পুরনো
দিনের বই - ভীমপলশ্রী
বাংলাসাহিত্যে সিচুয়েশন
কমেডি বেশি নেই। সিচুয়েশন কমেডি পড়ার পাঠক নেই, সেটা বিশ্বাস
করাটা একটু কঠিন। ইংরেজি জানা বাঙালী পাঠকদের মধ্যে পি.জি.
ওডহাউস বা বেন ট্র্যাভার্স-এর লেখার সঙ্গে পরিচিত নন - তেমন
প্রায় কাউকেই আমার চোখে পড়ে নি। তবু বাঙালী লেখকরা কেন সাহিত্যের
এই শাখাটির দিকে নজর দেন নি, সেটা একটু রহস্যই। দিলে তাঁরা
ঠকতেন না, পাঠকরাতো নয়ই।
তবে
সৌভাগ্যক্রমে বাংলা সিচুয়েশন কমেডির ভাণ্ডার একেবারে শূন্য
নয়, কিছু কিছু রত্ন সেখানে রয়েছে, যাদের মধ্যে ভীমপলশ্রী
নিঃসন্দেহে একটি। ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত এই বইটির লেখক
ছিলেন বনফুল (বলাইচাঁদ মুখপাধ্যায়)। বইটি বনফুলের মৌলিক
রচনা অবশ্য নয়। এককালে বেন ট্র্যাভার্সের মিসচিফ, ক্যুক্যু
ইন দ্য নেস্ট, রুকারি নুক, প্রভৃতি সিচুয়েশন কমেডি খুবই
জনপ্রিয় ছিল। তারই একটি, ক্যুক্যু ইন দ্য নেস্ট-এর কাহিনীকে
ভিত্তি করে বনফুল এটি লেখেন। কিন্তু বনফুলের প্রসাদগুণে
এবং কাহিনীর অল্পবিস্তর পরিবর্তনের জন্য এতে বিদেশের কোনও
ছায়া পাওয়া যাবে না।
ভীমপলশ্রীর নায়ক হল
সুশোভন। "সার্থকনামা ব্যক্তি।.... কান্তি অনিন্দ্য,
ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্সও অনিন্দ্য।.... সুদের টাকা উপভোগ করতে
করতে ক্যাপিটালিজিমের নিন্দা করে তিনি অবসর ও চিত্ত বিনোদন
করতেন। কমরেড বান্ধবীও জুটেছিল কয়েকটি। .... কমরেড অনীতার
সঙ্গে আলাপ অনেক দিন আগেই হয়েছিল - তবে অভিনব অনুভূতিটা
হঠাৎ উথলে উঠল একদিন এবং শেষ পর্যন্ত সামলানো গেল না। বিয়েই
করতে হল।"
কমরেড অনীতার মা অসাধারণ
মহিলা স্বয়ম্প্রভা সরকার। পাড়ার সকলের অন্তরে অবিমিশ্র ভীতি
ছাড়া অন্য কিছু ভাব উৎপাদন করতে তিনি ইচ্ছুক ছিলে না। তাঁর
ঘোরতর আপত্তি ছিল এই বিয়েতে। তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত সমাজের
সুশোভনকে তিনি বিশ্বাস করতেন না।
অনীতা সুশোভনের স্ত্রী
হলেও এই গল্পের নায়িকা কিন্তু সে নয়। নায়িকা হল শিক্ষিতা
ও সুন্দরী আরেক প্রাক্তন কমরেড সান্ত্বনা। সুশোভনের সঙ্গে
মাখামাখি ছিল এক সময় (প্রাক্-অনীতা যুগে)। একবার একজন লেখকের
লেখায় মু±ধ হয়ে তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ ঘনিষ্ঠতা করে সমাজহিতৈষীদের
নিন্দাভাজন হয়েছিল সান্ত্বনা । তারপরেই অনেকের কাছ থেকে
নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পরে গুরুগম্ভীর অধ্যাপক ব্রজেশ্বর দে-র
সঙ্গে আলাপ হয় এবং তাঁর সঙ্গেই বিয়ে হয়।
এছাড়া এই বইয়ে আছেন
পরম পরোপকারী সদারঙ্গ বিহারীলাল, যিনি সবজায়গাতেই হঠাৎ হঠাৎ
