটি
মাত্র সংলাপের মাধ্যমে অভিনয় করলেন 'শত্রুসংহার'
নাটকে। মাত করে দিলেন দর্শককুল ও নাট্যজগতকে।
বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীতে এই অভিজ্ঞতার বিবরণ
দিয়েছেন। পরের নাটকে নামলেন নায়িকার ভূমিকায়,
বয়স এত কম হওয়া সত্ত্বেও। (সেই সময়ে অভিজাত
ঘরের মেয়েরা নাটক-যাত্রায় অংশগ্রহণ করতেননা,
তাই নাটক-জগতকে এই বারাঙ্গনাদের থেকেই স্ত্রী
ভূমিকার জন্য মেয়ে যোগাড় করতে হত )
বিনোদিনীকে
অবশ্য বড় মেয়ের ভূমিকায় সাজাতে বেশ কষ্ট করতে
হত সাজাবার লোকেদের। তিনি নিজে লিখেছেন "
আমাকে সাজাতে বেশকারীর পরিশ্রমের অন্ত ছিলনা,
ছোট ছিলাম তো, কিন্তু সাজতে হত যুবতী "
।
তার পর
থেকেই অবিসংবাদিত নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় ও প্রতিভাবলে
স্বর্ণশিখরে আরোহণ। ১৮৭৫ সালে গ্রেট ন্যাশনাল
থিয়েটার নাটকের জন্য অর্থ-সংগ্রহের উদ্দেশ্যে
উত্তর ভারত ভ্রমণে বেরোয়। বিনোদিনীই ছিলেন দলের
প্রধান অভিনেত্রী। 'নীলদর্পণ' নাটক শ্রেষ্ঠ
প্রযোজনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বিনোদিনী তাঁর
স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের
কথা।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুরের 'সরোজিনী' নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় আর
এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ১৮৭৬-এর ডিসেম্বরে
তিনি গ্রেট ন্যাশনাল ছেড়ে 'বেঙ্গল' থিয়েটারে
যোগ দিলেন। শুরু হল তাঁর জীবনের আর এক ঐতিহাসিক
অধ্যায়। সেখানেও বেশী সময় রইলেননা। মাত্র ১৯
মাস কাজ করেছিলেন এই দলে। এই সময়কালীন অভিনয়ই
তাঁকে অনেক উঁচু আসনে বসাল। তাঁর জীবনের বহু
গুরুত্ব্পূর্ণ অধ্যায়ও রচিত হল সেই সময়েই।
মাত্র
১৩ বছর বয়স একালে এই বয়সকে আমরা বলি 'টিন এজ'।
শুরু হল কিশোরী থেকে যুবতীতে রূপান্তরিত হবার
প্রথম ধাপ কিন্তু উনবিংশশতাব্দী অর্থাত্ ১৮৭৬
সালের মনস্কতায় তিনি তখন পূর্ণযুবতী। গাম্ভীর্য
ও ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী এই যুবতী অন্তর্দ্বন্দে
বিদীর্ণ চরিত্রগুলিকে বোঝার ক্ষমতা- সহজাত বুদ্ধিতে
আত্মস্থ করেছেন ও অভিনয় ক্ষমতাগুণে পরিপূর্ণভাবে
ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেইসব চরিত্রগুলিকে। বঙ্কিমচন্দ্রের
উপন্যাসের নায়িকা চরিত্রগুলিতে তিনিই অভিনয়
করেছেন। শ্রী শরত্চন্দ্র ঘোষ ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু
