প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

জলবিদ্যুত্‍‌ ও পরিরক্ষিত উন্নয়ন

জল-শক্তি পৃথিবীর এক বহু পুরাণো এবং বহু ব্যবহৃত পুনর্ববীকরণ শক্তি উত্‍‌স । কয়েক হাজার বত্‍‌সর আগে জল-চক্র(water wheel) মানুষকে দিয়েছিল শ্রমশক্তির এক বিকল্প- যন্ত্রের চাকা ঘুরিয়ে শস্য পেষণ করত এবং একধরণের টারবাইন নির্মাণ করে প্রবাহিত জলে চাকা ঘুরাত সেচকার্যের প্রয়োজনে । কাষ্ঠনির্মিত এই সব জলচক্র কিন্তু কখনই বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদনে ব্যবহৃত হয়নি, বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম জলবিদ্যুত্‍‌কেন্দ্র স্থাপিত হয় উইসকোনসিনের এপ্যালটনে ফক্স নদীতে । আর ভারতে প্রথম জলবিদ্যুত্‍‌কেন্দ্র স্থাপিত হয় ১৮৯০ সালে, বর্তমান পশ্চিম-বঙ্গের দার্জিলিং-এ সিদ্রাপং নামক স্থানে ।


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আমরা জল থেকে কি ভাবে বিদ্যুত্‍‌ পাই ?

প্রকৃতপক্ষে, জল-বিদ্যুত্‍‌-কেন্দ্র এবং কয়লা-চালিত বিদ্যুত্‍‌-কেন্দ্র বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন করে একইভাবে ; দুটো ক্ষেত্রেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় 'টারবাইনের' প্রপেলরে শক্তি যোগান হয় যা' বৈদ্যুতিক জেনারেটরকে ঘোরায় এবং বিদ্যুত্‍‌ তৈরি হয় । কয়লা-চালিত বিদ্যুতের বেলায় বাষ্প গিয়ে পড়ে টারবাইন-ব্লেডের উপর, জলবিদ্যুতের বেলায় পতিত জল টারবাইন ব্লেডদের ঘোরায় ।
পতিত জলে শক্তি জোগানের জন্য নদীর বিশেষ জায়গায় বাঁধ দেওয়া হয় ; বিশেষ জায়গাটি হল যেখানে এলিভেশনে (elevation) আছে বড়-সড় পতন (drop) । বাঁধ দিলে সৃষ্টি হয় একটি জলাধার । বাঁধের দেওয়ালের মধ্যে থাকে টারবাইনে জল নিয়ে যাবার 'ইনটেক' বা গ্রহণস্থান ; কতটা জল যাবে তা' নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণতঃ থাকে একটি জলদ্বার(sluice gate)। মাধ্যাকর্ষনের বলে জল এই গ্রহনস্থান দিয়ে প্রবেশ করে 'পেনস্টক' (penstock)-এ, যার পরে আছে টারবাইনের প্রপেলর । জল ব্যবহারের পর পুনরায় নদীতে ফিরিয়ে দেওয়া হয় বাঁধের নীচের নির্গমপথ দিয়ে [ চিত্র ১ ] ।

টারবাইনকে ঘুরাবার শক্তি নির্ভর করে 'হেড'(head)- এর উপর যা হল জলাধারের জলের উপরিভাগের তল(surface)ও নির্গমণপথের মধ্যে অন্তর(difference)- এর উপর । হেড যত বেশি হবে বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন হবে ততবেশি ।

চিত্র ১ : জলবিদ্যুতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ।

জলবিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (উত্‍‌স ১) অতি সহজ । উচ্চতর অবস্থান থেকে Q পরিমাণ জল যখন নীচে পতিত হয়, তার স্থৈস্তিকশক্তি(potential energy)রূপান্তরিত হয় গতিশক্তি(kinetic energy)- তে । অর্থাত্‍‌,

