প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পরিপূর্ণ গ্রহ, কিন্তু থালা শূন্য- খাদ্যাভাবে নূতন ভূমি-রাজনীতি

দ্বিতীয় অধ্যায় ।
জনসংখ্যা-বৃদ্ধির ইকোলজি

পৃথিবীতে মনুষ্য-অবস্থানের প্রথম থেকেই জনসংখ্যা-বৃদ্ধি এতো মন্থর ছিল যে একটা বংশের মধ্যে তা' বোঝাই যেত না । ১৮০৪ খ্রীষ্টাব্দে ১ বিলিয়ন জনসংখ্যা হতে সময় লেগেছিল রঙ্গমঞ্চে আধুনিক মনুষ্যজাতি প্রবেশ পর্যন্ত । দ্বিতীয় বিলিয়ন জনসংখ্যা হল ১৯২৭ খ্রী-তে এক শতাব্দী পরে । তেত্রিশ বছর পরে, ১৯৬০ খ্রী-তে, জনসংখ্যা পৌঁছালো ৩ বিলিয়নে । তারপরের বিলিয়নে পৌঁছাতে সময় লেগেছে মাত্র ১৩ বছর এবং এই ভাবে ত্বরান্বিত হয়ে ৭ বিলিয়ন জনসংখ্যা হয়েছে ২০১১ খ্রী-র শেষভাগে ।

মনুষ্যজাতির সংখ্যার এই বিশাল বৃদ্ধির একটি ফলশ্রুতি হল আমাদের চাহিদা ছাড়িয়ে যেতে বসেছে প্রকৃতির ধারক-ব্যবস্থাগুলিকে যথা, বনভূমি, মত্‍‌সপালন, পশুচারণভূমি, জলস্তর এবং মৃত্তিকা । একবার যদি চাহিদা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উত্‍‌পাদনকে ছাড়িয়ে যায় তখন সম্পদের মূলকে নিয়ে টানাটানি পড়ে ; এবং বাড়তি চাহিদা মেটাতে আমরা সেই সম্পদকে ব্যবহার করি । এইকাজগুলিকে নির্দেশ করা যেতে পারে- অতি-বনচ্ছেদন, অত্যধিক মাছধরা, পশুচারনভূমিগুলির অত্যধিক ব্যবহার, ভূগর্ভস্থিত জলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, কৃষিজমির অতি-কর্ষণ । প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের বিশ্বসভ্যতাকে ম্লান করে দিচ্ছে ।
যে exponential হারে বৃদ্ধির জন্য আমাদের সংখ্যা আজ বিস্ফোরক অবস্থায় এসেছে, তা' সম্যক হৃদয়ঙ্গম করা সহজ নয় । এর ফলে আমরা অনেকেই- রাজ্নীতিকগণ-সহ, বুঝতে পারিনা যে বার্ষিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি আসলে শতাব্দী-শেষে ২০-গুণ বৃদ্ধি ।

ফরাসীদেশে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের exponential বৃদ্ধি বোঝাতে একটা হেঁয়ালি ব্যবহার করা হয়. হেঁয়ালিটা হল, একটা লিলিফুলের জলাধারকে নিয়ে যার মধ্যে ছিল একটি পাতা । প্রতিদিন পাতা দ্বিগুণ হয়ে যেত- দ্বিতীয় দিনে ২-টি, তৃতীয় দিনে ৪-টি, চতুর্থ দিনে ৮-টি, ইত্যাদি, ইত্যাদি । প্রশ্ন হল, জলাধারটি যদি পাতায় পূর্ণ হয় ত্রিশ দিনে, কতদিনে অর্ধেক পূর্ণ হবে ? উত্তর অবশ্যই- ঊনত্রিশ দিনে । আমাদের 'বিশ্ব-জলাধার' হয়তো ৩০ দিনে পৌঁছেচে ।
সাম্প্রতিককালের ইউ.এন. জনসংখ্যার প্রক্ষেপ থেকে জানা যাচ্ছে যে, ২০৫০ খ্রী-নাগাদ জনসংখ্যা হবে ৯.৩ বিলিয়ন ; অর্থাত্‍‌ আরও ২.৩ বিলিয়ন যুক্ত হবে । অনেকেই মনে করেন যে এই জনসংখ্যা-প্রক্ষেপ, যা' গত ৫০ বছর ধরে করা হচ্ছে, সঠিক হবে । কিন্তু এটা ঠিক নয় যখন আমরা ধরি খাদ্য যোগানের প্রতিবন্ধকতা, যথা, ক্রম-বর্ধিত স্থানে জলের দুষ্প্রাপ্যতা এবং বিশ্ব-উষ্ণায়ণ । মানুষের বর্ধিত সংখ্যাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পৃথিবীর সম্পদ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে ।
অবশ্য, পৃথিবীর জনসংখ্যা-বৃদ্ধির হার কমে আসছে শিখর ২.১-শতাংশ ( ১৯৬৭ খ্রী ) থেকে ১.১-শতাংশ, ২০১১ খ্রী-তে । এটা ঠিক পরিষ্কার নয় যে এই বৃদ্ধির হার আরও মন্থর হয়ে আসবে কিনা ; কারণ আমরা ছোট পরিবারে যাই বা না-যাই, মৃত্যুর হার পরিশেষে বৃদ্ধি পাবে । আমরা জানি- প্রয়োজনীয় কি করতে হবে । পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ নারী চায় পরিকল্পিত সংসার, কিন্তু প্রজনন-স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা অতি-অপ্রতুল । এই শূণ্যস্থান পূর্ণ করতে পারলে আমরা পৃথিবীর জনসংখ্যা সুস্থিত করর কাজে অনেকটা এগিয়ে যাবো । এতে নারীজাতির ও তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য ও অন্যান্য অবস্থার অশেষ উন্নতি হবে ।

