পরিপূর্ণ
গ্রহ, কিন্তু থালা শূন্য- খাদ্যাভাবে
নূতন ভূমি-রাজনীতি

পঞ্চম
অধ্যায়
মৃত্তিকার
অবক্ষয়ে অন্ধকার আমাদের ভবিষ্যৎ
১৯৩৮
খ্রীষ্টাব্দে ইউ.এস. কৃষি দপ্তরের জনৈক আধিকাকারিক
বিশ্ব পর্যটনে বেরিয়েছিলেন দেখার জন্য- কি
ভাবে পুরানো সভ্যতাগুলি হাজার হাজার বৎসর
ধরে কৃষিকার্য চালিয়ে এসেছে এবং কি ভাবে তারা
মৃত্তিকার ক্ষয় রোধ করেছেন । তিনি দেখেছিলেন
কিছু সভ্যতা ভূমির উর্বরতাকে দক্ষতার সঙ্গে
নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে এবং আজও উন্নত, বাকিদের
পড়ে আছে শুধু অতীত ।
তাঁর রিপোর্ট- 'একশত মৃত শহর' (The Hundred
Dead Cities)-এ তিনি উত্তর সিরিয়ায়, আলেপ্পো-র
কাছে একটি স্থানের উল্লেখে জানাচ্ছেন বেশ
কিছু পুরাতন গৃহের কথা যারা নিতান্ত পাথরের
স্তুপ, পুরাতন সভ্যতার সাক্ষী স্বরূপ দাৃঁয়ে
আছে । সপ্তম শতাব্দীতে এই অঞ্চল ছিল বর্ধিষ্ণু-
প্রথমে পারসিক সৈন্যদের দ্বারা এবং পরে আরব
মরুভূমির নোমাডদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল ।
ফলস্বরূপ, কয়েক শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত ভূমি-
এবং জল- সংরক্ষণ পদ্ধতিগুলি বিলুপ্ত হল ।
লেখকের মতে যদি শুধু শহর ধংস ও জনমানুষের
বিকীর্ণতা ঘটতো, তা'হলে হয়তো বা এলাকাগুলিকে
নূতন করে নির্মাণ করা সম্ভব হত । এখন ভূমি
বিলুপ্ত, সব শেষ ।
পৃথিবীর ভূমিতলের আচ্ছাদন, পাতলা মৃত্তিকা-স্তর
তৈরী হয় ভূতাত্বিক কালের লম্বা সময় ধরে যখন,
সাধারণ প্রাকৃতিক ভূমিক্ষয়ের হারের থেকে নূতন
মৃত্তিকার গঠন বেশি হয় । গত শতাব্দীর কোন
এক সময়ে ভূমিক্ষয় বেশি হতে থাকে নূতন মৃত্তিকা
গঠনের অপেক্ষা । পৃথিবার শস্যক্ষেত্রের প্রায়
এক-তৃতীয়াংশ উপরের স্তরের মৃত্তিকার ক্ষয়
নূতন মৃত্তিকার গঠন অপেক্ষা বেশি হয়, জমি
হারায় তার স্বাভাবিক উর্বরতা । ভূতাত্বিক
কালে যে জমি নির্মিত হয়েছিল সেটা হারিয়ে যায়
মনুষ্য-কালে ।
পৃথিবীর ভূমিতলের উপরের ছয় ইঞ্চির মত মৃত্তিকা-স্তর
হল সভ্যতার ভিত্তি । ভূমিরূপ্বিদ্ (Geomorphologist)
ডেভিড মণ্টোগোমারির মতে- মৃত্তিকা হল পৃথিবীর
ত্বক- যার সীমানা ভূবিজ্ঞান এবং জীবনবিজ্ঞানের
মাঝামাঝি ।
বায়ু এবং জলের দ্বারা মৃত্তিকার ক্ষয় সারা
বিশ্বের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ । যে সকল চারণভূমিতে
আছে ৩-৪ বিলিয়ন গোসম্পদ, ভেড়া ও ছগল, আসঙ্কার
কারণ হয়ে ওঠে অতি-চারণ যা' উদ্ভিদকে বিনষ্ট
করে, জমিকে করে ক্ষয়ের অধীন । পৃথিবীতে যে
সকল চারণভূমি অর্ধ-শুষ্ক অঞ্চলে তারা বায়ুর
দ্বারা ভূমিক্ষয়ের জন্য বিশেষভাবে অহননীয়
।
কৃষিকার্য্যে ভূমিক্ষয় হয় জমি যদি খাড়া হয়
বা যে জমি অতি-শুষ্ক কৃষিকার্য্যের জন্য ।
