পরিপূর্ণ
গ্রহ, কিন্তু থালা শূন্য- খাদ্যাভাবে
নূতন ভূমি-রাজনীতি

ষষ্ঠ
অধ্যায় :
চূড়ায় জল
১৯৩৮
খ্রীষ্টাব্দে ইউ.এস. কৃষি দপ্তরের জনৈক আধিকাকারিক
বিশ্ব পর্যটনে বেরিয়েছিলেন দেখার জন্য- কি
ভাবে পুরানো সভ্যতাগুলি হাজার হাজার বৎসর
ধরে কৃষিকার্য চালিয়ে এসেছে এবং কি ভাবে তারা
মৃত্তিকার ক্ষয় রোধ করেছেন । তিনি দেখেছিলেন
কিছু সভ্যতা ভূমির উর্বরতাকে দক্ষতার সঙ্গে
নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে এবং আজও উন্নত, বাকিদের
পড়ে আছে শুধু অতীত ।
তাঁর রিপোর্ট- 'একশত মৃত শহর' (The Hundred
Dead Cities)-এ তিনি উত্তর সিরিয়ায়, আলেপ্পো-র
কাছে একটি স্থানের উল্লেখে জানাচ্ছেন বেশ
কিছু পুরাতন গৃহের কথা যারা নিতান্ত পাথরের
স্তুপ, পুরাতন সভ্যতার সাক্ষী স্বরূপ দাৃঁয়ে
আছে । সপ্তম শতাব্দীতে এই অঞ্চল ছিল বর্ধিষ্ণু-
প্রথমে পারসিক সৈন্যদের দ্বারা এবং পরে আরব
মরুভূমির নোমাডদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল ।
ফলস্বরূপ, কয়েক শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত ভূমি-
এবং জল- সংরক্ষণ পদ্ধতিগুলি বিলুপ্ত হল ।
লেখকের মতে যদি শুধু শহর ধংস ও জনমানুষের
বিকীর্ণতা ঘটতো, তা'হলে হয়তো বা এলাকাগুলিকে
নূতন করে নির্মাণ করা সম্ভব হত । এখন ভূমি
বিলুপ্ত, সব শেষ ।
পৃথিবীর
ভূমিতলের আচ্ছাদন, পাতলা মৃত্তিকা-স্তর তৈরী
হয় ভূতাত্বিক কালের লম্বা সময় ধরে যখন, সাধারণ
প্রাকৃতিক ভূমিক্ষয়ের হারের থেকে নূতন মৃত্তিকার
গঠন বেশি হয় । গত শতাব্দীর কোন এক সময়ে ভূমিক্ষয়
বেশি হতে থাকে নূতন মৃত্তিকা গঠনের অপেক্ষা
। পৃথিবার শস্যক্ষেত্রের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ
উপরের স্তরের মৃত্তিকার ক্ষয় নূতন মৃত্তিকার
গঠন অপেক্ষা বেশি হয়, জমি হারায় তার স্বাভাবিক
উর্বরতা । ভূতাত্বিক কালে যে জমি নির্মিত
হয়েছিল সেটা হারিয়ে যায় মনুষ্য-কালে ।
পৃথিবীর
ভূমিতলের উপরের ছয় ইঞ্চির মত মৃত্তিকা-স্তর
হল সভ্যতার ভিত্তি । ভূমিরূপ্বিদ্ (Geomorphologist)
ডেভিড মণ্টোগোমারির মতে- মৃত্তিকা হল পৃথিবীর
ত্বক- যার সীমানা ভূবিজ্ঞান এবং জীবনবিজ্ঞানের
মাঝামাঝি ।
বায়ু এবং জলের দ্বারা মৃত্তিকার ক্ষয় সারা
বিশ্বের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ । যে সকল চারণভূমিতে
আছে ৩-৪ বিলিয়ন গোসম্পদ, ভেড়া ও ছগল, আসঙ্কার
কারণ হয়ে ওঠে অতি-চারণ যা' উদ্ভিদকে বিনষ্ট
করে, জমিকে করে ক্ষয়ের অধীন । পৃথিবীতে যে
সকল চারণভূমি অর্ধ-শুষ্ক অঞ্চলে তারা বায়ুর
দ্বারা ভূমিক্ষয়ের জন্য বিশেষভাবে অহননীয়
।
কৃষিকার্য্যে
ভূমিক্ষয় হয় জমি যদি খাড়া হয় বা যে জমি অতি-শুষ্ক
কৃষিকার্য্যের জন্য । চাষের জমি ঈষৎ খাড়া
বা ঢালু হলে বৃষ্টির জল আটকাতে অল্প উচুঁ
আল দিতে হয়, না হ'লে জলস্রোত নেমে আসে ভূমির
উপরের মৃত্তিকা নিয়ে, ভূমিক্ষয়ের সৃষ্টি হয়
। ফলে যে জমির ক্ষুধা কৃষককে পাহাড়ী এলাকায়
চাষ করতে বাধ্য করে তা' বিফলে পর্যবসিত হয়
।
ইউ.এস.-এতে
বায়ু দ্বারা ভূমিক্ষয় সাধারণভাবে হয় প্রায়-শুষ্ক
Great Plain-এ যেখানে মুলতঃ গম চাষ হয় । তুলনায়,
ইউ.এস.Com Belt-এ, যেখানে দেশের মূল শস্যদানা
ও সয়াবীন চাষ হয়, মৃত্তিকার বিপদ আনে জল দ্বারা
ক্ষয় । এটা প্রধাণতঃ হয় Iowa এবং Missouri-র
মত অতি-বৃষ্টির স্থানে ।
জল দ্বারা
ক্ষয়ের একটা পরোক্ষ প্রভাব হল জলাশয়গুলিতে
পলি পড়া এবং পলি-সহ নদীবাহিত জল সমুদ্রে পড়া
। পাকিস্তানে আছে দুটি বড় জলাশয়- Mangla এবং
Tarbela, যেখানে রাজ্যের বিশাল জলসেচ প্রকল্পের
অংশ হিসাবে সিন্ধু নদের জল সঞ্চিত হয় ; আজ
এই জলাশয়দুটির এক-তৃতীয়াংশ পলি-আচ্ছদিত ।
বায়ু দ্বারা ভূমিক্সয়ের দৃশ্যমান সাক্ষী হল
ধুলি-ঝড় । যখন অতি-চারণ বা অতি-কর্ষণ দ্বারা
মাঠের সকল গাছগাছড়া উৎপাটিত হয়ে যায়, বায়ুপ্রবাহ
মৃত্তিকার কণাগুলিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, যা'
থেকে সৃষ্টি হয় ধুলি-ঝড় । যেহেতু কণাগুলি
অতিক্ষুদ্র, এরা অনেকটা পথই হাওয়ায় ভাসে ।
একবার কণাগুলি অপসৃত হয়, বালোকা-ঝড় শুরু হয়
। এগুলি অবশ্য স্থানীয় ব্যাপার, যার থেকে
সৃষ্ট হয় বালুকা-স্তুপ, ফলে ব্যহত হয় কৃষিকার্য্য
এবং পশুচারণ । বালুকাজড় হল মরুভূমি সৃষ্টির
শেষ ধাপ ।
বিংশ
শতাব্দীর বিশাল খাদ্য-উৎপাদনের পরিধি কৃষিকে
করেছে ক্ষতির অধীন অনেক দেশ । ঊনবিংশ শতাব্দী
ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইউ.এস.-এর Great
Plainগুলিতে অতি-কর্ষণের ফল হল ১৯৩০ সালের
Dust Bowl । এটি ইউ.এস.-এর ইতিহাসে একটি করুণ
সময় যখন হাজার হাজার কৃষক-পরিবার জমি ত্কেকে
উৎখাত কয়েছিলেন । অনেকেই নূতন জীবনের অন্বেষণে
ক্যালিফর্নিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, যা' বিধৃত
রয়েছে John Steinbeck-এর The Grapes of Wrath-এ
তিন দশক পরে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল সোভিএট
ইউনিয়নে । ১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ খ্রী -র মধ্যে এখানকার
The Virgin Lands Project-এর উদ্দেশ্য ছিল
ঘাস-জমিকে রূপান্তর করা শস্য-জমিতে । চাষের
এলাকা ছিল কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার শস্য-জমির
থেকেও বেশি । প্রাথমিক ফল ছিল উৎসাহব্যাঞ্জক,
কিন্তু dust bowl-এর কল্যানে সাফল্য হয়েছিল
ক্ষণস্থায়ী ।
The
Virgin Lands Project-এর মধ্যেকার কাজাখস্টানের
শস্যভূমি শীর্ষে উঠেছিল ২৫ মিলয়ন হেক্টরে,
১৯৮০ সালের গোড়ায় । ১৯৯৯ সালে সেটা কমে দাঁড়াল
১১ মিলিয়ন হেক্টরে ; ২০০৯ সালে বৃদ্ধি পেল
১৭ মিলিয়ন হেক্টরে- তারপরে আবার পতন । বর্তমানে
এই খর্ব্বীকৃত জমির উৎপাদন হেক্টর প্রতি প্রায়
১ টন- যেখানে পশ্চিম ইয়োরোপের অগ্রণী গম-উৎপাদক
ও রপ্তানীকারক ফ্রান্সের কৃষকরা উৎপাদন করছে
৭ টন- হেক্টর প্রতি । কাজাখস্টানের শস্যভূমির
এই পতন সাক্ষ্য দিচ্ছে অতি-কর্ষণ এবং অতি-চারনের
ফলে দেশকে কি মূল্য দিতে হচ্ছে ।
আজ দুটো
বিশাল dust bowls নির্মিত হয়েছে- একটি এশিয়া
মহাদেশের মধ্যস্থলে উত্তর-পশ্চিম চীন ও পশ্চিম
মঙ্গোলিয়ায়, অন্যটি African Sahel-এ, একটি
বৃক্ষহীন ও তৃণাচ্ছাদিত সাভানা ইকো-অঞ্চল
পূর্ব-আফ্রিকার সোমালিয়া এবং ইঠিওপিয়া থেকে
পশ্চিমে সেনেগল এবং মরিটানিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত
। এটি সাহারা মরুভূমিকে বিচ্ছিন্ন করেছে দক্ষিণের
