পুরনো
দিনের বই - নীলাঙ্গুরীয়
বিভূতিভূষণ
মুখোপাধ্যায়ের কৌতুক গল্পের বই 'বরযাত্রী'র
ছয় বন্ধু গণশা, ঘোঁতনা, ত্রিলোচন, গোরাচাঁদ,
রাজেন আর কে. গুপ্তের সঙ্গে পরিচয় নেই বাংলা
সাহিত্যের এমন পাঠক বোধহয় কমই আছেন। অল্প
দু চার কথায় কি করে জীবন্ত চরিত্রদের সৃষ্টি
করা যায় বা একটা সমাজকে এরকম সুস্পষ্ট ভাবে
তুলে ধরা যায় - বিভূতিভূষণ সেটি অতি সহজে
সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন। কৌতুক রসের এরকম বই
বাংলা সাহিত্যে বেশি নেই। কৌতুক রসের ওঁর
আরেকটি বিখ্যাত সৃষ্টি 'রানু' সিরিজের গল্পগুলি।
কিন্তু বিভূতিভূষণের প্রতিভা ছিল বহুমুখী।
ছোটদের জন্য পুজোসংখ্যায় উনি নিয়মিত লিখেছেন,
'পোনুর চিঠি' ও অন্যান্য নানান গল্প - যা
বুড়োরাও পরম উৎসাহে পড়েছে। ওঁর ভ্রমণধর্মী
রচনাগুলি, যেমন 'কুশী প্রাঙ্গনের চিঠি', 'দুয়ার
হতে অদূরে' বা 'অযাত্রার জয়যাত্রা' অত্যন্ত
সুখপাঠ্য। তিন খণ্ডে উনি লিখেছেন 'স্বর্গদপী
গরিয়সী'। যার নায়ক নায়িকা - বিভূতিভূষণের
নিজের পিতা মাতা। তিনি নিজেও (শৈলেন) স্থান
পেয়েছেন সেই বইয়ে। এতে জীবনের নানান উপলব্ধি
প্রায় দার্শনিকের দৃষ্টিতে তিনি উপস্থাপিত
করেছেন।
এযুগের পাঠক গণশা
ঘোঁতনার রচয়িতা হিসেবে বিভূতিভূষণকে চিনলেও
এক সময়ে ওঁর জনপ্রিয়তম উপন্যাস ছিল 'নীলাঙ্গুরীয়'।
আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে (বাংলা ১৩৪৯ সালে)
প্রকাশিত এই বইটির ভূমিকায় উনি লিখেছিলেন:
শনিবারের
চিঠিতে 'কশ্চিত্ প্রৌঢ়' 'ভালোবাসা' শীর্ষক
একটি রচনা প্রকাশ করেন। লেখক তাহাতে ভালোবাসার
নানা বৈচিত্র্য সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া শেষে
পাঠকের নিজের নিজের অভিমত জানাইবার জন্য আহবান
করেন। ..... কশ্চিত্ প্রৌঢ়ের আহবানে আমি ভালবাসা
নামক একখানি গল্প শনিবারের চিঠিতে প্রকাশ
করি। ..... তাহাতে দেখাইয়াছি ভালবাসার সঙ্গে
মার খাওয়াইবার ইচ্ছা থাকাও বিচিত্র নয়। বৃত্তিটির
জটিলতার আরও একটি দিক দেখাইবার ইচ্ছা থাকায়
এই বইখানির অবতারণা।..... আর একটা কথা - নীলাঙ্গুরীয়
কৌতুক রসের লেখা নয়। গোড়া থেকেই অন্যবিধ প্রত্যাশায়
থাকিয়া পাঠে বাধা জন্মাইতে পারে বলিয়া এটুকু
বলিয়া দেওয়া প্রয়োজন মনে করিলাম।
উপন্যাসটির নায়ক
শৈলেন হল সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালীর সন্তান।
সদ্য বি.এ পাশ করেছে - গল্প কবিতা লেখে। হঠাৎ
পত্রিকায় একটি চাকরির বিজ্ঞাপন তার দৃষ্টি
আকর্ষণ করল। এক ব্যারিষ্টার তাঁর নয় দশ বছর
বয়েসের কন্যার জন্য একজন গ্র্যাজুয়েট গৃহশিক্ষক
খুঁজছেন। আবেদনকারীকে স্বয়ং এসে সাক্ষাৎ করতে