চাষের জমি ঈষৎ খাড়া বা ঢালু হলে বৃষ্টির জল
আটকাতে অল্প উচুঁ আল দিতে হয়, না হ'লে জলস্রোত
নেমে আসে ভূমির উপরের মৃত্তিকা নিয়ে, ভূমিক্ষয়ের
সৃষ্টি হয় । ফলে যে জমির ক্ষুধা কৃষককে পাহাড়ী
এলাকায় চাষ করতে বাধ্য করে তা' বিফলে পর্যবসিত
হয় ।
ইউ.এস.-এতে বায়ু দ্বারা ভূমিক্ষয় সাধারণভাবে
হয় প্রায়-শুষ্ক Great Plain-এ যেখানে মুলতঃ
গম চাষ হয় । তুলনায়, ইউ.এস.Com Belt-এ, যেখানে
দেশের মূল শস্যদানা ও সয়াবীন চাষ হয়, মৃত্তিকার
বিপদ আনে জল দ্বারা ক্ষয় । এটা প্রধাণতঃ হয়
Iowa এবং Missouri-র মত অতি-বৃষ্টির স্থানে
।
জল দ্বারা ক্ষয়ের একটা পরোক্ষ প্রভাব হল
জলাশয়গুলিতে পলি পড়া এবং পলি-সহ নদীবাহিত
জল সমুদ্রে পড়া । পাকিস্তানে আছে দুটি বড়
জলাশয়- Mangla এবং Tarbela, যেখানে রাজ্যের
বিশাল জলসেচ প্রকল্পের অংশ হিসাবে সিন্ধু
নদের জল সঞ্চিত হয় ; আজ এই জলাশয়দুটির এক-তৃতীয়াংশ
পলি-আচ্ছদিত ।
বায়ু দ্বারা ভূমিক্সয়ের দৃশ্যমান সাক্ষী হল
ধুলি-ঝড় । যখন অতি-চারণ বা অতি-কর্ষণ দ্বারা
মাঠের সকল গাছগাছড়া উৎপাটিত হয়ে যায়, বায়ুপ্রবাহ
মৃত্তিকার কণাগুলিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, যা'
থেকে সৃষ্টি হয় ধুলি-ঝড় । যেহেতু কণাগুলি
অতিক্ষুদ্র, এরা অনেকটা পথই হাওয়ায় ভাসে ।
একবার কণাগুলি অপসৃত হয়, বালোকা-ঝড় শুরু হয়
। এগুলি অবশ্য স্থানীয় ব্যাপার, যার থেকে
সৃষ্ট হয় বালুকা-স্তুপ, ফলে ব্যহত হয় কৃষিকার্য্য
এবং পশুচারণ । বালুকাজড় হল মরুভূমি সৃষ্টির
শেষ ধাপ ।
বিংশ শতাব্দীর বিশাল খাদ্য-উৎপাদনের পরিধি
কৃষিকে করেছে ক্ষতির অধীন অনেক দেশ । ঊনবিংশ
শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইউ.এস.-এর
Great Plainগুলিতে অতি-কর্ষণের ফল হল ১৯৩০
সালের Dust Bowl । এটি ইউ.এস.-এর ইতিহাসে
একটি করুণ সময় যখন হাজার হাজার কৃষক-পরিবার
জমি ত্কেকে উৎখাত কয়েছিলেন । অনেকেই নূতন
জীবনের অন্বেষণে ক্যালিফর্নিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন,
যা' বিধৃত রয়েছে John Steinbeck-এর The Grapes
of Wrath-এ তিন দশক পরে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
হল সোভিএট ইউনিয়নে । ১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ খ্রী
-র মধ্যে এখানকার The Virgin Lands Project-এর
উদ্দেশ্য ছিল ঘাস-জমিকে রূপান্তর করা শস্য-জমিতে
। চাষের এলাকা ছিল কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার
শস্য-জমির থেকেও বেশি । প্রাথমিক ফল ছিল উৎসাহব্যাঞ্জক,
কিন্তু dust bowl-এর কল্যানে সাফল্য হয়েছিল
ক্ষণস্থায়ী ।
The Virgin Lands Project-এর মধ্যেকার কাজাখস্টানের