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বর্ষারণ্য থেকে । দুটো dust
bowl-ই নূতন এবং বিশালাকার, যা' আগে পৃথিবীতে
দেখা যায়নি ।
চীনদেশ
এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি । ১৯৭৮ সালের
অর্থনৈতিক রিফর্মের পরে, যেটা বৃহৎ রাস্তৃয়
গঠন ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র ফার্ম-পরিবারগুলির
হাতে কৃষিকার্য্য ধরিয়ে দিল, চীনের গো-মহিষাদি
পশু, ভেড়া এবং ছগলের সংখ্যা বর্ধিত হতে থাকল
। সাধারণ্যে উন্মুক্ত হল এক ক্লাসিক ট্রজেদী
। তুলনীয় চারনভূমি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে
ছিল ৯৪ মিলিয়ন গো-মহিসাদি সম্পদ, চীনের ৮৪
মিলিয়ন থেকে সামান্য বেশি । কিন্তু, যখন ভেড়া
ও ছগলের সংখ্যা ধরা হল, ইউ.এস.-এর যেখানে
মোট ৯ মিলিয়ন, চীনের সেখানে ২৮৫ মিলিয়ন ।
চীনের উত্তর ও পশ্চিম প্রদেশগুলিতে এই প্রাণীরা
জমির রক্ষাপ্রদ গাছগাছর্হাকে সমূলে বিনষ্ট
করে । পরবর্তী কাজ করে বায়ু- মৃত্তিকাকে উড়িয়ে
নিয়ে চারণভূমিকে পরিণত করে মরুভূমিতে ।
বিশ্বের
এক বিশিষ্ট মরুভূমি-অভিজ্ঞ ব্যক্তি Wang Tao
লিপিবদ্ধ করেছেন যে, ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ সালের
মধ্যে প্রতি বৎসর গড়ে ৬০০ বর্গ মাইল জমি রূপান্তরিতে
হয়েছে মরুভূমিতে । '৭৫ থেকে '৮৭ সালে এটি
বেড়ে হয়েছে বছরে ৮১০ বর্গ মাইল । তারপর থেকে
শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বছরে ১,৩৯০ বর্গ মাইল
জমি হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি ।
Desert Mergers and Acquisitionsও নামক মার্কিন
দুতাবাসের এক রিপোর্টে উপগ্রহ-চিত্র থেকে
দেখা যাচ্ছে যে, চীনদেশের দুটি বড় মরুভূমি
Badain Jaran এবং Tengger বৃদ্ধি পেয়ে মধ্য
মঙ্গোলিয়া ও গানসু প্রদেশদুটিকে মিলিয়ে একটি
বিশাল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে । পশ্চিমে জিনজিয়াং
প্রদেশে আরও দোটি বড় মরুভূমি- টাকলিমাকান
এবং কুমটাগ মিলিত হবার পথে । এই দুটির মধ্যকার
বড় রাস্তাগুলি প্রায়শঃই বালুকা-স্তুপ দ্বারা
ভরে যায় ।
কোনও
কোনও স্থানে মানুষজন ভূমিক্ষয় বিষয়ে বুঝতে
পারে যখন ধুলিঝড় হয় । উদাহরণস্বরূপ ২০১০ সালের
মার্চ ২০ তারিখ যেদিন বেইজিং এক শ্বাসরোধকারী
ধুলিঝরের সম্মুখীন হয়েছিল । শহরের আবহাওয়া
বুরো উল্লেখ করলেন যে বায়ুর হাল বিপজ্জনক,
লোকজনকে যথাসম্ভব ঘরের ভিতরে থাকতে অথবা যদি
বাইরে থাকেন, মুখে ঢাকা দেওয়ার অনুরোধ করা
হল । দৃষ্টিগোচর ছিল স্বল্প, মোটরচালকরা বাধ্য
হয়েছিলেন দিনের বেলায় আলো জ্বেলে নিতে ।
বেইজিং
একমাত্র স্থান নয় যা' আক্রান্ত হয়েছিল । এই
বিশেষ ধুলি-ঝড়ের কবলে পড়েছিল পাঁচটা প্রদেশের
২৫০ মিলিয়ন জনমানুষ-সহ অনেকগুলি শহর । প্রতি
বসন্তকালে বেইজিং ও টিয়ানজিন সহ পূর্ব চিনের
শহরগুলির বাসিন্দারা গৃহের আচ্ছাদন নামিয়ে
দেন ধুলি-ঝড় শুরু হলে । শ্বাস নেওয়ার অসুবিধা
এবং চোখ ধুলির দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ছাড়া
মানুষকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হয় ঘরের ভিতর
এবং দরজার সামনে ও পাশের গলিগুলিকে ধুলি মুক্ত
রাখার জন্য । কৃষক ও পশুপালকদের আরও বেশি
মূল্য দিতে হয় জীবনধারণের জন্য ।
এই বিশাল
ধুলি-ঝড় সৃষ্ট হয় উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-মধ্য
চীন এবং পশ্চিম মঙ্গোলিয়ায় শীতের শেষ ও বসন্তের
প্রথমে । প্রতি বৎসর গড়ে ১০-টি মুখ্য ধুলি-ঝড়
এই অঞ্চল পরিত্যাগ করে ধাবিত হয় দেশের বিপুল
জনাকীর্ণ উত্তর-পূর্বের দিকে । এই ধুলি-ঝড়গুলির
দ্বারা চীনদেশ ছাঢ়াও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি
আক্রান্ত হয় । ২০১০ সালের মার্চ মাসের ধুলি-ঝড়
বেইজিং ত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়া ধাওয়া করেছিল
। কোরিয় আবহাওয়া দপ্তর একে তাদের রেকর্ডে
সব থেকে খারাপ ধুলি-ঝড় আখ্যা দিয়েছিল ।
মিডিয়াতে
এইসব ঝড়ের বিশদ সংবাদ সব সময়ে পাওয়া যায়না
। নিউ ইয়োর্ক টাইমসের Howard French বিবরণ
দিয়েছেন চৈনিক ধুলি-ঝড়ের যটা ২০০২ সালের এপ্রিল
১২ তারিখে দক্ষিণ কোরিয়া পৌঁছেছিল । তিনি
লিখেছেন, চীন থেকে ধুলি-ঝড় দক্ষিণ কোরিয়াকে
এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে সিওলের মানুষজন শ্বাস
নিতে কষ্ট পেয়েছেন । বিদ্যালয়গুলিকে বন্ধ
করে দেওয়া হয়েছিল, এয়ারলাইনগুলির ফ্লাইট বাতিল
করা হয়েছিল এবং ঔষধালয়গুলি শ্বাসকষ্টজনিত
রোগীদের দ্বারা ভর্তি ছিল । খুচরা বিক্রয়
বন্ধ ছিল । কোরিয়বাসীরা শীতলাকের শেষ ও বসন্তের
প্রথমের ঝড়, যার নাম তারা দিয়েছিলেন পঞ্চম
ঋতুও, তার বিষয়ে ভীত হয়ে পড়েছেন ।
পরিস্থিতি
ক্রমশঃই খারাপেরদিকে যাচ্ছে । কোরিয়ার পরিবেশ
দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী তারা ধুলি-ঝড়ে কষ্ট
পেয়েছেন- গড়ে ১৯৮০-র দশকে ৩৯ দিন, '৯০-এর
দশকে ৭৭ দিন এবং ২০০০ থেকে ২০১১ সালে ১১ দিন
। এট 'ডাটা' থেকে বোঝা যাচ্ছে যে জমির অবনমন
বাড়ছে । দুঃখের বিষয়, এর কোনও প্রতিকার হচ্ছে
না ।
যদিও চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষজন ধুলি-ঝড়ের
সঙ্গে পরিচিত, বিশ্বের অন্যান্য স্থান জানতে
পারে যখন সেখানে বিশাল ধুলি-ঝড় আছড়ে পড়ে ।
যেমন হয়েছিল ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল, যখন পশ্চিম
মাঃ. যুক্তরাষ্ট্রে- এযারিজোনার উত্তর সীমীনা
থেকে কনডা ধুলি দ্বারা ভরে গিয়েছিল । এটা
এসেছিল উত্তর-পশ্চিম চীন ও মঙ্গোলিয়া থেকে
উদ্ভূত বিশাল ধুলি-ঝড় এপ্রিল ৫ তরিখে ।
চাদ-এর
উত্তর-পূর্বে আছে এক বিশাল নিম্নভূমি, যাকে
বলে Bod২l২ Depression, যেখানে জমা হয় বছরে
১.৩ বিলিয়ন ধুলি, ১৯৪৭ সালের (যখন থেকে পরিমাপ
করা শুরু হয়েছে) থেকে প্রায় দশ গুণ । সাধারনতঃ
আফ্রিকা থেকে যে ধুলি-ঝড় বেরোয় তা' আটলাণ্টিক
পার হয়ে কারিবিয়ানে জমা হয় । আফ্রিকা থেকে
প্রতি বৎসর যে ২-৩ বিলিয়ন মৃত্তিকা-অণু ঝড়েরা
সঙ্গে বাহিত হয়, তা' ধীরে ধীরে এই মহাদেশের
উর্বরতাকে ক্ষীণ করে দেয়, ফলে মহাদেশটি জৈবিক
উৎপাদন-ক্ষমতা হারায় ।
মরুভূমিতে
পরিণত হওয়ার জন্য আফ্রিকার সবথেকে জনাকীর্ন
রাজ্য, নাইজেরিয়া প্রতি বৎসর হারাচ্ছে ৮৬৮,০০০
একর চারণভূমি এবং কৃষিভূমি । রাজ্য-সরকার
উৎপাদনমূলক জমিকে মরুভূমির কাছে হারানোর বিষয়টিকে