হবে। শৈলেন সেখানে গিয়ে ব্যারিস্টারের দেখা
পেল না; যার দেখা পেল - সে ব্যারিস্টারের
অষ্টাদশী কন্যা মীরা। বোঝা গেল সেই মোটামুটি
বাড়ির কর্ত্রী । শৈলেনের কথায়:
ব্যারিস্টার
সম্বন্ধেই ভাবিয়া আসিয়াছি, তাহার কন্যার সম্বন্ধে
কোনোরকম গড়াপেটা ধারণা নাই। এ জীবগুলি আবার
কি জাতীয় হওয়া সম্ভব, চেয়ারে বসিয়া নানারকম
জল্পনা-কল্পনা করিতেছি, এমন সময় মীরা উপর
হইতে নামিয়া আসিয়া একটি চেয়ারের পেছনে দাঁড়াইল।
মাথায় পরিস্কার বাঁকা সিঁথি, হাতে একটি রাঙা
মলাটের বই; একটি আঙুল তার মধ্যে গোঁজা, পায়ে
এক জোড়া জরির কাজ-করা মখমলের স্যাণ্ডেল। প্রথম
দর্শনেই মীরার সব খুঁটুনাটি দেখিয়া লওয়া অল্প
দক্ষতার কাজ নয়; অন্তত আমি তো পারি নাই; তবে
এই তিনটি চোখে যেন আপনিই পড়িয়া গিয়াছিল।
পাঠকদের বলতে
হবে না যে, মীরা আর শৈলেনের পরস্পরের প্রতি
অস্পষ্ট অনুচ্চারিত আকর্ষণই এই উপন্যাসের
মূল উপজীব্য। টান টান করে লেখা এই বই শেষ
পাতা পর্যন্ত পাঠককে ধরে রাখে। চাইলেও শৈলেনের
কাছে মীরা নিজেকে সহজ করে তুলে ধরতে পারে
নি আভিজাত্যের গরিমায়; তার আচরণে বারংবার
মনিব-ভৃত্যের সম্পর্কটাই যেন প্রকট ভাবে প্রকাশ
পেয়েছে। শৈলেন সমাজের উঁচুতলার মীরার এই আকর্ষণকে
পরে উল্লেখ করেছে 'ঘৃণামিশ্রিত ভালোবাসা'
বলে। অন্যপক্ষে শৈলেনও মনঃস্থির করে উঠতে
পারে নি - পারে নি ভালোবাসার দাবী নিয়ে সাহস
ভরে মীরার সামনে এসে দাঁড়াতে। ঘটনাচক্রে দুজনের
ভালোবাসা যখন দুজনের কাছে সুস্পষ্ট হল, তখন
বড় দেরি হয়ে গেছে। মীরার বিয়ে হয়ে গেলেও শৈলেন
আর বিয়ে করে নি। বইয়ের শেষে ইঙ্গিত আছে যে,
সে আর করবেও না। ভালোবাসা খাঁটি সোনা, আর
সেই সুবর্ণটি দেওয়া হয়ে গিয়েছে মীরাকে।
১৯৪৩ সালে সে
যুগের খ্যাতনামা পরিচালক গুণময় বন্দ্যোপাধায়
'নীলাঙ্গুরীয়' বইটি নিয়ে সিনেমা করেছিলেন।
ছবি বিশ্বাস সেজেছিলেন ব্যারিস্টার বাবা।
মীরার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন যমুনা বড়ুয়া,
আর শৈলেন হয়েছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। যদ্দুর
জানি পরে এটি নিয়ে আর কেউ সিনেমা করেন নি।
বিভূতিভূষণ নিজে অকৃতদার ছিলেন। তরুণ বয়সে
উনি একটি কম বয়সী মেয়ের গৃহশিক্ষক ছিলেন বলেও
শোনা যায়। 'নীলাঙ্গুরীয়'র ঘটনাবলী এতো মর্মস্পর্শী
যে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছিল - এর মধ্যে
বিভূতিভূষণের নিজের জীবন কিছুটা লুকিয়ে আছে
কিনা! তবে অনুমান করি, সে বিষয়ে সঠিক কিছু
জানা আর সম্ভব নয়। বিভূতিভূষাণ মারা গেছেন
১৯৮৭ সালে ৯৩ বছর বয়সে; আর মীরা বলে সত্যই
যদি কেউ বিভূতিভূষণের জীবনে থেকে থাকেন, তিনিও
নিশ্চয় এতদিন জীবিত নেই।