শস্যভূমি শীর্ষে উঠেছিল ২৫ মিলয়ন হেক্টরে,
১৯৮০ সালের গোড়ায় । ১৯৯৯ সালে সেটা কমে দাঁড়াল
১১ মিলিয়ন হেক্টরে ; ২০০৯ সালে বৃদ্ধি পেল
১৭ মিলিয়ন হেক্টরে- তারপরে আবার পতন । বর্তমানে
এই খর্ব্বীকৃত জমির উৎপাদন হেক্টর প্রতি প্রায়
১ টন- যেখানে পশ্চিম ইয়োরোপের অগ্রণী গম-উৎপাদক
ও রপ্তানীকারক ফ্রান্সের কৃষকরা উৎপাদন করছে
৭ টন- হেক্টর প্রতি । কাজাখস্টানের শস্যভূমির
এই পতন সাক্ষ্য দিচ্ছে অতি-কর্ষণ এবং অতি-চারনের
ফলে দেশকে কি মূল্য দিতে হচ্ছে ।
আজ দুটো বিশাল dust bowls নির্মিত হয়েছে-
একটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যস্থলে উত্তর-পশ্চিম
চীন ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়ায়, অন্যটি African
Sahel-এ, একটি বৃক্ষহীন ও তৃণাচ্ছাদিত সাভানা
ইকো-অঞ্চল পূর্ব-আফ্রিকার সোমালিয়া এবং ইঠিওপিয়া
থেকে পশ্চিমে সেনেগল এবং মরিটানিয়া পর্যন্ত
বিস্তৃত । এটি সাহারা মরুভূমিকে বিচ্ছিন্ন
করেছে দক্ষিণের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বর্ষারণ্য
থেকে । দুটো dust bowl-ই নূতন এবং বিশালাকার,
যা' আগে পৃথিবীতে দেখা যায়নি ।
চীনদেশ এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ।
১৯৭৮ সালের অর্থনৈতিক রিফর্মের পরে, যেটা
বৃহৎ রাস্তৃয় গঠন ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র
ফার্ম-পরিবারগুলির হাতে কৃষিকার্য্য ধরিয়ে
দিল, চীনের গো-মহিষাদি পশু, ভেড়া এবং ছগলের
সংখ্যা বর্ধিত হতে থাকল । সাধারণ্যে উন্মুক্ত
হল এক ক্লাসিক ট্রজেদী । তুলনীয় চারনভূমি
নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল ৯৪ মিলিয়ন
গো-মহিসাদি সম্পদ, চীনের ৮৪ মিলিয়ন থেকে সামান্য
বেশি । কিন্তু, যখন ভেড়া ও ছগলের সংখ্যা ধরা
হল, ইউ.এস.-এর যেখানে মোট ৯ মিলিয়ন, চীনের
সেখানে ২৮৫ মিলিয়ন । চীনের উত্তর ও পশ্চিম
প্রদেশগুলিতে এই প্রাণীরা জমির রক্ষাপ্রদ
গাছগাছর্হাকে সমূলে বিনষ্ট করে । পরবর্তী
কাজ করে বায়ু- মৃত্তিকাকে উড়িয়ে নিয়ে চারণভূমিকে
পরিণত করে মরুভূমিতে ।
বিশ্বের এক বিশিষ্ট মরুভূমি-অভিজ্ঞ ব্যক্তি
Wang Tao লিপিবদ্ধ করেছেন যে, ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫
সালের মধ্যে প্রতি বৎসর গড়ে ৬০০ বর্গ মাইল
জমি রূপান্তরিতে হয়েছে মরুভূমিতে । '৭৫ থেকে
'৮৭ সালে এটি বেড়ে হয়েছে বছরে ৮১০ বর্গ মাইল
। তারপর থেকে শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বছরে ১,৩৯০
বর্গ মাইল জমি হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি ।
Desert Mergers and Acquisitionsও নামক মার্কিন
দুতাবাসের এক রিপোর্টে উপগ্রহ-চিত্র থেকে
