পরিপূর্ণ
গ্রহ, কিন্তু থালা শূন্য- খাদ্যাভাবে নূতন
ভূমি-রাজনীতি

তৃতীয়
অধ্যায়
খাদ্য-শৃঙ্খল ধরে উপরে ওঠা
যে
সময় ধরে মানুষ এই পৃথিবীতে আছে, তার বেশিরভাগটাই
আমরা ছিলাম মৃগয়াকারী এবং খাদ্য-সংগ্রহকারী
। মনুষ্যখাদ্যের বিভিন্ন অংশ- শিকার বা সংগ্রহ
নির্ভর করত ভৌগলিক অবস্থান, শিকারের দক্ষতা
এবং বত্সরের ঋতুর উপর । উদাহরণস্বরূপ, উত্তর
গোলার্ধে শীতকালে খুব কমই খাদ্য সংগ্রহ করা
সম্ভব হত, মানুষকে নির্ভর করতে হত শিকারের
উপর । শিকারী-সংগ্রহকারী হিসাবে আমাদের লম্বা
ইতিহাস আমাদের খাদ্যরুচিকে তৈরী করেছে দিয়েছে
জৈব-আমিষ নির্ভর যা বর্তমানের খাদ্যাভাসকে
গঠন করেছে ।
এমনকি সাম্প্রতিককালে বর্তমান শতাব্দীর শেষার্ধে,
জৈব-আমিসের চাহিদার বেশিরভাগটাই পুরণ হত দুটি
প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে- সামুদ্রিক মত্স্য
এবং পশুচারণ-ভূমি । ১৯৫০ থেকে ১৯৯০ খ্রী-র
মধ্যে সামুদ্রিক মত্স্য সংগ্রহ বেড়েছিল
১৭ মিলিয়ন থেকে ৮৪ মিলিয়ন । এই সময়কালে জনপ্রতি
সামুদ্রিক মাছের গ্রহণ দ্বিগুণের বেশি হয়েছিল,
১৫ থেকে ৩৫ পাউণ্ড ।
এটা ছিল সামুদ্রিক মত্স্য উত্পাদনের একটি
স্বর্ণযুগ ।
প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে হিমায়িত যন্ত্রসহ
নৌকা সুদূর অঞ্চলে মাছ ধরার সুবিধা এনে দিল,মাছ
ধরার পরিমাণ গেল বেড়ে, কিন্তু দুঃখের বিষয়
যে মানুষের চাহিদা সামুদ্রিক মাছের ফলনের
চেয়ে হয়ে গেল বেশি । আজ পরিরক্ষিত সীমার বাইরে
মাছ ধরতে হচ্ছে আশি শতাংশ নৌকারই । ফলস্বরূপ,
অনেক নৌকাই যাচ্ছে বসে বা ধংসের পথে ।
চারণভুমিগুলিও প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার
অন্তর্গত । বেশিরভাগই প্রায়-উষর অঞ্চলে, এত
শুষ্ক যে কৃষির পক্ষে অনুপযুক্ত । এত বিশাল,
ফলনের জমির দ্বিগুণ এর পরিমাপ । কোনও কোনও
দেশ, যেমন ব্রাজিল এবং আর্জেণ্টিনা, গো-বত্সদের
খাদ্য হচ্ছে ঘাস, অন্যত্র যেমন, মাঃ যুক্তরাষ্ট্র
ও ইয়োরোপ, গোমাংস উত্পাদনকারী পশুদের খাদ্য
হল ঘাস ও শস্যের মিলিত ।
মনুষ্যসমাজে
যেখনই আয় বৃদ্ধি হচ্ছে, জৈব-আমিষ যথা, মাংস,
দুধ, ডিম এবং সামুদ্রিক মাছের চাহিদাও বাড়ছে
সাথে সাথে । আজ ৩ বিলিয়ন মানুষ খাদ্য-শৃংখল
বেয়ে উপরে উঠছে । যারা নীচু জীবনোপায়ে অবস্থান
করছেন তাদের খাদ্যে ক্যালরির ৬০ শতাংশ আসছে
একটি শ্বেতসারযুক্ত খাদ্য থেকে যেমন, চাল,