তখন। নিজেকে সম্পূর্ণ করে মেলে ধরার সুযোগ পেলেন
এখানে, নাটক যে কেবল প্রমোদের উপকরণ নয় তা বুঝতে
শিখলেন এখানেই। এই দলে নাটকের মহড়ায় আসতেন সমসাময়িক
সংস্কৃতিসম্পন্ন গুণীজনেরা। সেই সাংস্কৃতিক
পরিবেশ বিনোদিনীকে প্রভাবিত করেছিল। তার প্রমাণ
তাঁর চরিত্রাভিনয়। কিন্তু এই বেঙ্গল থিয়েটারও
তাঁকে ছাড়তে হল কারণ -- নাট্যাচার্য্য গিরিশ
ঘোষ। 'কপালকুণ্ডলা' নাটক দেখতে এলেন ন্যাশনাল
থিয়েটারের মালিক কেদারনাথ চৌধুরি,। সঙ্গে গিরিশ
ঘোষ। মুগ্ধ ও বিস্মিত গিরিশ ঘোষ বিনোদিনীকে
নিয়ে এলেন ন্যাশনাল থিয়েটারে, ১৮৭৭ সালে।
শুরু হল
আরেক পর্ব ও তাঁর অভিনেত্রী জীবনের শেষ অধ্যায়,
যা অত্যন্ত করুণ ও বেদনাদায়ক এবং তাঁর পক্ষে
আত্মসম্মানহানিকর।
গিরিশ
ঘোষের দলে আসার পর তাঁর অভিনয় প্রতিভা স্বীকৃতি
পায় বাংলার সর্বত্র ও নাটক ও সংস্কৃতিবান রুচিশীল
মহলে। হয়ে উঠলেন তিনি নাট্যসম্রাজ্ঞী। সীতা
প্রমীলা, কৈকেয়ী, কপালকুণ্ডলা, মতিবিবি এবং
এরকম আরো অনেক নারীপ্রধান চরিত্রগুলি তাঁর অভিনয়
গুণে হয়ে ওঠে বাস্তব। 'মৃণালিনী' নাটকে 'মনোরমা'
চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র
বলেছিলেন, 'আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম,
কখনো যে প্রত্যক্ষ দেখিব এমন আশা করি নাই। আজ
বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল ' এই বক্তব্য
প্রমাণ করে লেখকের কল্পনার নারীকে কিভাবে তিনি
বাস্তবায়িত করেছেন। অতীব প্রখর মননশক্তি না
থাকলে এরকম অভিনয় করা যায়না।
ন্যাশনাল
থিয়েটারে বিনোদের শিক্ষাগুরু হলেন এবার স্বয়ং
গিরিশ ঘোষ, শুরু হল উঁচুদরের অভিনয় শিক্ষার
উচ্চপাঠ। ১৮৭৭ ১লা ডিসেম্বর থেকে পরপর অভিনয়
করে চললেন।
পাঠক আবার
তাঁর বয়সটা স্মরণ করুন --মাত্র চোদ্দ বছর! কি
অসাধারণ প্রতিভাময়ী ছিলেন এই নারী-- ভাবলেও
বিস্মিত হতে হয়।
গিরিশচন্দ্রের
অভিনয় শিক্ষার মাধ্যমে তিনি আরো শিখলেন কিভাবে
স্ব্তন্ত্র ব্যক্তিত্ব লাভ করা যায়। বিনোদের
বাড়ীতে আলোচনার আসর জমে উঠত। আসতেন গিরিশ ঘোষ,
অমৃতলাল বসু অমৃতলাল মিত্র। বিলেতের অভিনেত্রীদের
থেকে শেক্সপীয়র মিল্টন বায়রণ পোপ প্রভৃতি কবিদের
কাব্য আলোচিত হত সব দৃষ্টিকোণ থেকে। বিনোদ অংশগ্রহণ
করতেন-- তাঁর স্মৃতিকথায় এইসব ধরা আছে।
'বিনোদ'
এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো বিচ্ছুরিত হয়েছিল
টানা বারো বছর ধরে।
কিন্তু