দেখা যাচ্ছে যে, চীনদেশের দুটি বড় মরুভূমি
Badain Jaran এবং Tengger বৃদ্ধি পেয়ে মধ্য
মঙ্গোলিয়া ও গানসু প্রদেশদুটিকে মিলিয়ে একটি
বিশাল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে । পশ্চিমে জিনজিয়াং
প্রদেশে আরও দোটি বড় মরুভূমি- টাকলিমাকান
এবং কুমটাগ মিলিত হবার পথে । এই দুটির মধ্যকার
বড় রাস্তাগুলি প্রায়শঃই বালুকা-স্তুপ দ্বারা
ভরে যায় ।
কোনও কোনও স্থানে মানুষজন ভূমিক্ষয় বিষয়ে
বুঝতে পারে যখন ধুলিঝড় হয় । উদাহরণস্বরূপ
২০১০ সালের মার্চ ২০ তারিখ যেদিন বেইজিং এক
শ্বাসরোধকারী ধুলিঝরের সম্মুখীন হয়েছিল ।
শহরের আবহাওয়া বুরো উল্লেখ করলেন যে বায়ুর
হাল বিপজ্জনক, লোকজনকে যথাসম্ভব ঘরের ভিতরে
থাকতে অথবা যদি বাইরে থাকেন, মুখে ঢাকা দেওয়ার
অনুরোধ করা হল । দৃষ্টিগোচর ছিল স্বল্প, মোটরচালকরা
বাধ্য হয়েছিলেন দিনের বেলায় আলো জ্বেলে নিতে
।
বেইজিং একমাত্র স্থান নয় যা' আক্রান্ত হয়েছিল
। এই বিশেষ ধুলি-ঝড়ের কবলে পড়েছিল পাঁচটা
প্রদেশের ২৫০ মিলিয়ন জনমানুষ-সহ অনেকগুলি
শহর । প্রতি বসন্তকালে বেইজিং ও টিয়ানজিন
সহ পূর্ব চিনের শহরগুলির বাসিন্দারা গৃহের
আচ্ছাদন নামিয়ে দেন ধুলি-ঝড় শুরু হলে । শ্বাস
নেওয়ার অসুবিধা এবং চোখ ধুলির দ্বারা আক্রান্ত
হওয়া ছাড়া মানুষকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হয়
ঘরের ভিতর এবং দরজার সামনে ও পাশের গলিগুলিকে
ধুলি মুক্ত রাখার জন্য । কৃষক ও পশুপালকদের
আরও বেশি মূল্য দিতে হয় জীবনধারণের জন্য ।
এই বিশাল ধুলি-ঝড় সৃষ্ট হয় উত্তর-পশ্চিম
ও উত্তর-মধ্য চীন এবং পশ্চিম মঙ্গোলিয়ায় শীতের
শেষ ও বসন্তের প্রথমে । প্রতি বৎসর গড়ে ১০-টি
মুখ্য ধুলি-ঝড় এই অঞ্চল পরিত্যাগ করে ধাবিত
হয় দেশের বিপুল জনাকীর্ণ উত্তর-পূর্বের দিকে
। এই ধুলি-ঝড়গুলির দ্বারা চীনদেশ ছাঢ়াও প্রতিবেশী
রাষ্ট্রগুলি আক্রান্ত হয় । ২০১০ সালের মার্চ
মাসের ধুলি-ঝড় বেইজিং ত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়া
ধাওয়া করেছিল । কোরিয় আবহাওয়া দপ্তর একে তাদের
রেকর্ডে সব থেকে খারাপ ধুলি-ঝড় আখ্যা দিয়েছিল
।
মিডিয়াতে এইসব ঝড়ের বিশদ সংবাদ সব সময়ে পাওয়া
যায়না । নিউ ইয়োর্ক টাইমসের Howard French
বিবরণ দিয়েছেন চৈনিক ধুলি-ঝড়ের যটা ২০০২ সালের
এপ্রিল ১২ তারিখে দক্ষিণ কোরিয়া পৌঁছেছিল
। তিনি লিখেছেন, চীন থেকে ধুলি-ঝড় দক্ষিণ
কোরিয়াকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে সিওলের
মানুষজন শ্বাস নিতে কষ্ট পেয়েছেন । বিদ্যালয়গুলিকে
বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এয়ারলাইনগুলির ফ্লাইট