গম বা শস্য । আয় যত বৃদ্ধি পায়, খাদ্যের তালিকায়
প্রোটিনের মাত্রা তত বাড়ে ; এইভাবে বিশ্বে
মাংসের চাহিদা বেড়েছে ১৯৫০ সালে ৫০ মিলিয়ন
টন থেকে ২০১০ সালে ২৮০ মিলিয়ন টন, - মোটামুটি
৫-গুণের বশি । জনপ্রতি চাহিদা বেড়েছে বছরে
৩৮ থেকে ৮৮ পাউণ্ড । ৬০ বছর ধরে চাহিদার এই
বৃদ্ধি মূলতঃ ঘটেছে শিল্পোন্নত দেশগুলিতে,
নূতন শিল্পোন্নত দেশগুলি সহ । কি ধরণের প্রোটিন
মানুষ গ্রহণ করবে তা' ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল
ভৌগলিক অবস্থানের উপর । যে সব দেশ বিশাল ঘাসজমি
দ্বারা সম্বৃদ্ধ যেমন, মাঃ. যুক্তরাস্ত্র,
ব্রাজিল, আর্জেণ্টিনা এবং রাশিয়া, এরা নির্ভরশীল
গোমাংসের উপর ; অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া এবং
কাজাখস্তান- ভেড়ার মাংস । যে সব দেশ জনাকীর্ণ
এবং বিস্তর চারণভূমিহীন, তারা ঐতিহাসিকভাবে
শুকর-মাংসের উপর নির্ভরশীল । এ ধরণের দেশ
হল জার্মানী, পোল্যাণ্ড এবং চীন । দ্বীপপুঞ্জসহ
দেশ এবং লম্বা সমুদ্রসৈকত আছে এমন দেশ যেমন,
জাপান এবং নরওয়ে, এরা নির্ভর করে সামুদ্রিক
জন্তুর প্রোটিন ।
সময়ের
সঙ্গে মাংসের চাহিদার নমুনাও পাল্টে যাচ্ছে
বিশ্বে । ১৯৫০ খ্রী-তে খাদ্য তালিকায় গো-
ও শুকর-মাংসের পরিমাণ ছিল মোটামুটি আধাআধি,
পাখীর চাহিদা ছিল অনেক কম । ১৯৫০ সাল থেকে
শুরু করে ১৯৮০ পর্যন্ত এদের চাহিদা বেড়েছিল
একইভাবে । গোমাংসের সীমা নির্ধারিত হয় ঘাসজমির
উপর । যেহেতু গোবত্সের দ্বারা শস্য থ্যেকে
মাংস হওয়ার সুযোগ কম, গোমাংসের চাহিদা বেড়েছে
১৯৫০ সালে ১৯ মিলিয়ন টন থেকে ১৯৯০ সালে ৫৩
মিলিয়ন, তারপরে বিশেষ বাড়েনি । তুলনায় মুর্গী
দ্বারা খুব সহজেই শস্য থেকে মাংসে রূপন্তর
সম্ভব ; ফলস্বরূপ বিশ্বে কুক্কুটজাতীয় পাখীর
মাংসের চাহিদা প্রথম দিকে কম থাকলেও পরে,
১৯৯৭ সাল নাগাদ, গোমাংসকে ছাড়িয়ে গেছে ।
চীন এবং মাঃ. যুক্তরাষ্ট্র হল বিশ্বের প্রধান
দুই মাংসের গ্রাহক- মাঃ. যুক্তরাস্ট্র প্রধান
ছিল ১৯৯২ সাল পর্যন্ত । ২০১২ সালে চীনের চাহিদা
ছিল ৭১ মিলিয়ন টন, মাঃ. যুক্তরাস্ট্র- ৩৫
মিলিয়ন । চীনের এই বিশাল বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে
শুকরের মাংসের জন্য- যা ১৯৭৮ খ্রী-র অর্থনৈতিক
সংস্কারের পর ছিল ১২০ মিলিয়ন টন ( সূত্র:
FAO ) ।
আজ বিশ্ব-খাদ্যে অগ্রণী স্থান হল শূকরমাংসের,
যার অর্ধেকই খাওয়া হয় চীনদেশে । এটা নূতন