সময় বা কালের করাল দংশন পড়তে আরম্ভ করল বিনোদের
অভিনয় জীবনে। নানা কারণে অবস্থার বিপাকে পড়ে
কেদারনাথ চৌধুরি ন্যাশনাল থিয়েটার বিক্রি করতে
বাধ্য হন। দু'তিনবার হাতবদল হয়ে প্রতাপচাঁদ
জহুরী কিনলেন ন্যাশনাল। গিরিশ ঘোষকে অধ্যক্ষ
করা হয়। শুরু হয় নিয়মনিষ্ঠ ব্যবসায়িক থিয়েটারের
এক নতুন যুগ। গিরিশের শিক্ষায় বিনোদের রূপান্তর
ঘটল বিস্ময়কর প্রতিভাশালিনী এক অভিনেত্রীতে,
যদিও গিরিশ তাঁর কৃতিত্ব দাবী করেননি এবং বিনোদের
প্রতিভার কথাই বলেছেন বারবার।
কিন্তু
একবার পনেরো দিনের ছুটিতে কাশী গিয়ে অসুস্থ
হয়ে পড়ে বিনোদ এক মাস অভিনয়ে যোগ দিতে পারেননি।
তাতে জহুরী তাঁর বেতন বন্ধ করেন। আত্মসম্মানী
বিনোদ তখনই থিয়েটার ছেড়ে দিতে চাইলে গিরিশ ঘোষ
ও অন্যরা নিজেদের থিয়েটার তৈরীর কথা বলে তাঁকে
শান্ত করেন।
ঠিক তখনই
গুর্মুখ রায় নামে এক যুবক বিনোদের জীবনে আসে।
সে টাকা দেবে থিয়েটার গড়তে কিন্তু বদলে চাই
চাই বিনোদকে। বিনোদ অনেক ভাবনা চিন্তা করে রাজী
হলেন-কারণ থিয়েটার ও অভিনয়ই ছিল তাঁর ধ্যান
জ্ঞান। ৫০হাজার টাকা দিলেন সেই যুবক বিনোদ সেই
টাকা ঢাললেন থিয়েটার গড়তে। বিডন স্ট্রীটে জমি
নেওয়া হল। সমস্ত উদ্যোগ স্বয়ং বিনোদের। গুর্মুখ
আশা দিয়েছিলেন থিয়েটারের নাম হবে 'বি-থিয়েটার'।
এই নামেই রেজিষ্ট্রী হবে স্থির হয়।
কিন্তু
দৈবের খেলা যাকে বলে তাই হল। থিয়েটারের নাম
'বি-থিয়েটার' হলনা হল 'ষ্টার থিয়েটার'।
আসলে গিরিশ
প্রমুখের চোখে বিনোদ বড় অভিনেত্রী হলেও বারাঙ্গনার
অতিরিক্ত কিছু নয়। এত বড় প্রবঞ্চনা বিনোদ ভুলতে
চেষ্টা করলেন মহড়ায় এলেন, কিন্তু এসেই বুঝলেন
গোটা পরিবেশ পালটে গেছে। আসা বন্ধ করলেন, দু'তিনমাস
কেটে গেল। গিরিশ আবারও মধ্যস্থতা করে ফেরালেন
বিনোদকে। ১৮৮৩সালের ২১শে জুলাই স্টার থিয়েটারের
উদ্বোধন হল 'দক্ষযজ্ঞ' নাটক দিয়ে। সতীর ভূমিকায়
বিনোদের অভিনয় সকলকে অভিভূত করে।
১৮৮৩ সালের
শেষ পর্যন্ত গুর্মুখ স্টারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
'নলদময়ন্তী'-তে দময়ন্তী ও 'ধ্রুবচরিত্র'-তে
সুরুচির ভূমিকায় তাঁর অভিনয় আবারও প্রমাণ করল
তাঁর অভিনয় দক্ষতা দুটি পৌরাণিক চরিত্রকে বাস্তব
রূপ দেওয়ায়।
কিন্তু
আবার দুর্যোগের ঘনঘটা! গুর্মুখ পরিবারের চাপে
পড়ে ষ্টারের স্বত্ব বিক্রী করতে মনস্থ করেন।
বিনোদকে অংশীদার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বারাঙ্গনার
অধীনে কাজে আপত্তি উঠল সুশীল সমাজের!