গতিশক্তি P = Q ೀ g H

যখন, ೀ = জলের ঘনত্ব, g = অভিকর্ষজাত ত্বরণ, H = 'হেড' বা জলের পতনের মোট খাঁড়াই উচ্চতা ।
পতিত জল টারবাইন-ব্লেডের উপর আঘাত করলে জলের 'সরল' গতিশক্তি টারবাইনে ঘূর্ণন-গতিশক্তিতে পরিণত হয় যা' টারবাইনের তথা বৈদ্যুতিক-জেনারেটরের আবর্তক(rotor)- এ সঞ্চালিত হয় ।
জলের গতি বৃদ্ধির জন্য টারবাইন-ব্লেডের আগে ব্যবহৃত হয় মুখ-নল(nozzle)যার মধ্য দিয়ে গতিপথে ঘর্ষণ ও অন্যান্য কারণে কিছুটা ক্ষয় হয় 'হেড'-এর । অর্থাত্‍‌ উপরের সমীকরণ হয়ে দাঁড়ায়,

P = Q ೀ g h

(H- h) হচ্ছে 'হেড লস ' (head loss) ।

মুখনলের মধ্যে যদি জলের গতিবেগ হয় u, আমরা পাবো,

P = ½ (Q ೀ) uċ
অর্থাত্‍‌, u = ( 2 g h)1/2

এই গতিবেগ সম্পন্ন জল টারবাইন ব্লেডের উপর ঘাতের সৃস্টি করবে যার ফলে টারবাইন ও জেনারেটর ঘুরবে ও বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন হবে ।

জলবিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদনে দু'ধরণের টারবাইন ব্যবহৃত হয়: (১) রিয়্যাকশন টারবাইন- মাঝারি, ছোট ও ক্ষুদ্র জলবিদ্যুত্‍‌ প্রকল্পের জন্য ; (২) ইমপাল্স টারবাইন, যার মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত হল 'পেলটন হুইল'(Pelton wheel)।
জলবিদ্যুত্‍‌-এর সুবিধা হল বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদনের জন্য কয়লা, প্রাকৃতিক তেল বা গ্যাসের মতন কোনও জ্বালানির দরকার হয়না । ফলে এটি দূষণহীন । নদীর জলের ধারা জল-চক্রের অংশ এবং অফুরন্ত হওয়ার ফলে জলবিদ্যুত্‍‌ একটি পুনর্নবীকরন শক্তি উটস । এর জীবত্‍‌কাল অন্যান্য বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন প্রক্রিয়ার থেকে অনেক দীর্ঘ । অনেক প্রকল্প আছে যা' বহুমুখী যেমন, সেচ, নৌচালন, মত্‍‌সচাষ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পর্যটন এবং জল-বিদ্যুত্‍‌ ।

বর্তমান ইতিহাস

মোটামুটি উপরে বর্ণিত তত্ত্বের ভিত্তিতে সারা বিশ্বে প্রচুর জলবিদ্যুত্‍‌ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে যার সংখ্যা হবে ৪৫,০০০ । গত চার দশক ধরে জলবিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন বেড়েছে ধীর-স্থির গতিতে, বছরে গড়ে ৩ শতাংশের মতন । ২০১১ খ্রীষ্টাব্দে ৩,৪৯৮ বিলিয়ন কিলোওয়াট-আওয়ার উত্‍‌পাদন নিয়ে জলবিদ্যুত্‍‌ বিশ্বের প্রয়োজনের প্রায় ১৬ শতাংশ বিদ্যুত্‍‌শক্তি দিচ্ছে, ছড়িয়ে আছে ১৬০-টিরও বেশি দেশে ।

এখনও পর্যন্ত সব থেকে বড় হল চীনদেশের হুবেই প্রদেশের Three Gorges Project- ২২,৫০০ মেগা-ওয়াট, স্থাপিত হয়েছে ২০০৩ খ্রী-তে । এছাড়া উল্লেখযোগ্য হল- ব্রাজিলের পারানা নদের পারে ইতাইপু শহরের কাছে ১০,০০০ মেঃ. ওয়াট প্রকল্প । ২০১১ খ্রী-তে বিশ্বে মোট জলবিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদিত হয়েছে ৩৪৯৪ বিলিয়ন কিলোওয়াট-আওয়ার [ চিত্র ২ ] ।