বিশেষ পরিবেশগত সমস্যা বলে বিবেচনা করছেন
। অন্য কোনও পরিবেশগত পরিবর্তন দেশটির অর্থনৈতিক
ভবিষ্যতকে এরকম ভাবে আক্রমণ করেনি । নাইজেরিয়া
যদি তার বর্তমান জনসংখ্যা-বৃদ্ধির পথে ( ২০৫০
খ্রী-তে ৩৯০ মিলিয়ন ) চলে, তবে অবস্থা সঙ্গীণ
হবে ।
যখন
নাইজেরিযার মনুষ্যজনসংখ্যা বেড়েছে ১৯৬১ সালের
৪৭ মিলিয়ন থেকে ২০১২ সালের ১৬৭ মিলিয়নে, এর
গৃহপালিত পশুর সংখ্যা কিন্তু বেড়েছে প্রায়
৮ মিলিয়ন থেকে ১০৯ মিলিয়ন । ১৭ মিলিয়ন গো-মহিষাদি
জন্তু, ৯২ মিলিয়ন ভেড়া এবং ছাগলের জন্য খাদ্য
পরিরক্ষিত ঘাসভূমিকে ছাড়িয়ে যতে শুরু করে,
দেশটি ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয় ।
বস্তুতঃ, নাইজেরিযার হল একটি গবেষণার ক্ষেত্র-
কি ভাবে মানুষ ও গৃহপালিত পশুর চাপ এর উদ্ভিদ
আচ্ছাদনকে কমিয়ে দেয় । বিশেষতঃ, এর ভেড়া ও
গো-সম্পদ অপেক্ষা ছগলের সংখ্যা বৃদ্ধি তৃণভূমি
ইকোব্যবস্থার অবনমনের একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার
চিহ্ন ।
১৯৭০ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিশ্বে গোরু-মহিষাদির
সংখ্যা বেড়েছে ৩২-শতাংশ, ভেড়ার সন্হখ্যা খুব
একটা পাল্টায়নি, কিন্তু ছাগলের সংখ্যা হয়েছে
দ্বিগুণের বেশি । গৃহপালিত প্শুর সংখ্যা মিশ্রণের
এই নাটকীয় পরিবর্তন, ছাগলের সংখ্যার অনেক
আধিক্যের অর্থ হল তৃণভূমির অপকৃষ্টতা ও মৃত্তিকার
ত্বরান্বিত ক্ষয় ।
ছাগলের
সংখ্যা-বৃদ্ধি অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশে নাটকীয়ভাবে
ঘটেছে, বিশেষতঃ আফ্রিকা ও এশিয়ায়, যার মোট
ছাগলের সংখ্যা বিশ্বের ৯০- শতাংশ । ১৯৬১ থেকে
২০১০ খ্রী-র মধ্যে পাকিস্তনের গো-মহিসাদির
সম্পদ হয়েছে দ্বিগুণের বেশি, ভেড়া- প্রায়
তিনগুণ আর ছগল- প্রায় সাতগুণ । বাংলাদেশে,
১৯৮০ সাল থেকে গো-সম্পদ ও ভেড়ার সংখ্যা বেড়েছে
মোটামুটি পরিমিত ভাবে, কিন্তু ছাগলের সংখ্যা-ব্রিদ্ধি
হয়েছে চারগুণ । ১৯৮৫ সালে মালি-তে গো-সম্পদ,
ভেড়া ও ছাগলের সংখ্যা ছিল প্রায় সমানসমান
; তখন থেকে গোরু-মহিষাদি ও ভেড়ার সংখ্যা রয়েছে
মোটামুটি স্থির, কিন্তু ছাগলের সংখ্যা হয়ে
গেছে তিনগুণের বেশি ।
ইতিমধ্যে,
সাহারার উত্তর সীমানায় ক আলজেরিয়া এবং মরক্কো-র
মতন দেশগুলি উর্বর জমিগুলির মরুভূমিকরণকে
থামানোর প্রচেষ্টা করে চলেছে । আলজেরিয়ার
প্রেসিডেণ্টের মতে আলজেরিয়া প্রতি বৎসর ১০০,০০০
একরের মতন উর্বর জমিকে মরুভূমিকরণের কাছে
হারাচ্ছে । একটা দেশ, যার মাত্র ৭.৭ মিলিয়ন
একর শ্হস্য জমি আছে, তার কাছে এটা খুব অল্প
নয় । আলজেরিয়া তার সুদূর দক্ষিণের কৃষিজমিতে
স্থায়ী গাছগাছর্হা যারা মাটিকে ধরে রাখে-
যেমন, ফলের গাছ, জলপাই গাছ এবং দ্রাক্ষার
উদ্যান রোপন করছে ।
ভারতও তার মরুভূমিগুলির প্রসারণের বিরুদ্ধে
লড়াই চালাচ্ছে । বিশ্বের মাত্র ২-শতাংশ ডাঙ্গাজমি
নিয়ে ভারতকে সামাল দিতে হচ্ছে বিশ্বের ১৮-শতাংশ
জনসংখ্যা এবং ১৫-শতাংশ গো-মহিষাদি সম্পদ ।
ISRO-র বিজ্ঞানীদের মতে ভারতের ডাঙ্গাজমির
২৫-শতাংশ ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিবর্তিত হচ্ছে
। এটা তাই আশ্চর্যের বিষয় নয় যে ভারতের গো-সম্পদের
সংখ্যা কৃষ ।
আফগানিস্তানের
বিষয়ে UNEP-র রিপোর্ট হল যে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের
সিসটান অঞ্চলে প্রায় ১০০-টি গ্রাম বায়ু-তাড়িত
ধুলি ও বালুকা দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে গেছে ।
রেজিসতান মরুভূমি এগিয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে-
কৃষিজমিকে ধংস করে । রেজিস্তান মরুভূমি এগিয়ে
চলেছে পশ্চিম দিকে কৃষিভূমিকে বিনাশ করে ।
দেশের উত্তর-পশ্চিমে আমু দারিয়া জলাশয় এলাকার
কৃষিভূমিতে বালুকাস্তুপ দেখা যাচ্ছে উদ্ভিদ
বিনষ্ট করে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ ও অতি-চারন
দ্বারা । UNEP পরিদর্শকগণ বালুকা দেখেছেন
পাঁচতলা বাড়ির সমান উঁচু, রাস্তাঘাট আটকে
।
আফগান
কৃষি ও খাদ্য মত্রিত্ব শঙ্কিতজনক রিপোর্ট
দিচ্ছেন : মৃত্তিকা হারাচ্ছে উর্বরতা, জলপীঠ
নাটকীয়ভাবে নেমে গেছে, উদ্ভিদের বিনাশ বিস্তৃত
অঞ্চলে, এবং জল ও বায়ুর দ্বারা মৃত্তিকা-ক্ষয়
সর্বব্যাপী । তিন দশকের সশস্ত্র সংঘর্ষ ও
সংস্লিষ্ট বঞ্চনা ও লুটপাটের ফলে আফগানিস্তান
হয়ে গেছে প্রায় বনসম্পদহীন । দক্ষিণের স্সতটি
প্রদেশ শস্যভূমি হারাচ্ছে অগ্রগামী বালুকা-স্তুপের
কাছে । আর অনেক বিফল হওয়া রাষ্ট্রের মতন,
আফগানিস্তান যদিও কোনও পরিবেশ-উন্নায়ন নীতি
গ্রহণ করে, তা' সাধন করার মতন এর কোনও আইনগত
ব্যবস্থা নেই ।
ইরাক,
প্রায় এক দশকের যুদ্ধ এবং হালের খরা ও বহুকালের
অতি-চারণ ও অতি-কর্ষণের ফলস্বরূপ কৃষির জল
থেকে বঞ্চিত হয়েছে তুরস্কের দ্বারা । নদীগুলির
খর্ব্বিত জল, কৃষির পরিকাঠামোর অপকৃষ্টতা,
ক্রমশঃ নিম্নগামী জলস্তর, কৃষিজমির সঙ্কোচন
এবং জলাভূমির ক্রমশুষ্কতা- ইরাককে শুকিয়ে
দিচ্ছে । The Fertile Crescent, যা' ছিল সভ্যতার
উৎপত্তি-স্থান কালে কালে রূপান্তরিত হবীর
সম্ভাবনা dust bowl-এ ।
ক্রমবর্ধমান
পৌনঃপুন্যকতায় ধুলি-ঝড় সংঘটিত হচ্ছে পশ্চিম
সিরিয়া ও উত্তর ইরাকে । ২০০৯ সালের জুলাই
মাসে বেশ কয়েক দিন ধরে ধুলি-ঝড়ে আক্রান্ত
হয়েছিল ইরাক, যাকে উল্লেখ করা হয় ইরাকের ইতিহাসে
সর্বাপেক্ষা বিধংসী । যখন এটা ইরাকের মধ্যে
প্রবেশ করে পূর্বদিকে বহিত হয়েছে, তেহরাণের
সরকার সরকারী অফিস সহ বেসরকারী অফিস, বিদ্যালয়
এবং ফ্যাক্টরিগুলিকে ব্ন্ধ করে দিয়েছে ।
৭৬ মিলিয়ন
জনসংখ্যা নিয়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের উপর কি
ধরণের চাপ তার উদাহরণ । ৯ মিলিয়ন গো-সম্পদ
এবং ৮০ মিলিয়ন ভেড়া ও ছগল নিয়ে ইরান, যে দেশ
কম্বল-শিল্পের পশমের জন্য বিখ্যাত, তার চারনভূমি
আজ অতি-সংগ্রহের ফলে অপকৃষ্ট অবস্থায় । ইরানের
মরুভূমি-করণের বিরোধী সংস্থার নেতৃত্বে মহম্মদ
জারিয়ান ২০০২ সালে বক্তব্য রেখেছেন যে সিস্তান-বালোচিস্তানের
দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশের ১২৪-টি গ্রাম ধুলি-ঝড়
দ্বারা আচ্ছদিত হওয়ার ফলে পরিত্যক্ত হতে বাধ্য
হয়েছে ।
বায়ুর
দ্বারা রাশিকৃত বালুকারাশি চারনভূমিকে আচ্ছাদিত
করেছে, গৃহপালিত পশুরা হয়েছে অভুক্ত, গ্রামবাসীরা
হারিয়েছে উপজীবিকা । দেশগুলি যত মৃত্তিকার
উপরিভাগ হারায় ততই তার প্রাণীসম্পদ নিজেদের
খাওয়ার ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয় । এধরণের
