পরিপূর্ণ
গ্রহ, কিন্তু থালা শূন্য- খাদ্যাভাবে
নূতন ভূমি-রাজনীতি (সূচী)

একাদশ
অধ্যায়
আমরা কি খাদ্যে ভঙ্গুর
অবস্থা রোধ করতে পারি ?
পৃথিবীর
কৃষি-ব্যবস্থা এক চ্যালেঞ্জের মুখে, যা আগে
কখনো হয়নি । কৃষি-ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর
থেকে পরবর্তী ফলন পর্যন্ত যথেষ্ট শস্যদানা
উৎপাদন কৃষকদের কাছে চিরকালই একটা চ্যালেঞ্জের
মতন । কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ আরও গভীর হয়েছে
নূতন নূতন প্রবণতার জন্য যথা, নিম্নগামী জলপীঠ,
শস্যদানার ফলনের আধিক্যটা-লাভ (plateauing),
এবং ক্রমবর্ধমান তাপমানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে
মৃত্তিকা-ক্ষয়, ফলে উৎপাদন-বৃদ্ধি ত্বরান্বিত
হওয়া শক্ত । ফলে, বিশ্বে পক্ষান্তরে নিয়ে
যাবার স্টক যা ছিল এক দশক আগে গড়ে ১০৭ দিনের
খাদন, তা' কমে হয়েছে ৭৪ দিন হালের বৎসরগুলিতে
।
বিগত দশকে বিশ্বে খাদ্যের মূল্য বেড়েছে দ্বিগুণের
বেশি । যারা ইউ.এস.-এতে থাকেন যেখানে খাদ্যের
জন্য ব্যয় হয় আয়ের ৯ -শতাংশের বেশি, তারা
এই সব মূল্য বৃদ্ধি থেকে স্বতন্ত্র থাকবেন
। কিন্তু যারা বিশ্ব অর্থনৈতিক-সিঁড়ির নীচের
ধাপে থাকেন তাদের অবস্থা কি ? এরা এখনই খাদ্যের
জন্য আয়ের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যয় করছেন ।
অনেকেই মূল্য বৃদ্ধির আগে দিনে এক বার আহার
করতেন । এখন বহু মিলিয়ন সংসারে রুটিন-মাফিক
সপ্তাহে এক অথবা বেশি দিন তারা আহারই করেন
না ।
কিন্তু,
কি হবে পরবর্তী সহসা-মূল্যবৃদ্ধি হলে ? এতদিন
তো কিছু গরীব মানুষের জন্য কষে বেল্ট বাঁধা
হয়েছে, কিন্তু এ বেশিদিন চলতে পারে না । খাদ্যের
জন্য অশান্তি রাজনৈতিক অস্থিরতায় পৌঁছাতে
পারে । কোনও কোনও সরকারের পতন হতে পারে ।
খাদ্যের
সরবরাহ যত শক্ত হবে একটা নূতন খাদ্য-ভূ-রাজনীতি
(geopolitics of food) গড়ে উঠবে- একটা বিশ্ব
যেখানে জমি এবং জলের জন্য প্রতিযোগিতা প্রবলরূপ
ধারণ করবে এবং প্রতিটি দেশ নিজেকে বাঁচাবার
চেষ্টা করবে । আমরা দাবী করতে পারিনা যে খাদ্য-সরবরাহের
এই অবস্থা হবে আমরা বুঝতে পারিনি এবং আমরা
জানি কি করতে হবে ।
একটা
সময় ছিল যখন আমরা খাদ্য নিয়ে অসুবিধায় পড়েছি
। কৃষি-মন্ত্রক তখন কৃষকদের ভরতুকি দিত যেমন,
উচ্চমূল্যে অবলম্বন হত, এবং সবকিছু স্বাভাবিক
অবস্থায় ফিরে যেত । কিন্তু এখন অবস্থা অনেক
জটিল । এখন কৃষি-মন্ত্রক ছাড়া আছে শক্তি-
, জল-সংস্থান -, পরিবহণ- , স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা-
মন্ত্রকগুলি, এবং আরও অনেকে । আবহাওয়া-পরিবর্তন,