জনসংখ্যা-প্রক্সেপন বেশ কিছু অনুমিতির উপর নির্ভরশীল যথা, প্রজনন-স্তর(fertility levels), বয়স-বিভাজন(age distribution)এবং জীবন-প্রত্যাশা(life expectancy)। এগুলি অনেক সময় ভ্রমের সৃষ্টি করে যে, পৃথিবী অনেক বেশি বর্ধিত-অব্স্থাকে ধারণ করতে পারবে । নিয়ামকরা সাধারণতঃ এইসব প্রশ্ন করেন না যে, বর্ধিত ২.৩ বিলিয়নের জন্য য্থেষ্ট খাদ্য পাওয়া যাবে তো ? শস্যহানিকর উষ্ণায়নের সামনে জনসংখ্যা-বৃদ্ধিতে কোনও ব্যাঘাত হবে না তো ?

বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাই সেচের প্রয়োজনে জল । এখন তো বিশ্বের অর্ধেক মানুষ বেঁচে আছে অত্যধিক পাম্প-চালিত জলের উপর । এ অবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না ।
মাছের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য । জনসংখ্যা-বৃদ্ধি সামুদ্রিক মাছের চাহিদা বাড়িয়েছে । একটা মাছের ট্রলার ততটাই মাছ ধরতে পারে যতক্ষণ সে মাছের প্রজনন-ক্ষমতার হিসাবের সীমার ভিতরে থাকে । সীমার বাইরে গেলেই মাছের সংখ্যা যাবে কমে অবং অবশেষে সর্বাঙ্গীণ পতন । বর্তমানে ৮০-শতাংশ সামুদ্রিক মাছ ধরা হচ্ছে পরিরক্ষিত-অবস্থার বাইরে ।

যখন সামুদ্রিক মত্‍‌সচাষ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, তখন আমাদের মূল ভূখণ্ডে মত্‍‌সচাষের কথা ভাবতে হবে । কিন্তু এতেও তো লাগবে জমি এবং জল, কারণ মাছদের তো খাদ্য দিতে হবে- শস্য ও সয়াবিনের মিশ্রণ । সুতরাং, সামুদ্রিক মত্‍‌সচাষ ব্যবস্থার পতন মানে মূল ভুখণ্ডে জমি ও জলের উপর চাপ ।
মানুষের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, পশুধনও বাড়বে পাশাপাশি- বিশেষতঃ পৃথিবীর যে সব অঞ্চলে পশুধনপালন একটা বৃত্তি । এটি সব থেকে বেশি দেখা যায় আফ্রিকা মহাদেশে, যেখানে ১৯৬১ সালের ২৯৪ মিলিয়ন জনসংখ্যা ২০১০ সালের প্রায় ১ বিলিয়নে বৃদ্ধি পেল, সঙ্গে পশুধন বৃদ্ধি পেল ৩৫২ মিলিয়ন থেকে ৮৯৪ মিলিয়ন ।
যখন তৃণভূমির পরিরক্ষিত উত্‍‌পাদন ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে পশুধন-সংখ্যার তুলনায়, ইকোব্যবস্থা অপকৃষ্টতা লাভ করবে । গাছপালার নাশ জমিকে করবে ভূমিক্ষয়ের অধীন । একটা সময়ে জমি পরিণত হবে মরুভূমিতে, সাধারণ মানুষ হরবে তাদের উপজীবিকা ও খাদ্যের যোগান. য়েমন হয়েছে আফ্রিকায়, মধ্যপ্রাচ্যে, মধ্য এশিয়া ও উত্তর চীনের কিছু অংশে ।

