পুরনো
দিনের বই - বিষের ধোঁয়া
শরদিন্দু
বন্দ্যোপাধ্যায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর গোয়েন্দাকাহিনী
(ব্যোমকেশের নানান গল্প) আর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলির (তুঙ্গভদ্রা
তীরে, গৌড়মল্লার, ইত্যাদি) জন্যে। কিন্তু শরদিন্দুর প্রথম
উপন্যাস ছিল একটি সামাজিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে। উপন্যাসটির
নাম ছিল 'বিষের ধোঁয়া'। বিষের ধোঁয়া উপন্যাসটি তিনি লেখেন
প্রায় দেড় বছর ধরে। বইটি প্রথমে বসুমতীতে ধারাবাহিক ভাবে
প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ১৩৪৫ সালে (অর্থাত্ আজ থেকে প্রায়
প্রায় সাতষট্টি বছর আগে) বরেন্দ্র লাইব্রেরী বইটির প্রথম
সংস্করণ প্রকাশ করে। দাম ছিল মাত্র দুটাকা।
বিষের ধোঁয়ায় নরনারীর
চিরন্তন প্রেমকাহিনী যেমন রয়েছে, সেরকমই রয়েছে একটি অনাত্মীয়
পুরুষ ও নারীর মধ্যে গড়ে ওঠা নিষ্কাম ভালোবাসা ও স্নেহের
আখ্যান। কিশোর (উপন্যাসের নায়ক) ও কিশোরের থেকে বছর চারেকের
বড় তীর্থনাথ একসঙ্গে হস্টেলে থাকতো। 'তীর্থনাথ বেঁটে
ও কৃশ, মস্ত মাথাটি বহন করিয়া ঘাড়টি যেন অত্যন্ত শীর্ণ হইয়া
পড়িয়াছে, চোখে মোটা কাচের চশমা। আর কিশোর ছ ফুট লম্বা, দোহারা,
অসাধারণ বলবান, গৌরবর্ণ ও সুশ্রী, কাচের চশমা পড়িয়া চোখের
সহজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণতর করিবার প্রয়োজন হয় নাই।'
তীর্থনাথ একটা মাস্টারী নিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার পর
কিশোরের সঙ্গে তার আর যোগাযোগ থাকে না। বেশ কয়েক বছর পর
কিশোর তীর্থনাথের কাছে একটি জরুরী চিঠি পায়।
'যশোরে পৌঁছিয়া
হাই স্কুলের মাস্টার তীর্থনাথের বাড়ি খুঁজিয়া লইতে বিলম্ব
হইল না। ভাড়াটে বাড়ি, অতিশয় জীর্ণ, উপরে খোলার ছাদ, কিশোর
কড়া নাড়িতেই একটি কুড়ি-একুশ বছর বয়সের মেয়ে আসিয়া দ্বার
খুলিয়া দিল। কিশোর তাহাকে দেখিয়া বুঝিল তীর্থনাথের স্ত্রী।
কিন্তু কী অপরূপ রূপসী এই রমণী! রুক্ষ চুল, ময়লা কাপড়, গহনা
না থাকারই মধ্যে, রাত জাগিয়া চোখের কোণে কালি পড়িয়াছে, কিন্তু
তাহার মধ্য দিয়াও রূপের জ্যোতি যেন বিচ্ছুরিত হইতেছে।'
ঘরে ঢুকে কিশোর দেখে তীর্থনাথ মৃত্যুশয্যায়। মৃত্যুর আগে
কিশোরের হাতে তীর্থনাথ তার সুন্দরী স্ত্রী বিমলার ভার দিয়ে
যায়। এই থেকেই উপন্যাসের সুরু।
এ যুগের পাঠক বইটা
পড়ে হয়তো নিরাশ হবেন, সুদর্শন কিশোরের সঙ্গে রূপসী বিমলার
প্রেম হল না বলে। কেউ কেউ বিরক্তও হবেন, কেন তিনি বিধবা
বিমলাকে রক্তমাংসের মানুষ না গড়ে, তাকে দেবীর আসনে বসিয়ে
হিন্দুনারীর চিরাচরিত আদর্শেরই জয়গান করলেন। কিশোরকে তিনি
দেখিয়েছেন নির্ভীক যুবক হিসেবে; সমাজকে সে ভয় করে না - অনাত্মীয়া
ও সম্পূর্ণ অপরিচিতা নিজের বয়সী সুন্দরী যুবতী বিমলাকে আশ্রয়
দিতে কুণ্ঠিত হয় না। কিন্তু সেই কিশোরকেও তিনি বিমলাকে অন্যভাবে
দেখতে দেন নি, যদিও নারী ও স্ত্রী হিসেবে বিমলা যে অত্যন্ত
বাঞ্ছিতা তা সেটা কিশোরের চিন্তার মধ্যেই তিনি দেখিয়েছেন।
....'কি অদ্ভুত বস্তু এই নারীর হৃদয়। ইহার ভালোবাসার
পরিধির মধ্যে আত্মপর বিচারের স্থান নাই। ভগিনীরূপে - মাতৃরূপে
- পত্নীরূপে যখনই সে ভালোবাসিয়াছে, তখনই সম্ভব-অসম্ভবের
গণ্ডী ছাড়াইয়া, শত বাধাবিঘ্ন মাড়াইয়া স্বচ্ছন্দে অবহেলে
চলিয়া গিয়াছে, দেহ দিয়াছে, প্রাণ দিয়াছে, ইহকাল-পরকাল দিয়াছে,
তবু ভালবাসার এক বিন্দু লাঘব করে নাই। ....সমস্ত মনপ্রাণ
ঢালিয়া এমন করিয়া ভালবাসা, পুরুষতো দূরে থাক, কয়জন স্ত্রীলোকেই
বা পারে? কি রূপে , কি গুণে, তাহার এই বৌদিদি একেবারে অদ্বিতীয়,
কোথাও তাঁহার দোসর নাই। একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল - কি
স্ত্রীই তীর্থদা হারাইয়াছে!'