চিত্র ২ : বিশ্বে জলবিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন, ২০১১ খ্রীষ্টাব্দ ।

জলবিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদনের মুখ্য ভুমিকায় আছে চারটি রাষ্ট্র : চীন, ব্রাজিল, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- যরা সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি জলবিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন করছে । চীনের উত্‍‌পাদন ২০০০ খ্রী-তে ছিল ২২০ বিলিয়ন কিলোওয়াত-আওয়ার যা' ২০১০ খ্রী-তে বেড়ে হল ৭২০ বিলিয়ন । মূখ্য কারণ হল ২০০৩ খ্রী-তে চালু ২৫,০০০ মেগা-ওযাট Three Gorges প্রকল্প । এটি আজ পর্যন্ত বিশ্বের সব থেকে বৃহত্‍‌ প্রকল্প যা' চীনকে এনে দিয়েছে সুনাম এবং দূর্নাম ( নীচে 'জলবিদ্যুত্‍‌ ও পরিরক্ষিত উন্নয়ন' দেখুন ) । ২০১১ খ্রী-তে খরা স্বত্ত্বেও চীনে জলবিদ্যুতে যা উত্‍‌পাদন হয়েছে তা' মোট উত্‍‌পাদনের ১৫ শতাংশ । বিশ্বে দ্বিতীয় বড় উত্‍‌পাদক হল ব্রাজিল যে তার প্রয়োজনের ৮৬ শতাংশ বিদ্যুত্‍‌ পায় জলবিদ্যুত্‍‌ থেকে । ব্রাজিলে আছে ৪৫০ টি বাঁধ- ইতাইপু বাঁধ সহ যেটি বছরে ৯২ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন করে ।
কানাডার ৬২ শতাংশ বিদ্যুত্‍‌ আসে ৪৭৫-টি প্রকল্প থেকে । এই দেশটি মার্কিন যুক্তরাস্ত্রকে প্রতি বত্‍‌সর যোগান দেয় প্রায় ৫০ বিলিয়ন উইনিট বিদ্যুত্‍‌, যা' ৪০ লক্ষ মার্কিন গৃহে বিদ্যুত্‍‌ যোগান দুতে সক্ষম ।


থ্রী গোর্জেস বাঁধ(The Three Gorges Dam)

চীনদেশের হুবেই প্রভ্গিন্স-এ ইয়াইচ্যুঙ্গ (Yichang)জেলা- সেখানে সানডুপিং(Sandouping) শহরেরপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শক্তিধর ইয়াংতসী নদী । এই নদীতে বাঁধ দিয়ে নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সব থেকে বড় বাঁধ ও জলবিদ্যুত্‍‌ প্রকল্প [ চিত্র ৩ ] ।