যেহেতু কৃষিকে ভঙ্গুর করে, আমরা হয়তো দেখবো
শক্তি-নীতিকে খাদ্য-সুরক্ষায় আরও কার্যকারী
ব্যবস্থা নিতে, কৃষি-নীতির চেয়ে । বস্তুত:,
খাদ্য-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া রোধ করতে আমাদের
পুরো সমাজকেই সংহত হতে হবে ।
দারিদ্র্য
দূরীকরণের ক্ষেত্রে কাজ করতে হলে বিশ্বকে
নজর রাখতে হবে সংযুক্ত স্বাস্থ্য পরিচর্যা
এবং পরিবার পরিকল্পনার মাঝের ছিদ্রকে পূরণ
করার বিষয়ে । একটিতে অগ্রগতির অর্থ অন্যটিতে
উৎকর্ষের পথে আগুয়ান । দারিদ্র্য দূরীকরণের
দুটি স্তম্ভ হল এটা নিশ্চিত করা যে সমস্ত
শিশু- বালক ও বালিকা- অন্তত: পায় প্রাথমিক
শিক্ষা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য-সুরক্ষা ।
এবং অতি-দরিদ্র দেশগুলির প্রয়োজন প্রতি স্কুলে
দুপুরের খাদ্য প্রোগ্রাম- যেটা পিতামাতাকে
উত্সাহ দেবে শিশুদের স্কুলে পাঠানো এবং
একবার স্কুলে গেলে যাবার অভ্যাস হয়ে যাবে
। পরিবার ছোট হওয়াটা অনেক সুবিধার । প্রথমত:
খাওয়ার টেবিলে খাদকের সংখ্যা হবে কম । এটা
কোনও আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে, বড় পরিবারে
অসমানুপাতিক পুষ্টি দেখা যায় ।
খাদ্য-বর্ণালির
শেষে দেখা যায় যে, পৃথিবীতে বেশ বড় সংখ্যায়
মানুষ এমন একটি স্তরে পশু মাংস ভোজন করে যা
অস্বাস্থ্যকর, ফলে তারা মেদবাহুল্যতা এবং
হৃত্পিণ্ড ও রক্তবাহ সম্পর্কিত অসুস্থতায়
ভোগেন । সুখের কথা এই যে, যখন অর্থবানরা কম
মাংস, দুধ ও ডিম খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করেন,
তাদের স্বাস্থ্যে উন্নতি হয় । মা:. যুক্তরাষ্ট্রে
যখন মাংসের খাদন কমে যায় যে রকম এখন হয়েছে,
শস্যদানা ব্যবহৃত হতে পারে সোজাসুজি খাদ্য
হিসাবে । তা' ছাড়া, খাদ্য-শৃঙ্খলে তলার দিকে
নামার অর্থ বিশ্বের জমি ও জল-সম্পদের উপর
ভার লাঘব হওয়া ।
আর
একটা কাজ, যার ফলে খাদ্যমূল্য তাড়াতাড়ি কমে
যায় ; সেটা হল জৈব-জ্বালানি থেকে দূরে থাকা
। খাদ্যকে মোটরগাড়ীর জ্বালানিতে অধিক মাত্রায়
রূপান্তরের কোনও সামাজিক যুক্তি নেই । যখন
বাজারে এসে গেছে প্লাগ-সহ সংকর-গাড়ী এবং পূর্ণ
ইলেকা্ট্রিক-গাড়ী, যারা স্থানীয় বায়ু-বিদ্যুতে
চলতে পারে ৮০-সেণ্ট প্রতি গ্যালনে ( তুল্য-মূল্য
গ্যাসোলিন ) সেখানে কেন জ্বালানি পোড়াবো চারগুণ
মূল্য দিয়ে ।
খাদ্য-সমীকরণের
সরবরাহের দিকে আমাদের কয়েকটি চ্যালেঞ্জের
মুখোমুখি হতে হবে, আবহাওয়া-সুস্থিত করা, জলের
উর্বরতা, এবং মৃত্তিকার পরিরক্ষণ । প্রথমটি
করা শক্ত, কিন্তু এটা সম্ভব যদি আমরা তাড়াতাড়ি
করি । কারবন-নিঃসরণে এক দশকে ৮০-শতাংশ করা
