প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের বই - রোবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম

ভারতকোষ-এ কান্তিচন্দ্র ঘোষ প্রসঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, 'প্রধানত অনুবাদক হিসেবে যাঁরা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এডওয়ার্ড ফিট্জেরাল্ড এবং কান্তিচন্দ্র ঘোষ একই সূত্রে স্মরণযোগ্য।' দুজনেই পারসীক কবি ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চৌপদী ছাঁদের লেখাগুলিকে অনুবাদ করেছিলেন। কান্তিচন্দ্র ঘোষ মূল ফার্সি থেকে কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন কিনা, সেটা এই লেখকের জানা নেই, সম্ভবতঃ নয়। অলোকরঞ্জন লিখেছিলেন, 'ফিট্জেরাল্ডের করা জগদ্বিখ্যাত ইংরেজি তর্জমা অবলম্বনে' কান্তিচন্দ্র রোবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম লেখেন। যদিও বইটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'বাংলা ছন্দে তুমি ওমর খৈয়ামের যে তর্জমা করেছ তা গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পূর্বেই আমি দেখেছি। এ-রকম কবিতা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় ছাঁচে ঢেলে দেওয়া কঠিন। কারণ এর প্রধান জিনিসটা বস্তু নয়, গতি। ফিট্জেরাল্ডও তাই ঠিকমত তর্জমা করেন নি - মূলের ভাবটা দিয়ে সেটাকে নূতন করে সৃষ্টি করা দরকার।.... মূল কাব্যের এই রসলীলা যে তুমি বাংলা ছন্দে এমন সহজে বহমান করতে পেরেচ এতে তোমার বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে।' নিন্দুকরা হয়তো বলবেন, রবীন্দ্রনাথ নিজে কি ফার্সি-তে ওমর খৈয়ামের লেখা পড়েছিলেন যে একথা লিখলেন? কিংবা রবীন্দ্রনাথ এরকম সার্টিফিকেট অকাতরে অনেককে দিতেন। সে কথা এখন থাক। এখানে শুধু উল্লেখ করা যেতে পারে এই অনুবাদ সম্পর্কে তরিকুল আলম কি বলেছেন: 'মূল পার্শি ভাষা পড়া সত্বেও .... এই অনুবাদ পড়িয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছি। ....যাঁরা মূল পার্শি পড়িতে পারেন তাঁহারাও যেন কান্তিবাবুর অনুবাদটি পড়িতে না ভুলেন।'

ওমর খৈয়াম নিজে ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। সারাজীবন বিজ্ঞানের সাধনাই তিনি করেছিলেন, কাব্যের নয়। অথচ কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। সম্ভবতঃ তার কারণ, তাঁর কবিতা শুধু ভাষা আর ভাবের ফুলঝুরি নয়, এগুলো রচিত হয়েছিল গভীর দার্শনিক অনুভূতি থেকে। প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন, 'যাঁদের মতে 'জগৎ মিথ্যা ব্রহ্ম সত্য', তাঁরা আমাদের উপদেশ দেন -

মায়াময়মিদং অখিলং হিত্বা
প্রবিশানু ব্রহ্মপদং বিদিত্বা।

ওমরের মতে কিন্তু 'মায়ময়মিদং অখিলং' হচ্ছে একমাত্র সত্য - অবশ্য সার সত্য নয় অসার সত্য। তিনি তাই উপদেশ দিয়েছেন -

এক লহমা সময় আছে সর্ব্বনাশের মধ্যে তোর
ভোগ-সায়রে ডুব দিয়ে কর্ একটা নিমেষ নেশায় ভোর।

বলাবাহুল্য ওমরের মুখে এ কথা হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাণী। এ জীবনের যখন কোন অর্থ নেই, তখন যা ইন্দ্রিয়গোচর আর যা অনিত্য তাকেই বুকে টেনে নিয়ে আসা যাক, তাকেই উপভোগ করা যাক।.... তাঁর কবিতায় বিশ্বের বিরুদ্ধে মানবাত্মার এই বিদ্রোহ, উপহাস, বিদ্রুপের আকারে ফুটে বেরিয়েছে; কিন্তু তাঁর সকল হাসিঠাট্টার অন্তরে একটা প্রচ্ছন্ন কাতরতা আছে, এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব। ওমর খৈয়ামের কবিতা যে আমাদের এতটা মুগ্ধ করে তার প্রধান কারণ, তিনি দার্শনিক হলেও কবি, চমৎকার কবি। দর্শন তাঁর হাতে জ্যামিতির প্রতিজ্ঞার আকার ধারণ করে নি, ফুলের মত ফুটে উঠেছে।'

কান্তিচন্দ্রের অনুবাদও সেই ফুলকে ম্লান হতে দেয় নি। বরং বাংলার জল-বাতাস ছুঁইয়ে আরও প্রস্ফুটিত করেছে। ওমর খৈয়ামের অন্যান্য যেসব অনুবাদ বাংলায় রয়েছে - সেগুলি যদি ওমর খৈয়ামের লেখাগুলির ছন্দ ও ভাব পুরোপুরি অনুসরণ করেও থাকে - তার কোনোটাই কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদের মত জনপ্রিয়তা অর্জন করে নি। কান্তিচন্দ্র ফিট্জেরাল্ডের লেখা থেকে অনুবাদ করে থাকলেও, তাঁর লেখা স্বাদে-গন্ধে পরিপূর্ণ ভাবে বাঙলা। রবীন্দ্রনাথের কথায়, 'কবিতা লাজুক বধূর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আস্তে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙ্গেচ, তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে।'

ফিট্জেরাল্ড যেখানে লিখেছেন,

Here with loaf of bread
               beneath the bough,
A flask of wine, a book of
               verse and thou,
Besides me singing in the wilderness
And wilderness is paradise enow.

কান্তিচন্দ্র সেখানে লিখেছেন,

সেই নিরালা পাতায় ঘেরা
               বনের ধারে শীতল ছায়
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে
               ছন্দ গেঁথে দিনটা যায় !
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে
               গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর -
সেইতো সখি স্বপ্ন আমার,
               সেই বনানী স্বর্গপুর !


এককালে আমাদের দেশে বিয়ে তে বই দেওয়ার চল ছিল। তখন যে বইগুলি বর-বৌ পেতো সেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রাধান্য থাকলেও, কান্তিচন্দ্র ঘোষের 'রোবাইয়াত্ ই ওমর খৈয়াম'-এরও উচ্চস্থান ছিল। সে দিন এখন আর নেই। বইকে অনেকেই আমরা ভুলতে বসেছি। সৈয়দ মুজতবা আলী এক জায়গায় লিখেছিলেন, 'রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা - যদি তেমন বই হয়। তাই বোধ করি খৈয়াম তাঁর বেহেশ্তের সরঞ্জামের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কেতাবের কথা ভোলেন নি।' আমি যোগ করব, সেই 'তেমন' বইয়ের মধ্যে কান্তিচন্দ্রের অনুবাদটিও পড়বে।

সুজন দাশগুপ্ত

 

 

 

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।