বাঙালী
পাঠকসমাজে সুবোধ ঘোষ এখন প্রায় বিস্মৃত
– এই কথাটা যদি সাহস করে বলতে যাই,
তাহলে অনেকেই ঘোর প্রতিবাদ করবেন। আমাকে
স্মরণ করিয়ে দেবেন - ফসিল, জতুগৃহ,
অযান্ত্রিক, জিয়াভরলি ইত্যাদি গল্প
ও উপন্যাসের কথা। এগুলো না হয় বাদ দেওয়া
গেল, কিন্তু ভারত প্রেমকথা-র মত বর্ণাঢ্য,
রূপাঢ্য, ধ্বনিসুন্দর (প্রমথনাথ বিশীর
বর্ণনা) গল্পগুলো আমি ভুলে যাই কি করে?
তার উপর সুবোধ ঘোষের বহুবন্দিত উপন্যাস
‘সুজাতা’-তো গোটা ভারতবর্ষে অমরত্ব
লাভ করেছে বিমল রায়ের ১৯৫৯ সালের হিন্দি
ছবি ‘সুজাতা’-র কল্যাণে। উপন্যাসের
অন্ত্যজ কন্যা অম্বালিকা বা অম্বির
কথা উঠলে এখনও অনেকের চোখে ভাসে সুন্দরী
অভিনেত্রী নূতনের মুখ।
সব
মানি, কিন্তু এগুলো তো চল্লিশ-পঞ্চাশ
বছর আগেকার কথা! এখনকার বাংলা পাঠকরা
কি সুবোধ ঘোষ তেমন পড়েন? কলকাতার কলেজ
স্ট্রীটের এক পুরনো বইয়ের দোকানের কর্ণধারের
সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বললেন, খুব অল্প
ক্রেতাই সুবোধ ঘোষের বই খোঁজে। বলবেন,
স্যাম্পল অফ ওয়ান দিয়ে কিছুই প্রমাণিত
হয় না। কিন্তু কলেজ স্ট্রীটে কার বই
কত বিক্রি হয় তার খোঁজ কোথায় পাই বলুন?
থাক
সে কথা, ব্যক্তিগত ভাবে আমি সুবোধ ঘোষের
ছোটগল্পের ভক্ত। ভাবতে অবাক লাগে যে
'অযান্ত্রিক' এবং 'ফসিল'-এর মত বাংলা
সাহিত্যের যুগান্তকারী গল্প অত দ্রুত
তিনি কি করে লিখেছিলেন! এই দুটি গল্পের
পেছনে যে কাহিনী - সেটি হল, দুটো গল্প
একই দিনে লেখা হয়েছিল তরুণ সাহিত্যিকদের
‘অনামী সঙ্ঘ’-র সদস্যদের অনুরোধে। সুবোধ
ঘোষের বয়ানে – ‘- সন্ধ্যা বেলাতে বৈঠক,
আমি দুপুর বেলাতে অর্থাৎ বিকেল হবার
আগেই মরিয়া হয়ে সাত তাড়াতাড়ি গল্প
দুটি লিখে ফেলেছিলাম। আশা ছিল, এইবার
অনামীদের কেউ আর আমার সম্পর্কে রীতি
ভঙ্গের অভিযোগ আনতে পারবেন না। কিন্তু
একটুও আশা করিনি যে বন্ধু অনামীরা আমার
লেখা ওই দুই গল্প শুনে প্রীত হতে পারেন।
অনামী বন্ধুদের আন্তরিক আনন্দের প্রকাশ
ও উৎসাহবাণী আমার সাহিত্যিক কৃতার্থতার
প্রথম মাঙ্গলিক ধান দূর্বা।’
শোনা
যায় মাথায় কিছু এলে উনি ঝড়ের বেগে লিখতে
পারতেন। গুছিয়ে বসে অনেক প্ল্যান করে
ভালো কিছু লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন
ঠিকই, কিন্তু কার্যত কতটা করতে পেরেছেন,
সেটা প্রশ্ন। আসলে চাপে না পড়লে উনি
গল্প লিখে উঠতে পারতেন না। সেটা খুব
ভাল ভাবে জানতেন দেশ পত্রিকার এককালীন
সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। ‘সম্পাদকের বৈঠকে’
বইয়ে তিনি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, পুজো
সংখ্যায় সুবোধ ঘোষের লেখা পাবার জন্যে
সবসময়ে শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে
হয়েছে। ‘সুবোধবাবুর সদিচ্ছা থাকলেও
শেষ পর্যন্ত আর আগে গল্প লেখা হয়ে ওঠে
না। অন্তত গত বাইশ বছর ধরে এই নিয়মের
ব্যতিক্রম একবারও হয় নি।’ কিন্তু শেষ
সময়ে তাড়াহুড়ো করে লিখেও ফল যে খারাপ
হয়েছে, সেটা কেউ বলবে না।
সুবোধ
ঘোষের কর্মজীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। কলেজ
ছেড়ে ট্যুইশনি, বাস কন্ডাক্টরি, ট্রাক
ড্রাইভা্রি – সবকিছুই করেছেন| সার্কাস
পার্টিতেও নাকি কিছুদিন ছিলেন| এমন
কি কর্পোরেশনে ঝাড়ুদারের কাজও করেছেন।
সেই অভিজ্ঞতার ফসল তাঁর লেখায় স্পষ্ট।
