প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পরিপূর্ণ গ্রহ, কিন্তু থালা শূন্য- খাদ্যাভাবে নূতন ভূমি-রাজনীতি (সূচী)

দশম অধ্যায় :
বিশ্বে জমি নিয়ে অভূতপূর্ব কাড়াকাড়ি

২০০৭ এবং মধ্য-২০০৮ এর মধ্যে বিশ্বের শস্যদানা ও সয়াবিনের মূল্য হয়েছে দ্বিগুণের বেশি । যেহেতু খাদ্যের মূল্য সর্বত্রই বাড়ছে, কিছু দেশ রপ্তানি বন্ধ করে দিল যেন দেশে খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতি না হয় । যারা আমদানির উপর নির্ভরশীল, তাঁরা ভীত হয়ে পড়লো । কেউ রপ্তানি-কারক দেশগুলির সঙ্গে দীর্ঘ-মেয়াদি শস্য পাঠাবার সর্ত করার চেষ্টা করল, বিক্রেতার বাজার মূল্যে ; কিছু সফলও হল । মনে হয় আগের দিনের কথা, আমদানি-কারক দেশগুলি বুঝতে পারলো, যে তাদের খুঁজতে হবে অন্য দেশে জমি, যেখানে ফসল উৎপাদন করে নিতে হবে ।

বিদেশে জমি গ্রাস নূতন কিছু নয় । সাম্রাজ্য বেড়েছে অর্জনের মধ্য দিয়ে, ঔপনিবেশিক শক্তি ব্যবহার করে উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছে, কৃষিভিত্তিক শিল্প তাদের সীমানা বর্ধন করেছে । কৃষিবিষয়ক বিশ্লেষক Derek Byerlee মধ্য-ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাজার- ভিত্তিক লগ্নীগুলির পদচিহ্ন ধরে এগিয়েছেন । বিগত ১৫০ বছর ধরে শিল্পোন্নত দেশগুলি থেকে বড়সড় লগ্নী করা হয়েছে মূলত: ক্রান্তীয় উৎপন্ন দ্রব্য যথা, আখ, চা, রবার এবং কলা ।

এখন নতুনত্ব এই যে বিদেশে জমি গ্রাস করার আগ্রহ হচ্ছে মূল খাদ্যের জন্য যথা গম, ভাত, শস্য ও সয়াবিন এবং জৈব-জ্বালানীর জন্য । বিগত বেশ কিছু বছর ধরে এই সব জমি গ্রাস করা বা জমি অসত্‍‌ উপায়ে গ্রহণ করা জমি-দুষ্প্রাপ্যতার-রাজনীতির নূতন অধ্যায় । এগুলি ঘটছে এমন পরিমাণে ০ তাড়াতাড়ি যা' আগে কখনো দেখা যায়নি ।

বিদেশে যেসকল দেশে জমি সোজাসুজি কেনা বা লীজ করা হতে পারে- সরকারের নিজস্ব অস্ত্রের মধ্য দিয়ে অথবা নিজস্ব-লালিত কৃষি-বাণিজ্য সংস্থার সাহায্যে এবং সহযোগিতায়, তারা হল- সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং ভারত । সৌদি আরবের মানুষজন তাদের জমি- ও জল-সম্ভাবনাগুলি একরকম বিদেশের হাতে তুলে দিয়েছে । দেশটি তার সেচের জল সত্বর হারাচ্ছে এবং শীঘ্রই পুরোপুরি বিশ্ব-বাজারের উপর আমদানি ন্যস্ত করবে ও তার শস্যদানার জন্য বৈদেশিক জোত-জমির পরিকল্পনার দ্বারস্থ হবে ।

দক্ষিণ কোরিয়া, যে তার শস্যদানার ৭০ শতাংশ আমদানি করে, বিভিন্ন দেশে জমিতে বড় লগ্নী কারক । ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশে ৯৪০ হাজার একর ফার্মল্যাণ্ড ভুট্টা, গম এবং সয়াবিন উৎপাদনের জন্য অধিগ্রহণ করতে হবে ; কোরিয় সরকার নিজস্ব কোম্পানিগুলিকে ফার্মল্যাণ্ড লীজ করতে সাহায্য করবে অথবা কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এবং ইউক্রেইনের মতন দেশগুলিতে কৃষিশিল্পে লগ্নী করবে ।