কি হাস্যকর
কথা! বারাঙ্গনার দেহ ব্যবহার করা যায় নিজের
জৈব চাহিদা মেটাতে কিন্তু তার অধীনে কাজ --নৈব
নৈব চ! হোকনা তিনি অসামান্যা-- শুধু রূপে অভিনয়ে
নয় বিচার বুদ্ধিতেও।
স্বত্ব
গ্রহণে অস্বীকার করতে গিরিশ রাজী করালেন বিনোদ
ও তাঁর মাকে। ষ্টারের স্বত্বাধিকারী হলেন অমৃতলাল
মিত্র দাশুচরণ নিয়োগী হরিপ্রসাদ বসু ও অমৃতলাল
বসু।
'চৈতন্যলীলা'
তখন অভিনীত হচ্ছে ষ্টারে। ১৮৮৪-র ২রা আগস্ট
প্রথম অভিনীত হয় চৈতন্যলীলা। সর্বাপেক্ষা আলোড়ন
সৃষ্টিকারী এই নাটক। চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদের
অভিনয় দেখে ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন "আসল
নকল এক দেখলাম "। নিমাই চরিত্রের ভাবতন্ময়তা
বিনোদকে আচ্ছন্ন করে রাখত। এর ভিতর দিয়েই পাঁক
থেকে পদ্ম হয়ে উঠলেন নটী বারাঙ্গনা বিনোদিনী।
শ্রী রামকৃষ্ণের স্পর্শে গ্লানিহীন, কলুষমুক্ত
হলেন বারাঙ্গনা, সঙ্গে বাংলার রঙ্গালয়ও অশুচিমুক্ত
হল।
ষ্টারে
বিনোদের শেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র 'বিল্বমঙ্গলের'
চিন্তামণি। সেই সময়েই সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে বিনোদের
বিরোধ আরম্ভ হয়। অনেকসময় ষ্টারের জন্য তাঁর
আত্মত্যাগের কথা মুখ ফুটে বলে ফেলতেন--তাই বিরোধ।
সহকর্মীরা এটাকে বারাঙ্গনার ধৃষ্টতা বলে মনে
করতেন। গিরিশ ঘোষ এসব ব্যাপারে একেবারে নিস্পৃহ
ভাব দেখাতেন। এই অপমান, এই অবমাননা বিনোদ কিছুতেই
মেনে নিতে পারলেননা। ছেড়ে দিলেন থিয়েটার ১৮৮৭-র
১লা জানুয়ারী। তাঁর অভিনীত শেষ নাটক 'বেল্লিক
বাজার'।
বিনোদিনী
লিখেছেন, "থিয়েটার ভালোবাসিতাম, তাই কার্য
করিতাম, কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই।
তাই অবসর বুঝিয়া লইলাম " লক্ষ করার মত
বিনোদের ভাষা ! কতটুকুই বা পড়াশুনা করেছিলেন
তিনি!
