পুরনো
দিনের বই - দৃষ্টিপাত
যাযাবরের
গল্প-উপন্যাসগুলি নিয়ে কয়েকবছর আগে দে'জ পাবলিশিং এক
খণ্ডে 'যাযাবর অমনিবাস' প্রকাশ করেছে। বইটির মুখবন্ধে
রয়েছে 'লেখকের প্রথম বই 'দৃষ্টিপাত' প্রকাশিত হওয়া মাত্রই
বাঙালী শিক্ষিত সমাজে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল তাহা
যেমন বিস্ময়কর তেমনি অভূতপূর্ব। সেকালের বিমুগ্ধ পাঠক
সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও এই বই-এর অনেক লাইন, অনেক অংশ
স্মৃতি থেকে উদ্বৃìত করতে পারেন। বস্তুতঃ এক নতুন গদ্যরীতি
ও অভিনব রচনা-শৈলীর চমত্কারিত্বে দৃষ্টপাত বাংলা রম্যরচনার
ক্ষেত্রে trend-setter - পথিকৃতের আসন দখল করিয়া রহিয়াছে।'
কথাগুলি অতিশয়
খাঁটি। বলা বাহুল্য, 'দৃষ্টিপাত' যাযাবর সবার জন্য
লেখেন নি। 'দৃষ্টিপাত'-এর পটভূমিকা হল স্যার স্ট্যাফোর্ড
ক্রীপসের মিশন - ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে
একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর গল্প বলার জন্য যে আঙ্গিকটা
যাযাবর বেছেছিলেন সেটাও অভিনব - একজনের চিঠির মাধ্যম
(Belles Letters-এর মত)। বইটির মুখবন্ধে তিনি বলেন
যে, ক্রিপস মিশন সম্পর্কে লেখার জন্য বিলেত ফেরত এক
বাঙালী যুবক বিদেশী পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে
দিল্লীতে যায়। সেখান থেকে তার বান্ধবীকে যে চিঠিগুলি
সে লেখে - রচনাগুলি সেখান থেকেই সংকলিত। 'দৃষ্টিপাত'-এ
রাজনৈতিক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে ইতিহাস, স্থাপত্য,
সঙ্গীত, মনুষ্যচরিত্র নিয়ে নানান আলোচনা। নিরস ভাবে
নয়, গল্প ও ঘটনার সহজ প্রবাহের সঙ্গেই সেগুলি এসেছে;
করেছে বইটিকে তথ্য-সম্বৃদ্ধ। বিভিন্ন বিষয়ে পত্রলেখকের
প্রচুর মতামত বইটিতে ছড়িয়ে আছে। এযুগের পাঠকদের সঙ্গে
সেগুলি নাও মিলতে পারে, কিন্তু চিন্তাভাবনা করার বহু
খোরাক সেখানে আছে।
'দৃষ্টিপাত'-এর
নানান খণ্ড কাহিনীর মধ্যে যেটি মধ্যে যেটি মনে সবচেয়ে
দাগ কাটে সেটি হল একটি মারাঠি যুবক চারুদত্ত আধারকারের
সঙ্গে এক বিবাহিতা বাঙালিনী সুনন্দার প্রেমকাহিনী।
সুনন্দাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে আধারকার বাঙলা শিখলেন, পড়লেন
রবীন্দ্রনাথ। সুনন্দাও অকুণ্ঠ চিত্তে আধারকারকে দিলেন
তাঁর হৃদয়। উভয়ের উদ্বেলহৃদয়ের গভীর ভাবাবেগ সমাজ-সংসারের
সমস্ত ক্ষুদ্রতা ও কলঙ্কের উর্ধে দেবমন্দিরের পবিত্র
হোমাগ্নির মত যেন জ্বলতে লাগল।
তারপর একদিন
নিভে গেল সে আগুনের শিখা। সুনন্দার তরফ থেকে আর সাড়া
পাওয়া গেল না। মোহমুক্তি? কলঙ্কের ভয়? কারণ জানা কঠিন।
পত্রলেখক তার কারণ হিসেবে বান্ধবীকে লিখেছেন: সে (সুনন্দা)
নারী। প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার
নয়, যেমন পুরুষের কাছে.....তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র
পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন
।
কথাটা কি সত্যি,
না পক্ষপাতদুষ্ট পুরুষের উক্তি! সে যাইহোক, ব্যর্থ
প্রেমও তো মূল্যহীন নয়। তাই লেখক আধারকারকে দিয়ে বলিয়েছেন,
(আমি) পরিহাসকে মনে করেছি প্রেম; খেলাকে ভেবেছি
সত্য। কিন্তু আমি তো একা নই। জগতে আমার মতো মুর্খরাই
তো জীবনকে করেছ বিচিত্র; সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত।
.....তাদের , ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন
কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গান, শিল্পী অঙ্কন করেছেন চিত্র,
ভাস্কর পাষাণখণ্ডে উত্কীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা ।
এর মধ্যেই বোধহয়
আধারকার খুঁজেছেন সুনন্দাকে হারানোর সান্ত্বনা। কিন্তু
এত বছর বাদেও সেই ক্ষত কি মিলিয়ে গেছে? দৃষ্টিপাতের
শেষ লাইনগুলি এখনও অনেক পাঠকের মুখস্ত আছে: প্রেম
জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে
দেয় কি? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন
করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ
হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।
যাযাবর ছদ্মনামের
পেছনে আসল ব্যক্তিটি বিনয় মুখোপাধ্যায়। চাকরি জীবনে
ছিলেন ইণ্ডিয়ান ইনফরমেশন সার্ভিসের একজন পদস্থ কর্মচারী;
প্রেস কাউন্সিলের কার্যাধক্ষ (সেক্রেটারি) হিসেবে
অবসর নেন। দুয়েকটি প্রবন্ধ ও খেলাধূলার উপর লেখা বইগুলি
ছাড়া এই ছদ্মনামের আড়ালেই তিনি বরাবর ছিলেন।
'দৃষ্টিপাত'
বই হিসেবে প্রকাশিত হয় বাংলার ১৩৫৩ সালে। তার আগে ধারাবাহিক
ভাবে মাসিক বসুমতীতে (বর্তমানে বিলুপ্ত) এটি প্রকাশিত
হয়েছিল। সেই সময়ে বইটি একটা আলোড়নের সৃষ্টি করে। ১৯৫০
সালে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ বই হিসেবে
'দৃষ্টিপাত' নরসিংহ দাস পুরস্কারে সন্মানিত হয়। ১৯৬০
সালে এর হিন্দী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অন্যান্য কয়েকটি
ভাষাতেও ওঁর লেখা অনূদিত হয়েছে। সাহিত্যকীর্তির জন্য
পরে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কাছ থেকে উনি বিদ্যাসাগর পুরস্কার
পান।
যাযাবর
বেশী লেখেন নি। 'দৃষ্টিপাত'-এর পরে আর কয়েকটি মাত্র
বই উনি লিখেছিলেন: 'জনান্তিক', 'ঝিলম নদীর তীর' (কাশ্মীরে
হানাদারদের আক্রমণ নিয়ে), 'লঘুকরণ', হ্রস্ব ও দীর্ঘ'
এবং 'যখন বৃষ্টি নামল'। ওঁর স্বনামে লেখা মাত্র দুটি
বইয়ের কথাই মনে পড়ছে 'খেলার রাজা ক্রিকেট'ও 'মজার খেলা
ক্রিকেট'। ওঁর প্রতিটি বই-ই জনপ্রিয় হয়েছিল। কেন উনি
আরও লেখেন নি, তা নিয়ে ভক্ত পাঠকদের একটা ক্ষোভ চিরদিনই
রয়ে যাবে।