চীন, যেখানে জলবাহী স্তর শুকিয়ে যাচ্ছে এবং নগরায়ন ও শিল্পায়নের জন্য কৃষিজমির ক্ষয় হচ্ছে, ভবিষ্যত্‍‌ খাদ্য-যোগানের বিষয়ে সে চিন্তিত আছে । যদিও ১৯৯৫ থেকে এই দেশ শস্যদানায় স্বনির্ভর, বিগত কয়েক বৎসর ধরে চীন হয়ে গেছে একজন প্রথম সারির শস্যদানার আমদানিকারক । এটি সয়াবিনের প্রথম সারির আমদানিকারক, সব কটি দেশের যুক্ত সয়াবিন আমদানি করে ।

ভারত, যাকে একটি বিশাল এবং বাড়ন্ত জনসাধারণকে খাওয়াতে হয়, সে জমি-অধিগ্রহণের মূল খেলোয়াড় । কৃষির জন্য কূপগুলি শুকিয়ে যাবার মুখে, মধ্য-শতাব্দী নাগাদ আরও ৪৫০ মিলিয়ন জনমানুষ যুক্ত হবার পথে এবং দুঃস্থিত আবহাওয়া নিয়ে ভারতও বর্তমানে খাদ্য-অনিশ্চয়তার জন্য চিন্তান্বিত ।

বিদেশে জমি গ্রাসের আরও অনেক দেশের মধ্যে আছে ইজিপ্ট, লিবিয়া, বাহরিন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব এমিরেটস (UAE) । উদাহরণস্বরূপ, ২০১২ খ্রী-র প্রথম দিকে Al Ghurair Foods, UAE-র একটি কোম্পানি ঘোষণা করল যে এটি সুদানে ২৫০ হাজার একর জমি লীজ দেবে ৯৯ বৎসরের জন্য, যেখানে গম এবং অন্যান্য শস্যদানা ও সয়াবিন উৎপন্ন করা যাবে । প্ল্যান হল উৎপাদিত শস্য যাবে UAE ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশে ।

সারা বিশ্বে এই জমি গ্রাসের প্রকৃত হিসাব পাওয়া দুষ্কর । বোধ হয়, জমি জোর করে অধিগ্রহণ বিষয়টি এতটা রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর যে জনরব এবং সত্যের মধ্যে তফাত্‍‌ বাহির করা একটা চ্যালেঞ্জ । প্রথম প্রথম খবরের বর্ধিত পৌনঃপুন্যতা থেকে একটা আন্দাজ করা যায় বিষয়টির সত্য-অসত্যতা, কিন্তু কেহই রীতিসঙ্গতভাবে এই কৃষিভিত্তিক বিষয়টি সত্য প্রমাণ করার প্রয়োজন দেখেনি । অনেক দল একটা ছোট বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান, যার বাজেট খুব অল্প, GRAIN এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে কাজ করে । বিশ্বব্যাঙ্ক এই GRAIN-এর তথ্যের ওপর নির্ভর করে তাদের সেপ্টেম্বর ২০১০ ঘোষণার জন্য, যা জানুয়ারি ২০১১-তে মার্জিত করা হয়েছিল ।

বিশ্বব্যাঙ্ক তার রিপোর্টে ৪৬৪টি জমি অধিগ্রহণের বিষয় সনাক্ত করেছেন যারা অক্টোবর ২০০৮ এবং আগস্ট ২০০৯-এর মধ্যে বিভিন্ন স্তরে ছিল । রিপোর্ট করা হয়েছে যে কাজ শুরু হয়েছে ঘোষিত প্রোজেক্টের এক-পঞ্চমাংশ স্থানে কারণ লেনদেন করা হয়েছিল জমি-স্পেকুলেটরদের মাধ্যমে । রিপোর্টে মন্থর শুরুর জন্য নানা কারণও দিয়েছে, যেমন অবাস্তবতা, মূল্য-পরিবর্তন, অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো, ইত্যাদি । ৪৬৪ প্রোজেক্টের মধ্যে ২০৩টির জমি সংক্রান্ত কিছু খবর পাওয়া গিয়েছে; বিশেষভাবে উল্লেখ্য ৪০৫ টি প্রোজেক্ট যাদের পণ্যদ্রব্য সমাচার পাওয়া যাচ্ছে- ২১ শতাংশ জৈব-জ্বালানি এবং আরেক ২১ শতাংশ শিল্প যথা, রবার ও কাঠ- মাত্র ৩৭ শতাংশ হল খাদ্য শস্য ।