সম্ভব, যার ফলে আমরা আবহাওয়া-পরিবর্তনের খারাপ
দিকটা এড়াতে পারার সুযোগ পাই । এর অর্থ হল
বিশ্ব-শক্তি- অর্থনীতির পরিপূর্ণ পুনর্গঠন
।
এটি
করার সর্বাপেক্ষা সহজ উপায় হল কর-ব্যবস্থার
পুনর্গঠন । বাজারের অনেক শক্তি আছে, কিন্তু
এর আছে কিছু ভয়ঙ্কর দুর্বলতা । এটা সহজেই
ধরে নেয় কয়লা উত্তোলনের সোজাসুজি মূল্য বিদ্যুত্কেন্দ্রে
পাঠানোর খরচ সহ । কিন্তু বাজার কখনও ধরে না
জৈব-জ্বালানির অপ্রত্যক্ষ মূল্য, যেমন, বিশ্বায়নের
সোসাইটির মূল্য । বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন
মূল অর্থনীতিবিদ, Sir Nicholas Stern আবহাওয়া-পরিবর্তনের
খরচার উপর তাঁর অনবদ্য লেখনীতে স্বীকার করেছেন
যে, আবহাওয়া-পরিবর্তন হল বাজারের বিশাল অধঃপতন
।
কর-ব্যবস্থার
পুনর্গঠন হল আয়কর কমানো এবং কারবন-কর বাড়ানো
যার ফলে সম্ভব হবে আবহাওয়া-পরিবর্তনের খরচ
এবং জৈব-জ্বালানি ব্যবহারের অপ্রত্যক্ষ খরচ
বাজারী-মূল্যতে ধরা হয় । আমরা যদি বাজারকে
সত্য বলাই, তা'হলে কয়লা ও তেল থেকে বায়ু-,
সৌর-এবং ভূতাপীয়-শক্তিতে উত্তরণ সহজ হবে ।
আমরা যদি জৈব-জ্বালানি শিল্পে বিশাল ভরতুকি
দূর করি, আমরা আরও তাড়াতাড়ি এগোবে ।
যদিও
কোনও কোনও মানুষের কাছে এই শক্তি-অবস্থান্তর
প্রাপ্তি অনেক কষ্টকল্পিত, এটা এগিয়ে চলেছে
এবং কোনও কোনও দেশে বেশ তাড়াতাড়ি । উদাহরণস্বরূপ,
জার্মানির উত্তরের চারটি প্রদেশ এখন তার অন্তত:
৪৬ শতাংশ বিদ্যুৎ পায় বায়ু থেকে. ডেনমার্কের
পক্ষে চিত্রটি হল ২৬ শতাংশ । যুক্তরাষ্ট্রের
আয়ওয়া এবং দক্ষিণ ডাকোটা এখন পায় তাদের প্রয়োজনের
এক-পঞ্চমাংশ বিদ্যুৎ বায়ু-ফার্ম থেকে । ইয়োরোপে
সৌর-বিদ্যুৎ বর্তমানে ১৫ মিলিয়ন গৃহের বিদ্যুৎ-চাহিদা
মেটাচ্ছে । কিনিয়া বর্তমানে ভূতাপীয় বিদ্যুৎ
দিয়ে তার এক-পঞ্চমাংশ চাহিদা মেটাচ্ছে । এবং
ইন্দোনেশিয়া ২০২৫ সাল নাগাদ ৯৫০০ মেগা-ওয়াট
উত্পন্ন করবে ভূ-তাপীয় উৎপন্ন থেকে যা তার
চাহিদার ৫৬- শতাংশ ।
কারবন-কর
ছাড়া আমাদের অটোমোবিলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে
বিশ্বব্যাপী গন-পরিবহনকে উন্নীত করা প্রয়োজন
ইয়োরোপের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী । যেখানে
মোটর গাড়ী ব্যবহার হবে, সেখানে বৈদ্যুতিকরণে
জোড় দিতে হবে । বিশ্ব এখনই রেলের প্যাসেঞ্জার
ব্যবস্থার অনেকটাই বিদ্যুতিকরণ করে ফেলেছে
। আমরা যদি পরম্পরাগত তৈল-ইঞ্জিন থেকে সরে
এসে প্লাগ-লাগানো সংকর ইঞ্জিন বা পুরো-বিদ্যুতিকরণে
যাই, আমরা তেলের থেকে সরে এসে অচিরাচরিত বিদ্যুতে
নির্ভরতা বাড়াতে পারি । যদি ইতিমধ্যে ইউ.
