পুরনো
দিনের বই - বকুলতলা পি.এল. ক্যাম্প
নারায়ণ সান্যাল সাহিত্য
জীবনে নানান ধরণের লেখা লিখেছেন: ঐতিহাসিক উপন্যাস (মহাকালের
মন্দির, লাড্লী বেগম), গবেষণা মূলক উপন্যাস (আমি নেতাজিকে
দেখেছি), কল্পবিজ্ঞান (নক্ষত্রলোকের দেবতারা), রহস্য (কাঁটা
সিরিজের লেখাগুলি), স্থাপত্য (রোঁদ্যা), নতুন সাক্ষরদের
জন্য বই (পরিকল্পিত পরিবার), জন্তুজানোয়ারদের জগত্ (তিমি-তিমিঙ্গিল,
না-মানুষী বিশ্বকোষ), বাস্তুবিজ্ঞান (বাস্তুবিজ্ঞান, গ্রামের
বাড়ি), ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যে বিষয়ের এত বৈচিত্র্য খুব
অল্প লেখকের লেখাতেই চোখে পড়ে। তবে শুধু বিষয়-বৈচিত্র্যই
নয়, তারসঙ্গে প্রসাদগুণও নারায়ণ সান্যালকে অন্যান্য অনেক
লেখক থেকে আলাদা করেছে। নারায়ণ সান্যালের দণ্ডক শবরী এক
সময়ে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল; পরে
১৯৬২ সালে সেটি পুস্তাকাকারে প্রকাশিত হয়। সাহিত্যজগতে
ওঁর জয়যাত্রা সেখান থেকেই সুরু।
নারায়ণ
সান্যাল পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৪৮ সালে শিবপুর
থেকে বি.ই.পাশ করে সরকারী পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেণ্টে
(P.W.D) অ্যাসিস্টেণ্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। পেশার
ফাঁকে ফাঁকেই তিনি লিখতেন। ওঁর প্রায় ২০০ টি বইয়ের বেশির
ভাগই লিখেছিলেন চাকুরিরত অবস্থায়। নিন্দুকরা হয়তো বলবে
সরকারী চাকরি করতেন বলেই - সেটা সম্ভব হয়েছিল। কথাটা সত্য
নয়, চাকরি জীবন তিনি অবহেলা করেন নি। ১৯৭৬ সালে তিনি ইনস্টিট্যুট
অফ ইঞ্জিনিয়ার্সের ফেলো নির্বাচিত হন। অবসর নেন ১৯৮২ সালে।
নারায়ণ সান্যালের
প্রথম উপন্যাস বকুলতলা পি.এল. ক্যাম্প প্রকাশিত হয় ১৯৫৫
সালে। বই হিসেবে এটি ছিল ওঁর দ্বিতীয়। প্রথম বই মুশকিল
আসান (১৯৫৪) ছিল একটি নাটক। বকুলতলা পি.এল. ক্যাম্পের
মুখ্য চরিত্র হল সদ্য পাশ করা তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ঋতব্রত,
যার প্রথম চাকরিস্থল বকুলতলার উদ্বাস্তু কলোনী। সরকারী
চাকরি, কাজ হল সেখানকার বাড়ি-ঘর তৈরি, সারাই ইত্যাদির
তদারক করা। বইটি পড়তে পড়তে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, উপন্যাসে
লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও হয়তো কিছুটা জড়িয়ে আছে। এমন
কি দুয়েকটি চরিত্রে সে সময়কার নামিদামি সরকারী ইঞ্জিনিয়ারদের
ছায়াও কেউ কেউ দেখতে পেয়েছিলেন।
কর্তব্যপরায়ণ ইঞ্জিনিয়ার
ঋতব্রত কী ভাবে অসত্ ঠিকাদার ও ধুরন্ধর সরকারী কর্মচারীদের
ষড়্যন্ত্র বা প্যাঁচ কাটিয়ে শেষমেষ নিজের সত্যে অবিচলিত
থাকতে পেরেছিল - সেটাই এই কাহিনীর উপজীব্য। সেই সঙ্গে
বোনা হয়েছিল একটি প্রেমের কাহিনী। বছর সতেরোর একটি রিফ্যুজি
মেয়ে কমলা কী ভাবে ঋতব্রতের জীবনে জড়িয়ে পড়ল, তার সরস
উপাখ্যান।
কমলার মা হাসপাতালে
মৃত্যুশয্যায়; সুন্দরী কমলার উপরে ক্যাম্পের কিছু কিছু
বদ্লোকের নজর পড়েছে। কিন্তু ঘটনাচক্রে এমন একটা পরিস্থিতির
সৃষ্টি হয়েছে, ঋতব্রত বুঝে উঠতে পারছে না যে সে কী করতে
পারে। ভাগ্যক্রমে সেই সময়ে দেখা দিলেন ঋতব্রতের পিতৃস্থানীয়
শুভ্রকেশ আজন্ম বেপরোয়া সঞ্জীব চৌধুরী। ঘটনাটা জানতে পেরে
ব্যারাকে গিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত কমলাকে বললেন, তোমার এখানে
থাকা চলবে না।....