এই সব জমি-ব্যবসায়ের অর্ধেক, এবং জমির এলাকার দুই-তৃতীয়াংশ হল নিম্ন-সাহারা অঞ্চলে- যেখানে জমির মূল্য কম-এমনকি এশিয়ার তুলনায় । একটি সযত্নে তৈরি করা লিপিতে রিপোর্ট করা হয়েছে যে, সাহারার নিম্নভাগে ২০০৫ ০ ২০১১ সালের মধ্যে এলাকার দুই-তৃতীয়াংশ লগ্নী হয়েছে মাত্র সাতটি দেশে- ইথিয়োপিয়া, ঘানা, লাইবেরিয়া, মাদাগাসকার, মোজাম্বিক, দক্ষিণ সুদান ও জাম্বিয়া । ইথিয়োপিয়ায়, উদাহরণস্বরূপ, এক একর জমি লীজ করা যায় ১ ডলারে প্রতি বছরে, যেখানে জমি-দুষ্প্রাপ্য এশিয়ায় হবে ১০০ ডলার বা তার বেশি ।

যাই হোক, জমি-এলাকায় দ্বিতীয় শ্রেণীর অঞ্চল হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া- কম্বোডিয়া, লায়োস, ফিলিপিন্স এবং ইন্দোনেশিয়া । অনেক দেশ ল্যাটিন আমেরিকায় জমির চেষ্টা করেছে, যেমন ব্রাজিল এবং আর্জেনটিনা । সরকারি চৈনিক প্রতিষ্ঠান Changqing Grain Group, উদাহরণ স্বরূপ, সয়াবিনের চাষ শুরু করেছে ব্রাজিলের বাহিয়া প্রদেশের ৫০০ হাজার একর জমিতে, ফলন রপ্তানি হবে চীনে । ২০১১ সালের গোড়ার দিকে কোম্পানিটি বাহিয়াতে তাদের বিবিধাকার বিলিয়ন লগ্নী প্যাকেজের অংশ হিসাবে ঘোষণা করেছিল যে তারা একটি সয়াবিনের শিল্প-পার্ক তৈরি করতে যাচ্ছে ১.৫ মিলিয়ন টন পেষণের ব্যবস্থা সহ, এক বছরের মধ্যে ।

দুঃখের বিষয়, যে সব দেশ তাদের জমি বিক্রয় বা লীজ করছে কৃষি পণ্য দ্রব্য বিদেশে পাঠাবার জন্য, তারা অতি দরিদ্র এবং বেশির ভাগ সময়েই তাদের দারিদ্র্য বহুকাল ধরে স্থায়ী, যেমন ইথিয়োপিয়া এবং দক্ষিণ সুদান । এ দুটো দেশই ইউ.এন. বিশ্ব খাদ্য প্রোগ্রামের পতাকা-তলে খাদ্যের প্রথম সারির গ্রহণকারী । জমি অর্জনের বেশ কয়েকটাই সোজাসুজি জমি-বিক্রয়, তবে বেশিরভাগই বহু বছরের জন্য লীজ, ২৫ থেকে ৯৯ বছর ।

ক্রমবর্ধমান তেলের মূল্য এবং বর্ধিত তৈল শঙ্কাকান্ততায় শক্তি নীতি উত্‍‌সাহ দেয় জৈবজ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারে যা জমি অর্জনে উত্‍‌সাহ দেয় । এর ফলে নূতন শস্যভূমি হয় পরিষ্কার করা হবে বা বর্তমান শস্যভূমি খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হবে না । ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের অচিরাচরিত শক্তি আইন বলে পরিবহনের ক্ষেত্রে ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ অচিরাচরিত শক্তি ব্যবহার করতে হবে । এতে কৃষি-ব্যবসায়ে জমিতে লগ্নী হবে ইয়োরোপিয়ন বাজারের জন্য জৈব-জ্বালানি উৎপাদনে । সাহারা নিম্নভূমিতে অনেক ব্যবসায়ী জাত্রোফা এবং তৈল-পাম গাছ রোপণ করেছেন বায়োডিজেল উৎপাদনে ।

