চাঁদনী থেকে ন'সিকে দিয়ে একটা শর্ট
কিনে নিয়েছিলুম। তখনকার দিনে বিচক্ষণ বাঙালীদের জন্য
ইউরোপীয়ন থার্ড নামে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান
ভারতের সর্বত্র আনাগোনা করত।
হাওড়া স্টেশনে সেই থার্ডে উঠতে যেতেই একটা ফিরিঙ্গি
হেঁকে বলল, "এটা ইউরোপীয়ানদের জন্য।"
আমি গাঁক গাঁক করে বললুম, "ইউরোপীয়ন তো কেউ নেই,
চল, তোমাতে আমাতে ফাঁকা গাড়িটা কাজে লাগাই।"
একটা তুলনাত্মক ভাষাতত্বের বইয়ে পড়েছিলুম, "বাঙলা
শব্দের অন্ত্যদেশে অনুস্বার যোগ করিলে সংস্কৃত হয়; ইংরেজি
শব্দের প্রাগদেশে জোর দিয়া কথা বলিলে সায়েবী ইংরেজি
হয়।" অর্থাত্ পয়লা সিলেবেলে অ্যাকসেন্ট দেওয়া খারাপ
রান্নায় লঙ্কা ঠেসে দেওয়ার মত - সব পাপ ঢাকা পড়ে যায়।
সোজা বাঙলায় এরি নাম গাঁক গাঁক করে ইংরেজি বলা।
এইভাবেই
শুরু হয়েছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণকাহিনী দেশেবিদেশে
। তবে এটিকে নিছক ভ্রমণ কাহিনী বলা উচিত হবে না। হাল্কা
চালে লেখা এ বইটিতে ভাষাতত্ববিদ আলীসাহেব তাঁর রসবোধ,
পাণ্ডিত্য, পর্যবেক্ষণশক্তি, অনুসন্ধিৎসা, বিশ্লেষণক্ষমতা
- সবকিছুই পরিপূর্ণ ভাবে তুলে ধরেছেন সাহিত্যরসে সিক্ত
করে। ১৯৪৯ সালে দেশ পত্রিকায় এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত
হবার আগে দেশ-এর তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষ সাহিত্যিকদের
এক আড্ডায় বলেছিলেন, 'এর জাতি-পাঁতি স্বতন্ত্র। উপন্যাস
এর ধারে কাছে লাগে না।' শুধু তাই নয়, ওঁর ভবিষ্যৎবাণী
ছিল: 'এই এক বই লিখেই ইনি (সৈয়দ মুজতবা আলী) বাংলা সাহিত্যে
পাঠকচিত্ত জয় করবেন' (সম্পাদকের বৈঠকে - সাগরময় ঘোষ)।
এই ভবিষ্যৎবাণী যে কত নির্ভুল ছিল, এ যুগের পাঠকরা না
জানলেও পঞ্চাশ ষাট দশকের পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন।
দেশেবিদেশে-র পটভূমি ছিল আফগানিস্তান। শান্তিনিকেতনের
পাঠ সমাপ্ত করে মাত্র তেইশ বছর বয়সে অধ্যাপকের চাকরি
নিয়ে তিনি স্বল্পকালের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। ১৯২৯
সালে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহী বাচ্চায়ে সাকাওর
(হাবিবুল্লা গাজী) ভয়ে আফগানিস্তানের প্রগতিশীল আমীর
আমানুল্লা খান পালিয়ে গেলে ঘোর অরাজকতার মধ্যে মুজতবা
আলী কোনওমতে প্রাণ বাঁচিয়ে ভারতবর্ষে ফিরে আসতে সমর্থ
হন। স্বল্প পরিসরের মধ্যে সেই সময়কার আফগানিস্তানের
একটা সুন্দর সামাজিক চিত্র পাঠকরা বইটিতে পেয়ে যাবেন।
পরে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে শবনম নামে একটা প্রেমের
উপন্যাসও মুজতবা আলী লিখেছিলেন। আফগানিস্তানের অভিজাত
পরিবারের উনিশ বছরের এক সুন্দরী কন্যার সঙ্গে কাবুলে
অধ্যাপকের চাকরি করতে আসা এক তরুণ বাঙালীর প্রেমগাথা
- যার নিদারুণ পরিসমাপ্তি আবার সেই গৃহযুদ্ধেই। প্রসঙ্গতঃ,
মুজতবা আলী নিজে কাবুল থেকে যখন ফিরে আসেন, তখন তাঁর
বয়স ছিল ২৫ বছর। শবনম কল্পনার কাহিনী, তবে টান-টান করে
লেখা কাব্যময় এই রোমান্সটা পড়তে পড়তে মনে হওয়া স্বাভাবিক
যে, কোথাও হয়তো সত্যের কিছু ছায়া আছে।
মুজতবা আলী অজস্র
ভাষা জানতেন - ইংরেজি, ফরাসী, জার্মান, ফারসী, আরবী,
হিন্দী, উর্দু, গুজরাতী, ইত্যাদি। তাঁর লেখায় নানা দেশের
সাহিত্যের কথা তাই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। বিভিন্ন
ধর্ম সম্পর্কে ওঁর জ্ঞান ছিল গভীর। শান্তিনিকেতন থেকে
বি.এ পাশ করে কলকাতা ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন
পড়ে তিনি জার্মানীতে গিয়ে তুলনামূলক ধর্ম নিয়ে ডক্টরেট
অর্জন করেন। কায়রোর বিখ্যাত অল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও
কিছুদিন পড়াশুনো করেন। প্রথম জীবনে পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধই
বেশি লিখেছেন, কিন্তু সাহিত্যজগতে ওঁর পরিচিতি রম্যরচনার
জন্য। আড্ডার মেজাজে হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে বহু গভীর
তত্বকথা অতি সহজে পাঠকদের বুঝিয়ে দেবার অপরিসীম ক্ষমতা
ছিল ওঁর। একবার উনি বলেছিলেন, 'কত কষ্ট করে যে সহজে
লিখি তা জানবে কি করে?' যাঁদের শান্তিনিকেতনে বা অন্য
কোথাও সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে আড্ডা দেবার সুযোগ হয়েছে,
তাঁরা বুঝবেন এটা ওঁর বিনয়। যাঁর এতো রসবোধ আর জমিয়ে
গল্প করার ক্ষমতা, তাঁর কলম কখনো থেমে থেমে চলতে পারে
না।
মুজতবা আলীর জন্ম
১৯০৪ সালে মৃত্যু ১৯৭৮ সালে। ওঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে
রয়েছে পঞ্চতন্ত্র, চাচা-কাহিনী, ময়ূরকণ্ঠী, জলে ডাঙায়,
চতুরঙ্গ, গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন, ইত্যাদি।
সুজন
দাশগুপ্ত