প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ইয়েতি-গুজবের মৃত্যু

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজের অন্যতম সেরা কাহিনি “পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক” আর টিভি চ্যানেল ও বিদেশি সিনেমার দৌলতে “ইয়েতি” শব্দটা আজ আর আদৌ অপরিচিত নয়। ‘ইয়েতি’ কথাটার সাথে জড়িয়ে আছে লোমহর্ষক ভয়, কৌতুহল আর উত্তেজনা। আর হবে নাই বা কেন! প্রায় দু’শতক ধরে ইয়েতি নিয়ে তো কম চর্চা হয়নি! বহু পর্বতারোহী নাকি দেখেছেন ইয়েতির পায়ের ছাপ। সে-সবের ফটোও তুলেছেন। স্বচক্ষে দেখেছেন বলেও কারো কারো দাবি। ইয়েতির দাঁত, হাড়, মাথার খুলি, লোম সন্দেহে অনেকেই নানা নমুনা সংগ্রহ করেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু না, বহুশ্রুত ইয়েতি বা তুষারমানবের কোনও প্রমাণ মেলেনি। আর তাই রহস্যের কিনারাও হয়নি। উলটে ইয়েতিকে উপজীব্য করে নানা রহস্যঘন গল্প, সিনেমা ও টিভি সিরিয়াল তৈরি হয়েছে। ১৯৫৪ সালে তৈরি হওয়া ‘দ্য স্নো ক্রিয়েচার’ সিনেমা দিয়ে শুরু ইয়েতিকে নিয়ে চলচ্চিত্রায়ন। সাম্প্রতিকতম (২০১২) হল ‘হোটেল ট্রান্সসিল্ভানিয়া’। হার্জের ‘টিনটিন ইন টিবেট’-এ ডিম্বাকার মাথাওয়ালা ইয়েতির কথাও নিশ্চয়ই অনেক পাঠকের মনে আছে।

ইয়েতি (Yeti) শব্দটির উৎপত্তি তিব্বতি শব্দ থেকে। তিব্বতি শব্দে ‘Ya’ মানে হল পাথুরে, আর ‘Tre’ হল ভালুক। কালক্রমে Tre হয়ে গেছে Ti ।অর্থাৎ তিব্বতি শব্দে ইয়েতি-র মানে হল পাথুরে ভালুক। তার মানে, পার্বত্য পাথুরে অঞ্চলে দেখা যায় যে ভালুক। তবে প্রাচীনকাল থেকে হিয়ালয়বাসী মানুষের ধারণা হল ইয়েতিরা দেখতে বনমানুষের মতো লোমশ, দ্বিপদ ও শাকাশী বিরাট আকৃতির প্রাণী।তবে ওরা নাকি স্বাভাবে লাজুক। ওরা পাথরের টুকরো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। আর ওরা মুখে হুশ-হুশ করে আওয়াজ করে। শোনা যায়, গ্রিক বীর আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায় অভিযানের সময় ইয়েতির সন্ধান করেছিলেন দেশে ফেরার সময় দু’একটা ধরে নিয়ে যাবেন বলে। যদিও ইয়েতি নামক এই প্রাণীটি আজও সারা পৃথিবীবাসীর কাছে থেকে গেছে রহস্যময়, কারণ প্রাণীটি সম্বন্ধে নিখুঁত বর্ণনা যেমন কেউ দিতে পারেননি, তেমনই কেউ এর বিশ্বাসযোগ্য ছবি তুলতে পারেননি বা একটা ধরতেও পারেননি। এর ফলে ইয়েতি নামে সত্যি কোনো প্রাণী বাস্তবে আছে, নাকি পুরোটাই গাঁজাখুরি গপ্পো, তার মীমাংসা আজও হয়নি।