এস. মোটর-যানের ফ্লীট, যেটা ২০০৮ খ্রী-তে
চুড়ায় পৌঁছে গেছে, সেটা সঙ্কুচিত হয়, ইউ.এস.এতে
গ্যাসোলিনের ব্যবহার আরও কমবে । এই দেশে,
অন্য ১৬-টি দেশের যুক্ত ব্যবহারের থেকে গ্যাসোলিন-ব্যবহার
থেকে কমা, একটা আশাব্যঞ্জক বিষয় বৈকি ।
সুস্থিত
আবহাওয়া ছাড়া খাদ্য-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া পরিহার
করার একটি মুখ্য উপাদান হল জল উৎপাদনকে উন্নীত
করা ।
এটিতে অর্ধ শতাব্দী আগে সারা বিশ্বে শস্যফসলের
উৎপাদন-বৃদ্ধির প্রচেষ্টার দৃষ্টান্তকে সামনে
রেখে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে । পূর্বের এই
অসামান্য সাফল্যজনক উদ্যম বিশ্বের শস্যদানার
প্রতি একরে ফলনকে ১৯৫০ এবং ২০১১ সালের মধ্যে
তিনগুণ করেছিল ।
জল-সম্পদের
উর্বরতা শুরু হয় কৃষির থেকে, শুধুমাত্র এই
কারণে যে জলের ৭০ শতাংশ ব্যয়িত হয় জলসেচ-এ
। জলসেচের কিছু কৃতকৌশল অন্যান্য কৌশল অপেক্ষা
দক্ষ । সবথেকে কম দক্ষ হল বন্যা এবং লাঙ্গল
পদ্ধতি । পশ্চিম ইউ.এস.-এর বিশাল সমতলে উপর
থেকে মাটিতে ছিটিয়ে সেচ (sprinkler system)
এবং ড্রিপ-সেচ অনেক বেশি দক্ষ । ড্রিপ সেচের
সুবিধা হল এতে জল দেওয়া হয় অত্যন্ত শ্লথ-ভাবে
যাতে প্রতিটি উদ্ভিদ গ্রহণ করতে পারে এবং
বাষ্পীভবন কম হয় । পাশাপাশি এতে ফলন বৃদ্ধি
পায় জলের ব্যবহার অনেক কম স্বত্বেও । কিন্তু
এই পদ্ধতি শ্রম-আতিশয্য যার জন্য এই প্রথা
ব্যবহৃত হয় উচ্চ মূল্যের শাক-সবজী ফলনী এবং
ফল-উৎপাদক উদ্যানে ।
আগেই
বলা হয়েছে, ইয়োরোপীয় স্ট্যাণ্ডার্ডের আদলে
বিশ্ব-ব্যাপী গন-পরিবহনকে উন্নীত করা প্রয়োজন
যাতে মোটরগাড়ির উপর আমাদের নির্ভরতা কমে যায়
; এছাড়া কারবন-কর তো থাকবেই । যেখানে মোটরগাড়ি
ব্যবহার হবে, জোর থাকবে সেগুলি বিদ্যুতায়িত
করনে । বিশ্বে এখনই রেল-পরিবহনের বেশ কিছু
অংশ বিদ্যুতায়িত করা হয়ে গেছে । আমরা যখনই
পরম্পরাগত তৈল-চালিত ইঞ্জিন থেকে প্লাগ-লাগানো
সংকর-গাড়ী এবং পুরা-ইলেকা্ট্রিক গাড়ীতে যাবো,
তখন তেলের পরিবর্তে অচিরাচরিত শক্তি-উত্স
ব্যবহার করতে পারি । ইতিমধ্যে, ইউ.এস.মোটর
গাড়ীর বহর যেটা ২০০৮ খ্রী-তে চুড়ায় পৌঁছে,
আরও কমবে, ইউ.এস.এতে গ্যাসোলিনের ব্যবহার
বর্তমান-বৎসরগুলিতে আরও কমবে । এই কমা, এমন
একটি দেশে যেখানে গ্যাসোলিন-ব্যবহার পরবর্তী
১৬টি দেশগুলির যুক্তভাবে ব্যবহারের থেকে বেশি,
নিশ্চয় একটি আনন্দজনক সংবাদ ।
আবহাওয়া
সুস্থিত করা ব্যতীত খাদ্য-ব্যবস্থা ভেঙ্গে
পড়া
রোধের একটি মূল উপাদান হল জলের উৎপাদিকা-শক্তি
বাড়ানো । এটা করা যেতে পারে শস্যদানা বৃদ্ধির
যে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা হয়েছিল অর্ধ-শতাব্দী
আগে, সেই মডেলে প্ল্যান করলে । এই আশ্চর্যরূপ
সাফল্য বিশ্বে শস্যদানার উৎপাদন একর প্রতি
তিনগুণ করেছিল ১৯৫৫ থেকে ২০১১ খ্রী-র মধ্যে
