প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বেরিলিয়াম, বেরিলিয়োসিস এবং তারপর!

বেরিলিয়াম একটি স্বল্পপরিচিত হাল্কা ধাতব মৌল। ১৭৯৮ খৃষ্টাব্দে ফরাসী খনিজ পদার্থ বিশেষজ্ঞ “রেনী যাস্ট হাউই”(Rene Just Hauy) লক্ষ্য করেছিলেন যে মহার্ঘ রত্নপাথর পান্নার আলোক বিচ্ছুরণের ধরণ বেরিল নামক খনিজ পদার্থটির সঙ্গে সাদৃশ্য যুক্ত। হাউই তখন রসায়নবিদ Louis Nicholas Vauquelin কে অনুরোধ করেন ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে বের করতে। Vauquelin দেখলেন পান্না এবং বেরিল, দুটো পদার্থেই রাসায়নিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য প্রায় একই এবং বেরিলে তখন পর্যন্ত একটি অজানা মৌল পদার্থ বর্তমান। ১৮২০ সালে, বিখ্যাত German রসায়নবিদ Wholer, বেরিল থেকে ঐ নতুন ধাতব মৌলটি নিষ্কাশিত করে, তার নাম দিলেন; “বেরিলিয়াম”। প্রথম অবশ্য এই ধাতুর লবণগুলোর(salt) মিষ্টি স্বাদের জন্য এর নাম দেওয়া হয়েছিল গ্লুসিনিয়াম(glucinium)। কিন্তু সেই নাম গৃহীত হয়নি। যে বেরিল খনিজ থেকে বেরিলিয়াম ধাতু নিষ্কাশন করা হয়, তার যখন অল্প পরিমাণে অশুদ্ধি হিসাবে ক্রোমিয়াম অক্সাইড বর্তমান থাকে তখন তার রং হয় ঘন সবুজ, যার নাম পান্না(Emerald)। অনেক সময়ে অশুদ্ধির পরিমাণের হেরফের ঘটলে পান্নার রং হয় নীলাভ সবুজ। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন; “আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ”, বৈজ্ঞানিকরা বলবেন ক্রোমিয়াম অক্সাইডের রঙে বেরিল হল সবুজ রত্ন পাথর পান্না। নীলাভ সবুজ বেরিলকে বলা হয় “Aquamarine”। বেরিল খনিজটি গ্রানাইট পাথরের ভেতরে ঢুকে থাকে কেলাস(Crystal) আকারে। এই ষড়ভুজি(hexagonal) কেলাস এমন দৈত্যাকার রূপেও পাওয়া যায়, যার ওজন ৬০-টন পর্যন্ত হতে পারে। ব্রাজিলেই সর্বাধিক পরিমাণে বেরিল পাওয়া যায়। তাই ১০০-টন গ্রানাইট পাথর কেটে সাধারণত অর্ধ টন বেরিল বের করে আনা যায়। ১-টন বেরিল থেকে প্রায় ৩২ কিঃগ্রাঃ ধাতব বেরিলিয়াম নিষ্কাশিত করা যায়। পান্না যদিও বেরিলেরই সমগোত্রীয়, কিন্তু তা সহজ লভ্য নয়, বরঞ্চ অত্যন্ত বিরল। সেই কারণে এক টন বেরিলের দাম যদি হয় ৪০০ থেকে ৫০০ ডলার, তবে এক টন পান্নার দাম হবে ২৫-বিলিয়ন ডলার।