ইউ.কে.-র GEM Biofuels নামক কোম্পানি মাদাগাস্কারের ১৮টি কমিউনিটিজে ১.১ মিলিয়ন একর জমিতে জাত্রোফা রোপণ করেছে । ২০১০ খ্রী-র শেষে এরা ১৪০ হাজার একরে এই গুল্ম রোপণ করেছে । কিন্তু এপ্রিল ২০১২-তে এরা মাদাগাস্কার প্রোজেক্ট পুনর্মূল্যায়ন করলেন আশানুরূপ কাজ না হওয়ার জন্য ।

মালয়েসিয়ার কোম্পানি Sime Darby যারা পাম-তেল ব্যবসায়ে পৃথিবীর একটি বড় খেলোয়াড়, ৫৪০ হাজার একর জমি নিয়েছেন পাম তেল এবং রবার চাষ করার জন্য । এরা অর্জিত জমিতে পাম তেল উদ্ভিদ রোপণ করেছে মে, ২০১১ সালে ; কোম্পানি প্ল্যান করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদন শুরু করবে ।

অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি জমির জন্য একটা অভূতপূর্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে যাচ্ছে । খাদ্য ও শক্তির আপদা্‌গ্রস্থতা নিয়ে জমিতে লগ্নী একটা লাভজনক সুযোগ হয়ে দেখা দিয়েছে । সেনেগাল-এর ActionAid-এর Fatou Mbaye-র মতে "জমি খুব তাড়াতাড়ি পরিণত হচ্ছে নূতন সোনায় এবং এখনই পিছনে ধাওয়া কর । "

লগ্নী-অর্থ আসছে অনেক দিক থেকে- লগ্নী ব্যাঙ্ক, পেনসন ফাণ্ড, বিশ্ববিদ্যালয়- সম্পত্তি এবং বিত্তশালী ব্যক্তি । এছাড়া, অনেক ফাণ্ড আছে যা পুরোপুরি জমির জন্য প্রদত্ত । শেষের এই ফাণ্ড এমন এক আগমের হার দেয় যেমন ১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত, যেটা সোনায় অথবা S&P 500 Stock index-এ লগ্নী করলে দ্বিগুণ এবং গৃহ-প্রকল্পে লগ্নীতে সাত গুণ আসবে । বেশিরভাগ আয় এসেছে ২০০৩-এর পরে ।

অনেক লগ্নীকারক জমি নিয়ে কি করবেন তা প্ল্যান করছেন ; তারা ভাবছেন খাদ্যের মূল্য-বৃদ্ধি আরও চলবে এবং জমির মূল্য আরও বাড়বে । বস্তুত:, জমির মূল্য সব দিকেই বাড়ছে । জমি-অধিগ্রহণ হল আর এক অর্থে জল-অধিগ্রহণ । জমি সেচ-সেবিত না বৃষ্টিপাত দ্বারা সেবিত, জমির উপরে দাবী অর্থ হল জলের উপরে দাবি । অর্থাত্‍‌ জমি অধিগ্রহণের এগ্রিমেন্ট একটা স্পর্শকাতর বিষয় যে স্থানে জল-বিষয়ে কাতরতা আছে ।

জলের বিকল্পের উপর একটি প্রবন্ধে Deborah Bossio ও তার সহকর্মীরা ইথিয়োপিয়ায় জমি অর্জনের প্রভাব সেচ-সেবিত জলের উপর অর্থাৎ নাইল নদের প্রবাহের উপর নিয়ে আলোচনা করেছেন । ১২টি বহাল রাখা প্রোজেক্টের মোট ৩৪৩-হাজার একর হিসাবের ডাটা নিয়ে তারা দেখালেন যে, যদি সব জমিতে জলসেচ হয় জল-সেবিত অঞ্চল বেড়ে যাবে ৭ শতাংশ এবং নাইল নদের গড় বার্ষিক প্রবাহ কমে যাবে প্রায় ৪ শতাংশ ।