। আবহাওয়া সুস্থিতির সঙ্গে আর একটি মূল উপাদান
যা দিয়ে কপো্ব বববদূপোা পতন রোধ করা সম্ভব
তা' হল জলের উৎপাদিকা বৃদ্ধি । এটিকেও বিশ্বব্যাপী
যে উদ্যম নেওয়া হয়েছিল অর্ধ-শতাব্দী আগে ফসল
উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সেই রকম প্যাটার্নে
ফেললে চলে । ঐ অত্যন্ত সফল আগেকার কার্যক্রম
বিশ্ব-শস্যদানার উৎপাদন প্রতি একরে তিনগুণ
বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৯৫০ থেকে ২০১১ খ্রী-র মধ্যে
।
জলের
উৎপাদিকা বৃদ্ধি আরম্ভ হয় কৃষি থেকে, কারণ
হল জলের ৭০ শতাংশ খরচ হয় জলসেচে । কিছু সেচব্যবস্থার
কৃতকৌশল অন্যগুলির থেকে বেশি দক্ষ । সব থেকে
কম দক্ষ হল বন্যা এবং নালাদ্বারা বায়ব সেচ
। মাঝখানে উপর থেকে ছিটিয়ে বায়ব সেচ যা' অনেক
সমজ দেখা যায় উদ্ভিদের বেলায়, সেটায় বাষ্পায়ন
কম । এটা যুগ্মভাবে ফলন বাড়ায় এবং তা' কম
জলের প্রয়োজনে । কিন্তু এই ব্যবস্থা শ্রম-গাঢ়,
তাই উচ্চমূল্যের শাক-সবজী অথবা ফল-উৎপাদক
উদ্যানে ব্যবহৃত হয় ।
রেকটি
বিকল্প হল সেই সব ফসল ফলন করা যেখানে জল কম
লাগে যথা, চালের বদলে গম । উদাহরণস্বরূপ ইজিপ্টে
চালের উৎপাদন সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে ;
চীনে পে-ইচিংের আশেপাশের জমিতে চাল উৎপাদন
বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । খাদ্য-শৃঙ্খল বেয়ে
নীচে নামার অর্থ জল বাঁচানো । যদিও শহরে জলের
ব্যবহার চাষের জন্য জলের ব্যবহারের থেকে কম,
শহরেও জল বাঁচানো যায় । কোনও কোনও শহরে জল
পুনরাবর্তন করা হচ্ছে । সিংগাপুরে ভৌগলিক
কারণে পরিচ্ছন্ন জলের ব্যবহার ভীষণভাবে নির্দিষ্ট
করে দেওয়া হয়েছে, যত জল ব্যবহার করবে তত গ্যালন
অনুসারে তোমাকে মূল্য দিতে হবে, সঙ্গে ৫ মিলিয়ন
শহরবাসীর জন্য পুনরাবর্তন প্রকল্প তো আছেই
।
জল-ব্যবহারে
দক্ষতা বাড়াবার মূলে আছে মূল্য-নীতি । চাষের
ক্ষেত্রে যখনই মূল্য কমানো হয় তখনই দেখা যায়
জলের অপচয় । পরিরক্ষণে উত্সাহিত করার উদ্দেশ্যে
জলের মূল্য ধরলে ব্যবহারে দক্ষতা বাড়ে, ফলস্বরূপ
সরবরাহ বাড়ে চাষের ক্ষেত্রে ।
আবহাওয়া-পরিরক্ষিত
করা এবং জলের উর্বরতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করার
পর তৃতীয় বড় সরবরাহে চ্যালেঞ্জ হল মৃত্তিকার
ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ । উপরের মৃত্তিকার রেকর্ড-গতিতে
উড়ে যাওয়া এবং এশিয়া ও আফ্রিকায় দুটি বিশাল
ধূলি-খাদের সৃষ্টি হওয়ার পর মৃত্তিকাকে সুস্থিত
করা একটি ব্যয়সাধ্য ব্যাপার । বোধ হয়, মৃত্তিকা-ক্ষয়
কমাবার প্রচেষ্টার সবথেকে বড় উদাহরণ হল ১৯৩০
সাল, যখন অতি-কর্ষণ ও ভুল জমি-নির্বাহ তৈরি
করেছিল একটি ধূলি-ঝড় যা'তে ইু.এস. great plains-কে
বিশাল মরুভূমিতে রূপান্তরের উপক্রম হয়েছিল
। এই সাংঘাতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইু.এস.