কিছু নয় ; বহু বছর ধরেই গ্রামগুলিতে শুকর
পালন ছিল একটা প্রথা যার মূল খাদ্য হল পাকশালার
বর্জ । শুকর পুষ্ট হলে তাদের খাওয়া হয় এবং
তার স্থান নেয় একটি শিশু শুকর, যাকে পাকশালা-বর্জ
দ্বারা বড় করা হয় । এই ভাবে শুকর-মাংস স্থান
করে নিয়েছে চৈনিক খাদ্যতালিকায় । চীনের ১.৩৫
বিলিয়ন জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে শুকর-মাংসের
উত্পাদন বেড়েছে ১৯৭৮ সালের ৯ মিলিয়ন টন
থেকে ২০১২ সালে ৫২ মিলিয়ন টন । একই সময়ে মাঃ.
যুক্তরাষ্ট্রে শুকর-মাংসের চাহিদা বেড়েছে
৬ থেকে ৮ মিলিয়ন টন ।
বিভিন্ন
ধরণের মাংসের চাহিদায় রূপান্তর ঘটছে প্রধাণতঃ
গ্রাহকরা সস্তার দিকে ঝুকছে । ১৯৫০ সালে কুক্কুট-
মাংসের মূল্য ছিল চড়া, অনেকটা গোমংসের মত
। কিন্তু শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে কুক্কুটমাংসের
উত্পাদন পদ্ধতি উন্নত হওয়ায় মাংসের মূল্য
কমে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ভিতরে চলে যায় ।
মাঃ. যুক্তরাস্ট্রে অর্ধ-শতাব্দী আগে কুক্কুটমাংস
ছিল বিশেষ স্থানে- এর জায়গা হত সাধারণতঃ রবিবারের
রাত্রের পাতে । এখন প্রতিদিনই খাদ্যতালিকায়
থাকছে কুক্কুটমাংস ।
বোধ হয় সব থেকে বেশি পরিবর্তন এসেছে সামুদ্রিক
পশুপক্ষীর মাংস গ্রহণে । ঐতিহাসিকভাবে মত্সচাষের
কৃত্কৌশল উন্নত হওয়ার সঙ্গে চাহিদা-বৃদ্ধি
যুক্ত, বিশেষতঃ সৈকত-অশ্রিত ও দ্বীপ সংলগ্ণ
দেশগুলিতে । যেমন, জাপানের মতো দেশে জমির
প্রয়োজন মূল খাদ্য চালের জন্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে মাছ-মাংসের প্রয়োজন মেটাতে সামুদ্রিক
খাদ্যের উপর নির্ভরতা বেড়ে গিয়েছে । বিংশ
শতাব্দীর প্রথম থেকেই জমির অভাব বোধ করা গিয়েছে
এবং বর্তমানে জৈব-আমিষের প্রয়োজন মেটাচ্ছে
সামুদ্রিক খাদ্য ।
জাপান
বর্তমান সামুদ্রিক খাদ্য গ্রহণ বছরে ৮ মিলিয়ন
টন, কিন্তু সামুদ্রিক মত্স্য-ব্যবসায় পৌঁছে
যাচ্ছে অতি-গ্রহণের জন্য তার চরম সীমায় ।
অন্যান্য রাজ্যের পক্ষে খুবই কম সুযোগ আছে
সমুদ্রের দিকে যাওয়ার, প্রোটিনের জন্য । যদি
চীনের জনপ্রতি সামুদ্রিক খাদ্য গ্রহণ জাপানের
সমতায় আসে, তবে বিশ্বের পুরো সংগ্রহই চীনের
জন্য প্রয়োজন হবে ।
যদিও চীন হল সামুদ্রিক মত্স্যের প্রথম সারির
দাবিদার, যার বাত্সরিক মাছধরা হল ১৫ মিলিয়ন
টন, এই দেশ মুখ্যতঃ ঝুকেছে মত্স্য-ফার্মের