অন্যপক্ষে, এক বাড়িতে
এক যুবক ও যুবতী নিভৃতে বাস করলেও যে, তাদের মধ্যে কামগন্ধহীন
সুন্দর বন্ধìত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব (কারণ যাই হোক),
এটা নিঃসন্দেহে আধুনিক চিন্তাধারা; সেযুগে, এমন কি এযুগেও
অনেকের কাছে এটা অচিন্তনীয়। সেই বিচারে শরদিন্দু আধুনিকতা
দেখিয়েছেন। উপন্যাসে বিমলার জন্য কিশোরকে কম ঝক্কি পোহাতে
হয় নি: নানান কুত্সিত অপবাদ, অর্থশালী পিতার ত্যাজ্যপুত্র
হওয়া, যাকে ভালোবাসলো সেই সুহাসিনীর সঙ্গেও ভুল বোঝাবুঝি!
বইটি অবশ্য মিলান্তক। পরে সেই সুহাসিনী, যার বর্ণনা দিতে
শরদিন্দু বলেছেন, সর্বাপেক্ষা মধুর তাহার মুখের হাসি,
যেমন সুমিষ্ট তেমনি অকুণ্ঠিত। এই পূর্ণযৌবনা মেয়েটির হৃদয়ের
নির্মল সহজতাটুকু যেন অকৃত্রিম হাসির ভিতর দিয়া ধরা পড়ে,
তার সঙ্গেই কিশোরের মিলন হয়।
সাহিত্যের বিচারে বিষের
ধোঁয়াকে উচ্চস্থানে বসানো যায় না; কিন্তু শরদিন্দুর গল্পবলার
অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর এই প্রথম উপন্যাসেই ধরা পড়ে। আর চোখে
পড়ে ভাষার উপর ওঁর অনায়াস দখল। 'কাহিনীকে ভাসিয়ে তাঁর ভাষা
যেন তর্তর্ করে বয়ে গেছে সমাপ্তির সাগরসঙ্গমে '(সুকুমার
সেন)।
বিষের ধোঁয়া সম্পর্কে
আরেকটি গল্প হয়তো পাঠকদের ভালো লাগবে। ওকালতি ছেড়ে সাহিত্যচর্চা
সুরু করার প্রথম দিকেই হিমাংশু রায়ের আহবানে শরদিন্দু মুম্বাই
গিয়ে বোম্বে টকিজ-এ গল্প বা সিনারিও লেখার কাজে যোগদান করেন।
হিমাংশু রায়ের ভগ্নীর উত্সাহে শরদিন্দু তাঁর বিষের ধোঁয়ার
চিত্রনাট্য তৈরি করেন। সে সময়ে বোম্বের ছবিগুলো হত পৌরাণিক,
কিংবা ছুরি-ছোরা-গোলা-গুলি-নারীহরণ ইত্যাদি(যা আংশিক ভাবে
এখনও সত্য) নিয়ে। শরদিন্দু পরে এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, বোম্বে
টকিজের কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিলেন যে এই গল্প নিয়ে তোলা ছবি
বাজারে চলবে না - এতে না আছে সেক্স বা প্যাশন, না আছে টেনশন
বা ডেয়ারিং ডু। কিন্তু হিমাংশু রায়ের হাতে তখন অন্য কোনো
চিত্রনাট্য নেই, এদিকে আগের তিন তিনটে ছবিই ফেল মেরেছে।
তাই প্রায় বাধ্য হয়েই তিনি বিষের ধোঁয়া চিত্রায়িত করতে সুরু
করলেন। ছবিতে কিশোর সেজেছিলেন একজন নতুন অভিনেতা জয়রাজ।
কিশোরের প্রেম সুহাসিনী সেজেছিলেন রেণুকা দেবী। বইটির নাম
দেওয়া হয়েছিল 'ভাবী'। সেযুগে ছবিটি অসামান্য সাফল্য লাভ
করেছিল।
সুজন
দাশগুপ্ত