তবে মানুষ ইয়েতির সন্ধানে বা অস্তিত্ব প্রমাণে নিরুৎসাহ কখনো হয়নি। কবে থেকে এই সন্ধান চলছে তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও এ সংক্রান্ত প্রথম নথি পাওয়া গেছে ১৮৩২ সালে প্রকাশিত “জার্নাল অফ এশিয়াটিক সোসাইটি”-তে। ওই সংখ্যায় পর্বতারোহী এইচ. হজসন-এর উত্তর নেপাল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছাপা হয়। তাঁর গাইডরা একটা কালো লোমে ঢাকা, লম্বা, দু-পাওয়ালা জন্তুকে পালাতে দেখেছিল। গত শতাব্দীতে ইয়েতির সন্ধানে অভিযাত্রীদের উৎসাহ বেশ বেড়ে যায়। ১৯২৫ সালে লন্ডনের রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য ও নামী ফটোগ্রাফার এন.এ. টোম্বাজি ইয়েতির খোঁজে হিমালয়ের প্রায় ১৫ হাজার ফুট উপর পর্যন্ত ওঠেন। সিকিমের জেমু হিমবাহের কাছাকাছি তিনি নাকি তাঁর থেকে মাত্র ২৫০ মিটার দূরে একটা অদ্ভুত প্রাণীকে দেখেন। প্রাণীটি রডোডেন্ড্রোনের একটি ঝোপ ধরে টানছিল। টোম্বাজি প্রায় এক মিনিট ধরে ওই দৃশ্য দেখেন। প্রাণীটির সাইজ ও হাঁটার ধরণ মানুষের মত। টোম্বাজি তার পায়ের ছাপের ফটোও তোলেন। পায়ের ছাপের আকৃতি মানুষের মত হলেও সাইজে ছোটো। তবে টোম্বাজির এই সব কথা কতটা সত্য তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ পর্বতারোহী এরিক শিপটন নাকি হিমালয়ের ২০ হাজার ফুট উঁচুতে অনেকগুলো পায়ের ছাপ দেখতে পান যা চেনা কোনো প্রাণীর পায়ের ছাপের সাথে মেলে না। তিনি ফটোও তুলেছিলেন। অবশ্য ছবি দেখে কেউ কেউ বলেন যে ওগুলো অন্য কোনো প্রাণীর পায়ের ছাপ যা বরফ গলে যাওয়ায় অন্যরকম দেখতে হয়ে গেছে। এই এরিক শিপটনের নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক” উপন্যাসে অনেকেই পড়েছেন।

যাইহোক, সংবাদমাধ্যমের দৌলতে অতি সম্প্রতি একটা কোটি ডলারের প্রশ্ন মানুষের মনে জেগে উঠেছে। সত্যিই কি ইয়েতি আছে? প্রশ্নের সমাধান নাকি প্রায় করেই ফেলেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান জেনেটিক্সের অধ্যাপক ব্রায়ান সাইকস ও তাঁর সহযোগীরা। ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর টিভি নেটওয়ার্কে ‘বিগ ফুট ফাইলস’ শীর্ষক একটি ডকুমেন্টারি সিরিজে প্রফেসর সাইকস তাঁর গবেষণালব্ধ ফলের কথা জানিয়েছেন।

সাইকস বছর তিনেক আগে একটা ঘোষণা করেছিলেন, অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি এমন সব রহস্যময় প্রাণীর দেহের কোনও নমুনা (লোম, হাড়, টিস্যু ইত্যাদি) যদি কারও সংগ্রহে থাকে তা যেন তাঁর গবেষণাগারে পাঠানো হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩০টি নমুনা এসে পৌঁছয় সাইকসের হাতে। নমুনাগুলোর মধ্যে থেকে মাত্র দুটি নমুনাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বেছে নেন সাইকস। একটি নমুনা সংগৃহীত হয়েছিল ৪০ বছর আগে পশ্চিম হিমালয়ের লাদাখ থেকে। আর একটি নমুনা ভূটান থেকে ১০ বছর আগে। লাদাখের নমুনাটি সংগ্রহ করেছিলেন একজন ফরাসি পর্বতারোহী। তাঁর সাথে লাদাখে একজন শিকারির দেখা হয়, যিনি একটা মানুষ-প্রমাণ সাইজের অচেনা প্রাণীকে হত্যা করেছিলেন। গুলিবিদ্ধ সেই দেহটা রাখা ছিল বরফের মধ্যে। ফরাসি পর্বতারোহীটি মৃতদেহটা থেকে নমুনা হিসেবে যে লোম সংগ্রহ করেছিলেন তা-ই পাঠান প্রফেসর সাইকসের কাছে। ওদিকে ভূটানের রাজার ব্যক্তিগত ‘ইয়েতি রক্ষী’-রা বাঁশের জঙ্গলে ১০ বছর আগে একটা অচেনা প্রাণীর মৃতদেহ দেখতে পায়। তারা ইয়েতি সন্দেহ করে সেই প্রাণীর লোম সংগ্রহ করে রেখেছিল। সেই লোমের নমুনাও পৌঁছয় সাইকসের হাতে।