কোনোদিন
তিনি অস্বীকার করেননি, বারাঙ্গনার ঘরে তাঁর
জন্ম। কিন্তু মর্যাদাহীন জীবনকে সম্মানের শিখরে
নেবার সাধনা তিনি করেছিলেন তাঁর সারস্বত সম্পদের
নৈবেদ্য সাজিয়ে। লিখেছিলেন দুটি বই 'আমার কথা',
'আমার অভিনেত্রী জীবন'। যদিও দ্বিতীয়টি তিনি
শেষ করে যেতে পারেননি। 'আমার কথা-য়' তিনি বিবৃত
করেছেন তত্কালীন বাঙালী সমাজের কথা বাংলা থিয়েটারের
কথা। তাঁর এই আত্মজীবনীমূলক লেখা এক ঐতিহাসিক
দলিল- যার ভাষাও ছিল অত্যন্ত সহজ, সাবলীল কিন্তু
ভাষাশৈলী ও মাধুর্যে পরিপূর্ণ। তিনি একাধারে
কবিও ছিলেন। তাঁর রচিত দুটি কবিতার বই--'বাসনা'
ও 'কনক নলিনী'
তাঁর সময়েই
বাংলা রঙ্গজগতও রূপান্তরিত হয়েছিল মুক্তমঞ্চের
যাত্রা ঢং-এর অভিনয় থেকে মঞ্চে পর্দা সহ ইউরোপীয়ান
বৈশিষ্ট্যের অভিনয়ের দিকে। বিনোদিনীই ভারতীয়
বা দেশজ সাজসজ্জার সঙ্গে ইউরোপীয় সাজ (make
up) সজ্জার সংমিশ্রণ করেন, যদিও তাঁর সামনে
কোন রোল-মডেল ছিলনা Moon of The Star, Flower
of the Native Stage এইসব বিশেষণে তিনি ভূষিতা
হয়েছিলেন তবুও মাত্র ২৩ বছর বয়সে অভিনয় জীবনের
মধ্যগগনে পৌঁছে তাঁকে ছাড়তে হল তাঁর ভালবাসার
পেশা ও জীবন।
স্বামী-সন্তানভরা
সংসারের স্বপ্নও তিনি দেখতেন। তাঁর ব্যক্তিগত
জীবনের বাকী ভাগটা অনেকটাই পর্দার আড়ালেই থেকে
গেছে। পুরুষরা এসেছে গেছে তাঁর জীবনে কিন্তু
প্রকৃত ভালবাসার জন্য তাঁর অন্তর কেঁদেছে সর্বদাই।
সন্তানও এসেছিল তাঁর কোলে, কিন্তু মাত্র ১৩
বছর বয়সে তাঁর একমাত্র কন্যা মারা যায় ১৯০৪
সালে।
থিয়েটার
থেকে বিদায় নেবার পর তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর
প্রকৃত উপকারী বন্ধু ও ভালবাসার জন, রক্ষক রাঙাবাবুর
কাছে। তিনিও চলে গেলেন পরপারে ১৯১২ সালে। সেই
সময় থেকে তাঁর মৃত্যু পর্য্ন্ত(১৯৪২ সাল) ত্রিশ
বত্সরব্যাপী জীবন কিভাবে কেটেছে ভাল জানা যায়না।
সম্ভবতঃ যে জায়গাকে ও যে পেশাকে তিনি সবচাইতে
বেশী ঘৃণা করতেন, সেই জায়গায় যেখানে তাঁর ছেলেবেলা
কেটেছে-- সেখানেই ফিরে গেছিলেন পেটের দায়ে!
মাঝে মাঝে ষ্টার থিয়েটারেও গিয়ে বসে থাকতেন
-হয়তো ভিক্ষে ও করতে হয়েছে তাঁকে।
ভাগ্যের
কি করুণ পরিহাস! সম্রাজ্ঞীকে লাঞ্ছিত হতে হল
নিয়তির কাছে!
৭৯ বছর
বয়সে মৃত্যু তাঁকে শান্তি দিল। তবুও এই কথা
বলা যায় লেডিজ গ্রীনরুমের আড়াল থেকে বেরিয়ে
তিনি নারীর অধিকার দাবী করেছিলেন।
শেষ কথা:
She left
behind a legacy of outstanding stage performance
in which her acting and singing talent enthralled
the audience for over a decade.
( এই কথা
কটি ইচ্ছে করেই ইংরেজীতে লিখলাম) শুনেছি তাঁর
জন্মের দেড়শ বছর বাদে ষ্টার থিয়েটারের নাম হয়েছে,
'বিনোদিনী থিয়েটার' --তবুও ভাল।
কিন্তু
যাঁর এটার প্রয়োজন ছিল-- সে তো জীবিত অবস্থায়
সে সম্মান পেলনা।
মণিকা
মুখার্জী
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।