ব্যাবহারিক দিক থেকে বিচার করলে বেরিলিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাতু। ১৯৩২ সালে James Chadwick, তেজস্ক্রিয়(radioactive) পোলনিয়াম থেকে নির্গত আলফা কণাকে দিয়ে বেরিলিয়ামের পাতলা চাদরে আঘাত করে দেখলেন এই অভিঘাতের ফলে ওই ধাতুর চাদর থেকে নির্গত হচ্ছে প্রোটনের মতন প্রায় একই ভরযুক্ত এক ধরণের তড়িৎ আধারহীন(neutral) কণা। এই কণাকে তিনি নাম দিলেন নিউট্রন(Neutron)। এই যুগান্তকারী গবেষণার জন্য Chadwick ১৯৩৫ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এই আবিষ্কারের পর থেকেই বেরিলিয়ামের দিকে বিজ্ঞানীদের বেশি দৃষ্টি পড়ে। এর আগে ১৯২০ সালেই জানা গিয়েছিল, তামার সাথে ২% বেরিলিয়াম মিশিয়ে যে সংকর ধাতু(Alloy) পাওয়া যায় সেটি তামার চাইতে ছয়গুণ শক্ত এবং অধিক তাপ সহনশীল। এটির ধাতুক্ষয় প্রতিরোধ শক্তি আছে, যাকে ইংরাজিতে corrosion resistant বলা হয় এবং এই সঙ্কর ধাতু চুম্বক দ্বারা আকর্ষিত হয় না। অন্য কোন ধাতব বা অধাতব বস্তুর সঙ্গে ঠোকা-ঠুকি লাগলে বা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে এর থেকে কোন আগুনের ফুলকি ছিটকে বের হয় না। এই সব গুণাবলীর অধিকারী হবার সুবাদে বেরিলিয়াম যুক্ত সংকর ধাতুটি ব্যাবহার হয় উড়োজাহাজের সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশে, নানা প্রকার নির্ভুল পরিমাপক যন্ত্রে, কম্পিউটারের বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশে, বৈদ্যুতিক রিলে(relay) ব্যবস্থায় এবং দামী ক্যামেরার শাটার(Shutter) এর মধ্যে। এই শঙ্কর ধাতুর তৈরি স্প্রিং(spring)-এর কার্যকারিতা প্রায় অবিনশ্বর বলা হয়। তামা+বেরিলিয়াম সংকর ধাতুর থেকে বানান হাতুড়ি, রেঞ্চ(spanners) এবং অন্যান্য নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ছোট-ছোট যন্ত্রাদি পেট্রোলিয়াম শোধনাগারে, নানান সহজ দাহ্য গ্যাস উৎপাদনকারী শিল্পে বহুল ব্যবহৃত হয়, যেখানে সাধারণ ইস্পাত নির্মিত যন্ত্র ব্যাবহারে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতে পারে আর বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। রঞ্জন রশ্মি যন্ত্রের জানালা হিসাবে বেরিলিয়াম ধাতু ব্যবহার প্রচলিত আছে। কারণ ওই রশ্মি জানালা ভেদ করে অভিপ্ত বস্তুর ওপরে গিয়ে পড়তে পারে।

পারমানবিক গবেষণায় বেরিলিয়ামের ভূমিকা অতীব কার্যকরী। বেরিলিয়ামকে Chadwick নিউট্রনের উৎস হিসাবে আবিষ্কার করার পর, এই নিউট্রনের উৎসকে কাজে লাগিয়ে কিম্বদন্তীর পরমাণু বিজ্ঞানী এনরিকো ফারমি(Enrico Fermi) প্রথম গবেষণাগারে ইউরেনিয়াম ধাতুর বিভাজন(fission) প্রক্রিয়ার যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছিলেন। বেরিলিয়াম যে শুধুই নিউট্রনের উৎস হিসাবে কাজ করে তাই নয়, ধাতুটির আর একটি গুন হল, এই ধাতুর ভেতর দিয়ে নিউট্রনকে প্রবেশ করালে তার গতি হ্রাস পায়। এই শ্লথ গতির নিউট্রন(slow Neutron) ইউরেনিয়ামের নিয়ন্ত্রিত বিভাজন ঘটায় এবং নির্গত পারমানবিক শক্তিকে সঠিক মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এই ব্যবস্থা গঠনাত্মক কাজে সাহায্য করতে সক্ষম। বেরিলিয়ামকে তাই চমৎকার একটি নিউট্রন প্রতিফলন(reflector) হিসাবে গণ্য করা হয়। বেরিলিয়াম ধাতু পারমানবিক চুল্লীতে নিউট্রনের সহনীয় মাত্রা বজায় রাখতে(moderator) কাজ করে থাকে। যে কাজ আজকাল গ্রাফাইট(graphite) দিয়ে করা হয়। তবে ওজনে অনেক হালকা বলে, অনেক স্থানে গ্রাফাইটের চেয়ে বেরিলিয়াম কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি এবং তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার একটি পরমাণু শক্তি চালিত ডুবোজাহাজে বেরিলিয়াম মডারেটর হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কঠিন অথচ হালকা এবং রুপোর মতন উজ্জ্বল এই ধাতুটি আজকাল উন্নত ধরনের উড়োজাহাজ, ক্ষেপণাস্ত্র, মহাকাশযান তৈরির নানা কাজে ব্যাবহারের চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। বেরিলিয়ামের অক্সাইড যৌগটি অন্য অনেক সিরামিক(ceramic) বস্তুর থেকে অধিক তাপ পরিবহনে সক্ষম, তাই মহাকাশযানে এর ব্যাবহার নিয়ে জোর সওয়াল করা হচ্ছে।