দিকে সামুদ্রিক খাদ্যের চাহিদা মেটাতে । ২০১০
সালে এর জলজ উত্পাদন- প্রধানতঃ কার্প ও
শেলফিশ(carp&shellfish)- হয়েছিল ৩৭ মিলিয়ন
টন বিশ্বের অন্য সব দেশের মিলিত উত্পাদনের
থেকে বেশি । আয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এশিয়ার
অন্যান্য গভীর জনাকীর্ণ দেশগুলি চীনের পদাঙ্ক
অনুসরণ করছে ; এর মধ্যে আছে ভারত, থাইল্যণ্ড
ও ভিয়েতনাম ।
গত ২০
বছর ধরে জলজ-ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াল জৈব-আমিষের
একটি মূল উত্স । কার্প, তিলাপিয়া ও ক্যাটফিশের
মতন সর্বভূক জাতিরা যে সাফল্যের সঙ্গে শস্যদানাকে
জৈব-আমিষে পরিবর্তন করে, তার ফল হল জলজ-খাদ্যের
উত্পাদন চারগুণ বৃদ্ধি পেল ১৯৯০ থেকে ২০১০
সালের মধ্যে(FAO)। সব জলজ-ব্যবস্থা যে পরিবেশগতভাবে
হিতকর তা' নয় । কিছু আছে যারা পরিবেশগতভাবে
ভঙ্গুর এবং খাদ্যহিসাবে সফল নয়, যেমন ছোট
চিংড়ী ও সামন । ছোট চিংড়ীর ব্যবসায় প্রায়শঃই
উপকুলবর্তী ম্যানগ্রোভ নষ্ট করে চিংড়ীর বাসস্থান
নির্মাণের খাতিরে ।
সামন মাছ ফলোত্পাদক নয় যেহেতু এরা খাদ্য
হিস্সবে গ্রহণ করে খুব ছোট ছোট মাছ ফিশ-মিল(fishmeal)হিসাবে
মত্স্য-প্রবর্ধক যন্ত্রের বর্জ থেকে । মানুষ
যতই বেশিমাত্রায় মাংস, দুধ, ডিম ও ফার্মের
মাছ খেতে আরম্ভ করে, ততই পরোক্ষে শস্যদানার
ব্যবহার বাড়ে । ভারত ও মাঃ. যুক্তরাস্ট্রের
শস্যদানার ব্যবহার তুলনা করলে পাওয়া যাবে
খাদ্য-শৃংখল বেয়ে ওঠার জন্য কতটা শস্যদানার
প্রয়োজন হয় । অল্প-আয়ের ভারতবাসীর শস্যদানার
ব্যবহার হল জনপ্রতি ৩৮০ পাউণ্ড বছরে ; এর
প্রায় সবটাই খাওয়া হয় সোজাসুজি খাদ্যহিসাবে,
মাত্র ৪ শতাংশের মতন যায় পশুখাদ্যে প্রোটিন
তৈরীর কাজে । এটা বিষ্ময়ের কারণ নয় যে পশুধন-দ্রব্যের
ব্যবহার ভারতে কম । তবে বর্ধিত মধ্যবিত্তের
মধ্যে দুধ, ডিম ও কুক্কুটাদি খাদ্য হিসাবে
গ্রহণ বাড়ছে ।
তুলনায়
সাধারণ আমেরিক্যান বছরে গ্রহন করে প্রায় ১,৪০০
পাউণ্ড, যার আশি-শতাংশ সোজাসুজি মাংস, দুধ
ও ডিম অবস্থায় । অতএব, মাঃ. যুক্তরাস্ট্রে
জনপ্রতি শস্যদানা গ্রহণ ভারতের থেকে চারগুণ
।
শূকর ও কুক্কুট-মাংস বিশ্বের ভূমি থেকে পাওয়া
জৈব-আমিষের প্রধান উত্স, কিন্তু ২০১০ সালে
৬৯ মিলিয়ন টন উত্পাদন করে ডিম খুব পিছিয়ে
নেই । বিগত অর্ধ-শতাব্দী ধরে ডিমের উত্পাদন
বাড়ছে স্থিরভাবে । ডিম হল তুলনামূলকভাবে শস্তা
এবং বিশ্বে প্রতি মানুষ গড়ে সপ্তাহে গ্রহণ
