পরিরক্ষার সামর্থ প্রশ্নাতীত
নয়।
সবুজ
বিপ্লব
সবুজ
বিপ্লব বলতে বোঝায় অনেকদিনের অধ্যাবসায়- সহযোগে কৃষিতে
গবেষণা , [উচ্চ ফলনশীল ফসল এবং শক্তি-আতিশয্য কৃষি (energy-intensive
agriculture)], প্রযুক্তি-হস্তান্তর এবং আনুসাঙ্গিক
পরিকাঠামো উন্নয়ন, যা ঘটেছিল বিশেষভাবে ষাট-সত্তরের
দশকে যখন সারা পৃথিবীতে হয়েছিল খাদ্যাভাব। সত্তরের দশকে
তো ভারতে দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ- অবস্থা।
কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা ও উদ্যমের ফল দেখা গেল পৃথিবীর
অনেক রাষ্ট্রে, বিশেষতঃ এশিয়া মহাদেশে। বিশেষভাবে নির্বাচিত
উদ্ভিদের লালনপালনের ফলে নানারকম ধান ও অন্যান্য উচ্চক্ষমতা-শীল
ফসল যেমন, ভূট্টা, সরঘম ও গমের উত্পাদন বাড়ে। এই সব
উচ্চফলনশীল বীজ ভালো উত্পাদন দেয় যদি সার ব্যবহার করা
যায় অনেক এবং জল ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয় বিপুল। ধান
বিশেষতঃ হল সাফল্যের সোপান এবং সয়াবীনও উত্পাদন হয়েছে
রেকর্ডমাপের। সবুজ-বিপ্লব, নিয়ে এসেছিল এক বিশাল বৃদ্ধি
ফসল উত্পাদনে (পৃথিবীর ফসল উত্পাদন ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ খ্রী-র
মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল )। ১৯৬০ খ্রী-তে ভারতে
চাল উত্পাদন ছিল হেক্টর-প্রতি ২ টন ; ১৯৯০ খ্রী-র মাখামাঝি
তা' হল ছয়গুণ ; মূল্য ১৯৭ে০ ৫৫০ মার্কিন ডলার টন-প্রতি,
২০০১ খ্রী-তে তা' নেমে হল ২০০ মাঃ, ডলার টন-প্রতি। তবে,
এখন জনপ্রতি উত্পাদন ক্রমশঃ কমছে।
ষাটের
দশকের খাদ্য উত্পাদন বিপর্যয়বাদীদের স্তব্ধ করে দিয়েছিল
; এশিয়া মহাদেশ সব থেকে ভালো কৃতকার্যতা দেখিয়েছিল গড়ের
থেকে বেশি উত্পাদন করে আর আফ্রিকা সব থেকে খারাপ। কারণ,
ধান নিয়ে সাফল্য ছিল বিপ্লবের মূলে, আর নূতন ফসলের বৈচিত্র্য
রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে মিলে আফ্রিকার অবস্থা করুণ
করেছিল। আফ্রিকায় জনপ্রতি শস্য-উত্পাদন ১৯৬৭-র ২২ শতাংশ
থেকে ১৯৮১ খ্রী-তে নেমে গিয়েছিল ১২ শতাংশে। ২০ বত্সর
আগে আফ্রিকা যা প্রয়োজন তা' উত্পাদন করতো, এখন প্রয়োজনের
৮০ শতাংশ উত্পাদন করছে।
তাই এখন প্রয়োজন- একটা
দ্বিতীয় ' সবুজ বিপ্লব '-এর, যে উপকল্পকে ব্রিটেনের রয়্যাল
সোসায়িটি সঠিকভাবেই বিবৃত করেছেন বিশ্ব- কৃষির পরিরক্ষিত
প্রাখর্য (sustainable intensification of global agriculture)।
এই বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন কৃষি গবেষণায় অগ্রাধিকারের পুরোপুরি
নববিন্যাস। আবশ্যকীয় প্রয়োজন হল নূতন নূতন জাতের ফসল যা'
বেশি উত্পাদন দেয়, কম জল টানে, সার ও অন্যান্য দ্রব্য কম
ব্যবহার করে ; উদাহরণস্বরূপ, বহুকাল-আগে-ছেড়ে-দেওয়া শিকর
রূপান্তরের উপর গবেষণা। প্রয়োজন আছে, একই জমিতে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে
ফসল উত্পাদনের উপর গবেষণার, পশু- ও উদ্ভিদ- উত্পাদনে সমন্বয়,
মৃত্তিকা-নির্বাহ এবং খাদ্য-অপচয় নিবারণ ( দেখুন, 'খাদ্য
অপচয়')।
গবেষণার পরিধি প্রস্তুত করার সময় মনে রাখতে হবে (১) পৃথিবীতে
আরও নূতন কৃষি-জমি পাওয়া যাবে কি না ; (২) ভৌমজল (groundwater)-এর
ব্যবস্থা করা যাবে না কারণ এটি এখনই প্রায় নিঃশেষ।
বর্তমানে পৃথিবীতে
কৃষিকার্য হয় ১৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার জমিতে, যা' দক্ষিণ
আমেরিকার সমান ; আর আমরা ৩০ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার, পুরো
আফ্রিকা মহাদেশের সমান জায়গা ব্যবহার করছি পশুধন পালনে।
দুটো মিলে পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ৪০ শতাংশ, যেটা মোট শহর
ও নগরের জমির থ্যেকে ৬০ গুণ বেশি। এর পরেও যদি জমির অন্বেষণ
চালাই, হয়তো পাওয়া যাবে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকাতে, যার
বেশিরভাগই বন্যভূমি। এই জমি পরিষ্কার করে বর্তমানের উদ্ভাবনমুখী
পরিবেশ ধংসকারী কৃষিকে নিয়ে আসা একটা 'ক্ষীণ' সম্ভাবনা ছাড়া
আর কি !