চিত্র ৩ : ইয়াংতসী নদী এবং থ্রী গর্জেস বাঁধও জলাধার ।

প্রকল্পটি কমিশন হয়েছে ২০০৩ খ্রীষ্টাব্দে । জলাধার ৬০০ কিলোমিটার লম্বা, বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন ক্ষমতা- ২৫,০০০ মেগা-ওয়াট । বাসচ্যুত হয়েছে ১২ লক্ষ মানুষ, নমজ্জিত হয়েছে ১৩ টি বড় শহর, ১৪০-টি ছোট শহর এবং ১,৩৫০-টি গ্রাম । হাজার হাজার শিল্প, খনি এবং আবর্জনা-আগার নিমজ্জনের ফলে জলাধার হয়েছে পঙ্কিল পলিযুক্ত, ইয়াংশীর নিম্ন- অববাহিকা দূষিত, পূর্ব-চীন সমুদ্রের মত্‍‌স্যপ্রজাতি বিপন্ন । বাঁধ ও জলাশয় নির্মাণের ফলে বহু পক্ষী-প্রজাতি তাদের বাত্‍‌সরিক সঞ্চারভূমি হারিয়েছে ; উদাহরণ- স্বরূপ, সাইবেরিয়ার সারসপক্ষী যারা প্রতি বছরেই ইয়াংশীর নিম্ন অববাহিকায় আসতো ডিম পাড়ার প্রয়োজনে । অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে আছে ইয়াংশী sturgeon মত্‍‌স্য, ইয়াংশী প্রিশ্রুত জলের Dolphin, এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদকুল । মোট প্রায় ২,০০০-টি পক্ষী-প্রজাতি বিপন্ন ও অবলুপ্তির পথে ।

যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় বাঁধ প্রকল্পগুলি রূপায়িত হয়েছে ১৯৮০ খ্রী-র আগে, এই দেশের জলবিদ্যুত্‍‌ ধারকত্ব মোটামুটি সুস্থির থাকে । দেশের সব থেকে বড় বাঁধ-প্রকল্প হল Grand Coulee Dam-ওয়াশিংটন প্রদেশের কলাম্বিয়া নদীর ওপর, কমিশন-বত্‍‌সর : ১৯৪২ সন । বর্তমানে মার্কিন দেশের ৭ শতাংশ বিদ্যুত্‍‌ হল জলবিদ্যুত্‍‌ ।
ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের জলবিদ্যুত্‍‌ মোটামুটি সুস্থির, বিগত ৩০ বছর ধরে প্রতি বছরেই বাড়ছে ১ শতাংশ মতন, জোগান দিয়েছে মোট বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পদনের ৯.৫ শতাংশ ২০১১ খ্রী-তে ।

বিশ্বের বড় উত্‍‌পাদকদের মধ্যে আছে নরওয়ে, যে প্রয়োজনের ৯৫ শতাংশ পায় জলবিদ্যুত্‍‌ থেকে ; অন্যান্য দেশগুলি যারা ভালোভাবে নির্ভরশীল জলবিদ্যুতের উপর হল পারাগুয়ে ( ১০০ শতাংশ ), ইথিওপিয়া ( ৮৮ ), এবং ভেনেজুয়েলা ( ৬৮ ) । এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশ যারা মোটামুটি তাদের সব প্রয়োজনটাই জলবিদ্যুত্‍‌ দিয়ে মেটায়, তারা হল : ভুটান, কঙ্গো গনতান্ত্রিক রিপাবলিক, লেসোথো, মোজামবিক, নেপাল এবং জাম্বিয়া ।


পরিবেশ ও পরিরক্ষিত উন্নয়ন

' জলবিদ্যুত্‍‌ এবং পরিরক্ষিত উন্নয়ন ' -বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের প্রথমেই ' পুনর্নবীকরন ' কথাটির ব্যাখ্যা বিষয়ে ভাবতে হবে ।
উপর-উপরে আমরা বলে থাকি, পুনর্নবীকরন-শক্তি উত্‍‌স হল একটি অক্ষয় শক্তি উত্‍‌স যা' সঙ্গতভাবে উজ্জ্বল ( যেমন সৌরশক্তি ), বা বাহিত ( যেমন বায়ু ) বা প্রবাহিত ( যেমন নদীর জল ) ; তুলনায়, অ-নবীকরন-শক্তি উত্‍‌স হল সসীম, যা একদিন নিঃশেষ হবে ।