জনসংখ্যা-বৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পায় জ্বালানি, কাগজ ও অপ্রয়োজনীয় জিনিষের । ফলশ্রুতি হল কাঠের চাহিদা বনভূমির নবোত্‍‌পাদন ক্ষমতার বাইরে চলে যায় । বিশ্বের বনভূমি গত কয়েক দশক ধরে ক্ষীয়মান, বর্তমানে বছরে ৫.৬ মিলিয়ন হেক্টর হিসাবে কমে আসছে । কোনও কোনও দেশ, যেমন মরিটানিয়া, তার বনভূমির প্রায় পুরোটাই হারিয়েছে । বৃক্ষহীন অবস্থায় মৃত্তিকাকে ও জলনিকাশী ব্যবস্থাকে বাঁচানো যায় না, পুরো ইকোব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং প্রয়োজীয় খাদ্যোত্‍‌পাদন ব্যহত হয় ।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সঙ্গে আনে অত্যধিক কর্ষণ- চরম ভূমিক্ষয় জমিকে করে চাষের অযোগ্য । এই অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি আফ্রিকায়, মধ্য-পূর্বাঞ্চলে এবং এশিয়া মহাদেশে । প্রান্তস্থ জমি কর্ষণের ফলে ভূমিক্ষয় হয় যার পরিণতি জমি কৃষির অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায় । উর্বরতাহীন জমি পরিণত হয় পতিত জমিতে ।
সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা পৃথিবীর পরিবেশ-বিষয়ক নিবৃত্তির চিহ্ণগুলি অগ্রাহ্য করেছি । জলপীঠ নিম্নগামী হওয়া সত্ত্বেও একটি দেশও নেই যে জলের ব্যবহার কমিয়েছে জলবাহী-স্তরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে । আমরা যদি বিপদগুলি অগ্রাহ্য করার ইচ্ছাকে বন্ধ না করি, যদি যে ঝুঁকি নেোয়া হচ্ছে সে বিষয়ে সচেতন না হই, তবে অবস্থা হবে পূর্বেকার সভতাগুলির মতন যারা পরিবেশের প্রবণতাগুলিকে পাল্টাতে অক্ষম হয়ে খাদ্য-ব্যবস্থার ক্ষতিসাধন করেছে । সুখের কথা এই যে, পশ্চিমের এবং পূর্ব-ইয়োরোপের ৪৪-টি দেশের জনসংখ্যা একটা স্থায়ী মানে পৌঁছেচে বিগত কয়েক পুরুষ ধরে উর্বরতা-হ্রাসের কারণে । এদের জনসংখ্যা এখন ৯৭০ মিলিয়ন, মোট বিশ্ব-জনসংখ্যার প্রায় এক-সপ্তমাংশ ।
আরও দুটি ভৌগলিক অঞ্চল বর্তমানে দ্রুত এগোচ্ছে সুথিত জনসংখ্যার দিকে । পূর্ব-এশিয়া- জাপান, উঃ ও দঃ কোরিয়া, চীন ও তাইওয়ান - প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মনুষ্যসহ, জনসংখ্যা সুস্থিতে প্রায় পৌঁছে গেছে । জাপানের জনসংখ্যা কমছে, দুই কোরিয়া ০ তাইওয়ানের্স জনসংখ্যা বাড়ছে অল্পস্বল্প আর চীনের ১.৩৫ বিলিয়ন জনসংখ্যাকে প্রক্ষেপন করা হয়েছে ১.৪ বিলিয়ন-শীর্ষে, ২০২৬ সালে । ২০৪৫ সাল নাগাদ এর জনসংখ্যা বর্তমানের থেকে কম হবে, আশা করা হচ্ছে ।
ল্যাটিন আমেwরিকায় দারিদ্র্য-দূরীকরণ ও জনসংখ্যা-নিয়ন্ত্রণের যৌয্হ কর্মসূচী জনসংখ্যাকে কমিয়ে আনছে । এর জনসংখ্যা, ২০১২ খ্রী-তে ৬০০ মিলিয়ন, -কে প্রক্ষেপন করা হয়েছে ৭৫১ মিলিয়নে, ২০৫০ খ্রী নাগাদ । এই অঞ্চলের সব থেকে বড় ব্রাজিলের প্রক্ষেপন হল ২০১২ খ্রী-র ১৯৮ মিলিয়ন থেকে ২০৫০ খ্রী-তে ২২৩ মিলিয়নে- গত চার দশকে মাত্র ১২ শতাংশ বৃদ্ধি ।