সমস্যায় পড়েছে লেসোথো, মোঙ্গোলিয়া, উত্তর
কোরিয়া এবং হাইতি । লেসোথো হল আফ্রিকার ছোট
দেশগুলির একটা, জনসগখ্যা মাত্র ২ মিলিয়ন ;
কিন্তু মাটি হারিয়ে একে দিতে হচ্ছে বিশাল
মূল্য । ২০০২ খ্রী-তে একটি UN team এখানকার
খাদ্যের অবস্থা নির্ণয় করে এক রিপোর্ট দিয়েছিল-
লেসোথোর কৃষি-ব্যবস্থা হাল অত্যন্ত সঙীণ,
শস্য উৎপাদন কমছে এবং দেশের বশির ভাগ স্থানে
সম্পুর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে যদি না এখনই কোনও
ব্যবস্থা নেওয়া না হয় - মৃত্তিকা-ক্ষয়, অবনমন
এবং উর্বরতা-হানির বিরুদ্ধে ।
ওয়াশিংটন
পোস্ট-এর Michael Grunwald রিপোর্ট দিচ্ছেন,
লেসোথোর পাঁচ বছরের নীচের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ
শিশু শারিরীকভাবে কৃশ- অনেকেই এতো অসুস্থ
যে বিদ্যালয়ে যেতে অক্ষম । বিগত এক দশকে এর
ফসল উৎপাদন অর্ধেক হয়ে গেছে মৃত্তিকার উর্বরতা-হানির
জন্য । ঘেঙ্গে পড়া কৃষি-ব্যবস্থা এই দেশকে
বাধ্য করেছে বিশালভাবে নির্ভরতায় আমদানীর
উপর ।
একই
ধরণের অবস্থা রয়েছে মঙ্গোলিয়ায়, যেখানে বিগত
২০ বৎসরের বেশি সময় ধরে গমের কৃষিভূমিকে ত্যাগ
করা হয়েছে যখন গম-এর উৎপাদন কমতে থাকে । মঙ্গোলিয়া
এখন প্রায় ২০-শতাংশ গম আমদানী করছে । একই
সময়ে উত্তর কোরিয়া, যার বিশাল বনসম্পদ বিনষ্ট
হয়েছে বন্যা-প্ররচিত মৃত্তিকার ক্ষয় ও ভূমি-
অবনমনে, দেকলো তার বাৎসরিক শস্য-উৎপাদন কমতে,
১৯৮০-র দশকের ৬ মিলিয়ন টন থেকে আজকের ৩ মিলিয়ন
টনে ।
হাইতি
হল পশ্চিম গোলার্ধের একটি পতন্মুখী রাজ্য
যা' ৪০ বৎসর আগেও স্বনির্ভর ছিল শস্য-উৎপাদনে
। সেই সময় থেকে এই রাজ্য হারিয়েছে প্রায় সমস্ত
বনসম্পদ এবং উপরের মৃত্তিকার বেশিরভাগটাই,
বাধ্য হয়েছে প্রয়োজনের অর্ধাংশ শস্য আমদানী
করতে । এটি বর্তমানে জীবনধারণের জন্য নির্ভর
U. N. World Food Programme-এর উপর । উপর-মৃত্তিকার
ক্রমবর্ধমান ক্ষয় ধীরে এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবে
পৃথিবীর স্বাভাবিক জৈব উৎপাদিকা হরণ করে নিচ্ছে
। উৎপাদিকা জমির ক্রনঃ সঙ্কুচিত অবস্থার সঙ্গে
যেন 'কলিশনে' মেতেছে ক্রমবর্ধমান মানুষের
সংখ্যা । ভূমিক্ষয এবং জমির অবনমন হল স্থানীয়
সমস্যা কিন্তু খাদ্য- নিশ্চয়তা হল পৃথিবী-ব্যাপী
ষষ্ঠ অধ্যায় :
চূড়ায় জল এবং খাদ্যের অনটন
যদিও
অনেক বিশ্লেষক বিশ্বে তৈল ভাণ্ডার নিঃশেষের
বিষয়ে চিন্তিত, ভূতলে জলের নিঃশেষ হওয়ার বিষয়
আমাদের ভবিষ্যতের পক্ষে আরও বড় আশঙ্কাজনক
। তেলের একাধিক বিকল্প আছে, কিন্তু জলের কোনও
বিকল্প নেই । বস্তুতঃ, মানুষ অনেক সময়েই তেল
ছাড়া দিন কাটিয়েছে, কিন্তু জল ? তার কোনওবিকল্প
নেই ।
জলের তো কোনও বিকল্প নেই-ই, খাদ্য উৎপাদনে
পৃথিবীর প্রয়োজন অনেক জলের । প্রাপ্ত বয়স্কদের
প্রতিদিন কোনও এক ভাবে জলের প্রয়োজন ৪ লিটার
। কিন্তু আমরা প্রতিদিন যে খাদ্য গ্রহণ করি
তার জন্য প্রয়োজন ২০০০ লিটার- পাঁচশ গুণ ।
যেহেতু খাদ্য এমন একটি বিশেষ বস্তু যার উৎপাদনে
প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়, এটি কোনও আশ্চর্যের
বিষয় নয় যে কৃষিতে জলের প্রয়োজন বিশ্বের ৭০-শতাংশ
। যদিও এটা এখন বিশেষভাবে গ্রাহ্য যে পৃথিবী
কঠীন জলসংকটের সম্মুখীণ, সবাই কিন্তু বোঝে
না যে ভবিষ্যতের জলসংকট হয়ে দাড়াবে খাদ্যসংকটে
।
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে জলসেচের প্রয়োজনীয়তা
মানুষ বুঝেছে প্রায় ৬,০০০ বৎসর আগে । বস্তুতঃ,
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিসের জল ব্যবহার করে সেচ-ব্যবস্থার
প্রবর্তন থেকে হল সুমেরীয় সভ্যতার অভ্যুদয়
এবং নাইল নদ থেকে জন্ম নিল প্রাচীন ঈজিপ্ট
।
ইতিহাসের
বেশির ভাগ সময়েই জলসেচের প্রসার হয়েছে বেশ
মন্থরভাবে । কিন্তু, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে
এর বিস্তার হয়েছে বহুলভাবে । ১৯৫০ সালে বিশ্বে
ছিল আনুমানিক ২৫০ মিলিয়ন একর সেচ-জমি । ২০০০
সালে এটি বেড়ে হল প্রায় তিন-গুণে, ৭০০ মিলিয়ন
একরে । এই কয়েক দশকের দ্রুত বৃদ্ধির পর শতাব্দীর
শেষভাগে হঠাৎ সেচব্যবস্থার বর্ধন কমে গেল
নাটকীয়ভাবে, মাত্র ৯-শতাংশ বৃদ্ধি ২০০০ থেকে
২০০৯ সালের মধ্যে । সরকার সাধারণতঃ কমে যাওয়া
অপেক্ষা বেশি হওয়াটিকে রেপোর্ট করে- এটি ধরে
নিয়ে বলা যায় সেচসেবিত অঞ্চল আরও কম হয়েছে
। সেচ-ব্যবস্থার নাটকীয় পতন এবং তার সঙ্গে
কোনও কোনও দেশে নিম্নগামী জলস্তর, এই দুইয়ে
মিলে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে জলের ঊর্ধসীমায় অবস্থান
আমাদের দোরগোড়ায় ।
জনপ্রতি সেচসেবিত জমির পরিমান আরও কম আশ্বাসজনক
। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে সেচের জমি বৃদ্ধি
পেয়েছে, কিন্তু জনসংখ্যা-বৃদ্ধির তুলনায় কম
। ফলস্বরূপ, জনপ্রতি সেচসেবিত এলাকা আজ ১০
শতাংশ কম ১৯৬০ খ্রী-র তুলনায় । এত বেশি জলবাহী
স্তর নিম্নগামী হয়েছে এবং এত সেচের কূপ শুষ্ক
হয়ে যাচ্ছে যে, জনপ্রতি সেচবাহিত জমির পরিমাণ
শুধু সঙ্কুচিতই হবে না, বরং আগামী বৎসরগুলিতে
সঙ্কোচন আরও বৃদ্ধি পাবে ।
বিশ্বের
আনুমানিক ৪০-শতাংশ শস্য-ফসল উৎপন্ন হয় সেচ-সেবিত
ভূমিতে । তিনটি বৃহৎ শস্য-ফসল উৎপাদক, চীন,
ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে- সেচের নির্দিষ্ট
প্রথা বিভিন্ন । চীন-এ ফসলের আশি শতাংশ আসে
সেচ- সেবিত অঞ্চল থেকে ; ভারতে এটি তিন-পঞ্চমাংশ,
মাঃ.যুক্তরাষ্ট্রে- মাত্র এক-পঞ্চমাংশ । এশিয়া
মহাদেশ, যেখানে ভাত হচ্ছে প্রধান খাদ্য, সেখানে
বিশ্বের সেচ-সেবিত ভূমির প্রাধান্য বেশি ।
কৃষকরা সেচের জন্য ভূমির উপরের ও নীচের জল
ব্যবহার করে । উপরের জল সাধারনতঃ নদীর উপরের
বাঁধে সঞ্চিত থাকে- সেখান থেকে খালের নেটওয়ার্কের
মাধ্যমে বিভিন্ন জমিতে পাঠানো হয় । ১৯৫০ থেকে
১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর বড় বড় বাঁধগুলি
নির্মিত হয়েছিল যারা ছিল সেচ-ব্যবস্থার প্রধান
উৎস । ১৯৭০ সাল থেকে বাঁধ-নির্মাণ কমতে শুরু
করলো, মনোযোগ চলে গেল কুপ খননের দিকে জমির
নিচের জলের সন্ধানে ।
মাটির
নীচের জল সাধারণতঃ আসে জলবাহী স্তর থেকে যা,
নিয়তঃ পরিপূরিত হয় বৃষ্টিপাত দ্বারা ; জল
নিষ্কাশন ততদিন অবারিত থাকে যতদিন না নিষ্কাশন
পরিপূরণের থেকে বেশি হয় । কিছু অল্প-সংখ্যক
জলবাহী স্তর হল ফসিল স্তর, যেখানে জল আছে
অতিকল্প থেকে । এগুলি বৃষ্টিপাত দ্বারা পরিপূরণ