জলশক্তির বেলায় উপরের অর্থনির্দেশ একটু জটিলতায় ফেলে দেয় । জলশক্তি পুনর্নবীকরন, যার অর্থ হল বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদনকারী জল নিঃশেষ হয় না কয়লা, প্রাকৃতিক তেল বা গ্যাসের মতন । কিন্তু, জলশক্তির বিকাশের কথা ভাবলে দেখতে পাই বিশ্বের শক্তিধর নদীগুলিকে যেমন, উত্তর আমেরিকার কোলোরাডো, চীনের ইয়াংত্‍‌সে এবং দক্ষিণ আমেরিকার পারানা বাঁধ দিয়ে বেধে রাখার জন্য ইকোব্যবস্থা সার্বিকভাবে বিপন্ন । বাঁধগুলির বিশ্ব কমিশনের(World Commission on Dams)হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের বাঁধ ( যার জন্য খরচ পড়েছে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন-ডলার ) ৪ থেকে ৮ কোটি মানুষকে বাসচ্যুত করেছে, ধ্বংস করেছে বনান্চল এবং বহু নদীকে পরিণত করেছে ক্ষীণ জলধারায় সমুদ্রে পৌঁছনোর আগে । বস্তুতঃ, অনেক বাঁধই নদীর নিম্ন অববাহিকায় জলসম্পদ ব্যবহারে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, ইকো-ব্যবস্থার ক্ষতিসহ, যা পুনর্নবীকরণ সংজ্ঞাকে ম্রিয়মান করে দিয়েছে ।

তাই আমরা একটি নূতন সংজ্ঞা ভাবতে বাধ্য হয়েছি । ছোট জলবিদ্যুত্‍‌কে অনেক সময়েই ব্যাখ্যা করা হয়েছে ' পরিরক্ষিত ' (sustainable) শক্তি-উত্‍‌স হিসাবে । ভারতের মতে ২৫ মেঃ-ওয়াটের তলায় হলে হবে ' ছোট ', যেখানে মাঃ যুক্তরাষ্ট্র বলছে ৩০ মেঃ-ওয়াট । সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের Clean Development Mechanism শ্রেণীবিন্যাস করেছে- ' ছোট '(small) ১৫ মেঃ-ওয়াটের নীচে, ' ক্ষুদ্র ' (micro) ৫ মেঃ-ওয়াটের নীচে আর ' পাইকো ' (pico|- ৫ কিলো-ওয়াট বা তার কম ।

পরিরক্ষিত ব্যবস্থার নিরিখে এই সব সংজ্ঞা কি অর্থবহ ? হাঁ এবং না । অনেক প্রকল্প রূপয়িত হয়েছে যাদের ⤛ ছোট ⤛ বলা যায়, কিন্তু হয়েছে ইকোব্যবস্থা এবং তার উপর নির্ভরশীল মানুষজনের সর্বনাশের কারণ । উদাহরণস্বরূপ, বেলিত্‍‌সে(Belize)৭.৫ মেঃ-ওয়াটের চলিলো বাঁধ ( নির্মাণ ২০০৫ খ্রী ) যেটা Mesoamerican Wildlife Corridor-এর মধ্য দিয়ে গিয়েছে । এটি ছিল দেশান্তরের গমন করার রাস্তা ও সন্তান-জন্ম দেবার স্থান বহু প্রাণীপ্রজাতির যেমন, তাপির, জাগুয়ার এবং লোহিত মাকাও । বাঁধটি মানুষেরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে- নিম্ন অববাহিকায় জলে পওয়া যচ্ছে নানা প্রকারের তলানি যার ঘনস্রোত অবক্ষেপ WHO-র মানের একশো গুণের বেশি । জনসাধারণ মাকালে অবগাহন করলে দেহে চুলকানি-র সংবাদ আসছে ।

মেগা-ওয়াট ধারকত্ব ছাড়া পরিরক্ষিত সংজ্ঞা হতে পারে বাঁধের উচ্চতা, নদী অববাহিকার স্থান, জলাধারের প্রকৃতি এবং বাঁধের পরিচালন । বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ঊর্ধ ও নিম্ন অববাহিকার যোগাযোগ-ব্যবস্থায় : প্রাণীদের ঊর্ধ অববহিকায় যাওয়ার প্রয়োজন এবং জৈব পদার্থ ও তলানির- নিম্ন অববাহিকায় । সব থেকে ভালো হয় বাঁধ ব্যবহার না করা । যেখনে যেখানে সম্ভব নদীর ভৌগলিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীল ' নদীর গতিপথের বাইরের '(run-of-river)জলবিদ্যুত্‍‌ প্রকল্প ব্যবহার করা সঙ্গত [ চিত্র ৪ ] ।