তাঁর প্রথম গল্প অযান্ত্রিক-এ লিখছেন:
' সকাল সাড়ে নটা থেকে হাজারিমলের আটোমবিল
স্টোরে হিসেব কষে কষে সন্ধ্যে ছটার
সময় যখন কান্তিকুমারের মাথার ভেতর পিস্টনগুলো
ক্ষয়ে গিয়ে ঝিমঝিম করতে থাকে, ঘাড়ের
কাছে স্নায়ুর গিঁটগুলিতে স্পার্কের
শক লাগে, বুকের ভেতর ফ্যানবেল্ট ছিঁড়ে
গিয়ে দম ফুরিয়ে আসে – তখন ছুটি হয়।’
ভাষার
ওপর অনায়াস দক্ষতার প্রমাণ মেলে ওঁর
বিভিন্ন স্বাদের গল্পে। মহাভারতের গল্পগুলি
বলার জন্যে তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন,
তার সঙ্গে অযান্ত্রিক বা ফসিলের গল্পে
ব্যবহৃত ভাষার কোনও মিল নেই। যেমন,
ভারত প্রেমকথা সিরিজের ‘অতিরথ ও পিঙ্গলা’-র
গল্পে দেখতে পাই – ‘দূরে সপ্তপর্ণ অটবীর
জ্যোৎস্নামোদিত নিঃস্বাসবায়ু হতে তরুক্ষীরগন্ধ
ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। নির্ঝরমূলে
এক লতাকুঞ্জের নিভৃত পল্লবাসনে গমনধ্বনি
উত্থিত হয়, যেন পুঞ্জ পুঞ্জ বক্ষঃপঞ্জর
চূর্ণ হয়ে শব্দ করছে। প্রহরের পর প্রহর
উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে, তবু নিকুঞ্জদ্বারে
বাঞ্ছিত প্রেমিকের পদধ্বনি শোনা যায়
নি।’
সুবোধ
ঘোষের শ্রেষ্ঠগল্পের একাধিক সংকলন আছে।
আমার কাছে যেটি আছে, তাতে অযান্ত্রিক,
ফসিল, সুন্দরম্, পরশুরামের কুঠার,
মা হিংসীঃ, তিন অধ্যায়, উচলে চড়িনু,
ইত্যাদি ১৬-টি গল্প স্থান পেয়েছে। এই
সংকলনের বহু গল্পেই চোখে পড়ে ওঁর গভীর
মানবিকতা বোধ। জাত ধর্ম রূপ বৈভব সবই
বাহ্যিক। ‘সুন্দরম’ গল্পে কৈলাস ডাক্তার
কুৎসিতা তুলসীর লাস কেটে আবিষ্কার করেন
চামড়ার নীচে তার সৌন্দর্য – ‘প্রবাল
পুষ্পের মালঞ্চের মত বরাঙ্গের এই প্রকট
রূপ, অছদ্ম মানুষের রূপ। এই নবনীতপিণ্ড
মস্তিষ্ক, জোড়া শতদলের মত উৎফুল্ল হৃৎকোষের
অলিন্দ আর নিলয়। রেশমী ঝালরের মত শত
শত মোলায়েম ঝিল্লী। আনাচে কানাচে যেন
রহস্যের ডুব দিয়ে আছে সুসূক্ষ কৈশিক
জাল।’
'পরশুরামের
কুঠার' গল্পে ধনিয়ার নিজের সন্তানদের
পিতৃ পরিচয় থাকতো না, সন্তানকে জন্ম
দিয়েই মিশনারি হাসপাতালে তাকে ফেলে
রেখে সে অদৃশ্য হত। ঘরে ফিরে বাবুদের
বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাঁদের ক্ষুধার্ত শিশুদের
স্তনদান করে রোজগার করত। কিন্তু বিজ্ঞানের
অগ্রগতিতে এসে গেল মায়ের দুধের কৃত্রিম
বিকল্প। ধনিয়ার প্রয়োজন আর রইল না বাবুদের
কাছে। এরকম একটি পতিতা নারী ভদ্রলোকদের
পাড়ার কাছাকাছি থাকে – সেটা আর শোভন
নয়। পুলিশ দিয়ে তাকে উঠিয়ে বেশ্যাপল্লীতে
পাঠানোর ব্যবস্থা হল। রাতে ধনিয়া দুঃস্থ
বৃদ্ধ প্রসাদী-চাচার কাছে শেষ দেখা
করতে গেল, চোখে জল। এইসব পুলিশি ঝামেলায়
দুদিন ধরে বৃদ্ধের জন্যে খাবার আনতে
পারে নি ধনিয়া। মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ
চমকে উঠল।
‘- একি? তুই ধনিয়া?
- হাঁ চাচা। আমার জাত নেই, আমি নাকি
রাণ্ডি!
- ছি ছি, এ কি বলছিস?
- হাঁ চাচা, আমাকে নাম লেখাতে হয়েছে।
কাল থেকে বাজারে থাকতে হবে।
- আরে না, তুইতো লছমী।
- না চাচা, আমার স্বামী নেই।
- গাইগরুরও স্বামী নেই, তারা কি লছ্মী
নয়?
- তা বললে চলে না, আমি তো গাই নই। আমি
মানুষ।’
বহু
বছর আগে যখন এ গল্পটা প্রথমবার পড়েছিলাম,
তখন এই লাইনের পরে আর পড়তে পারি নি।
সুবোধ
ঘোষ জন্মেছিলেন ১৯০৯ সালে ঢাকার বিক্রমপুরে
জেলায়, মৃত্যু ১৯৮০ সালে।