এবার দেখা যাক, প্রফেসর সাইকসের বক্তব্য। তিনি বলছেন, আশ্চর্যজনকভাবে ৩০ বছর ও ৮০০ মাইল দূরত্বের ব্যবধানে সংগৃহীত নমুনা দুটি একই প্রাণীর। তিনি নমুনা দুটির মাইটোকন্ড্রিয়াল ডি.এন.এ-র জিন পরীক্ষা করেন। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডি.এন.এ-র বিশেষত্ব হল এই ডি.এন.এ মায়ের দেহ থেকে সন্তানের দেহে স্থানান্তরিত হয় অপরিবর্তিতভাবে। ফলে যুগ যুগ ধরে এই ডি.এন.এ-এর জিন অপরিবর্তিত থাকে। তবে সাইকস এখানেই শেষ করেননি। আরও চমকপ্রদ কথা শুনিয়েছেন। নরওয়ের উত্তরতম প্রান্তে ভ্যালবার্ড অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ৪০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত মেরু ভালুকের (আর্কটিক বিয়ার) চোয়ালের একটা হাড় থেকে প্রাপ্ত জিনবিন্যাসের সাথে লাদাখ ও ভূটান থেকে সংগৃহীত নমুনার জিনবিন্যাস ১০০ শতাংশ মিলে গেছে!

বিস্ময়টা এখানেই। যে প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল ৪০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর আগে সুমেরু অঞ্চলে এবং বহুকাল আগে যারা সম্পূর্ন বিলুপ্ত, তাদেরই সাথে হিমালয়ে পাওয়া নমুনার ১০০ শতাংশ মিল কীভাবে সম্ভব? তা হলে কি ওই মেরু ভালুক হিমালয় অঞ্চলে বেঁচে আছে? আর তারাই তথাকথিত ইয়েতি? উপগ্রহ চিত্র প্রযুক্তির এত উন্নতি, এত অভিযান, এত গবেষণাতেও কেন এতদিন হিমালয়ে মেরু ভালুকের অস্তিত্ব ধরা পড়ল না? বর্তমানে হিমালয় অঞ্চলে যে ভালুক পাওয়া যায় তা হল বাদামি ভালুক (ব্রাউন বিয়ার)। সুমেরু অঞ্চলে যে সাদা মেরু ভালুক (পোলার বিয়ার) দেখা যায়, তারা ও হিমালয়ের বাদামি ভালুক ভিন্ন প্রজাতি। আর তাদের সাথে কিন্তু প্রাপ্ত নমুনার জিনগত সাদৃশ্য নেই। তা হলে কি সত্যিই হিমালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মেরু ভালুক?

প্রফেসর সাইকস সে সম্ভাবনা নিজেই খারিজ করে দিয়েছেন। তবে সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও একটা দাঁড় করিয়েছেন- হিমালয়ের ওই অজানা প্রাণী বাদামি ভালুকের কোনও উপপ্রজাতি হতে পারে, যারা প্রাচীন মেরু ভালুকের পূর্বপুরুষ থেকে উৎপন্ন হয়েছে কিংবা প্রাচীন মেরু ভালুকের কোনও উত্তরসূরীর সাথে বাদামি ভালুকের মিলনে উৎপন্ন সাম্প্রতিক সংকর প্রজাতি। আরও পরীক্ষা না করে এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে চান না সাইকস। তবে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে তথাকথিত ইয়েতি মানুষের কোনও ভিন্ন প্রজাতি বা প্রাচীন তুষারমানব নয়। অন্ততঃ ওই নমুনা বিশ্লেষন করে এমন কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি যা মানুষের সাথে মেলে। সুতরাং ইয়েতি নামক মনুষ্য-সদৃশ দ্বিপদ ও লোমশ, হঠাৎ হঠাৎ করে অদৃশ্য হওয়া তুষারমানব যে নিছকই গাঁজাখুরি গপ্পো তার প্রমাণ আরও শক্তপোক্ত হল প্রফেসর সাইকসের গবেষণায়।

সৌম্যকান্তি জানা

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।