চিত্র ৪ : Run-of-river প্রকল্প ।

উচ্চস্থান থেকে নদীর জলকে নালার সাহায্যে ( সাধারণতঃ ভূমধ্যে ) টারবাইন-হাউসে নিয়ে যাওয়া হয় । জলবিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদনের পরে জলকে নদীতে ফিরিয়ে দেওয়া হয় । অনেক সময় উত্‍‌সমুখে একটি ছোট বাঁধ দেওয়া হয়, নদীর প্রবাহ কমে গেলে ব্যবহারের জন্য । একটি ভাল উদাহরণ ভারতের সিকিম প্রদেশের সিংটামে- তিস্তা ৫ প্রকল্পে ( ৫১০ মেগা-ওযাট ) । প্রায় ১৮ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থিত নালার সাহায্যে জলকে নামিয়ে আনা হয়েছে টারবাইন হাউসে । বিশ্বে বহুস্থানে অজস্র ক্ষুদ্র, মাইক্রো ও পাইকো প্রকল্পে এই ব্যবস্থা সাফল্যের সঙ্গে চালু আছে ।

বাঁধগুলির বিশ্ব কমিশন(World Commission on Dams)বিভিন্ন জলবিদ্যুত্‍‌ প্রকল্প অধ্যয়ন করে মত প্রকাশ করেছেন যে- মানুষের উন্নয়নে বাঁধগুলি অনেক প্রয়োজন মিটিয়েছে যেমন সত্য, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এদের জন্য মানুষকে অপ্রয়োজনীয় মূল্য দিতে হয়েছে ।

বিষয়টিকে সার্বিক মানচিত্রে দেখা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে । পুনর্নবীকরণ- শক্তি উত্‍‌সগুলি এবং শক্তির কার্যকারিতা বিষয়ে সম্পুরিত শক্তি স্ত্র্যাটেজি(integrated energy stretegy)নিলে- বায়ু, সৌর, ভূতাপীয় এবং বায়োমাস-সহ- সহজেই ২০৩০ খ্রী-র মধ্যে বিশ্বের ৫০ শতাংশ চাহিদা মেটানো যাবে- এটি Worldwatch-সহ বিভিন্ন সংস্থার মত । আরেকটি উচ্চাভিলাষী রিপোর্ট বলছে যে ২০৫০ খ্রীষ্টাব্দ নাগদ ১০০ শতাংশ সবুজ-শক্তিতে যাওয়া সম্ভব কারণ অতিরিক্ত ১,০০০,০০০ সৈকত (onshore) এবং ১০০,০০০ সৈকতাশ্রিত (0ffshore) বায়ু-প্রকল্প ও ভূতাপীয় উত্‍‌সগুলিকে সঠিকভাবে রূপায়ন করা যায় । ভূতাপীয় শক্তি উত্‍‌স- বিষয়ে আরও গভীর অধ্যয়ন আবশ্যক ।


জলবিদ্যুতের আরও তিনটি রূপ

বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদনে জলশক্তির আরও তিন প্রকার রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি যথা, পাম্প-স্টোরেজ ব্যবস্থা, জোয়ার-ভাঁটা থেকে বিদ্যুত্‍‌ এবং সমুদ্রের ঢেউ থেকে বিদ্যুত্‍‌ । প্রথম্টি 'অবসরে' অন্যত্র আলোচনা হয়েছে ।
এই ধরণের প্রযুক্তিতে ইকো-ব্যবস্থায় লঙ্ঘন হয় সব থেকে কম ।