কৃষি-ব্যবস্থায় প্রবর্তন করেছিল একাধিক বৈপ্লবিক
নিয়ম যথা, অতি-ক্ষয়িত জমিকে তৃণভূমিতে পরিণত
করা, সোপান চাষ, গাছের আশ্রয়-পট্টি বানানো,
এবং স্ট্রীপ-গঠন প্রক্রিয়ায় চাষ ( প্রতি বৎসর
পর্যায়ক্রমে স্ট্রীপ ও অকর্ষিত জমিতে গম রোপণ
করা ) । এছাড়া সরকার প্রতিষ্ঠা করলেন একটি
অসাধারণ নূতন দপ্তর ইউ.এস.কৃষিদপ্তরে- মৃত্তিকা
পরিরক্ষণ বিভাগ, যার একমাত্র কাজ হল ইউ.এস.এতে
মৃত্তিকার নির্বাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা ।
মাটি
পরিরক্ষণের আর একটি দামী অস্ত্র হল কর্ষণ-হীন
কৃষি-ব্যবস্থা । পরম্পরাগত প্রথা যথা, কর্ষণ
ও মই দেওয়া এবং পরে যান্ত্রিক কর্ষণযন্ত্র
দিয়ে সারির ফসল থেকে আগাছা নির্মূল করার বদলে
কৃষকদের কাজ হল কেবল অনালোড়িত-মৃত্তিকায় ছেঁদা
করে তার মধ্যে বীজকে চালান করা এবং প্রয়োজনে
সাথে সাথে আগাছাগুলি ওষুধ দিয়ে নাশ করা ।
ক্ষয় কমানো ছাড়া এই প্রথায় জল ধরে রাখবে,
মাটির জৈব অংশ বাড়াবে এবং কর্ষণের শক্তি ব্যয়
অনেক কমিয়ে দেয় ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্ষণহীন জমির এলাকা
১৯৯০ সালের ৭ মিলিয়ন হেক্টর থেকে বেড়ে ২০০৭-এ
হল ২৬ মিলিয়ন হেক্টর ( ৬৭ মিলিয়ন একর) । এখন
বিস্তীর্ণ এলাকায় ভুট্টা ও সয়াবিন উৎপাদনে
ব্যবহৃত না-কর্ষণ রীতি ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম
গোলার্ধে- ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় প্রত্যেকে
২৬ মিলিয়ন হেক্টর, কানাডায়- ১৩ মিলিয়ন হেক্টর
। ১৭ মিলিয়ন হেক্টর নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পূর্ণ
করল পাঁচটি প্রথমসারির না-কর্ষণ দেশ ।
আমাদের
তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হতে হবে । সময় আমাদের ক্ষীণ
সম্বল । সাফল্য আসবে যদি আমরা চলি যুদ্ধকালীন
ভিত্তিতে । এর অর্থ, উদাহরণস্বরূপ, যদি বিশ্ব
শক্তি-অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করি ১৯৪২-এর মতন
যখন জাপানীরা হঠাত্ ১৯৪১-এর ডিসেম্বর ৭-এ
পার্ল হারবার আক্রমণ করেছিল ।
১৯৪২
সালের ৬ জানুয়ারি তারিখে, আক্রমণের এক মাস
পরে, ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ইউ.এস.কংগ্রেস
এবং আমেরিকাবাসীদের কাছে অস্ত্র-উত্পাদনের
চরম উদ্দেশ্য ও সীমা বিষয়ে ব্যক্ত করলেন ।
তিনি বললেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্পাদন
করতে যাচ্ছে ৪৫,০০০ ট্যাঙ্ক, ৬০,০০০ এরোপ্লেন,
এবং হাজার হাজার জাহাজ । যেহেতু সেই দেশ তখনও