ভবিষ্যত্‍‌ জনসংখ্যা-অনুশীলনে খারাপ সংবাদ হল সকল জনসংখ্যা-বৃদ্ধি হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ভূমির আয়তন এই বৃদ্ধিকে ধারণ করতে সক্ষম নয় । দুটি অঞ্চল যেখানে ভবিষ্যতে জনসংখ্যা-বৃদ্ধি হবে, তা' হল ভারতীয় উপমহাদেশ এবং সাহারা- সন্নিহিত আফ্রিকা । ভারতীয় উপমহাদেশ যার মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, এর মোট জনসংখ্যা হল ১.৬ বিলিয়ন ; ২০৫০ খ্রীতে যার প্রক্ষিপ্ত জনসংখ্যা হল ২.২ বিলিয়ন । সাহারার দক্ষিণের জনসংখ্যা আজ ৮৯৯ মিলিয়ন, ২০৫০ খ্রী-তে যার প্রক্ষেপন হল ২.২ বিলিয়ন । বিশ্বের সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল এই দুই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলিতে দারিদ্র্য-দূরীকরন, পরিবার-পরিকল্পনা ও প্রজনন-স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নারীদের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে ছোট পরিবার আন্দোলনকে সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য করা ।

জনসংখ্যা সুস্থিত হয়েছে এমন দেশগুলি এবং যে সব দেশে এখনও বৃহত্‍‌ পরিবার চালু আছে- এদের মধ্যে প্রভেদ খুব বেশি নয় । বর্ণালীর একদিকে রয়েছে জার্মানী- জনসংখ্যা ৮২ মিলিয়ন, রাশিয়া- ১৪৩ মিলিয়ন এবং জাপান- ১২৬ মিলিয়ন । প্রক্ষেপন-অনুযায়ী এই তিনটি রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ২০৫০ খ্রী-তে আরও প্রায় দশ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে । বয়ষ্ক জনসাধারণ ও নিম্ন জন্মহার নিয়ে এই দেশগুলিতে মৃত্যুহার নবজাতকের হারের থেকে বেশি । অন্যদিকে, নাইজেরিয়া, ইথিয়োপিয়া এবং পাকিস্তান-এ জনসংখ্যা-বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রবল । নাইজেরিয়া, ভৌগলিক-অঞ্চল টেক্সাসের থেকে বেশি নয়, এর জনসংখ্যা হল ১৬৭ মিলিয়ন, ২০৫০ খ্রী-র প্রক্ষেপন ৩৯০ মিলিয়ন ; ইথিয়োপিয়া, বলা যায় বিশ্বের সবথেকে ক্ষুধার্থ দেশ, তার বর্তমান জনসংখ্যা ৮৭ মিলিয়ন, ২০৫০ খ্রী-র প্রক্ষিপ্ত- ১৪৫ মিলিয়ন ; আর বর্তমানে ১৮০ মিলিয়ন জনসংখ্যার পাকিস্তান ( ভৌগলিক এলাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৮-শতাংশ ) ২০৫০ খ্রী-তে পৌঁছবে ২৭৫ মিলিয়নে- প্রায় মাঃ. যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান জনসংখ্যায় ।