ইথিয়োপিয়া, যেখান থেকে নাইল নদের বেশিরভাগ উৎসই উঠেছে, অথবা সুদান যেখানে নাইল থেকে জল নেওয়া হয়েছে, এদের অর্জনের অর্থ হল ইজিপ্ট জল কম পাবে, ফলে গমের ফলন সঙ্কুচিত হবে এবং আমদানি বেড়ে যাবে ।

জমি-অর্জন অনেক প্রশ্ন তুলে দেয় । উত্‍‌পাদকী জমি অল্পই অলস থাকে, তাই এগ্রিমেন্টের অর্থ বহু স্থানীয় কৃষি-কর্মীদের কর্ম-বিচ্যুতি ঘটবে । এই জমি হয় কেড়ে নেওয়া হয় বা স্বল্পমূল্যে কিনে নেওয়া হয় যার ফলে প্রতিভূ দেশে জন-বিদ্বেষ হয়ে থাকে ।

এছাড়া, এগ্রিমেন্টগুলি সব সময়েই স্থির করা হয় গোপনে । সাধারণত:, দু-একজন বড় আধিকারিক লিপ্ত থাকে এবং বিষয়টি গুপ্ত রাখা হয় । স্থানীয় কৃষকরা জানতে পারে যখন সই-সাবুদ শেষ হয়ে যায় অথবা যখন তারা উৎখাত হয় । উন্নয়নশীল দেশে সাধারণত: জমির মালিক থাকে সরকার ; সেখানে গরীবরা সহজেই সরকার দ্বারা স্থানান্তরকরণ হয়ে থাকে । উচ্ছেদ হওয়া লোকজনের না আছে জমি না আছে জীবনযাপনের কোনও উপায় । মূল সামাজিক পরিণাম হল উচ্ছেদ হওয়া মানুষজন যুক্ত হয় বিশ্বের ক্ষুধার্তদের দলে ।

Oakland Institute-ক্যালিফোর্নিয়ার একটি 'think tank'। এরা একটি রিপোর্টে বলছেন যে বিদেশী ফার্মের কাছে ইথিয়োপিয়ার বিশাল জমি লীজ দেওয়া একটি নামান্তরে জনমানুষের অধিকার ভঙ্গ এবং এক মিলিয়নের উপর ইথিয়োপিয়া-বাসীকে জোর করে পুনর্বাসন । দুঃখের বিষয়, যেহেতু ইথিওপিয়ার সরকার জমি-লীজ প্রোগ্রাম নিয়ে এগিয়ে যেতে বধ্যপরিকর, অনেক গ্রামবাসীকে জোর করে গৃহহীন করা হবে ।

অবজারভার পত্রিকায় John Vidal গ্যাম্বেলা অঞ্চলের জনৈক ইথিয়োপিয়ান Nyikaw Ochalla-কে উদ্ধৃতি করেছেন : বিদেশী কোম্পানিগুলি অনেক সংখ্যায় এখানে আসছেন এখানকার মানুষকে তাদের জমি থেকে উৎখাত করতে, যে জমি তারা সহস্র বৎসর ধরে ভোগ করে আসছেন । এই বিষয়ে এখানকার মানুষের সঙ্গে কোনও কথা বলছে না । লেনদেন হচ্ছে গুপ্তভাবে । মানুষ দেখছেন যে অনেক ট্র্যাক্টর মেশিন নিয়ে তাদের দেশ আক্রমণ করতে আসছে । তাঁর নিজের গ্রামের বিষয় Ochalla জানাচ্ছেন, একটি ভারতীয় কর্পোরেশন জমি অধিগ্রহণ করেছে জোর করে, কোনও ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত দেয়নি । কি হচ্ছে তা' মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না ।