করে তিনটা ডিম ।
চীনে শূকরের মাংসের মতনই ডিমের উত্পাদন
বাড়ছে ভীষণভাবে, ১৯৯০-এর ৬ মিলিয়ন টন থেকে
২০১০-এ ২৪ মিলিয়ন টন । ফলে চীন বর্তমানে ডিম
উত্পাদনে বিশ্বে সেরা । মাঃ. যুক্তরাস্ট্র
বছরে ৫ মিলিয়ন ও ভারত বছরে ৩ মিলিয়ন উত্পাদন
নিয়ে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ।
এ সত্ত্বেও
কোনও কোনও দেশ খাদ্যশৃঙ্খলের উপরের দিকে থেকেও
তুলনায় কম শস্যদানা ব্যবহার করে পশুখাদ্য
হিসাবে । উদাহরনস্বরূপ, জাপানের কথা ধরা যাক
। জাপানীদের জৈব-আমিষ আসে প্রধাণতঃ সামুদ্রিক
মত্স্য থেকে । আর্জেণ্টিনা ও ব্রাজিলের
একই অবস্থা- এদের জৈব-আমিষ আসে ঘাসকে খাদ্য
হিসাবে গ্রহণকারী পশু থেকে ।
বিগত কয়েক দশকে ব্রাজিল, যে দেশ খাদ্যে মাংস-গ্রহণে
বিশ্বে তৃতীয় স্থানের অধিকারী, তার নকশা অনেকটা
পালটে গেছে । ১৯৬০ সালে গো-মাংস গ্রহণ ছিল
সবার ঊর্ধে, শূকর-মাংস ছিল দূর দ্বিতীয় স্থানে
আর কুক্কুট-মাংস গ্রহণ ছিল না বললেই চলে ।
২০০০ সালে সবাইকে বিষ্মিত করে কুক্কুট-মাংস
গ্রহন গো-মাংসকে ছাড়িয়ে গেল ; শূকর-মাংসের
স্থান সেই নীচেই ছিল । ঘাসজমি কমে আসাতে ছোট
চৌবাচ্চা(feedlot)ব্যবহার শুরু হল । এই চৌবাচ্চায়
গোরুর জন্য ৭ পাউণ্ড শস্যদানা দিলে গোরুর
ওজন বাড়ে ১ পাউণ্ড, শূকরের বলায় লাগে ৩.৫
পাউণ্ড, কুক্কুটের বেলায় ২ পাউণ্ড । ডিম পেতে
গেলে ২ পাউণ্ডে পাওয়া যায় ১ পাউণ্ড । চীন
ও ভারতে কার্প এবং মাঃ. যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাটফিশের
বেলায় ১ পাউণ্ড ওজন-বৃদ্ধির জন্য লাগে ২ পাউণ্ড
শস্যদানা । ফলে, বিশ্বে স্থানে স্থানে মাংসের
উত্পাদন- মূল্য নির্ভর করে উপরোক্ত নকশার
উপরে ।
বর্তমান
কালে উত্পাদনের ঝোঁক দেখলে বোঝা যাবে পৃথিবী
কোন দিকে যাচ্ছে । ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে
গো-মাংসের উত্পাদন বেড়েছে গড়ে বছরে ১ শতাংশ
। অন্যদিকে শূকর-মাংস উত্পাদন বেড়েছে বছরে
২ শতাংশ, ডিম প্রায় ৩ শতাংশ আর কুক্কুট-মাংস
৪ শতাংশ । জলজ-ব্যবস্থায়(aquaculture)উত্পাদন,
যার থেকে বোঝা যায় রূপান্তরের কার্যক্ষমতা,
বেড়েছে বছরে প্রায় ৮ শতাংশ, ১৯৯০ সালে ১৩
মিলিয়ন টন থেকে ২০১০ সালে ৬০ মিলিয়ন টনে ।
পশুখাদ্য, পোলট্রী ও ফার্ম-মত্স্য ব্যবস্থায়
শস্যদানার মোট ব্যবহার কিন্তু বিগত কয়েক দশকে
প্রায় স্থির জায়গায় রয়েছে । একটা কারণ হতে