অর্থনৈতিক অবসন্নতায় ভুগছে, লোকে ভেবেছিল
কি ভাবে এটা সম্ভব ! প্রয়োজন হয়েছিল প্রায়োরিটির
একটা আমূল পরিবর্তন এবং কিছু সাহসী পদক্ষেপ
। ১৯৪২-এর শিল্প-উদ্যোগের পরিবর্তনের মূলে
ছিল মোটরগাড়ি-নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা যার ফলে
মোটরগাড়ি-শিল্পগুলি বাধ্য হয়েছিল অস্ত্র নির্মাণে
। নিষেধাজ্ঞা জারী ছিল ১৯৪২-এর প্রথম থেকে
১৯৪৪ সালের শেষ পর্যন্ত । প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের
অস্ত্রনির্মাণের প্রতিটি টার্গেট সীমা ছাড়িয়ে
গিয়েছিল ।
. আমরা যদি খাদ্য-সমীকরণের দু'দিকের উপরে-বর্ণিত
পদক্ষেপকে অনুসরণ করি, আমরা বিশ্বের শস্যদানার
স্টক মুতন করে নির্মাণ করতে পারি খাদ্য সুরক্ষাকে
নিশ্চিত করতে । যেহেতু আর কোনও অ-কর্ষিত জমি
আমাদের হেপাজতে নেই, বিশ্বে ফলন না হওয়ার
মতন দুর্দশা হলে পিঠ-ঠেকানোর মত জায়গা হল
পক্ষান্তরে নিয়ে যাওয়ার মত স্টক বা সঞ্চয়
।
কেহই
জানেনা কত স্টক হলে আজ চলবে । তবে, ৪০ বছর
আগে যদি ৭০ দিনের খাদনের স্টককে যথেষ্ট মনে
করা, তবে আজ আমাদের স্টক রাখতে হবে অন্তত:
১১০ দিনের খাদন যাতে আবহাওয়া-পরিবর্তনের মত
কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করা যায় । যদি মাঃ.যুক্তরাষ্ট্র
তার শিল্প-বিষয়ক অর্থনীতিকে পরিবর্তন করতে
পারে ১৯৪২ সালের কয়েক মাসের মধ্যে, তা'হলে
সে নিশ্চিতই সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারবে
শক্তি-অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে, জনসংখ্যা
সুস্থির করতে এবং বিশ্বের শস্যদানার স্টককে
পুনর্নির্মাণ করতে । এখন ১৯৪২-এর থেকে সমস্যা
অনেক বেশি সঙ্কটাপন্ন । তখনকার চ্যালেঞ্জ
ছিল গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রাকে বাঁচানো নাৎসি
জার্মানি এবং সমাজবাদী জাপানের আগ্রাসন থেকে
। আজ চ্যালেঞ্জ হল সভ্যতাকে বাঁচানো ।
বিজ্ঞানীরা
সহ অন্য অনেকেই বহু দিন ধরেই মত দিচ্ছেন যে
বিশ্ব-অর্থনীতি একটি অ-পরিরক্ষিত পরিবেশের
রাস্তায় ঢুকে পরেছে । এটি আজ সকলের কাছেই
প্রতীয়মান যারা বিভিন্ন গতিধারা অনুসরণ করছেন,
যথা, বনরাজি ধ্বংস, মৃত্তিকার ক্ষয়, নিম্নগামী
জলস্তর, ভেঙ্গে-পড়া মত্স্যধারণ স্থান এবং
আবহাওয়ায় মারাত্মক-বৃদ্ধি কারবন-ডাই- অক্সাইড
। এই অপরিরক্ষিত রাস্তায় বিশ্বকে নিয়ে যাচ্ছে,
তা' জানা নেই । মনে হচ্ছে, সর্বাপেক্ষা প্রত্যাসন্ন
ফলাফল হবে খাদ্য-সরবরাহে টান । আমাদের বর্তমান
আধুনিক সভ্যতায় খাদ্য হল এক দুর্বল বন্ধনী-