এ পর্যন্ত বেরিলিয়ামকে আমরা নানা গুণ সম্পন্ন, প্রায় একটি অত্যাশ্চর্য ধাতু রূপে জানলাম। তবে এর অত্যন্ত বিশিষ্ট কতগুলি কাজে সীমাবদ্ধ। কেবল বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিশেষজ্ঞরাই এই ধাতুর সংস্পর্শে আসতেন। সাধারণ লোক যাকে বলে আম জনতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে এই ধাতুরযৌগ সমূহের সাথে পরিচয় হল যখন বিশেষ রূপে তৈরি বেরিলিয়াম যৌগ ফ্লুরেসেন্ট টিউব আলোর ভেতরে প্রলেপ রূপে ব্যবহার করা শুরু হল। এই আলোর টিউবের আলো থেকে যে সাদা আলোর স্ফুরণ হয় তার জন্য টিউবের ভেতরে প্রলেপটি দেওয়া হত বেরিলিয়াম-জিংক-সিলিকেট নামক যৌগের সাহায্যে। এই পদার্থটি স্বয়ংপ্রভ অর্থাৎ আলো পড়লেই এর থেকে শ্বেতবর্ণের জ্যোতি স্ফুরণ ঘটে থাকে, যাকে ইংরাজিতে ফসফর বলা হয়। কিন্তু বিপদ তখনই দেখা দিল; এই “বেরিলিয়াম ফসফর” থেকে মানব দেহে নতুন এক রোগের সৃষ্টি হল। বেরিলিয়াম ফসফর তৈরির সময়ে এক বিরাট সংখ্যক শিল্প শ্রমিক এবং কারখানার অন্যান্য সাধারণ কর্মীরা বেরিলিয়োসিস(Berylliosis) ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। বেরিলিয়াম ফসফর তৈরির সময়ে যে ক্ষুদ্র কণা বাতাসে ভেসে বেড়ায় কারখানার ভেতরে, সেই ভাসমান কণার সংস্পর্শে আসার পরেই এই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময়ে অথবা উৎপাদিত ফসফরের গুঁড়ো স্থানান্তরিত করার সময়ে এই বিষটি মানব দেহে প্রবেশের সুযোগ পায় বলে ধারনা করা হয়। বেরিলিয়োসিস্ রোগের উপসর্গ প্রথমে যক্ষ্মা রোগের মতন মনে করা হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই রোগের প্রকৃত লক্ষণগুলি বুঝতে পারলেন। এবং দেখা গেল এই রোগটি ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, চামড়ার উপরি ভাগে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে বাহু, মুখে এবং ঘাড়ের ত্বকে। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ডের ডাঃ এইচ. এস. ভেন ওরডেসস্ট্রান্ড(Dr.H.S.Van Ordstrand) ও তাঁর সহকর্মীরা ১৭০-জন বেরিলিয়োসিস রোগীর চিকিৎসা করেছেন যাদের চামড়ায় ও ফুসফুসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এদের যথাযথ চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা হয়েছিল, এমনকি চামড়ার ভেতরে ঢুকে যাওয়া বেরিলিয়াম ফসফরের কণাগুলিকে বিশেষ উপায়ে বের করে এনে। এদের মধ্যের বেশ কয়েকজন রোগীকে সুস্থ করা হয়ে ছিল। ক্রমশ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে(Germany, Italy, USSR) থেকে এই ধরণের রোগের খবর আসতে থাকে। ম্যাসাচুসেটস থেকে কয়েকজন ডাক্তার জানিয়েছিলেন যে বেরিলিয়াম সিলিকেটের কারখানায় কাজ করা বন্ধ করে দেবার বেশ কয়েক বছর পরে ১৭-জন শ্রমিকের দেহে বেরিলিয়াম উপসর্গ দেখা