হয় না, তাই নিষ্কাশন বন্ধ হলে চাষও বন্ধ হয়
। ভূমিনিম্ন ফসিল জলস্তরের মধ্যে প্রধান হল
আমেরিকার ঘরএঅত লঅনেস-এর নীচে গঅললঅলঅ জলস্তর,
উত্তর চীনের বিশাল সমতলের গভীরে এবং সৌদির
নীচের জলস্তর ।
কৃষকদের
পছন্দ অবশ্য নিজস্ব কুপ বা পাম্প কারণ এর
দ্বারা এরা কখন, কতটা এবং কতক্ষণ ধরে জলের
প্রয়োজন তা' নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এত সূক্ষভাবে
যা' কেন্দ্রস্থ সেচ-ব্যবস্থায় সম্ভব নয় ।
পাম্পের দ্বারা জল দেওয়া যায় উদ্ভিদের প্রয়োজন
মত, ফলে বেশী উৎপাদন পাওয়া যায় । বর্তমানে
পৃথিবীর ৪০-শতাংশ সেচ ভূতলের নীচের উপর নির্ভরশীল
। যত শস্যদানার প্রয়োজন বাড়ছে, কৃষকরা তত
বেশি কুপ খনন করে নিচ্ছে, ভূতলের জলবাহী স্তর
কতগুলি কুপ বহন করতে পারে তা' না ভেবেই ।
ফলে জলস্তর হয় আরও নিম্নগামী- এভাবে লক্ষ
লক্ষ কুপ শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে ।
যত কৃষির
জন্য ভৌমজল ব্যবহার বাড়ছে, শস্য-ফসল ততই বাড়ছে
। কিন্তু যদি জলস্তরের পরিরক্ষিত নমনাঙ্ক
থেকে পাম্প করা বেশি হয়, জলস্তর শূণ্যীকৃত
হয়ে যায় । এ অবস্থায় পাম্প চালানোর হার কমিয়ে
দিতে হয় জলস্তরের স্বাভাবিক পরিপূরণের জন্য
এবং শস্য-ফসলের উৎপাদন কমে যায় ।
এর ফল হল খাদ্যসুরক্ষা বিষয়ে জনমানসে একটা
ভুল সুরক্ষার ধারণা গড়ে ওঠে, যা' হয়েছে ১৮-টি
দেশে যেখানে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ
বাস করেন । এদের মধ্যে আছে চীন, ভারত এবং
মাঃ. যুক্তরাস্ট্র ।
সৌদি আরবে বেশ কয়েকটি জলস্তর খুব তাড়াতাড়ি
নিম্নগামী হয়ে যাচ্ছে অত্যধিক পাম্প চালানোর
জন্য । ১৯৭০ সালের আরব দেশ থেকে তেল রপ্তানীর
উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার পর এই রাষ্ট্রের
অধিবাসীরা উপলব্ধি করলেন যে যেহেতু তারা শস্যাদি
আমদানীর উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল, তারা শস্য
রপ্তানী-নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে পারেন ।
এই অবস্থায় ভূমধ্য থেকে তৈল নিষ্কাসন যন্ত্র
ব্যবহার করে তারা মরুভূমির নীচে জলস্তর ব্যবহার
করে গম উৎপাদন করেছেন । কয়েক বৎসরের মধ্যেই
রাজ্যটি তাদের প্রধান খাদ্য গম-এ সয়ম্ভর হয়েছিল
।
কিন্তু ২০ বৎসর বাদে, জানুয়ারি ২০০৮ সালে,
সৌদিরা ঘোষণা করল যে জলবাহী স্তরগুলির জল
অনেক নীচে নেমে গেছে এবং তারা গমের উৎপাদন
বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করে দেবে । ফলে, ২০০৭
থেকে ২০১০ সালের মধ্যে গমের উৎপাদন ৩ মিলিয়ন
টন থেকে অর্ধেক হয়ে গেল । এই ভাবে ২০১৬ খ্রী
পর্যন্ত গমের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে পরে গম
আমদানী করবে ৩০ মিলিয়ন অধিবাসীকে খাওয়ানোর
জন্য ।
সৌদি আরবে এই ধরণের গমের উৎপাদন পর্যায়ভূক্ত
করার পিছনে দুটো কারণ আছে । প্রথমতঃ, দেশটি
শুষ্ক, তাই জলসেচ ব্যতীত চাষ প্রায় অসম্ভব
। দ্বিতীয়তঃ, সেচ নির্ভরশীল মোটামুটি ফসিল
জলস্তরের উপর । শহরবাসীদের জন্য সমুদ্রের
যে জল লবণমুক্ত করে দেওয়া হয় তা' অত্যন্ত
দামী সেচে ব্যবহারের পক্ষে ।
সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান খাদ্য আপদ্গ্রস্থতা
অন্য কিছু দেশে জমি ক্রয় বা লিজ্ করার প্রবণতায়
নিয়ে গিয়েছে, যেমন, ইথিওপিয়া এবং সুডান ।
সৌদিরা পরিকল্পনা করছে নিজেদের জন্য খাদ্য
উৎপন্ন করা অন্য দেশের জমি ও জল সম্পদ ব্যবহার
করে, বিশ্বের বাজার থেকে নিজস্ব প্রয়োজনে
খাদ্য ক্রয় করার বদলে ।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইয়েমেন-এ ভূগর্ভের জলবাহী
স্তরগুলি থেকে নিষ্কাশন করা হচ্ছে পরিপূরণের
হার থেকে বেশি, ফলে অতি নিম্নের ফসিল জলস্তরগুলিও
তাড়াতাড়ি শুষ্ক হওয়ার পথে । ফলে সারা ইয়েমেনেই
জলপীঠ নিম্নগামী, বছরে ২ মিটারের মত । রাজধানী
শঅনঅ'অ, যেখানে ২ মিলিয়ন মানুষের বাস, সেখানে
২০০৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী কলে জল আসে ৪
দিনে একবার ; দক্ষিণের একটি ছোট শহর %থঅ্েয%-এ
২০ দিনে একবার ।
ইয়েমন,
যার জনসংখ্যা-বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে
যাচ্ছে, সত্বর হয়ে উঠছে জলবিজ্ঞানের এক ঝুড়ি
সমস্যা । নিম্নগামী জলপীঠ সহ এর শস্য-ফসল
বিগত ৪০ বৎসরে কমে হয়েছে অর্ধেক, চাহিদা বাড়ছে
ক্রমান্বয়ে । ফলে ইয়েমেনবাসীরা এখন শস্য আমদানী
করছে ৮০ শতাংশের বেশি । যৎসামান্য তেলের রপ্তানী
নিম্নগামী, বলার মতন কোনও শিল্প নেই এবং ৬০-শতাংশ
শিশু চিররুগ্ন ও বহুকলব্যাপী অপুস্টির শিকার-সহ
মধ্য-পূর্ব আরব দেশগুলির মধ্যে সব থেকে দরিদ্র
এই দেশ এখন একটি বিবর্ণ এবং অস্থির ভবিষ্যতের
সম্মুখীন ।
ইয়েমেনের
জলবাহী-স্তরগুলির ক্রমশঃ শুষ্কতা এবং ফলস্বরূপ
কৃষি-উৎপাদনের ক্ষীণতার অর্থ ক্ষুধার ব্যাপ্তি
এবং সামাজিক নিমজ্জন । এরই মধ্যে এমন একটি
দুর্বল রাষ্ট্র যে কোনও সময়ে বিভক্ত হয়ে যেতে
পারে নানা উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে, যারা লিপ্ত
হবে নিজেদের মধ্যে বিবাদে জলের অধিকারের জন্য
। আন্তর্জাতিকস্তরে এই বিবাদ ছড়িয়ে যেতে পারে
সৌদি আরবের সঙ্গে দীর্ঘ ও অরক্ষিত সীমানা
পার হয়ে ।
সৌদি আরবের ভঙ্গুর খাদ্য-ব্যবস্থা এবং ইয়েমেন-এর
অতি দ্রুত অপকৃষ্ট জল-সমস্যা ছাড়া আরও দুটি
জনবহুল রাষ্ট্র- সিরিয়া ও ইরাক নানা জল-সমস্যায়
ভুগছে । এর কিছুটা হচ্ছে ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস
নদীদুটির খর্বীত প্রবাহ, দুটি রাষ্ট্রই চাষের
জন্য জলের উপর নির্ভরশীল হওয়ার জন্য । তুরস্ক,
যার কতৃত্তাধীনে রয়েছে এই দুটি নদীর উৎপত্তিস্থানের
জল, এখন একটি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণে রত এবং ধীরে
ধীরে নিম্নাভিমুখী জলের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে
। যদিও এই ব্যবস্থা হয়েছে তিন রাষ্ট্রের মধ্যে
আলোচনার পর, জলবিদ্যুৎ ও কৃষি বিষয়ে তুরস্কের
উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে কিছুটা
নীচেরদিকের প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের স্বার্থ
লঙঘন করে ।
বিশাল আনাতোলিয়া প্রকল্প দ্বারা ইউফ্রেতিস
নদের জলের অন্যত্র প্রেরণ থেকে তুরস্কের ইচ্ছা
প্রকাশ পাচ্ছে । বিশ্বব্যাঙ্কের জল-সমস্যা-নির্বাহী
বঅরঅলদ রএদএরকেসএন-এর মতে ইউফ্রেতিস এবং তাইগ্রিসের
জল ধরে রাখা উদ্দেশ্যে তুরস্কের ইচ্ছা নদীতীরবর্তী