জোয়ার-ভাঁটা থেকে বিদ্যুত্‍‌:

পরিচ্ছন্ন-শক্তির এই পদ্ধতিটি এখনও পর্যন্ত বহুলাংশে অ-ব্যবহৃত ; কোনও কোনও মূল্যান অনুসারে ১,০০০ গিগা-ওয়াট মতন বিদ্যুত্‍‌ লাভ হতে পারে ।

মধ্যযুগে ছোট ছোট 'জোয়ার-ভাঁটা যন্ত্র' ব্যবহৃত হয়েছে শস্য পেষণের জন্য । বর্তমানকালে বড় বড় মাপের স্কীমের কথা ভাবা হয়েছে যা' মোটামুটি দু'ধরণের প্রযুক্তি আশ্রিত । প্রথমটিতে বড় বড় টারবাইন পঙা্‌তিতে সাজানো হয়েছে এমন স্থানে যেখানে জোয়ার-ভাঁটা তীব্র । দ্বিতীয় পদ্ধতিটি খানিকটা বাঁধ-সম্বলিত জলবিদ্যুতের মতন, যেখ্হানে বিশাল বাঁধের মতন ব্যারেজ ব্যবহৃত হয় ।

সেভার্ন ব্যারেজ Severn Barrage প্রকল্প

চিত্র ৫ : সেভের্ন ব্যারেজ

একবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে প্রস্তাবিত Severn Barrage নির্মিত হবার কথা ইংল্যাণ্ডের ব্রিষ্টল খালে- যুক্ত করবে ওয়েলসের দক্ষিণ কারডিফ এবং ইংল্যাণ্ডের সমারসেট-কে । ২০-বিলিয়ন পাউণ্ড ( মার্কিন ডলার ৩০ বিলিয়ন )-এর এই প্রস্তাব রূপায়িত হলে তা' হবে বিশ্বের বৃহত্তম সবুজ প্রকল্প । সেভার্ন মোহনায় জল দিনে ১১. ০ মিটার ওঠে ও নামে জোয়ার- ভাটায় । ব্যারেজে থাকবে ২১৬-টি ৪০-মেগা-ওয়াটের টারবাইন এবং জোয়ারের সময় জাহাজ-গমনাগমনের জন্য shipping lick । বিদ্যুত্‍‌ উত্‍‌পাদন হবে বছরে ১৭ বিলিয়ন কিলো-ওয়াট সবুজ বিদ্যুত্‍‌শক্তি । ফলে প্রতি বছর ১৬ মিলিয়ন টন কারবন-নিঃসরণ কম হবে ।

জোয়ারের জল প্রবেশ করার পর ব্যারেজ-দ্বারা তাকে বন্দী করা হয় এবং পরে ভাঁটার সময়ে একটি ' হেড ' তৈরী হয় যা' দ্বারা টারবাইন ঘোরানো হয় । রাশিয়া ও ফ্রান্সে এই পদ্ধতিতে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু আছে গত ৩০ বত্‍‌সর ধরে ।
একটি উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হল ইংল্যাণ্ডের Severn estuary-র ৯ গিগা-ওয়াট প্রকল্প [ চিত ৫ ], যেটা এখনও রূপায়িত করা সম্ভব হয়নি অর্থের জন্য ।

উত্‍‌স
(১) দিলীপ বসু, শক্তি ও পরিবেশ ভাবনা, WBREDA, বিকল্প শক্তি ভবন, সল্ট লেক সেক্টর ৫ ।

(২) Merek Walisiewicz, alternative energy, Dorling Kinderslay, London,
(৩) হেয়লি মোল্লের, ⤛Hydropower continues Steady Growth⤜, www, earthpolicy.org/data/highlight 29
(৪) Allie Goldstaein, ⤛Hydropower in Central America, 'Renewable', ⤛Sustainable' and without alternative?⤜, Revolt 2012-08-14

শঙ্কর সেন
১২-০৫-১৩


 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।