দেয়। বেরিলিয়াম শিল্পের শ্রমিকের কারখানার পোশাক ধুয়ে পরিষ্কার করার কারণে শ্রমিকের স্ত্রীদের দেহে এই রোগের আক্রমণ দেখা দেয়। পারমানবিক বোমা তৈরির “মানহাটন” প্রজেক্টে কর্মরত একজন পদার্থবিদ ১৯৩৮ সালে বেরিলিয়ামের সংস্পর্শে আসেন কিন্তু তাঁর দেহে বেরিলিয়োসিসের উপসর্গ দেখা দেয় ১৯৪৬ খৃষ্টাব্দে। বেরিলিয়োসিস আক্রান্ত রোগীদের তালিকায় প্রথম নামটি তাঁরই। আক্রান্ত হবার ১০-বছর পরেও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে এমন ৩৫-জনের সন্ধানও পেয়েছেন চিকিৎসকেরা। এই যে আক্রান্ত হবার বহু পরে উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার ঘটনাকে চিকিৎসা শাস্ত্রে Chronic symptoms বলা হয় এবং এই লক্ষণ প্রকাশ পেলে ডাক্তাররা বেশির ভাগ সময়েই বিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভাঙ্গা ফ্লুরেসেন্ট টিউবের টুকরো জঞ্জালের সাথে ফেলে দেওয়া হয়। এই ভাঙা টুকরোতে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হলেও বেরিলিয়োসিস দেখা দিতে পারে। এক কিশোর বয়সের ছেলের গায়ে ক্ষত সৃষ্টি হবার ২-মাস পরে এই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক শক্তি কমিশনে কর্মরত ১৫-জন বৈজ্ঞানিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেরিলিয়ামের সংস্পর্শে এসেছিলেন। যাবতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও তাদের শরীরে বেরিলিয়োসিস রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। বেরিলিয়াম ফসফর তৈরির কারখানার চিমনির থেকে নির্গত ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে থাকা কণা থেকেও প্রায় ১-মাইল দুরে বসবাসকারী জনসাধারণকে বেরিলিয়োসিস এর রোগী হিসাবে চিহ্নিত করা গেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বেরিলিয়ামের আর মারাত্মক কোন প্রভাব আছে কিনা তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ৫০-দশক থেকেই করছেন। এখন পর্যন্ত বেরিলিয়োসিস রোগের নির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক ওষুধ আবিষ্কার হয়নি যার প্রয়োগে acute বা chronic অবস্থায় তার প্রয়োগে রোগটি মনুষ্য শরীর থেকে নির্মূল করা সম্ভব হবে, অতি অল্প সময়ে। এ ব্যাপারে কিন্তু বৈজ্ঞানিকরা বসে নেই। গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে অবিরাম পরীক্ষা নিরীক্ষা তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পেছনের ছবিটি দৈত্যাকৃতি বেরিলের কেলাসের। সামনের চারটি ছবি যথাক্রমে বাঁদিক থেকে এমারেল্ড যুক্ত লাইমস্টোন খণ্ড, অ্যাকোয়ামেরিণের খণ্ড, এবং তৃতীয় ও চতুর্থ ছবি দুটি এমারেল্ড (পান্না) খণ্ডের। এই সবগুলোই অ্যামেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচেরাল হিস্ট্রিতে রক্ষিত আছে।