বাতিল করা হয়েছিল এবং ঔষধালয়গুলি শ্বাসকষ্টজনিত
রোগীদের দ্বারা ভর্তি ছিল । খুচরা বিক্রয়
বন্ধ ছিল । কোরিয়বাসীরা শীতলাকের শেষ ও বসন্তের
প্রথমের ঝড়, যার নাম তারা দিয়েছিলেন পঞ্চম
ঋতুও, তার বিষয়ে ভীত হয়ে পড়েছেন ।
পরিস্থিতি ক্রমশঃই খারাপেরদিকে যাচ্ছে ।
কোরিয়ার পরিবেশ দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী তারা
ধুলি-ঝড়ে কষ্ট পেয়েছেন- গড়ে ১৯৮০-র দশকে ৩৯
দিন, '৯০-এর দশকে ৭৭ দিন এবং ২০০০ থেকে ২০১১
সালে ১১ দিন । এট 'ডাটা' থেকে বোঝা যাচ্ছে
যে জমির অবনমন বাড়ছে । দুঃখের বিষয়, এর কোনও
প্রতিকার হচ্ছে না ।
যদিও চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষজন ধুলি-ঝড়ের
সঙ্গে পরিচিত, বিশ্বের অন্যান্য স্থান জানতে
পারে যখন সেখানে বিশাল ধুলি-ঝড় আছড়ে পড়ে ।
যেমন হয়েছিল ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল, যখন পশ্চিম
মাঃ. যুক্তরাষ্ট্রে- এযারিজোনার উত্তর সীমীনা
থেকে কনডা ধুলি দ্বারা ভরে গিয়েছিল । এটা
এসেছিল উত্তর-পশ্চিম চীন ও মঙ্গোলিয়া থেকে
উদ্ভূত বিশাল ধুলি-ঝড় এপ্রিল ৫ তরিখে ।
চাদ-এর উত্তর-পূর্বে আছে এক বিশাল নিম্নভূমি,
যাকে বলে Bod২l২ Depression, যেখানে জমা হয়
বছরে ১.৩ বিলিয়ন ধুলি, ১৯৪৭ সালের (যখন থেকে
পরিমাপ করা শুরু হয়েছে) থেকে প্রায় দশ গুণ
। সাধারনতঃ আফ্রিকা থেকে যে ধুলি-ঝড় বেরোয়
তা' আটলাণ্টিক পার হয়ে কারিবিয়ানে জমা হয়
। আফ্রিকা থেকে প্রতি বৎসর যে ২-৩ বিলিয়ন
মৃত্তিকা-অণু ঝড়েরা সঙ্গে বাহিত হয়, তা' ধীরে
ধীরে এই মহাদেশের উর্বরতাকে ক্ষীণ করে দেয়,
ফলে মহাদেশটি জৈবিক উৎপাদন-ক্ষমতা হারায় ।
মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার জন্য আফ্রিকার সবথেকে
জনাকীর্ন রাজ্য, নাইজেরিয়া প্রতি বৎসর হারাচ্ছে
৮৬৮,০০০ একর চারণভূমি এবং কৃষিভূমি । রাজ্য-সরকার
উৎপাদনমূলক জমিকে মরুভূমির কাছে হারানোর বিষয়টিকে
বিশেষ পরিবেশগত সমস্যা বলে বিবেচনা করছেন
। অন্য কোনও পরিবেশগত পরিবর্তন দেশটির অর্থনৈতিক
ভবিষ্যতকে এরকম ভাবে আক্রমণ করেনি । নাইজেরিয়া
যদি তার বর্তমান জনসংখ্যা-বৃদ্ধির পথে ( ২০৫০
খ্রী-তে ৩৯০ মিলিয়ন ) চলে, তবে অবস্থা সঙ্গীণ
হবে ।
যখন নাইজেরিযার মনুষ্যজনসংখ্যা বেড়েছে ১৯৬১
সালের ৪৭ মিলিয়ন থেকে ২০১২ সালের ১৬৭ মিলিয়নে,
এর গৃহপালিত পশুর সংখ্যা কিন্তু বেড়েছে প্রায়
৮ মিলিয়ন থেকে ১০৯ মিলিয়ন । ১৭ মিলিয়ন গো-মহিষাদি
জন্তু, ৯২ মিলিয়ন ভেড়া এবং ছাগলের জন্য খাদ্য
পরিরক্ষিত ঘাসভূমিকে ছাড়িয়ে যতে শুরু করে,
দেশটি ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয় ।
বস্তুতঃ, নাইজেরিযার হল একটি গবেষণার ক্ষেত্র-
