বিশ্ব
খাদ্যসংবাদ (২) : খাদ্য বিনষ্ট ও অপচয়

সংযুক্ত
রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার(FAO) হিসাব অনুসারে বিশ্বে
প্রতিবৎসরে মানুষের ভোগ্য সকল রকমের খাদ্যের প্রায় ১.৩ বিলিয়ন
টন বিনষ্ট হচ্ছে নানাভাবে । অথচ পাশাপাশি আরেকটি চিত্র হল বিশ্বের
স্বল্প আয় ও হতদরিদ্র্য দেশগুলিতে ১ বিলিয়নের মতো মানুষের বুভুক্ষা
।
২০১০ খ্রী-তে ৫.৪ শতাংশ
গৃহস্থালি কঠোর খাদ্য-অনিশ্চয়তার সম্মুখীণ হয়েছিল ।
- খাদ্যে অ-নিশ্চয়তা হতে
পারে সাময়িক অথবা বহুদিনের স্থায়ী । এর মূল কারণগুলি হল :
যুদ্ধবিগ্রহ, দারিদ্র্য, জনসংখ্যা-বৃদ্ধি, পরিবেশ অবনমন, অসম্পূরণ
কৃষি-কৃৎকৌশল, অকার্যকর নীতি এবং রোগ ] ।
- অনেক স্বল্প-আয়ের দেশগুলিতে
যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য উৎপাদিত হয় না, ফলে জাতীয় স্তরে খাদ্য-অনিশ্চয়তা
থেকেই যায় । আবার, একই দেশে আয়ের অসাম্য নিম্নবিত্তদের মধ্যে
খাদ্যে অ-নিশ্চয়তা ডেকে আনে ।
- কিছু রাজ্যে- কিছুটা
খাদ্য-নীতি পরিবর্তন এবং অর্থনীতির সতেজ বিকাশের জন্য- ১৯৬৬
খ্রী-র বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনের পর থেকে খাদ্য নিশ্চয়তার উন্নতি
করতে পেরেছে । এর মধ্যে আছে এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার কিছু
স্বল্প আয়ের রাষ্ট্র । সাহারা-সন্নিহিত দেশগুলি(Sub-Saharan
Africa)অবশ্য বিশেষ অগ্রগতি দেখাতে পারেনি এখনও পর্যন্ত ।
সংযুক্ত
রাষ্ট্রপুঞ্জ
২০১১ খ্রী-তে Swedish Institute
for Food and Biotechnology(SIK) FAO-র পক্ষে একটি প্রতিবেদনে-
Global Food Losses and Food Waste,- 'খাদ্য নষ্ট' এবং 'খাদ্য
অপচয়' -এর মধ্যে তফাৎটি বিশ্লেষণ করেছেন :
'খাদ্য নষ্ট' পরিমাপ করে কতটা শস্য কমেছে ক্ষেত থেকে তোলার সময়ে
থেকে মাড়াই-ঝাড়াই ইত্যাদি ক্রিযাকর্মের সময় পর্যন্ত ; অর্থাৎ
উৎপাদন, শস্যসংগ্রহের পরবর্তী কাল, এবং খাদ্যে রূপান্তর পর্যন্ত
ক্ষয় ।
'খাদ্য অপচয়' হল যে অংশ খুচরা বিক্রয়ের স্তর থেকে খাদকদ্বারা
খাদ্য গ্রহণ করা পর্যন্ত ক্ষয় হয় ; অর্থাৎ খাদ্যকে গ্রহণ না
করে ফেলে দেওয়া ।
২০১১-র SIK-প্রতিবেদনে বিশ্বে মোট খাদ্য নস্ট ও অপচয়-এর হিসাব
দেওয়া হয়েছে যা' হল মানুষের গ্রহণযোগ্য খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ,
প্রায় ১.৩ বিলিয়ন টন । সারণী ১-এ দেখা যাবে, শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল
দেশগুলির মধ্যে তফাৎ এই যে, প্রথমটিতে ৪০ শতাংশের বেশি ক্ষয়
হয় খুচরা এবং খাদকের স্তরে, যেখানে দ্বিতীয়টিতে ৪০ শতাংশের বেশি
ক্ষয় হয় ফলনের পরে এবং পরবর্তী প্রস্তুত-প্রক্রিয়ায় । শিল্পোন্নত
দেশগুলিতে মোট খাদ্য-হানি হয় ২২২ মিলিয়ন টন, যা সাহারা-অধ্যুষিত
অঞ্চলের মোট খাদ্য-ক্ষয়ের ( ২৩০ মিলিয়ন টন ) প্রায় সমান ।

সারণি ১ : খাদ্য নষ্ট ও অপচয়,
২০১১ খ্রী ।
উৎস : Gustavson, Jenny; Cederberg, Christel; Sonesson, Ulf;
van Otterdijk, Robert; Meybeck, Alexandre (2011). Global Food
Losses and Food Waste. FAO. ।
বিশ্বাস করুণ বা নাই করুণ,