কৃষি যতই মরুভূমি ও
অন্যান্য শুষ্ক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে, পরিশ্রুত জলের উপর চাপ
পড়বে ততই বেশি। বর্তমানে ব্যবহৃত জলের ৭০ শতাংশ যাচ্ছে কৃষিতে।
তাই, আগামী দশকের আসল চ্যালেঞ্জ হল এটাই যে কিভাবে কৃষি-উত্পাদন
বাড়ানো যায় কৃষিজমির আয়তন না বাড়িয়ে এবং জলের প্রয়োজন হবে
অনেক কম।
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলি আধুনিক প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি ব্যবহার
করে ভালোরকমের লাভ করতে পারে। কিন্তু, তার জন্য প্রয়োজন
অর্থের। FAO-র হিসাব অনুসারে ২০৫০ খ্রী-র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা
করতে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির প্রয়োজন বছরে ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন
ডলার। এর বেশিরভাগটাই লাগবে কৃষি-পরিকাঠামোর পিছনে- উত্পাদন
থেকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী আনুসাঙ্গিক প্রক্রিয়াগুলির জন্য।
আফ্রিকায় প্রয়োজনীয় রাস্তার অভাবে কৃষি-বিপনন নিয়ে আসা-যাওয়া
যেমন শ্রমসাধ্য, তেমনি ব্যয়সাধ্য সংশ্লেষিত সার খামারে নিয়ে
আসার। হতদরিদ্য ও সঙ্গতিবিহীন রাষ্ট্রগুলির ( যেখানে পৃথিবীর
সর্বাপেক্ষা গরীব লোকেদের বাস এবং যেখানে জনসংখ্যা-বৃদ্ধি
হবে প্রচুর আগামী কয়েক দশকে ) জন্য আলাদা গবেষণা-কার্যতালিকা
স্থির করা আশু প্রয়োজন। বস্তুতঃ, কৃষিকে নূতনভাবে আবিষ্কার
করতে হবে বহুগুণিত শিক্ষা-ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যাতে শুধু
জীববিজ্ঞানী, কৃষিবিদ্ ও কৃষকরা থাকবেন তা' নয়, রাখতে হবে
ইকোলজিস্ট, সমাজবিজ্ঞানী ও নীতি-নির্ধারকদেরও।
সুখের কথা, বিশ্বের
কৃষিবিদরা এইরকমের উন্মুক্ত চিন্তা করছেন। মার্চ, ২০১২ খ্রী-তে
ফ্রান্সের মন্টপেলিয়ারে প্রথম বিশ্ব কৃষি গবেষণা সম্মেলনে
তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন কিভাবে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলির কৃষকদের
প্রয়োজন নিরুপণে গবেষণা- কার্যতালিকা প্রস্তুত করা যায়।
কিন্তু এধরণের প্রচেষ্টা কখনই ফলপ্রসু হবে না নীতি-নির্ধারক
এবং অর্থলগ্নীকারকদের সাহায্য ছাড়া।
জন-কৃষি-গবেষণায় অর্থলগ্নী
শীর্ষে উঠেছিল ৭০-দশকে; তারপর থেকে লগ্নী ক্রমশঃই কমছে।
ধনী রাষ্ট্রগুলিতে এটা বাড়ছেও না কমছেও না, কিন্তু সাহারা-সন্নিহিত
অঞ্চলে, যেখানে খাদ্যের প্রয়োজন সবথেকে বেশি, সেখানে ক্রম-ক্ষীয়মান।
ব্যতিক্রম হল চীন, যেখানে খাদ্য-গবেষণায় ব্যয় বাড়ছে 'এক্সপোনেন্সিয়াল'-হারে
গত এক দশক ধরে, এবং কিছুটা কম- ভারত ও ব্রাজিলে। মনে হচ্ছে,
এই তিনটি রাষ্ট্র কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গরীব দেশগিলিতে
নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেবে। কিন্তু ধনী রাষ্ট্রগুলিরও
দায়িত্ব আছে ; এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির স্বার্থে কৃষি-গবেষণায়
অধিক লগ্নীর বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ডাক নিঃসংশয়ে সমর্থনীয়।
এবিষয়ে 'প্রাইভেট সেক্টরের' কিছু করণীয় আছে। পূর্বে কৃষি-জৈবপ্রযুক্তি