ঠিক যে রকম হয়েছিল সুমের-(sumerian), মায়া-
(MaYa), ও অন্যান্য সভ্যতার বেলায় যারা এসেছেন
এবং চলেগেছেন । তারা তাদের ভাগ্যকে খাদ্য-সরবরাহ
থেকে আলাদা করতে পারেনি । আমরাও পারবো না
।
এখন
চ্যালেঞ্জ~ হল একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতাক্কে
একটা পরিরক্ষিত রাস্তায় নিয়ে যাওয়া । আমাদের
প্রত্যেককে যুক্ত হতে হবে । এটি কিন্তু ঠিক
জীবনের মান পরিবর্তন করা এক বা অধিক ইলেক'ট্রিক
বালা্ব পাল্টানো বা খবরের কাগজ পুনরাবর্তন
করা, যদিও এগুলি আবশ্যক নয় তা' নয় । পরিবেশবিদরা
কয়েক দশক ধরেই বলে আসছেন আমাদের এই গ্রহকে
বাঁচাবার তাগিদে, কিন্তু এখন নূতন চ্যালেঞ্জ
হচ্ছে সভ্যতাকে বাঁচানো । এখন বিশ্বের অর্থনীতিকে
ঢেলে সাজানোর তাগিদ এবং এই কাজ সম্পন্ন করতে
হবে আবহাওয়া পরিবর্তন কোনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে
চলে না যায়, এবং খাদ্যাভাব আমাদের রাজনৈতিক
ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে না দেয়
। এবং এর অর্থ আমাদের নৈতিকভাবে তৎপর হতে
হবে, কাজ করতে হবে সত্বর উপরে আলোচিত চরম
উদ্দেশ্যগুলিতে পৌঁছানোর তাগিদে ।
আমাদের
সকলকে একটি বিষয় নির্বাচন করে তার উপর কাজ
করা উচিত । কয়েকজন বন্ধু, যারা তোমার মতন
উদ্বিগ্ন, তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজে নেমে পড়
। সব থেকে আশু কর্তব্য হল প্রতিভূতিকে নূতন
করে ব্যাখ্যা করতে হবে এবং সেইমতো রাজস্ব
সংস্থানকে নূতনভাবে বণ্টন করতে হবে । যদি
আপনার প্রধান সমস্যা হয় জনসংখ্যা বৃদ্ধি,
যুক্ত হোন কোনও একটি আন্তর্জাতিক দিকা্নির্দিষ্ট
সংস্থার সঙ্গে এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে
রাজনীতিকদের উদ্বুদ্ধ করুণ । যদি তোমার অন্যকোনও
বিষয় থেকে আবহাওয়া-পরিবর্তন মূখ্য হয়, কয়লা-চালিত
বিদ্যুত্কেন্দ্রগুলি বন্ধের জন্য প্রচেষ্টার
সঙ্গে যুক্ত হোন । আমরা খাদ্য-ব্যবস্থা ভেঙ্গে
যাওয়া রোধ করতে পারি, কিন্তু এক বিশাল রাজনৈতিক
প্রচেষ্টার প্রযোজন বিভিন্ন দিকে সঙ্গে নিয়ে
প্রচণ্ড তাগিদ ।
সভ্যতার
ভবিষ্যতে আমাদের সকলেরই দায় আছে । আমাদের
সকলেরই আছে সন্তান-সন্ততি, অনেকেরই আছে নাতি-নাতনী
। আমরা জানি কি আমাদের করনীয় । আসুন, আমরা
সেটা শুরু করি । মনে রাখবেন সভ্যতাকে বাঁচানো
একটা খেলা নয় ।
লেষ্টার
আর. ব্রাউন
(Lester R. Brown)
অনুবাদক : শঙ্কর সেন । Earth Policy Release
জানুযারি ২৮, ২০১৪ www.earth-policy.org/books/fpep/fpepch5
সমাপ্ত