খাদ্য-ক্ষয়ের অনেকটাই আসছে গৃহস্থবাড়ী থেকে ।
সারণি ১-এ দেখতে পাচ্ছি তিনটি অঞ্চলে খাদ্য নষ্ট ও অপচয় মারাত্মক
রকমের বেশি । আমরা সংক্ষেপে এই অঞ্চলগুলির অবস্থা আলোচনা করবো
:-
ইওরোপীয়
ইউনিয়ন
ইওরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৪ সালকে
ঘোষণা করেছে ' খাদ্য নষ্ট করার ইওরোপীয় বৎসর' । তারা নজর দিয়েছে
'খাদ্য নষ্ট' হওয়ার প্রতি ( সারণী ১ ) যার পরিমাণ খুবই বেশি
এবং ইউনিয়ন মনে করে খাদ্য-প্যাক করার প্রণালীগুলির প্রতি নজর
দেওয়া দরকার । এই চিন্তায়, ইওরোপীয় ইউনিয়নে প্যাকেজ-তৈরিতে নূতন
উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং হচ্ছে যার ফলে খাদ্য বিক্রেতার দোকানে
অনেক আগেই পৌঁছে যাবে ' খারাপ হোয়ার তারিখের' অনেক আগে । জৈব
পদার্থ যেমন, শাক-সব্জী, ফল এবং অন্যান্যরা প্রাকৃতিক কারণে
ইথাইলিন গ্যাস ছাড়ে যা সেগুলিকে পাঁকতে সাহায্য করে বটে কিন্তু
তাদের পচন ঘটায় তাড়াতাড়ি । তরঙ্গায়িত কার্ডবোর্ড-এর জন্য একটা
বিশেষরকমের আবরণ উদ্ভাবিত হয়েছে যার দ্বারা খাদ্যকে খারাপ হওয়ার
থেকে বাঁচানো যাবে প্যাকিং করা থেকে ক্রেতার কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত
সময়ের মধ্যে ।
কিন্তু যে বিশাল খাদ্য বিনষ্ট হচ্ছে ( সারণী ১ ), সে বিষয়ে গ্রাহকদের
বক্তব্য হল বেশির ভাগটাই হচ্ছে ক্ষেতে উৎপাদনের সময় থেকে মুদির
দোকানে পৌঁছবার সময়ের মধ্যে । আদর্শ প্যাকেজের সাইজ কি হবে তা'
একটা গবেষণার বিষয় কারণ সাইজ বড় হলে প্যাকেজ খুলে তার একটা অংশ
ব্যবহার করতে হয়, বাকীটা রেখে দিতে হয় ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য
। খাদ্য অব্যবহারযোগ্য হয় এই সময়টি দীর্ঘ হলে । অনেকগুলি সাইজের
প্যাকেট করলে সমস্যা লাঘব হয় বটে, তবে প্যাকেট তৈরির খরচা যায়
বেড়ে ।
ইয়োরোপীয় পার্লামেণ্টে একটা প্রস্তাব পাশ হয়েছিল জানুয়ারি ২০১২
খ্রী-তে খাদ্য-শৃঙ্খলে কি উপায়ে আরও সম্যক কার্যক্ষমতা আনা যায়
। আলোচিত হয় বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরাতে 'ইন্সেণ্টিভ' দেওয়ার
কথা যা'তে স্থানীয় উৎপাদন কেনা হয় এবং উদ্বৃত্ত খাদ্য বিনা মূল্যে
খাদ্য-ব্যাঙ্কে দেওয়া হয় ।
যুক্তরাজ্যে খাদ্য-অপচয় কমাবার জন্য ত্রি-ফলা কার্যক্রম নেওয়া
হয়েছে : গ্রাহকদের মধ্যে প্রচার, খাদ্য-শিপের সঙ্গে আলোচনা এবং
প্যাকেট-নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে খুঁটি-নাটি বিষয়ে কথা বলা । গবেষণায়
২,১৩৮-টি গৃহে সমীক্ষা চালিয়ে প্রতিবেদনে বলছে যে, ইংল্যাণ্ড
ও ওয়েলসে বৎসরে ৩.৬ মিলিয়ন টন খাদ্য বিনষ্ট হয়- যার মূল্য হবে
প্রায় ৯ বিলিয়ন পাউণ্ড ( অন্য এক সমীক্ষকের মতে ১০.২ বিলিয়ন
পাউণ্ড ), যার মধ্যে পাউরুটি, ফল ও স্যালাডের ভাগ বেশি ; তা'
ছাড়া ভাগাড়ে ফেলা খাদ্যের ৬০-শতাংশ ছোঁয়াই হয়নি ।
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের
একটি গবেষকের দল মত প্রকাশ করেছেন যে, প্রতি বৎসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে
যে খাদ্য নষ্ট হয় তার তুল্যমূল্য হল ৩৫০ মিলিয়ন তেল । বিশেষজ্ঞদের