অন্যান্য রাজ্যগুলির সহশ্রাধিক বৎসরের জল-বণ্টনের
প্রথাকে বিঘ্নিত করবে । কোনও কোনও বিশ্লেষকের
মতে সিরিয়া হারাবে ৩০-শতাংশের মত এবং ইরাক,
যে দেশ তাইগ্রিস-ইউফ্রেতিস প্রবাহের একেবারে
শেষে অবস্থিত, হারাবে অন্ততঃ ৬০ শতাংশ । অন্যান্যরা
যারা আরও ক্ষতিকর ছবি দেখছেন, তাদের মতে সিরিয়া
হারাবে ৫০ শতাংশ এবং ইরাক- ৯০ শতাংশ । কৃষিতে
জল না পাওয়ার জন্য অনেক ইরাকী তাদের জমি ত্যাগ
করে শহরবাসী হয়েছেন । রএদএরকেসএন-এর মতে প্রবাহের
শেষভাগের অবস্থা বিশ্ববাসীর কাছে একটি বিশাল
চাঞ্চল্যকর আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে আসবে
।
নদীর
জল-প্রাপ্তির অনিশ্চয়তার জন্য সিরিয়া ও ইরাক-এর
অনেক কৃষক চাষের জন্য কূপ খনন করে নিচ্ছেন,
যার ফলে এই দুটি দেশেই প্রয়োজন-অতিরিক্ত পাম্প
চালানো এবং জলবাহী-স্তরের নিম্নাভিমুখী গমন
চলছে । কূপ শুষ্ক হওয়ার ফলে সিরিয়াতে শস্য-ফসল
কমছে এক-তৃতীয়াংশ, ২০০১ খ্রী-র প্রায় ৭-মিলিয়ন
টন থেকে । ইরাকে শস্য-ফসল কমেছে এক-ষষ্ঠাংশ,
২০০২ খ্রী-র ৪.৫ মিলিয়ন টন থেকে ।
৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে জর্ডনও কৃষিতে সঙ্কটাপন্ন
অবস্থায়, জলবাহী-স্তরগুলি থেকে প্রয়োজনের
অতিরিক্ত জল তোলার জন্য । জল-সেচ মন্ত্রণালয়ের
হিসাব মত ভৌমজল নিষ্কাশিত হচ্ছে পরিরক্ষিত
উৎপাদনের জন্য যা প্রয়োজন তার প্রায় দ্বিগুণের
মত ; ফলে মিউনিসিপাল ও সেচের জন্য কূপগুলির
হয় অতিরিক্ত ব্যবহার নয় সেগুলি পরিত্যক্ত
করা হচ্ছে । ৪০-৫০ বৎসর আগে দেশটি উৎপাদন
করতো বছরে ৩ লক্ষ টন শস্য-ফসল । আজ এই রাষ্ট্র
৫০,০০০ টন উৎপাদন করে এবং একে আমদানী করতে
হয় প্রয়োজনের ৯০ শতাংশ । এই অঞ্চলে একমাত্র
রাস্ট্র- লেবানন পেরেছে শস্য-ফসল উৎপাদনের
পতন রোধ হরতে ।
অতএব
মধ্য-পূর্ব আরব দেশে, যেখানে জনসংখ্যা-বৃদ্ধি
হচ্ছে দ্রুত, বিশ্ববাসীরা দেখতে পাবে প্রথম
আঞ্চলিক বিবাদ- জনসংখ্যা-বৃদ্ধি এবং জল-সরবরাহের
মধ্যে । এই প্রথম ইতিহাসে, জলাভাব শস্য-ফসল
উৎপাদনকে সঙ্কুচিত করছে একটি ভৌগলিক অঞ্চলে-
যে সঙ্কোচনকে রোধ করার কোনও উপায় নজরে আসছে
না । জনসংখ্যা-বৃদ্ধি ও জলের প্রাপ্তির মধ্যে
একটা সামঞ্জস্য আনার অক্ষমতার জন্য এই অঞ্চলের
সরকারগুলিকে প্রতিদিন ৯,০০০ নূতন মানুষকে
খাদ্য যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে ফসলের জন্য
চাষের জল-সহ ।
একই
ধরণের জলাভাব চীনদেশকে আতঙ্কিত করছে । এ ক্ষেত্রে
যদিও ভূমির উপরের জল বিস্তীর্ণভাবে কৃষিকার্যে
ব্যবহৃত হচ্ছে, মূখ্য উদ্বেগ হল রাজ্যের উত্তর
দিকের অর্ধভাগে ভৌমজলের অবস্থা, যেখানে বৃষ্টিপাত
কম এবং জলপীঠ সকল স্থানেই নিম্নগামী । এই
অঞ্চলেই আছে উত্তর চীনের সমভূমি- বেইজিং-এর
উত্তর থেকে দক্ষিণে সাংহাই পর্যন্ত বিস্তৃত-
যেখানে উৎপাদিত হয় দেশের অর্ধেক গম এবং শস্য-ফসলের
এক-তৃতীয়াংশ ।
উত্তর
চীনের সমভূমিতে জলনিস্কাশনের জন্য পাম্পের
অত্যধিক ব্যবহার থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে
যে ১৩০ মিলিয়নের মতন চীনার খাদ্য- শস্য-ফসল
দেওয়া হচ্ছে জলের অপরিরক্ষিত ব্যবহার থেকে
। এই অঞ্চলের কৃষকরা দুরকমের জলবাহী-স্তর
থেকে জল পাম্প করছে, অগভীর স্তর যা নূতনভাবে
চার্জ করা যায়, কিন্তু বেশিরভাগই শূণ্য, এবং
গভীর ফসিল জলবাহী স্তর । দ্বিতীয় রকমের স্তর
একবার শুষ্ক হয়ে গেলে কৃষকদের ফিরতে হবে বৃষ্টির
জলের উপর ।
চীন
কিন্তু অনেক সাবধান-বার্তা পেয়েছে । এক দশকের
বেশি সময় পূর্বে ভৌমজলের জরীপ করেছিল বেইজিং-এর
Geological Environment Monitoring Institute
(GEMI)। এই সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে হেবেই
প্রদেশের তলায়, উত্তর চীন মালভূমির মধ্যস্থলে
গভীর জলস্তরের গড় লেভেল নেমে গেেছ ২.৯ মিটার
( প্রায় ১০ ফুট ), ২০০০ খ্রীষ্টাব্দে । এই
প্রদেশের কিছু শহরের আশেপাশে জলস্তর নেমে
গেছে এক বছরে ৬ মিটার । GEMI--র ভৌমজল উপদেশক
সংস্থার অধ্যক্ষ He Qingcheng-র মতে উত্তর
চীন সমভূমির নীচে গভীর জলস্তর, যা এলাকার
শেষ জলের সংস্থান, সেই নিরাপদ-আশ্রয় ক্ষীণ
হয়ে গেছে ।
২০১০
সালে Washington Post-এর রেপোর্টার Steven
Mufson-এর সঙ্গে ইনটারভিউতে He Qingcheng
বলেছেন যে বর্তমানে বেইজিং-এ জল পাওয়ার জন্য
১,০০০ ফুট খনন করতে হচ্ছে যা' ২০ বৎসর আগের
থেকে পাঁচগুণ । তাঁর উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে
চীনের জল-ব্যবস্থার উপর বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে
কঠিন ভাষায় লিখিত রিপোর্টে- “ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের
সামনে অমঙ্গলজনক পরিনাম” হবে যদি না জল-ব্যবহার
ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় করা হয় ।
ভারতবর্ষের
সমস্যা বোধ হয় অনেক বেশি সঙ্কটময়, কারণ প্রকৃত
খাদ্য-গ্রহণ এবং বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য
অত্যন্ত ক্ষীণ । পৃথিবীতে কূপ খননের এই উপকেন্দ্রে,
যেখানে কৃষকরা চাষের জন্য ২১ মিলিয়ন চাষের
কূপ খনন করেছেন, দেশের বেশিরভাগ স্থানেই জলপীঠ
নিম্নগামী । এর মধ্যে সব থেকে বেশি প্রভাব
পড়েছে উত্তরে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান
ও গুজরাটে এবং দক্ষিণে তামিলনাদুতে । যে সকল
কূপ বিদ্যুতে চলে এবং ভারী ভরতুকি পায়, সেখানে
জলপীঠের নিম্নগমণের হার বেশি । উত্তর গুজরাটে
জলপীঠ নামছে বৎসরে ৬ মিটার বা ২০ ফুট । কোনও
কোনও প্রদেশে বিদ্যুৎ-ব্যবহারের অর্ধেকই যাচ্ছে
জল পাম্প করার জন্য ।
তামিলনাদু,
যে প্রদেশে ৭২ মিলিয়ন মানুষের বাস, সেখানে
জলপীঠের নিম্নগমণে কূপগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে
। তামিলনাদু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের Kuppannan
Palanisami জানালেন যে নিম্নগামী জলপীঠ শুকিয়ে
দিয়েছে ৯৫ শতাংশ কূপগুলিকে যাদের মালিক হল
ক্ষুদ্র কৃষকগণ, যার ফলে বিগত দশকে এই প্রদেশের
সেচ-সেবিত এলাকা হয়ে গেছে অর্ধেক । জলপীঠ
নীচু হয়ে গেলে ক্ষুদ্র চাষীরা হয় সর্বস্বান্ত,
কারণ তাদের এত অর্থ নেই কূপগুলির গভীরত্ব
বাড়ায় । ভারতে বড় চাষীরা আরও গভীর থেকে জল
পাওয়ার জন্য পরিবর্তিত তৈল নিস্কাশন পদ্ধতির
কৃৎকৌশল ব্যবহার করছে যার ফলে কোনও কোনও স্থানে
১,০০০ ফুট তলায় যেতে সক্ষম হচ্ছে । এতো নীচ
থেকে পাম্প করার অর্থ অত্যন্ত বেশি বিদ্যুৎশক্তির
ব্যবহার যা' ব্যয়সঙ্কুল । যে সকল অঞ্চলে ভৌমজলের