সংস্থাগুলি ধনীদেশগুলির লাভজনক কৃষি বিপননের দিকে নজর দিয়েছিল
; কৃষি-গবেষণায় লগ্নীর অর্ধেকের মত ছিল 'প্রাইভেট' সংস্থাগুলির।
বর্তমানে অবশ্য তারা ' প্রাইভেট-পাবলিক ( পি-পি )' মডেল
ব্যবহার করছে নির্ধন দেশগুলির জন্য। এই ভূমিকা মনে করিয়ে
দেয় একদশকের বেশি আগে ঔষধ কোম্পানিগুলির 'পি-পি' লগ্নীর
কথা ঔষধ ও টীকার ক্ষেত্রে। তাই এই মডেল ব্যবহার প্রশংশনীয়,
অবশ্য আরও বর্ধিত আকারে।
চিরাচরিত কৃষি-উত্পাদনের
পাশাপাশি কিছু জীন- পরিবর্তিত ( GM ) ফসল ভালো কাজ দিচ্ছে।
যদিও, পৃথিবীতে ক্ষুধা দূরীকরণে এর ব্যবহার 'সর্ব-হর' (panacea)
নয়, যতই এর প্রস্তাবকারীরা চেঁচামিচি করুন না কেন। বস্তুতঃ,
GM-ফসলের প্রথম জনন দরিদ্র রাষ্ট্রগুলির কাছে অপ্রাসঙ্গিক
; তা' সত্বেও এ-বিষয়ে অধিক-কথন জনসাধারণের মনে অবিশ্বাসের
বীজ বপন করেছে- কৃষিতে ব্যক্তি-মালিকানা', একচেটিয়া ব্যবসা
এবং অনায্য লাভের মধ্য দিয়ে।
শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,
নিজ নিজ ভাবে আবার পৃথিবীর ক্ষুধা দূরীকরণে সমর্থ হবে না।
খাদ্য উত্পাদনে ঘাটতি নয়, দারিদ্র্যই হছে আসল কারণ। ঠিক
এখনই পৃথিবীতে রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাদ্য, তবুও
প্রতিদিন ১ বিলিয়নের মতো মানুষ ক্ষুধিত, কারণ, তারা খাদ্য
কিনতে অক্ষম। ২০০৮ খ্রী-র খাদ্য বিপর্যয়, যা ১০০ মিলিয়ন
মানুষকে ক্ষুধায় ঠেলে দিয়েছিল, তা' খাদ্যের অভাবের জন্য
যত নয় তার থেকেও বেশি খাদ্যে উদ্বাহিতা- যা' খাদ্যমূল্যকে
বৃদ্ধি করেছিল চরমভাবে, যার ফলে বহু রাষ্ট্রে দাঙ্গা দেখা
দিয়েছিল। অর্থনীতি খাদ্য-সরবরাহকে অনেকভাবেই আঘাত করতে পারে।
OECD-র অন্তর্গত রাষ্ট্রগুলি কৃষকদের দৈনিক প্রায় ১ বিলিয়ন
মার্কিন ডলার ভরতুকি দিয়েছিল যার ফলে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির
কৃষকদের পক্ষে বিশ্ব-বাজারে স্থান পাওয়া শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে
ছিল। আবার, কৃষিকার্য ৩০ শতাংশ গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণের
জন্য দায়ী। এই পরিমান কিন্তু যানবাহন বা উত্পাদন-শিল্প থেকে
বেশি। দুঃখের বিষয়, কৃষিতে পরিবেশের লিপ্ততা নিয়ে ঠিক এখনই
কিছু করা যাচ্ছে না। আর যদি পেট্রোলিয়াম-সমস্যার কথা ধরি
এবং জৈবজ্বালানির কথা ভাবি, আরও সমপরিমাণ জমি লাগবে। তাই
গবেষণার পরিধি হতে হবে নূতন সবুজ বিপ্লবের কৃত্কৌশলের সঙ্গে
সমন্বয় জৈব কৃষিব্যবস্থা এবং পরিবেশ পরিরক্ষণ। সঙ্গে অবশ্যই
থাকবে ফসলে নূতন বৈচিত্রতা, ড্রিপ-জলসেচ, অপরিশ্রুত-জলের
পুনরাবর্তন ইত্যাদি। পরিরক্ষিত ও উত্পাদনমুখী কৃষির উপর
গবেষণার এক অমোঘ নিয়ন্ত্রণ আছে- একটা প্রমাণিত ব্যবস্থাপত্র
( ঠিক যে রকম হয়েছিল উপেক্ষিত অসুখের চিকিৎসায় ) যা তৈরি
করবে একটা পবিত্র পরিমণ্ডল যা' কম্যুনিটিকে দারিদ্র্য থেকে
মুক্তি দেবে।
দ্রঃ
Nature- “ How to feed a hungry world”,( Editorial )29
July, 2010 ;
Cameron Scheror- “John Foley’s TED Talk Calls Agriculture
“The Other Inconvenient Truth”
জুন
7, 2012 শঙ্কর সেন
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)