মতে এই সমস্যা পরিবেশগত সমস্যার মতন নয়, এটার সমাধান সম্ভব ।
সমস্যার একটা বড় কারণ হল আমেরিকাবাসীর খাদ্যের প্রতি মানসিকতা
। আমেরিকার খাদ্য অপচয় হল চোখ ধাধানো ২৭ শতাংশ- তেল, চর্বি,
শস্যাদি এবং 'ডেয়ারি'-বস্তু বর্জে স্থান পায় ।
The National Institute of Health-এর একটি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে,
১৯৭০ থেকে ২০০৫ খ্রী-তে না-খেয়ে ফেলে দেওয়া খাদ্যের পরিমাপান
হল প্রায় ৩৩ শতাংশ অর্থাৎ তিনভাগের একভাগ । আমেরিকায় প্রাচুর্যে
ভরা খাদ্যের জোগান- উর্বর কৃষিক্ষেত্র ও ফেডারেল ভর্তুকির খাতিরে
। বিষেশজ্ঞরা বলেন, খাদ্য যখন প্রচুর ও সস্তা, মানুষ তখন কেয়ার
করে না অপচয়ের মর্মার্থ । কেন্দ্রীয় সরকার যে রকম 'আবহাওয়া-পরিবর্তন'
হেতু ফারনেস ও ইন্সুলেসনে ট্যাক্স-এ সহজ নিয়ম করে দিয়েছে শক্তি-দক্ষতা
বাড়াবার জন্য, সেই রকম নিয়ম করা প্রয়োজন খাদ্য-অপচয়ের বিরুদ্ধে,
বলে অনেকে মনে করেন ।
চীন
চীনদেশে শুধুমাত্র রানাঘরের
বর্জই হল বছরে ৬০ মিলিয়ন টন । এটা আট হাজার বর্গ কিলোমেটার জমিতে
শস্য উৎপাদনের সমতুল্য ।
শুধুমাত্র পেইচিং-এ গৃহস্থালীর খাদ্য-বর্জ হল প্রতিদিনে ১৮,০০০
টন ।
মোটামুটি সবটাই ব্যবহৃত হয় জমি ভরাট করার কাজে ।
বিশেষ কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে চীনদেশের মানুষের ব্যবহারিক
চরিত্রের একটা দিক- অতিথি আপ্যায়নে নিজের সামর্থ্য জাহির করার
জন্য প্রয়োজনের অধিক খাদ্য অতিথির সামনে দেওয়া ।
বর্জ কাগজ ও প্লাস্টিক পুনরাবর্তন করার জন্য আলাদা আধার দেওয়া
হয় ; অনেকের মতে, প্রতিদিনের বর্জ খাদ্যের জন্য আলাদা ভাণ্ডার
দেওয়া হোক এবং তা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পশুখাদ্য তৈরি হোক ।
জনসাধারণকে জ্ঞাত করার জন্য বিশেষ আন্দোলনের প্রয়োজন বলে অনেকে
মনে করেন ।
ভারত
একটা এস্টিমেট অনুযায়ী
ভারতে প্রতি বৎসরে ৫৮,০০০ কোটি টাকার ( ৫৮০ বিলিয়ন ) কৃষিজাত
খাদ্য নষ্ট হয় । কারণ, ফসল-তোলার পরবর্তী কালের আনুসাঙ্গিক ব্যবস্থার
যেমন, ঠাণ্ডাঘর, যানবাহন ও প্রকৃত সংরক্ষণব্যবস্থার অভাব ।
উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বিবাহাদি সামাজিক ক্রিয়াকর্মে প্রচুর
খদ্য নষ্ট হয় ।
আমরা কি
করতে পারি ?
বাজারে যাওয়ার আগে প্ল্যান
করুন কি কিনবেন, একটা কেনাকাটার তালিকা তৈরি করে নিলে ভালো হয়
। বিবেচনা করে খাদ্য পাতে দিন, যা' উদ্বৃত্ত, তা' ফ্রিজে রাখুন
যাতে পরে খাওয়া যায় ।
সভা-সমিতি বা অন্যান্য উৎসবে খাবার দিতে হলে আয়োজনে সঠিক খাদ্যতালিকা
করুন ; কোন জিনিসের কতটা প্রয়োজন তা' সঠিক নিরূপণের মধ্যেই আয়োজনকারীর
সাফল্য ; যথেচ্ছ ব্যবস্থা করলাম এবং যথেচ্ছ উদ্বৃত্ত পড়ে থাকার
মধ্যে কোনও গৌরব নেই ।
উৎস :
www.fao.org/docrep/014/mb060e/mb060e00.pdf
http://blogs.worldwatch.org/nourishingtheplanet/category/food;
http://www.wrap.org.uk
online.wsj.com
www.alonews.com/team/hugh-collins
www.abc.net.au/worldtoday/content/2006/s1583287.htm
শঙ্কর সেন
৮ মে, ২০১২
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)