পারে তা' হল খাদ্যে সয়াবীনের ব্যবহার- মোটামুটি
৪ ভাগ শস্যদানার সঙ্গে ১ ভাগ সয়াবীন । এর
ফলে শস্যদানা থেকে প্রোটিনে রূপান্তরের কার্যক্ষমতা
অনেক বেড়েছে ।
বিগত অর্ধ-শতাব্দী ধরে জৈব-আমিষের চাহিদা
যেমন বেড়েছে, সয়াবীনের চাহিদা তার থেকে বেড়েছে
অনেক বেশি । সারা বিশ্বে মোট ২.৩ বিলিয়ন টন
বার্ষিক শস্যদানা তোলার প্রায় ৩৫- শতাংশ পশুপাখীদের
খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় । তুলনামূলকভাবে সয়াবীনের
সবটাই খাওযা হয় । শূকর- ও কুক্কুট-মাংসের
উত্পাদন নির্ভর করে শস্যদানার উপর, গো-মাংস
ও দুধ নির্ভরশীল যৌথভাবে ঘাস ও শস্যদানার
উপর ।
বিশ্বের
তিনটি প্রধান মাংস-উত্পাদক দেশ চীন, মাঃ.
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল এখন পশু-পাখী খাদ্যে
সয়াবীনের উপর নির্ভরশীল প্রোটিনের খাতিরে
। বস্তুতঃ, প্রতিটি দেশে খাদ্যে সয়াবীনের
মাত্রা হল ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ ।
জমি ও জলের উপর ক্রমবর্ধমাণ নির্ভরতা জৈব-আমিস
উত্পাদনের ক্ষেত্রে নূতন নূতন মডেলের খোঁজ
করছে মানুষ ।
এমন একটি উদাহরণ হল ভারতে দুধ উত্পাদন ।
১৯৭০ খ্রী থেকে ভারতে দুধের উত্পাদন বেড়েছে
ছয়গুণ, ২১ মিলিয়ন থেকে ১১৭ মিলিয়ন টন । ১৯৯৭
সালে ভারত দুধ উত্পাদনে মাঃ. যুক্তরাষ্ট্রকে
অতিক্রম করে বিশ্বের প্রথম স্থানে পৌঁছে গেছে
। এই বিশাল বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে যখন ১৯৬৫ খ্রী-তে
জনৈক ভারতীয় যুবক, ডক্টর ভার্গীজ কুরিয়েন
সৃষ্টি করলেন National Dairy Development
Board যেটা ডেয়ারি কোঅপারেটিভগুলির একটি umbrella-প্রতিষ্ঠান
। কোঅপারেটিভগুলির প্রাথমিক কাজ হল দুটি বা
তিনটি গোরুর ( যা' আছে প্রতিটি গ্রামীণ সংসারের
অধিকারে ) দুধ বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা । এই
কোঅপারেটিভগুলি ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং লক্ষ
লক্ষ গ্রামীণ সংসারগুলির স্বল্প উদ্বৃত্তের
বাজার তৈরী করার মধ্য দিয়ে যোগসূত্রের কাজ
করে । একটি দেশ যেখানে সামান্য প্রোটিনের
জন্য শত শত শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়ে
যায়, সেখনে ২৫ বছর আগে জনপ্রতি দৈনিক এক কাপ
দুধ একটি বিশাল পদক্ষেপ সামনের দিকে ।
অদ্বিতীয় বিষয় হল ভারত বিশ্বের সর্ববৃহত্
ডেয়ারি শিল্প নির্মাণ করেছে প্রায় সবটাই অব্যবহার্য