কি ভাবে মানুষ ও গৃহপালিত পশুর চাপ এর উদ্ভিদ
আচ্ছাদনকে কমিয়ে দেয় । বিশেষতঃ, এর ভেড়া ও
গো-সম্পদ অপেক্ষা ছগলের সংখ্যা বৃদ্ধি তৃণভূমি
ইকোব্যবস্থার অবনমনের একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার
চিহ্ন ।
১৯৭০ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিশ্বে গোরু-মহিষাদির
সংখ্যা বেড়েছে ৩২-শতাংশ, ভেড়ার সন্হখ্যা খুব
একটা পাল্টায়নি, কিন্তু ছাগলের সংখ্যা হয়েছে
দ্বিগুণের বেশি । গৃহপালিত প্শুর সংখ্যা মিশ্রণের
এই নাটকীয় পরিবর্তন, ছাগলের সংখ্যার অনেক
আধিক্যের অর্থ হল তৃণভূমির অপকৃষ্টতা ও মৃত্তিকার
ত্বরান্বিত ক্ষয় ।
ছাগলের সংখ্যা-বৃদ্ধি অন্য অনেক উন্নয়নশীল
দেশে নাটকীয়ভাবে ঘটেছে, বিশেষতঃ আফ্রিকা ও
এশিয়ায়, যার মোট ছাগলের সংখ্যা বিশ্বের ৯০-
শতাংশ । ১৯৬১ থেকে ২০১০ খ্রী-র মধ্যে পাকিস্তনের
গো-মহিসাদির সম্পদ হয়েছে দ্বিগুণের বেশি,
ভেড়া- প্রায় তিনগুণ আর ছগল- প্রায় সাতগুণ
। বাংলাদেশে, ১৯৮০ সাল থেকে গো-সম্পদ ও ভেড়ার
সংখ্যা বেড়েছে মোটামুটি পরিমিত ভাবে, কিন্তু
ছাগলের সংখ্যা-ব্রিদ্ধি হয়েছে চারগুণ । ১৯৮৫
সালে মালি-তে গো-সম্পদ, ভেড়া ও ছাগলের সংখ্যা
ছিল প্রায় সমানসমান ; তখন থেকে গোরু-মহিষাদি
ও ভেড়ার সংখ্যা রয়েছে মোটামুটি স্থির, কিন্তু
ছাগলের সংখ্যা হয়ে গেছে তিনগুণের বেশি ।
ইতিমধ্যে, সাহারার উত্তর সীমানায় ক আলজেরিয়া
এবং মরক্কো-র মতন দেশগুলি উর্বর জমিগুলির
মরুভূমিকরণকে থামানোর প্রচেষ্টা করে চলেছে
। আলজেরিয়ার প্রেসিডেণ্টের মতে আলজেরিয়া প্রতি
বৎসর ১০০,০০০ একরের মতন উর্বর জমিকে মরুভূমিকরণের
কাছে হারাচ্ছে । একটা দেশ, যার মাত্র ৭.৭
মিলিয়ন একর শ্হস্য জমি আছে, তার কাছে এটা
খুব অল্প নয় । আলজেরিয়া তার সুদূর দক্ষিণের
কৃষিজমিতে স্থায়ী গাছগাছর্হা যারা মাটিকে
ধরে রাখে- যেমন, ফলের গাছ, জলপাই গাছ এবং
দ্রাক্ষার উদ্যান রোপন করছে ।
ভারতও তার মরুভূমিগুলির প্রসারণের বিরুদ্ধে
লড়াই চালাচ্ছে । বিশ্বের মাত্র ২-শতাংশ ডাঙ্গাজমি
নিয়ে ভারতকে সামাল দিতে হচ্ছে বিশ্বের ১৮-শতাংশ
জনসংখ্যা এবং ১৫-শতাংশ গো-মহিষাদি সম্পদ ।
ISRO-র বিজ্ঞানীদের মতে ভারতের ডাঙ্গাজমির
২৫-শতাংশ ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিবর্তিত হচ্ছে
। এটা তাই আশ্চর্যের বিষয় নয় যে ভারতের গো-সম্পদের
সংখ্যা কৃষ ।
আফগানিস্তানের বিষয়ে UNEP-র রিপোর্ট হল যে,
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সিসটান অঞ্চলে প্রায়
১০০-টি গ্রাম বায়ু-তাড়িত ধুলি ও বালুকা দ্বারা
আচ্ছাদিত হয়ে গেছে । রেজিসতান মরুভূমি এগিয়ে
চলেছে পশ্চিম দিকে- কৃষিজমিকে ধংস করে । রেজিস্তান