'গণতান্ত্রিক অবস্থান্তর (democratic transition)' আমাদের বুঝতে সাহায্য করে স্বতন্ত্র দেশগুলির জনসংখ্যা-বৃদ্ধি কি ঘটায় তাদের উন্নয়নের ওপর । প্রিন্স্টনের জনসংখ্যা-গবেষক ফ্রাঙ্ক নোটেস্টািন ১৯৪৫ খ্রী-তে একটি তিন-ধাপের জনসংখ্যা বিষয়ক মডেল প্রস্তাব করেছিলেন, যাতে সমাজের আধুনীকরণের উপর জনসংখ্যা-বৃদ্ধির প্রভাব বোঝা যায় । তিনি দেখিয়েছিলেন যে, আধুনীকরণের পূর্বে সমাজে জন্ম ও মৃত্যু দুটোই বেশি ছিল ; অর্থাত্‍‌ জনসংখ্যার বৃদ্ধি খুব একটা হত না । দ্বিতীয় ধাপে, জীবনধারণের মান এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা, দুয়েরই উন্নতি ঘটল, মৃত্যুর হারও কমল । জন্মহার বেশি এবং মৃত্যুহার কম অর্থ হল জনসংখ্যা-বৃদ্ধি যা' দাঁড়াল বছরে প্রায় ৩ শতাংশ হারে । এবার জীবনধারণের মান বৃদ্ধির সঙ্গে, বিশেষতঃ স্ত্রীশিক্ষা বৃদ্ধি পাওয়াতে জন্মহার কমতে কমতে মৃত্যুহারের সমান হলে আমরা পৌঁছাব তৃতীয় ধাপে যখন জন্ম ও মৃত্যুর হর হবে সমান এবং জনসংখ্যা হবে সুস্থিত ।

বেশিরভাগ দেশই পৌঁছে গেছে দ্বিতীয় ধাপে, যদিও অনেক শিল্পোন্নত দেশই তৃতীয় ধাপে পৌঁছেচে অনেক আগেই । দুঃখের বিষয়, বহু দেশই নিজেদের জন্মহার কমাতে পারেনি তৃতীয় ধাপে পৌঁছবার মতন । দ্বিতীয় ধাপটা তাদের কাছে একটা জনসংখ্যার ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে । তিন শতাংশ হারে বর্ধিত জনসংখ্যা, আগেই বলা হয়েছে, তাদের শতাব্দী-শেষে জনসংখ্যা-বৃদ্ধি করেছে ২০-গুণ । উদাহারণ-স্বরূপ আফ্রিকার একটি বড় রাষ্ট্র তানজানিয়ার কথা ধরা যাক ; ২০১২ খ্রী-তে এর ৪৮ মিলিয়ন জনসংখ্যা ৩-শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে আগামী একশত বছরে দাড়াঁবে ৯১৬ মিলিয়নে ; ইরাক-এর জনসংখ্যা ৩৪ মিলিয়ন ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে একশত বছর বাদে দাড়াবে ৬৪৮ মিলিয়নে ।
দু'বংশ ধরে সত্বর জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রকোপে পড়া রাষ্ট্রগুলির সরকারগুলিতে একটা জনসংখ্যা-ক্লান্তির ছাঁপ দেখা যাচ্ছে । নূতন নূতন বিদ্যালয় স্থাপনা এবং নিয়ত-বর্ধিত জনসমুদ্রের জন্য কর্মসংস্থপনা করা এদের রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে ।

যে দেশগুলি ছোট পরিবারে রূপান্তরিত হতে পারেনি, তারা ব্যতিব্যস্ত রয়েছে জমি ও জলের হ্রস্বতায়, রোগ-ব্যধি-তে, জন-বিরোধিতায় এবং সত্বর জনসংখ্যাবৃদ্ধির অন্যান্য প্রতিকুল পরিণামে । আমরা এদের বলব- পতিত রাষ্ট্র- যে দেশগুলির সরকার আর যোগান দিতে পরছে না ব্যক্তিগত সাশ্রয়, খাদ্য-সুরক্ষা এবং মূল সামাজিক প্রয়োজনগুলি যথা, শিক্ষা ও সাশ্ব- ব্যবস্থা । এই অবস্থায় সরকার হারিয়ে ফেলে তার বৈধ্যত্ব, শাসন করার ক্ষমতা । বর্তমানে এরকম রাষ্ট্র হল ইয়েমেন, সোমালিয়া, কঙ্গো গনতান্তিক রিপাবলিক এবং আফগানিস্তান । বড় পতিত-রাষ্ট্রের মধ্যে আছে পাকিস্তান এবং নাইজেরিযা ।