বস্তু যথা, শস্যের অবশিষ্টাংশ যথা গম ও ধানের
খড়, শস্য-দণ্ড- এবং রাস্তার পাশের ঘাস সংগ্রহ
করে । গোরুদের প্রায়শঃই খেতে দেওয়া হয় ফেলে
দেওয়া শস্য এবং প্রতিদিন সংগৃহীত ঘাস ।
প্রোটিন
উত্পন্নের দ্বিতীয় এবং হালের মডেল হল চীনদেশের,
মূলতঃ চারটি প্রদেশে- হেবেই, শাংডং, হেনান
এবং আন্হুই- যেখানে শীতকালে দ্বিতীয় শস্য
বোনার হয় । শীতের ফসল -গম গ্রীষ্মের প্রথমেই
পাকলে একে তাড়াতাড়ি তুলে ফেলা হয় পরবর্তী
শস্য বোনার জন্য । মাটি তৈরী করার আগেই খড়
তুলে ফেলা হয় যা' গোরুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত
হয় । এর সঙ্গে মিশানো হয় সামান্য নাইট্রোজেন,
সাধারণতঃ ইউরিয়া হিসাবে । উপরোক্ত প্রথাদুটি
ব্যবহার করে ভারতে দুধ এবং চীনে গো-মাংস উত্পাদনের
অর্থ হল দুটি দেশের কৃষকরা দুটি ফসল উত্পন্নের
সুবিধা পাচ্ছে । এছাড়া চীনে শতাব্দী ধরে জলজ-ব্যবস্থায়
চাররকমের কার্প একসঙ্গে চাষ করা হয় । একটি
শ্রেণীকে খেতে দেওয়া হয় ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন,
দ্বিতীয়টিকে জুপ্ল্যাঙ্কটন, তৃতীয়টিকে জলজ
লতা এবং চতুর্থটিকে তলানি । এই বহুমুখী ব্যবস্থা
চীনে কার্প উত্পাদনকে নিয়ে গেছে ১৬ মিলিয়ন
টনে, ২০১১ সালে ।
যদিও
প্রোটিন উত্পাদনের উপরোক্ত তিনটি মডেল চালু
হয়েছে জনবহুল ভারত ও চীনদেশে, এই মডেল অন্যান্য
দেশে ও চালু হতে পারে জনসংখ্যার চাপে । এই
গতিধারা এখনই দেখা যাচ্ছে । শস্য-দানা থেকে
জৈব-প্রোটিনে পরিবর্তন-পদ্ধতি, যথা গো-মাংসের
জন্য বড় পাত্র বা চৌবাচ্চার জায়গায় ফার্ম
পদ্ধতির দিকে যাচ্ছে বিশেষতঃ মাছ ও পোলট্রির
জন্য । এই ব্যবস্থা চললে পোলট্রিতে উত্পাদন,
যা' এখনই গো-মাংসকে ছাড়িযে গেছে তা' ২০২০
নাগাদ শূকর-মাংসকেও ছাড়িয়ে যাবে । আর কয়েক
বছরের মধ্যে, ২০২৩ সালে, ফার্মে উত্পাদিত
মাছের উত্পাদন পোলট্রি ও শূকর-মাংসকে ছাড়িয়ে
গিয়ে অধিকার করবে প্রথম স্থান ।
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে মাংস-আহারের মাত্রা গত অর্ধ-শতাব্দী
ধরে বেড়ে চূড়ায় পৌঁছেচে ২০০৭ সালে, পরে ২০১২-তে
৬-শতাংশ কমেছে । কারণ হিসাবে বলা যায়, পশুধন-খাদ্যের
মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক জাগরণের অনিশ্চয়তা
; এবং খাদকদের মধ্যে একটা সাধারণ অবগতি যে
বেশি মাংস-আহারের ফল হৃদরোগ, ক্যানসার এবং