উপস্থিত হন এবং নিজের অজান্তেই এক একটা জটিলতার সৃষ্টি করেন।
আছেন ব্রাহ্ম জমিদার দিগবিজয়বাবু এবং তাঁর স্ত্রী সান্ত্বনার
পাতানো মাসি সুরেশ্বরী দেবী। অন্যান্যদের মধ্যে ফাতনাফিঙ্গিপুরের
হরিমটর পান্থনিবাসের মালিক নিষ্ঠাবান শ্লীলমনা গোঁসাইজী,
সুরেশ্বরী দেবীর আত্মীয় মদ্যসেবী ছকুবাবু, অনীতার বাবা গিন্নীর
ভয়ে সদাভীত জিতু সরকারের উপস্থিতিও রসবস্তুকে ঘন করেছে।
দিগবিজয়বাবুর বাড়িতে
নেমন্তন্ন রক্ষা করতে গিয়ে অনীতাকে ট্রেনে বসিয়ে প্ল্যাটফর্মে
হঠাৎ সান্ত্বনাকে পিছলে পড়তে দেখে তাকে সামলাতে যাওয়া; ফলে
ট্রেন মিস্। সান্ত্বনাও দিগবিজয়বাবুর কাছে যাচ্ছে জেনে একসঙ্গে
ট্যাক্সিতে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা; পথে গাড়ি খারাপ হওয়ায়
দুজনের হরিমোটর পান্থনিবাসে রাত্রি কাটানো। সেই খবর সদারঙ্গবিহারীলালের
কৃপায় চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া। দুশ্চরিত্র (!) সুশোভনকে হাতেনাতে
ধরবার জন্য স্বয়ম্প্রভার গোয়েন্দাগিরি এবং রঙ্গমঞ্চে ব্রজেশ্বর
দের আবির্ভাব। নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে অবশেষে অনীতা-সুশোভনের
ভুল-বোঝাবুঝির সমাপ্তি।
ভীমপলশ্রী বইটি চিত্রায়িত
হয় একটি রাত নাম নিয়ে। উত্তমকুমার সেজেছিলেন সুশোভন, সুচিত্রা
সেন সান্ত্বনা। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী
(গোঁসাইজী), জীবন বসু (সদারঙ্গবিহারীলাল), মলিনাদেবী (স্বয়ম্প্রভা),
সবিতা বসু (অনীতা), পাহাড়ী সান্যাল (দিগবিজয়বাবু), ভানু
বন্দ্যোপাধ্যায় (ছকুবাবু), প্রভৃতি। বইটি ছবি হিসেবে তেমন
সাফল্য লাভ করে নি। বাঙালী দর্শক বোধহয় সুচিত্রা-উত্তমের
রোমান্স ও মিলন দেখতে এত অভ্যস্থ যে, ছবিতে বাধ্য হয়ে ওঁদের
একসঙ্গে এক রাত কাটানো এবং পরে সানন্দে নিজের স্বামীর বা
স্ত্রীর কাছে ফিরে যাওয়াটা তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে
নি।
প্রসঙ্গত: বাংলা সাহিত্যে
ক্ষুদ্রতম ছোটগল্পের জনক বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) পেশায়
ছিলেন ডাক্তার। ১৯২৭ সালে পাটনা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারী
পাশ করে ৪০ বছর ধরে ভাগলপুরে প্যাথলজিস্ট কাজ করেন। প্রথম
উপন্যাস তৃণখণ্ড ডাক্তারী জীবনের প্রথম দিকে লেখা। সাহিত্যজীবনে
শতাধিক বই তিনি লিখেছেন। বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে স্থাবর,
জঙ্গম, অগ্নীশ্বর (ব্যাঙ্গরচয়িতা ডাক্তার বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের
উপর ভিত্তি করে), হাটে বাজারে, ইত্যাদির নাম করা যায়। পাখীর
জীবনকে কেন্দ্র করে ওঁর উপন্যাস ডানা একটি অমূল্য সৃষ্টি।