উৎস একদম শুকিয়ে গেছে কৃষিকার্য হয় বৃষ্টির
জলের দ্বারা এবং খাদ্যের জল নিয়ে আসতে হয়
দূর থেকে ট্রাক করে । আন্তর্জাতিক জল নির্বাহী
ইন্সটিটিউট-এর জনৈক মূখ্য আধিকারিকের মতে
“ বেলুন যখন ফাঁটবে, গ্রামীণ ভারতের ভাগ্যে
থাকবে শুধুই অবর্ণনীয় অরাজকতা " ।
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রেও ভূগর্ভের জলবাহী স্তরগুলি
শুকিয়ে আসছে । যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ কৃষি-প্রদেশে
কর্ষিত এলাকা চূড়ায় পৌঁছে গেছে এবং কৃষি অবনতির
মুখোমুখি । ইতিহাসের নিরিখে, ক্যালিফর্নিয়া
হল সেচসেবিত প্রদেশগুলির নেতৃস্থানে ; যেখানে
জলবাহী-স্তরগুলি নিম্নগমণ এবং দ্রুত-বর্ধিত
শহরগুলির জন্য কৃষি এলাকা কমে গেল ১৯৯৭-এ
৯ মিলিয়ন একর থেকে ২০০৭-এ ৮ মিলিয়ন একর ।
টেক্সাসে কৃষি-জমি ছিল চুড়ায়- ৭ মিলিয়ন একর
১৯৭৮ সালে, কমে দাঁড়াল ৫ মিলিয়ন একরে ২০০৭
সালে, যখন ওগঅললঅলঅ জলবাহী-স্তরের দক্ষিণ
দিক শুকিয়ে গেল ।
অন্যান্য প্রদেশ, যাদের কৃষি-জমি কমে আসছে,
তারা হল এরিজোনা, কোলোরাডো এবং ফ্লোরিডা ।
কোলোরাডো বিগত কয়েক দশক ধরে কৃষি-জমি কমতে
দেখছে । গবেষকরা ২০১০ থেকে ২০৫০ খ্রী-র মধ্যে
৭ লক্ষ একর কৃষি-জমি হারাবার কথা বলছেন যেটা
প্রদেশের এক-পঞ্চমাংশ । তিনটি প্রদেশই জলবাহী
স্তরের নূ্যনতা এবং শহরাঞ্চলের দিকে জল প্রেরণের
দোষে দুষ্ট । এখন, যখন নেব্রাস্কা এবং আরকানসাস-এর
মতন প্রদেশগুলিতে কৃষি-এলাকা সমান-সমান হয়ে
আসছে, জাতীয় স্তরে কৃষি-এলাকার বর্ধন হওয়া
দূর-অস্ত । এখন, Great Plain এবং ক্যালিফর্নিয়ার
ছএনতরঅল ঠঅললএয-তে জলস্তর নীচে যাওয়ার ফলে
জলপীঠ শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে, এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের
ক্রম-বর্ধমান শহরগুলির আরও জলের প্রয়োজন হচ্ছে,
মনে হচ্ছে ইউ.এস.-এতে কৃষি-এলাকা চূড়ায় পৌঁছে
গেছে এবং সামনে রয়েছে বহুদিনের অবনমন ।
মেক্সিকো
হল একটি আবাদি-জমির প্রদেশ, যেখানে বাস করেন
১১৬ মিলিয়ন মানুষজন- এখানেও জলের চাহিদা সরবরাহকে
ছাঁড়িয়ে যাচ্ছে । শহরের অবস্থা সকলের গোচরে
আছে, কিন্তু গ্রামীণ এলাকাও জলকষ্ট ভোগ করছে
। Guanajuato-র মতন কৃষি-প্রদেশে জলপীঠের
পতন হচ্ছে বৎসরে ৬ ফুটের মতন । উত্তর পশ্চিমে
Sonora, একটি গম-উৎপাদনের কেন্দ্র, সেখানে
কৃষকরা একদা জল পাম্প করতেন মাত্র ৪০ ফুট
তলায় Hermosillo-জলবাহী স্তর থেকে ; এখন তাঁদের
যেতে হয় ৪০০ ফুটের বেশি তলায় । মেক্সিকোর
সমস্ত জলপীঠের ৫৮-শতাংশ জল নিস্কাশন করা হয়ে
গেছে- এ অবস্থায় খাদ্য-বুদ্বুদ যে কোনও সময়
ফেটে যাবে ।
পৃথিবীর
অনেক নদী অববাহিকায় স্বল্প জল কে ঘিরে 'টেন্শন্'
গড়ে ওঠে । নীল নদের নিম্ন-অববাহিকায় রয়েছে
ঈজিপ্ট, যেখানে ৮৪ মিলিয়ন লোকের বাস এবং বৃষ্টিপাত
নেই বললেই চলে, সেখানকার হাল অত্যন্ত অহননীয়
। ঈজিপ্ট হয় গম আমদানী করে, অথবা গম-কে উৎপাদন
করতে জল আমদানী করে নীল নদের সাহায্যে ; ঈজিপ্টবাসীদের
মূল খাদ্য হল রুটি, তাই গম-প্রাপ্তির সমস্যা
হল জনসাধারণের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
।
নাইল-নদের
জলের এগ্রিমেন্ট (Nile Waters Agreement)
সই হয়েছিল ১৯৫৯-এ ঈজিপ্ট ও সুদানের মধ্যে,
যার দ্বারা স্থির হয় যে, নদের জলের ৭৫-শতাংশ
পাবে ঈজিপ্ট, ২৫ শতাংশ- সুদান, এবং ইথিওপিয়া-
শূণ্য । বস্তুতঃ, এই এগ্রিমেন্ট কখনই কার্যকরী
হয়নি ধনী বৈদেশিক রাস্ট্রগুলি এবং আন্তর্জাতিক
কৃষি-ব্যবসায়ীদের জন্য, যারা নাইল নদের উপরের
অববাহিকার বেশকিছু আবাদিজমিগুলি ছিনিয়ে নিচ্ছে
। যদিও এইসব লেনদেনগুলিকে বলা হচ্ছে জমি-অধিগ্রহণ,
কার্যতঃ এগুলি হচ্চে জল-অধিগ্রহণ ।
ঈজিপ্টের
পক্ষে বিষয়টি দূখঃজনক এই যে, নাইল নদের অববাহিকার
তিন-চতুর্থাংশ ইথিওপিয়া ও দুই সুদানের করতলগত,
যা জমি- অধিগ্রহনকারীদের মূল টার্গেট । দক্ষিণ
সুদানের জমির ৪-শতাংশ আগেই, স্বাধিনতা-প্রাপ্তির
সময়ে অধিগ্রহণ করা হয়েছে বৈদেশিক লগ্নী-কারকদের
দ্বারা । নাইল অববাহিকায় জলের চাহিদা এমন
যে খুব সামান্যই পৌঁছায় নদীপথের শেষে-ভূমধ্যসাগরে
।
নাইল-নদের জলের প্রতিযোগিতায় কায়রোকে এখন
বিচার করতে হবে বেশ কিছু সরকারী এবং ব্যবসায়িক
বিষয় নিয়ে যা ১৯৫৯-এর এগ্রিমেন্টে ছিলনা ।
তা'ছাড়া, ইথিওপিয়ার ঘোষণা মতন একটি বিশাল
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নাইলের উপনদীতে
বাঁধ তৈরী হলে ঈজিপ্টের জলের ভাগ অনেক কমে
যাবে ।
ঈজিপ্টের গম উৎপাদন এখনই বিশ্বে সব চাইতে
বেশি, তাই এর পক্ষে জমির উৎপাদিকা-শক্তি এখনই
বাড়ানোর চিন্তা খুব একটা বাঞ্ছনীয় নয় । বরং
জনসংখ্যা-বৃদ্ধির প্রক্ষেপনে ২০২৫ সালে ১০১
মিলিয়ন ধরলে এর পক্ষে একটা প্রত্যাসন্ন এবং
নির্ভীক চ্যালেঞ্জ হল খাদ্য ও জলের ব্যবস্থা
করা ।
ঈজিপ্টের দশা হল আরও বড় এবং আরও উত্ত্যক্তকারী
দৃশ্যপটের অংশীদার হওয়া । নাইলের উজান স্রোতের
প্রতিকুলে এর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি হল সুদান
এবং দক্ষিণ সুদান যাদের মোট জনসংখ্যা ৪৬ মিলিয়ন
এবং ইথিওপিয়া- জনসংখ্যা ৮৭ মিলিয়ন ; জনসংখ্যা
বাড়ছে তাই এদের খাদ্যের জন্য প্রয়োজন আরও
জলের । রাস্ট্রপুঞ্জের প্রক্ষেপন অনুসারে
নাইল অববাহিকার চারটি দেশের যুক্ত জনসংখ্যা
বাড়বে বর্তমানের ২১৬ মিলিয়ন থেকে ২৭২ মিলিয়ন
।
নাইল নদ একটি মাত্র নদী নয় যার জল পরিপূর্ণ
ভাগাভাগি হয়েছে । দক্ষিণ-পশ্চিম ইউ.এস.এ.-র
কোলোরাডো নদী, যেটা কোলোরাডোর রোকী পর্বতমালা
থেকে উদ্ভুত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত
হয়েছে, সেটা তত্বগতভাবে ক্যালিফর্নিয়া উপসাগরে
পড়েছে । কিন্তু এখন এটি উপসাগর পর্যন্ত পৌঁছায়
না । অথচ এটি ইউ.এস.-এর দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে
সেচের জলের উৎস- দিচ্ছে কোলোরাডো, উটা, নেভাদা,
এরিজোনা এবং ক্যালিফর্নিয়া প্রদেশগুলিতে Phoenix,
San Diegoএবং Los Angeles-এর মত বড় শহরগুলি
এর জলের উপর নির্ভরশীল ।
আরও একটি নদী যা থেকে ভবিষ্যতে বিবাদ হতে
পারে তা' হল সিন্ধুনদ । যদিও সিন্ধুনদের বেশিরভাগ
জলই উৎপন্ন হয় ভারতে, এর ব্যবহার হয় পাকিস্তানে,
কারণ-ভৌগলিক এবং ১৯৬০ সালের জলের সন্ধি ।
সিন্ধুনদ, যেটা হিমালয়ের পশ্চিম থেকে উঠে
পড়ছে ভারত মহাসাগরে, জল দেয় শুধু যে বিশ্বের
সব থেকে বড় সেচ প্রকল্প পাকিস্তানের সিন্ধু
অববাহিকায় তা' নয়, দেশের অন্যান্য কাজেও ব্যবহ্রিত