মেদবাহুল্য । পাশাপাশি আছে পশু-সুরক্ষা এবং
পরিবেশ জনসংস্থাগুলি যাদের অভিযোগ উত্পাদন-পদ্ধতি
ও সংশ্লিষ্ট দূষণের বিরুদ্ধে । যে কোনও কারণেই
হোক আমেরিকাবাসীরা মাংসগ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে
। মনে হয়, মার্কিন যুক্তরাস্ট্র হল জনবহুল
দেশগুলির মধ্যে এবিষয়ে প্রথম এবং এই অবস্থা
চলবে আরও বেশ কয়েক বছর ধরে ।
আয়ুষ্কাল বেশি এমন মানুষরা খাদ্য-শৃঙ্খলের
খুব তলার দিকে বা খুব উপরের দিকে নেই, বরং
তারা শৃঙ্খলের মাঝামাঝি স্থানে আছে । ইতালীয়রা
খাদ্য-শৃঙ্খলে আমেরিকানদের তলায় আছে গড় আয়ুষ্কাল
৮১ বত্সর নিয়ে ; তুলনায় আমেরিকানদের গড়
আয়ুষ্কাল ৭৯ বত্সর । ইতালীয়দের খাদ্য হল
যাকে বলা হয় ' ভুম্ধ্যসাগরীয় খাদ্য ', পশুধন
ও কুক্কুট-জাতীয়ের পরিমিত সংমিশ্রণ ।
প্রতি
বত্সর বর্ধিত ৮০ মিলিয়ন পেটকে খাদ্য দেবার
অভিজ্ঞতা বিশ্বের হয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে,
এর কিন্তু বেশি অভিজ্ঞতা নেই ৩ বিলিয়ন মানুষকে
খাদ্য জোগাবার, যারা আরও শস্য-দানা থেকে উত্পন্ন
দ্রব্য গ্রহণ করে খাদ্য-শৃঙ্খল বেয়ে উপরে
উঠতে চায় । যদিও জনসংখ্যা-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে
দুটি মূল খাদ্যবস্তু গম ও চালের চাহিদা বাড়বে,
ক্রমবর্ধমান অর্থ-প্রাচুর্যের সঙ্গে কিন্তু
বৃদ্ধি পাবে ভুট্টা-দানার চাহিদা-যা' পশুধনেরও
খাদ্য । ইতিহাসগতভাবে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বে
গম ও ভুট্টা-দানার চাহিদা পাশাপাশি একইভাবে
বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫৫০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে
; কিন্তু ২০১১ সালে ভুট্টা-দানার চাহিদা বেড়ে
হল ৯৬০ মিলিয়ন টন, আর গম থেকে গেল ৭০০ মিলিয়ন
টনের নীচে ।
পশুধন-দ্রব্যের ব্যবহার এবং শস্যদানার জ্বালানিতে
রূপান্তর যৌথভাবে বিশ্বে শস্যদানার চাহিদা
বৃদ্ধি করেছে এক দশক আগের ২০ মিলিয়ন টন থেকে
বর্তমানের ৪০ মিলিয়ন টন । আগামীদিনে আয়বৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের উপর চাপ বাড়বে আরও শস্য-দানা
ও সয়াবীন উত্পন্ন করার ।
আগস্ট,
২০১৩ লেষ্টার আর. ব্রাউন
(Lester R. Brown)
অনুবাদক : শঙ্কর সেন ।
Earth
Policy Release
www.earth-policy.org/books/fpep/fpepch1
[
পরবর্তী প্রকাশ : চতুর্থ অধ্যায় : খাদ্য না
জ্বালানি ]