ওপরে যে ছবিটি দেওয়া হল এই প্রবন্ধের মাধ্যমে, সেই চিত্রটি গত শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে, বেরিলিয়ামের বিষক্রিয়া সম্বন্ধে প্রায় সব প্রকারের তথ্য হাতে আসায়, চিকিৎসকরা এর চিকিৎসায় কোন প্রকারের অসুবিধায় পড়ছেন না। তাছাড়া, বেরিলিয়াম ঘটিত বিপর্যয় এড়াতে নানান নিয়মকানুন মেনে চলার নির্দেশ পাওয়া গেছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। যেমন; বেরিলিয়াম ও সেই সম্পর্কিত শিল্প কারখানায় উচ্চস্তরের গৃহস্থালির নিয়মাবলী প্রয়োগ করতে হবে যাতে বেরিলিয়াম ধাতু বা তার যৌগ দেহের সংস্পর্শে না আসতে পারে। শ্বাসক্রিয়ার মাধ্যমে যেন দেহে প্রবেশ না করে। কারখানার আবহাওয়ায় যেন বেরিলিয়াম বা তার যৌগকণার পরিমাণ প্রতি কিউবিক মিটার বাতাসে ১০০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কোন কোন সংস্থা এই পরিমাণ ০২ মাইক্রোগ্রামে নামানর ব্যবস্থা করতে বলেছে। কারখানার বাইরের বায়ুমণ্ডলে এর পরিমাণ হওয়া উচিৎ এক মাইক্রোগ্রামের ১০০-ভাগের ১-ভাগ। বেরিলিয়োসিসের কোন অমোঘ প্রতিষেধক আজও আবিষ্কার না হলেও, বেরিলিয়িমের খনি, কারখানা, গবেষণাগার ইত্যাদি, প্রায় সব ক্ষেত্রে সঠিক গাত্রাবরণ, জুতো, মুখোস, দস্তানা, চশমা, মস্তকাবরণ ইত্যাদি ব্যাবহার বাধ্যতামূলক করার পর, বহুল পরিমানে এই মারণ রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।