হয় । কোলোরাডো নদীর মত এটিও বিশ্বের বেশির
ভাগ সময়ে মহাসাগরে পৌঁছায় না বললেই চলে ।
পাকিস্তান,
জনসংখ্যা ১৮০ মিলিয়ন, প্রক্ষিপ্ত জনসংখ্যা
২৭৫ মিলিয়ন- ২০৫০ সাল, এখনই জলসমস্যায় ভুগছে
। বিশ্ব-ব্যাঙ্কের জল-পারদর্শী জনৈক John
Briscoe একটি প্রতিবেদনে জানাচ্ছেন যে, পাকিস্তান
এখনই বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জল-সমস্যা দ্বারা
পীড়িত, যে অবস্থার অবনতি হবে জনসংখ্যা-বৃদ্ধির
কারণে । তিনি আরও বলছেন যে একটি আধুনিক এবং
ক্রমবর্ধমান পাকিস্তান জল দ্বারা তর্জিত ।
আন্তর্জাতিক
স্তরে দেশগুলির মধ্যে জল নিয়ে বিবাদ 'হেডলাইন'
হয়ে থাকত । কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে শহর ও
ফার্মের মধ্যে জলের জন্য প্রতিযোগিতা রাজনীতিকদের
ব্যস্ত রাখতো । অর্থনীতি অথবা রাজনীতি কোনটাই
কৃষকদের অনুকূলে নয় । তারা সব সময়েই শহরের
কাছে পরাজিত হয় ।
বস্তুতঃ, আজ অনেক দেশেই কৃষকরা পচ্ছে শুধু
যে জলের সঙ্কুচিত সরবরাহ, তা' নয়, তাদের ভাগ্যে
পড়ছে সঙ্কুচিত সরবরাহের সঙ্কুচিত ভাগ । মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল এলাকা - southern Great
Plains এবং the Southwest, মোটামুটি সবটা
জলই ব্যবস্থিত হয়েছে । প্রধান প্রধান শহরগুলি
এবং হাজার হাজার ছোট শহরগিলির জলের প্রয়োজনিতা
কোনও মেটাতে পারা যাচ্ছে কৃষিক্ষেত্র বঞ্চিত
করে । জলের মূল্য যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষকরা
ততই নিজেদের চাষের অংশ শহরের কাছে বিক্রয়
করে দিচ্ছে নিজেদের জমিকে শুষ্ক রেখে ।
পশ্চিম
ইউ.এস.-এতে একটি দিনও যায় না নূতন বিক্রয়ের
ঘোষণা দিয়ে । অর্ধেক বা তার বেশি বিক্রয় হচ্ছে
স্বতন্ত্র কৃষকদের কাছী বা তাদের সেচ-জেলার
শহর বা মিউনিসিপালিটির কাছে । ক্যালিফরনিয়ার
ইম্পেরিয়াল ভ্যালী থেকে এলচেতেয ভঅররনেগএর
নিউ ইয়র্ক টাইমসে লিখছেন যে, অনেকেই ভীত 'কলোরাডো
নদীর জলের এই সীমাহান যোগান শুরু হওয়ার এক
শতাব্দী পড়ে আমাদের জমি পরিণত হবে একটি মরুভূমিতে'
।
তড়িৎগতিতে
জনসংখ্যা-বৃদ্ধি নিয়ে কোলোরাডো বিশ্বের একটি
চির-ব্যস্ত জলের বাজার । নানা সাইজের শহর
ও নগর কৃষির জলের অধিকার কিনছে কৃষক ও রাঞ্চারদের
কাছ থেকে । আরকানসাস নদীর অববাহিকা যা' প্রদেশের
এক-চতুর্থাংশের অধিকারী, Colorado Springs
এবং % Aurura (ডেনভারের একটি শহরতলি ), আগেই
কিনে নিয়েছে অববাহিকার কৃষিক্ষেত্রের এক-তৃতীয়াংশের
জন্য জলের অধিকার । ারেওরঅ এত জলের অধিকার
কিনে নিয়েছে যা' একসময়ে Arkansas উপত্যকার
চাষের ১৯,০০০ একর জমিতে সেচের জল দিত । The
US Geological Surveyএস্টিমেট করেছেন যে,
২০০০ থেকে ২০০৫ খ্রী-র মধ্যে সারা রাজ্যে
৪০০,০০০ একর কৃষিজমি শুকিয়ে গেছে ।
কোলোরাডো-ই একমাত্র কৃষিজমি হারায়নি । ভারতের
কৃষকরাও জল হারাচ্চে শহরের কাছে । এটি বিশেষভাবে
প্রতীয়মান পূর্ব-সৈকতে ৯ মিলিয়ন বসবাসকারী
চেন্নাই ( আগেকার মাদ্রাজ )-এর দ্বারা । শহরের
সরকারি ব্যবস্থা অনেক মানুষকেই জল দিতে না
পারায় জন্ম দিয়েছে একটা বর্ধিষ্ণু ট্যাঙ্ক—ট্রাক
ব্যবসায় যেটা কাছাকাছির কৃষকদের কাছ থেকে
জল কিনে শহরে যোগান দিচ্ছে ।
শহরের
কাছের চাষীদের পক্ষে জলের বাজার দর ফসলের
থেকে অনেক বেশি যে ফসল উৎপাদিত হত ঐ জল দ্বারা
। দুঃখের বিষয়, যে ১৩,০০০ ট্যাঙ্কার চেন্নাইতে
অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ কূপ থেকে
জল দিচ্ছে, যার ফলে জলপীঠ নিম্নগামী এবং অগভীর
কূপগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে । এর পরপরই গভীর কূপগুলি
শুকিয়ে যাবে, যার ফলে গ্রামীন মানুষজন হারাবে
খাদ্য এবং জীবনযাত্রা । জলের প্রতিযোগিতা
এত প্রখর যে ভারতের জল-সম্পদের মন্ত্রী নিজেকে
আখ্যা দিয়েছেন জল-বিবাদের মন্ত্রী হিসাবে
।
একদিকে কৃষকদের জন্য জল অন্যদিকে শহর ও শিল্পের
জন্য জল, অর্থনীতি কৃষিকে অগ্রাধিকার দেয়
না । চীনের মতন দেশ যেখানে শিল্পোন্নয়ন এবং
তৎসহ চাকুরী হল জাতীয় অর্থনীতির অতিবর্তনীয়
দিশা, জলের দাবীতে কৃষি হল অবশিষ্ট-স্থানে
।
এমন দেশগুলি যেখানে জলের ভাগাভাগি পরিপূর্ণ
হয়েছে যেমন, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্য-প্রাচ্য,
শহরগুলি বেশি জল পেতে পারে কেবলমাত্র সেচের
জলকে ব্যবহার করে । তখন দেশগুলিকে শস্য-উৎপাদনে
ঘাটতি মেটাবার জন্য শস্য আমদানী বাড়াতে হবে
। যেহেতু সাধারণভাবে ১ টন শস্যদানা প্রস্তুত
করতে প্রয়োজন হয় ১,০০০ টন জল, শস্য-ফসল আমদানী
অনেক বেশি কর্মদক্ষ জল আমদানী অপেক্ষা । একই
ভাবে, শস্য-ফসলের ব্যবসা হল জলের ব্যবসার
সমান ।
আমরা
এখন এমন একটি বিশ্বে বাস করছি যেখানকার অর্ধেকের
বেশি মানুষ বাস করে এমন সব দেশে যেখানে 'খাদ্য-বুদ্বুদ'
রয়েছে অত্যধিক জল পাম্প করার জন্য । এই সব
রাস্ট্রের সামনে আসল প্রশ্ন নয় বুদ্বুদ ফাটবে
কিনা, বরঞ্চ কখন ফাটবে ? এবং কি ভাবে সরকারগুলি
এই সমস্যা মোকাবিলা করবে ? সরকারগুলির ক্ষমতা
কি আছে উৎপাদন-ক্ষয় লোপ করতে শস্য আমদানীর
দ্বারা ? কোনও কোনও দেশের পক্ষে বুদ'বুদ ফাটা
বিপজ্জনক হতে পারে । সমগ্র বিশ্বকে একত্রে
ধরলে, জলপীঠের অবনমন হেতু প্রায় একই সঙ্গে
জাতীয় 'বুদ্বুদ'-এর ফেটে যাওয়া অবস্থা নিয়ে
আসতে পারে এক অদমনীয় খাদ্য বিপর্জয় ।
শুধুমাত্র অতি-মাত্রায় জল পাম্প করার ভৌগলিক
স্কেল, বহুদেশের জলপীঠের একসঙ্গে পতন এবং
ক্রমবর্ধমান পতনের হারের কথা স্মরণ রেখে জলপীঠদের
সুস্থিত করা অত্যন্ত জরুরী । যদিও পড়ন্ত জলপীঠগুলি
ঐতিহাসিকভাবে হালের, তারা এখনই জল-বণ্টনের
প্রতিভূতিকে তর্জন করছে কেবলমাত্র এইসব দেশে
নয় সারা বিশ্বব্যাপী ।
ক্রমবর্ধমান জলের ব্যবহার এবং জলবাহী স্তরের
পরিরক্ষিত উৎপাদনের মধ্যে ফারাক বাড়ছে প্রতি
বৎসরেই, যার অর্থ হল প্রতি বছরে জলপীঠের নিম্নগমন
আগের বৎসরের থেকে বেশি । আজপর্যন্ত কোনও দেশ
জলের অবনমনকে রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়নি এটি মনে
রেখে জলের ব্যবস্থাপনায় দ্রুত শক্তহাতে ধরা
দরকার যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে । জল-সমস্যার এই
দ্রুত উৎঘাটন বিশ্ব-সমস্যার নিরিখে এখনও পরিণত
হয়নি খাদ্যসমস্যায়, তবে এই সমস্যায় এখনই নজর
দেওয়া প্রয়োজন ।
আগস্ট,
২০১৩ লেষ্টার আর. ব্রাউন
(Lester R. Brown)
অনুবাদক : শঙ্কর সেন ।
Earth
Policy Release
www.earth-policy.org/books/fpep/fpepch1