মরুভূমি এগিয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে কৃষিভূমিকে
বিনাশ করে । দেশের উত্তর-পশ্চিমে আমু দারিয়া
জলাশয় এলাকার কৃষিভূমিতে বালুকাস্তুপ দেখা
যাচ্ছে উদ্ভিদ বিনষ্ট করে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ
ও অতি-চারন দ্বারা । UNEP পরিদর্শকগণ বালুকা
দেখেছেন পাঁচতলা বাড়ির সমান উঁচু, রাস্তাঘাট
আটকে ।
আফগান কৃষি ও খাদ্য মত্রিত্ব শঙ্কিতজনক রিপোর্ট
দিচ্ছেন : মৃত্তিকা হারাচ্ছে উর্বরতা, জলপীঠ
নাটকীয়ভাবে নেমে গেছে, উদ্ভিদের বিনাশ বিস্তৃত
অঞ্চলে, এবং জল ও বায়ুর দ্বারা মৃত্তিকা-ক্ষয়
সর্বব্যাপী । তিন দশকের সশস্ত্র সংঘর্ষ ও
সংস্লিষ্ট বঞ্চনা ও লুটপাটের ফলে আফগানিস্তান
হয়ে গেছে প্রায় বনসম্পদহীন । দক্ষিণের স্সতটি
প্রদেশ শস্যভূমি হারাচ্ছে অগ্রগামী বালুকা-স্তুপের
কাছে । আর অনেক বিফল হওয়া রাষ্ট্রের মতন,
আফগানিস্তান যদিও কোনও পরিবেশ-উন্নায়ন নীতি
গ্রহণ করে, তা' সাধন করার মতন এর কোনও আইনগত
ব্যবস্থা নেই ।
ইরাক, প্রায় এক দশকের যুদ্ধ এবং হালের খরা
ও বহুকালের অতি-চারণ ও অতি-কর্ষণের ফলস্বরূপ
কৃষির জল থেকে বঞ্চিত হয়েছে তুরস্কের দ্বারা
। নদীগুলির খর্ব্বিত জল, কৃষির পরিকাঠামোর
অপকৃষ্টতা, ক্রমশঃ নিম্নগামী জলস্তর, কৃষিজমির
সঙ্কোচন এবং জলাভূমির ক্রমশুষ্কতা- ইরাককে
শুকিয়ে দিচ্ছে । The Fertile Crescent, যা'
ছিল সভ্যতার উৎপত্তি-স্থান কালে কালে রূপান্তরিত
হবীর সম্ভাবনা dust bowl-এ ।
ক্রমবর্ধমান পৌনঃপুন্যকতায় ধুলি-ঝড় সংঘটিত
হচ্ছে পশ্চিম সিরিয়া ও উত্তর ইরাকে । ২০০৯
সালের জুলাই মাসে বেশ কয়েক দিন ধরে ধুলি-ঝড়ে
আক্রান্ত হয়েছিল ইরাক, যাকে উল্লেখ করা হয়
ইরাকের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বিধংসী । যখন
এটা ইরাকের মধ্যে প্রবেশ করে পূর্বদিকে বহিত
হয়েছে, তেহরাণের সরকার সরকারী অফিস সহ বেসরকারী
অফিস, বিদ্যালয় এবং ফ্যাক্টরিগুলিকে ব্ন্ধ
করে দিয়েছে ।
৭৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের
উপর কি ধরণের চাপ তার উদাহরণ । ৯ মিলিয়ন গো-সম্পদ
এবং ৮০ মিলিয়ন ভেড়া ও ছগল নিয়ে ইরান, যে দেশ
কম্বল-শিল্পের পশমের জন্য বিখ্যাত, তার চারনভূমি
আজ অতি-সংগ্রহের ফলে অপকৃষ্ট অবস্থায় । ইরানের
মরুভূমি-করণের বিরোধী সংস্থার নেতৃত্বে মহম্মদ
জারিয়ান ২০০২ সালে বক্তব্য রেখেছেন যে সিস্তান-বালোচিস্তানের
দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশের ১২৪-টি গ্রাম ধুলি-ঝড়
দ্বারা আচ্ছদিত হওয়ার ফলে পরিত্যক্ত হতে বাধ্য
হয়েছে ।
বায়ুর দ্বারা রাশিকৃত বালুকারাশি চারনভূমিকে
আচ্ছাদিত করেছে, গৃহপালিত পশুরা হয়েছে অভুক্ত,
গ্রামবাসীরা হারিয়েছে উপজীবিকা । দেশগুলি