Foreign Poilcy ম্যাগাজিনে প্রতি বত্‍‌সর প্রকাশিত শান্তির জন্য পুঁজি- তালিকা অনুযায়ী উপর থেকে ২০-টি পতিত-রাষ্ট্রের প্রতিটির উর্বরতা সুউচ্চ । উদাহারণ-স্বরূপ, আফগানিস্তান এবং সোমালিয়ার প্রতিটি স্ত্রীলোকের সন্তান হল গড়ে ছয় । এসব দেশ বোঝায় কি ভাবে জনসংখ্যা-ব্রিদ্ধি এবং রাষ্ট্রের ভাঙ্গন একে অপরের বলবৃদ্ধি করে ।

যে সব দেশগুলি তৃতীয় ধাপে পৌঁছে গেছে ক্ষীণ প্রজনন ও অল্প সন্তান নিয়ে, তারা উচ্চ সঞ্চয় দ্বারা উপকৃত । তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্ব্দৃদ্ধ, যাকে জনসংখ্যা-অনুশীলনকারীরা বলেন ⤛ জনসংখ্যা-বোনাস ⤛ । যখন একটি রাষ্ট্র তাড়াতাড়ি ছোট পরিবার গ্রহণ করে, এর ছোট ছোট আশ্রিতরা শিক্ষা ও পালন-পোষণে চাহিদা বড়দের থেকে কম হয় ; ফলে গৃহস্থের সঞ্চয় বাড়ে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় । এই বোনাস থেকে উপকৃত হয়েছে মোটামুটি সব রাষ্ট্রই যারা ছোট ছোট পরিবারে উন্নীত হয়েছে । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ খ্রীর মধ্যে জাপান জনসংখ্যা-বৃদ্ধি রোধে প্রয়াস করেছিল বৃদ্ধির হারকে অর্ধেক করে । ফলশ্রুতি হল পরবর্তী তিন দশকে জাপানের অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনপ্রতি আয় বিশ্বের সেরা হয়েছিল, আধুনিক শিল্প-ইকোনমি হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই দ্বিতীয় স্থানে ।
লাইনে এর পরে আছে, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং এবং সিংগাপুর । এই চার রাষ্ট্রকে বলা হয় তথাকথিত ব্যাঘ্র-অর্থনীতি, যারা বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিপুল অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হর কমার জন্য এবং ফল হিসাবে 'বোনাস'-এর জন্য ।

বৃহত্তর পটভূমিকায় চীনের জন্মহার, বিশেষ করে এর এক-সন্তান সংসার প্রোগ্রাম এনে দিল এক বিশাল জনসংখ্যা-বোনাস যার ফলে জনসাধারণ তাদের আয়ের বর্ধিত অংশ সঞ্চয় করতে ও লগ্নী করতে পারল । বিশাল লগ্নীর হার, তার সঙ্গে বৈদেশিক লগ্নী ও কৃত্‍‌কৌশল চীনকে আজ আধুনিক শিল্প-শক্তিতে পরিণত করেছে । অন্যান্য রাষ্ট্র, যারা উচ্চ সঞ্চয় এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথে, হল শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো, ইরান, তিউনিশিয়া এবং ভিয়েতনাম ।

আমাদের দায়িত্ব আছে এটা দেখার যে, পৃথিবীর সর্বত্র রাষ্ট্রগুলি জনসংখ্যার তৃতীয় ধাপে পৌঁছাতে পারে । যারা জনসংখ্যার ফাঁদে পড়ে আছে, তারা অবশ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আভ্যন্তরীণ সংঘাতের মুখে পড়বে । এই সকল পতিত-রাস্ট্রগুলি সন্ত্রাসবাদের লালন-পালনস্থল হয়ে দাড়াঁবে । যদি বিশ্ব-জনসংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে না যায়, জলের অভাব এবং দারিদ্র্য নিশ্চ্তভাবে বাঁড়বে, ফল হবে খাদ্য-অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে হানি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা । একমাত্র বিকল্প হল দম্পতী-পিছু দুই সন্তান এবং বিশ্ব জনসংখ্যার সত্বর সংহতি ।

মে ০৯, ২০১৩ লেষ্টার আর. ব্রাউন
(Lester R. Brown)
অনুবাদক : শঙ্কর সেন । Earth Policy Release
www.earth-policy.org/books/fpep/fpepch1


[ পরবর্তী প্রকাশ : তৃতীয় অধ্যায় : খাদ্য-শৃঙ্খল ধরে উপরে ওঠা ]

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।