ফিলিপিন সরকারের সঙ্গে ২.৫ মিলিয়ন একর জমি লীজের জন্য এগ্রিমেন্ট করেছিল, ওখানে শস্য রোপণ হবে এবং তা' স্বদেশে পাঠানো হবে । বিষয়টি যখন প্রকাশ হয়ে গেল এর বিরুদ্ধে এতো জনগণের হৈচৈ হল, বিশেষত: ফিলিপনের কৃষকদের যে সরকার বাধ্য হল এগ্রিমেন্টটি স্থগিত রাখতে । একই ধরণের অবস্থা ঘটে মাদাগাস্কারে যেখানে একটি দক্ষিণ কোরীয় ফার্ম Daewoo Logistics ৩ মিলিয়ন জমির স্বত্ব, যা এলাকায় বেল্জিয়ামের অর্ধেক, কেনে । এত রাজনৈতিক ক্রোধের সৃষ্টি হল যে সরকারের পতন হল এবং এগ্রিমেন্ট বাতিল হল ।

জমি কতটা উর্বর যে তাকে ইজারা দেওয়া যায় ? কৃষিকার্যে কৃত্‍‌কৌশল এবং কি ধরণের টেকনলজী ব্যবহার হবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সতেজ ফলন আশা করা যায় । Malawi-তে যা ঘটেছিল ( সপ্তম অধ্যায় ), পুষ্টিহীন মাটিতে শুধু সার দিলে, বৃষ্টিপাত পর্যাপ্ত হলে এবং উচ্চফলন্শীল বীজ ব্যবহারে জমি সহজেই দ্বিগুণ ফলন দেবে । বোধ হয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হবে, স্থানীয় মানুষজনের উপর কি প্রতিক্রিয়া হবে ?

রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সহযোগী এজেন্সির সহযোগিতায় বিশ্বব্যাঙ্ক স্পষ্টাক্ষরে প্রকাশ করলেন জমি অধিগ্রহণের জন্য এক সেট মূল সূত্র । এই মূল সূত্রগুলি সহজেই বুদ্ধিগ্রাহ্য, কিন্তু দুখের বিষয় কোনও যন্ত্র ছিল না এগুলি রূপায়নের । যারা জমি অধিগ্রহণ করছেন তাদের মূল বক্তব্য হল তাদের আপত্তিগুলি পরে মানুষদের ভালো করবে কিন্তু ব্যাঙ্ক কখনই রাজী ছিল না বদল করার ।

জমি অধিগ্রহণ মূলত: আপত্তি করেছিল ১০০-র বেশি NGO-র এক সম্মিলন- কিছু জাতীয় এবং কিছু আন্তর্জাতিক । এই সম্মিলন তর্কের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করলেন যে বিশ্বে উন্নয়নশীল রাজ্যগুলির জন্য বিশাল বিশাল ভারী স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি-সহ মূলধন বর্ধনশীল কৃষি তারা চায়না । বিনিময়ে এই দেশগুলি চায় আন্তর্জাতিক সহায়তায় স্থানীয় গ্রামীণ-স্তরে ফার্মগুলি যার কেন্দ্রে আছে শ্রম-গাঢ় (labour intensive) সংসার ভিত্তিক ফার্ম, যারা স্থানীয় ও আঞ্চলিক বাজার তৈরি করবে এবং তারসঙ্গে ব্যবস্থা করবে অতি-প্রয়োজনীয় চাকুরীর ।

জমি এবং জল দুটোই যখন ফুরিয়ে আসবে তার সঙ্গে বাড়বে পৃথিবীর তাপমান, এবং যত খাদ্য-সুরক্ষা অপকৃষ্ট হবে, খাদ্য-দুষ্প্রাপ্যতা একটা কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর এক ভূমি-রাজনীতির অভ্যুত্থান হবে । বেশ কিছু দশক ধরেই এর জন্য নানা অবস্থা ঘটছে, কিন্তু অবস্থা গত কয়েক বৎসরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে । এখানে আলোচিত জমি অধিগ্রহণ হল বিশ্ব শক্তি-দ্বন্দ্বের একটি গোটা অংশ পৃথিবীর জমি- এবং জল- সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ।

লেষ্টার আর. ব্রাউন
(Lester R. Brown)
অনুবাদক : শঙ্কর সেন । Earth Policy Release
জানুযারি ২৮, ২০১৪ www.earth-policy.org/books/fpep/fpepch5

 

[ পরবর্তী প্রকাশ : একাদশ ও শেষ অধ্যায় : আমরা কি খাদ্যে ভঙ্গুর অবস্থা রোধ করতে পারি ? ]

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।