যত মৃত্তিকার উপরিভাগ হারায় ততই তার প্রাণীসম্পদ
নিজেদের খাওয়ার ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয় ।
এধরণের সমস্যায় পড়েছে লেসোথো, মোঙ্গোলিয়া,
উত্তর কোরিয়া এবং হাইতি । লেসোথো হল আফ্রিকার
ছোট দেশগুলির একটা, জনসগখ্যা মাত্র ২ মিলিয়ন
; কিন্তু মাটি হারিয়ে একে দিতে হচ্ছে বিশাল
মূল্য । ২০০২ খ্রী-তে একটি UN team এখানকার
খাদ্যের অবস্থা নির্ণয় করে এক রিপোর্ট দিয়েছিল-
লেসোথোর কৃষি-ব্যবস্থা হাল অত্যন্ত সঙীণ,
শস্য উৎপাদন কমছে এবং দেশের বশির ভাগ স্থানে
সম্পুর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে যদি না এখনই কোনও
ব্যবস্থা নেওয়া না হয় - মৃত্তিকা-ক্ষয়, অবনমন
এবং উর্বরতা-হানির বিরুদ্ধে ।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর Michael Grunwald রিপোর্ট
দিচ্ছেন, লেসোথোর পাঁচ বছরের নীচের প্রায়
পঞ্চাশ শতাংশ শিশু শারিরীকভাবে কৃশ- অনেকেই
এতো অসুস্থ যে বিদ্যালয়ে যেতে অক্ষম । বিগত
এক দশকে এর ফসল উৎপাদন অর্ধেক হয়ে গেছে মৃত্তিকার
উর্বরতা-হানির জন্য । ঘেঙ্গে পড়া কৃষি-ব্যবস্থা
এই দেশকে বাধ্য করেছে বিশালভাবে নির্ভরতায়
আমদানীর উপর ।
একই ধরণের অবস্থা রয়েছে মঙ্গোলিয়ায়, যেখানে
বিগত ২০ বৎসরের বেশি সময় ধরে গমের কৃষিভূমিকে
ত্যাগ করা হয়েছে যখন গম-এর উৎপাদন কমতে থাকে
। মঙ্গোলিয়া এখন প্রায় ২০-শতাংশ গম আমদানী
করছে । একই সময়ে উত্তর কোরিয়া, যার বিশাল
বনসম্পদ বিনষ্ট হয়েছে বন্যা-প্ররচিত মৃত্তিকার
ক্ষয় ও ভূমি- অবনমনে, দেকলো তার বাৎসরিক শস্য-উৎপাদন
কমতে, ১৯৮০-র দশকের ৬ মিলিয়ন টন থেকে আজকের
৩ মিলিয়ন টনে ।
হাইতি হল পশ্চিম গোলার্ধের একটি পতন্মুখী
রাজ্য যা' ৪০ বৎসর আগেও স্বনির্ভর ছিল শস্য-উৎপাদনে
। সেই সময় থেকে এই রাজ্য হারিয়েছে প্রায় সমস্ত
বনসম্পদ এবং উপরের মৃত্তিকার বেশিরভাগটাই,
বাধ্য হয়েছে প্রয়োজনের অর্ধাংশ শস্য আমদানী
করতে । এটি বর্তমানে জীবনধারণের জন্য নির্ভর
U. N. World Food Programme-এর উপর । উপর-মৃত্তিকার
ক্রমবর্ধমান ক্ষয় ধীরে এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবে
পৃথিবীর স্বাভাবিক জৈব উৎপাদিকা হরণ করে নিচ্ছে
। উৎপাদিকা জমির ক্রনঃ সঙ্কুচিত অবস্থার সঙ্গে
যেন 'কলিশনে' মেতেছে ক্রমবর্ধমান মানুষের
সংখ্যা । ভূমিক্ষয এবং জমির অবনমন হল স্থানীয়
সমস্যা কিন্তু খাদ্য- নিশ্চয়তা হল পৃথিবী-ব্যাপী
।
আগস্ট,
২০১৩ লেষ্টার আর. ব্রাউন
(Lester R. Brown)
অনুবাদক : শঙ্কর সেন ।
Earth
Policy Release
www.earth-policy.org/books/fpep/fpepch1
[ পরবর্তী
প্রকাশ : পঞ্চম অধ্যায় : মৃত্তিকার অবক্ষয়ে
অন্ধকার আমাদের ভবিষ্যৎ ]