তবে কোথায় থাকবো আমি?
অzাট হিজ প্লেস। ওর রান্না করার লোক নেই - তোমার থাকার
জায়গা নেই। সো অফার মিউচুয়াল হেল্প।
কমলাকে রাজি করালেন
সঞ্জীব চৌধুরী; সে এসে ঋতব্রতের সংসারের হাল ধরল। ধীরের
ধীরে প্রেমে পড়ে গেল কাজ-পাগলা মানুষটার, যদিও জানতো একটি
নিঃসম্বল রিফ্যুজি মেয়ের পক্ষে ঋতব্রতকে পাবার আশা করা
আকাশস্পর্শী স্পর্ধা। এদিকে ঋতব্রতও নিজের অজান্তেই কমলার
প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু জ্ঞানতঃ তখনও সে প্রেমে হাবুডাবু
খাচ্ছে কলকাতার বড়ঘরের এক শৌখীন মেয়ে রেখা মিত্তিরের।
কমলার দিকে তাকানো হবে অশোভন, তাই কমলার শাড়ী ব্লাউজের
দশা যে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হচ্ছে তা নজরে পড়ে নি। কমলাই
শেষে একদিন ঋতব্রতে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো ওর জামাকাপড়ের
অবস্থা। অতি-লজ্জিত ঋতব্রত শাড়ি কেনার টাকা দিয়ে ওর মাইনের
ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। কমলা শাড়ির
টাকাতো নিলোই না, রাগে অভিমানে কথা বন্ধ করে দিল। মহা
বিপদ! ভাগ্যক্রমে সেই সঞ্জীব চৌধুরীই আবার বেড়াতে এলেন।
তিনিই উদ্যোগ করে ঋতব্রতকে নিয়ে কমলার শাড়ী-ব্লাউজ কিনে
আনলেন। জোর করে কমলাকে সেই শাড়ি ব্লাউজ পড়ে আসতে বললেন।
মুগ্ধ বিস্ময়ে ঋতব্রত
দেখল, সবুজ রঙের ডুরে শাড়িটা জড়িয়ে উঠেছে কমলার তনুদেহ।
সদ্য স্নান করে ভিজে চুল খুলে দিয়েছে পিঠের উপর। পাউডারের
প্রলেপ লেগে রয়েছে রজনীগন্ধার ডাটার মত গ্রীবার পাশ্র্বে।
কপালের মাঝখানে একটি বড় সিঁদুরের টিপ্। প্রসাধনের একটা
স্নিগ্ধ মৃদু সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। ওদের মুগ্ধ দৃষ্টির
সামনে চোখ নিচু করল কমলা। ফুটে উঠলো অনভ্যস্ত সজ্জার সলজ্জ
হাসি। টোল পড়ল গালে।
কিন্তু কেন কমলা
ঋতব্রতের উপর এত রাগ করল টাকা মাইনে নেওয়ার ব্যাপারে।
ঋতব্রত তখনও বুঝে উঠতে পারছে না (এসব ব্যাপারে ইঞ্জিনিয়াররা
বোধহয় একটু গবেটই হয়! রোম্যাণ্টিক ইঞ্জিনিয়ার পাঠকদের
কাছে মাপ চেয়ে নিচ্ছি - ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে।)।
যাবার আগে সঞ্জীব চৌধুরী ব্যোমশেলটা ফাটিয়ে গেলেন, য়ু
আর এ রিয়েল সিম্পল্টন। এ ফুল!
এ কথার মানে কি?
শি লাভস য়ু ইডিয়ট!
কি হল শেষে? কে ঋতব্রতের
জীবনে শেষ পর্যন্ত এলো - রেখা মিত্তির না কমলা? এ প্রশ্নটা
বুদ্ধিমান পাঠকদের না করাটাই উচিত।
বকুলতলা পি.এল. ক্যাম্প
নারায়ণ সান্যালের শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর মধ্যে নিশ্চয় পড়ে
না। কিন্তু ঐ প্রথম উপন্যাসেই উনি বহু তরুণ পাঠকের মন
জয় করেছিলেন। সেইসব পাঠকদের মধ্যে একজনকে অন্ততঃ জানি,
যে বইটা আবার হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করবে না।
সুজন
দাশগুপ্ত