বেরিলিয়াম-জিংক-সিলিকেট, এই স্বয়ংপ্রভ পদার্থটিকে টিউব লাইটে ব্যাবহার ১৯৪৯ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফ্লুরেসেন্ট টিউব নির্মাণ কারখানায় যখন বহু সংখ্যক শ্রমিক এই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছিলেন, তখন উৎপাদক নিজেরাই U.S.Public health service-এর কর্তাব্যক্তিদের পরামর্শ মেনে বেরিলিয়াম ফসফরের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নতুন করে গবেষণা শুরু হয় নতুন কোন ফসফর যৌগ আবিষ্কারের তাগিদে। ক্যালসিয়াম-হ্যালো-ফসফেট জাতীয় যৌগর ব্যবহার শুরু হয়। এই যৌগটি হল, ক্যালসিয়াম-ফ্লুর-ফসফেট বা ক্যালসিয়াম-ক্লোর-ফসফেট। এদের কোন রকমের বিষক্রিয়া নেই। একেবারে আধুনিক ফ্লুরসেন্ট টিউবে এই যৌগ অবশ্য ব্যবহার করা হয় (T-12, slim type, T-8, slim type & CFL)।

3-band Phosphor; এই ফসফর হল লাল, সবুজ ও নীল ফসফরের মিশ্রণ। সাধারণত, জিংক-সিলিকেট যৌগর সাথে অন্য ধাতু, যেমন; ইউরোপিয়ান, স্টংসিয়াম, অ্যান্টিমনি ইত্যাদি উজ্জিবক(activator) মিলিয়ে এদের তৈরি করা হয়। আবার, বেরিয়াম বা ম্যাগনেসিয়াম এলুমিনেটে ইওরোপিয়াম উজ্জীবক ব্যবহার করেও ফসফর তৈরি হয় আধুনিক যুগের টিউব লাইটের ভেতরে স্বয়ংপ্রভ প্রলেপ দিতে।
কিন্তু বেরিল থেকে বেরিলিয়াম নিষ্কাসন অথবা খনি থেকে বেরিল উত্তোলন, এই কর্মকাণ্ড ত থেমে থাকতে পারে না! তাই শ্রমিক, যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সব রকমের নিরাপত্তা দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই জন্য হয়ত নতুন করে কেউ বেলিয়োসিসে আক্রান্ত হচ্ছেন না কিন্তু, রোগটির উপসর্গ আক্রান্ত হবার ১০-১৫ বছর পরে দেখা যায়(chromic effect) বলে আজও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে চলেছেন এই রোগের সঠিক প্রতিষেধক আবিষ্কারের আসায়।

পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয়(environment health) ব্যাপারটি নিয়ে আজকাল পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বিশেষ জোর দিচ্ছেন ধাতুর বিষক্রিয়ার ওপর। পারদ, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক ইত্যাদির খবর আজকাল বহুল প্রচারিত খবর। কিন্তু স্বল্প পরিচিত বেরিলিয়াম ও তার যৌগরা যে কি পরিমাণ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পেরেছিল এবং পারে, সেই বিষয়ে পাঠকদের অবহিত করার জন্যই এই প্রবন্ধের অবতারণা। এই বিষয়ে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রায় ২৫০ বছর আগে Bernadino Ramazzini নামে এক চিকিৎসক শিল্প কারখানার শ্রমিকদের নানান রোগ সম্বন্ধে গবেষণা চালানর সময়ে একটি দামি কথা বলেছিলেন; তাঁর পরামর্শ ছিল, “ডাক্তাররা যখন কোন কর্মজীবী মানুষের চিকিৎসা করবেন তখন তাঁদের অবশ্যই জেনে নেওয়া উচিৎ সেই ব্যক্তি কি ধরণের কর্মে সঙ্গে যুক্ত আছেন”? তা না হলে নির্ভুল রোগ নির্ণয় করা কখনই সম্ভব হবে না। বেরিলিয়োসিস রোগের ক্ষেত্রে এই উপদেশ অতীব মূল্যবান এবং যাঁরা পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন তাদের ক্ষেত্রে এই পরামর্শ দিক নির্দেশক বলে বিবেচিত হতে পারে।

প্রকৃতির কি বিচিত্র লীলা! বেরিল খনিজের মধ্যে ক্রোমিয়াম অক্সাইড অশুদ্ধি রূপে থাকার ফলে সেটি রূপান্তরিত হয়েছে অত্যন্ত মহার্ঘ রত্ন প্রস্তর পান্না(Emerald) আর অ্যাকোয়া মেরিনে(Aquamarine)। বেরিল থেকে প্রাপ্ত ধাতব মৌল বেরিলিয়াম প্রমাণিত হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও জন-হিতকারী মৌল রূপে, যা পারমানবিক শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিশেষ ভাবে প্রয়োজনীয়। কিন্তু প্রকৃতির ঋণ পরিশোধ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়না, প্রায় সব ক্ষেত্রেই। তবে প্রকৃতি ও তার ঋণ আদায় করে নিতে জানে এবং এই ক্ষেত্রে বেরিলিয়োসিস ব্যাধির সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক বার্তা দিয়েছে; যথেচ্ছ এবং অনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করার আগে ভাল এবং খারাপ দুটো দিকই বিচার করা যে একান্ত ভাবে প্রয়োজন সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে কু-দিকটার মোকাবিলা করার জন্য ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত ভাবে জরুরি সেই কথা বারংবার মনে করিয়েছে। না হলে কি ভয়ঙ্কর বিপদ মানুষের জন্য অপেক্ষা করে আছে, তা বেরিলিয়োসিস রোগ মারফত জানিয়ে দিয়েছে।

ডঃ সবুজ ভাওয়াল


অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।