শিশুর
বিকাশ (জন্ম থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত)*
নয়মাস দশদিন (ক্ষেত্র
বিশেষে এর তারতম্য ঘটে) মাতৃগর্ভ থেকে যখন শিশু জন্মায়
সে অতি ছোট্ট ও অসহায়। ধীরে ধীরে তাদের দেহের ও কর্মশক্তির
বিকাশ ঘটে। এই বিকাশের দুটি রূপ আমাদের চোখে পড়ে।
প্রথমটিকে বলা যেতে পারে দৈহিক বিকাশ, দ্বিতীয়টি শিক্ষা-জনিত
বিকাশ। শরীর এবং মন এ দুয়ের বিকাশেই শিশু বড় হয়ে ওঠে
- অনেক দিক থেকেই এই দুটি বিকাশ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল।
নিচে শিশুর বিকাশের একটা
সময়পঞ্জী দেওয়া হল। বলা বাহুল্য যে, এই সময়পঞ্জী মোটামুটি
ভাবে সঠিক হলেও - বিভিন্ন শিশুর বেলায় এর অল্পকিছু
হেরফের অবশ্যই হয়। তবে এই সময়পঞ্জীর ভিত্তিতে শিশুর
পরিবার অন্তত কিছুটা বুঝতে পারবেন যে, তাঁদের শিশুর
বিকাশ ঠিকমত হচ্ছে কিনা। শিশু বড় হবার সময় নিয়মিত
ডাক্তার দেখানো বিশেষ জরুরী। অসুখ বিসুখ (পোলিও, ডিপথেরিয়া,
টাইফয়েড, টিটেনাস ইত্যাদি) নিরোধের জন্য প্রয়োজনীয়
টিকা বা প্রতিষেধক শিশু বয়েসেই প্রয়োগ করতে হয়। শিশুর
শারীরিক ও অন্যান্য বিকাশ সময়মত হচ্ছে কিনা ডাক্তার
সেগুলিও দেখেন। বিশেষ ক্ষেত্রে যা করণীয় তার উপদেশও
ডাক্তার দেন।
সময়পঞ্জী
জন্ম থেকে
১ মাস
দেহগত ও ভাষাগত:
দিনে ৫ থেকে ৮ বার দুধ খাওয়া। প্রায় কুড়ি ঘণ্টা ঘুমনো।
দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, স্পর্শবোধ,
ব্যথাবোধ - সব কিছুই এই সময়ে খুব প্রাথমিক পর্যায়ে
থাকে। কান্না ছাড়া অন্য কোনোভাবে আবেগ বোঝানোর ক্ষমতা
তাদের থাকে না।
২ থেকে
৩ মাস
দেহগত ও ভাষাগত:
বোধশক্তির বিকাশ - রঙের তফাত্ একটু আধটু বোঝা; চোখ
ঘুরিয়ে আশে পাশে তাকানো; মুখ দিয়ে জিনিস অনুভব করার
চেষ্টা শিশুরা এই বয়সে করে। ঘাড় একটু শক্ত হয় - উল্টো
অবস্থায় শোয়ানো থাকলে মাথাটা একটু তুলতে পারে। শিশুরা
এইসময়ে কান্না ছাড়া গলা দিয়ে শব্দ বার করতে শুরু করে।
আবেগগত:
খুশি প্রকাশ করতে শেখে, হাসতে শেখে; কষ্ট পেলে মুখে
তার অভিব্যক্তি দেখা যায়।
সামাজিক:
স্থির দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকাতে পারে; মুখ দেখলে
হাসে; কোলে নিয়ে দোলালে শান্ত হয়।
৪ থেকে ৬ মাস
দেহগত ও ভাষাগত:
শব্দ কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারে। অ আ উ ইত্যাদি বলতে
শেখে - বেশ কিছু ব্যাঞ্জনবর্ণও উচ্চারণ করতে পারে।
এই পর্যায়ে দিনে শিশুদের ৩ থেকে ৫ বার খাওয়াটাই স্বাভাবিক।
আবেগগত:
জড়িয়ে ধরে আদর করলে খুশি হয়। কোল চেনে।
সামাজিক:
মাকে চিনতে পারে। চেনা-অচেনা বোধ শুরু হয় - সবাইকে
দেখে আর হাসে না। এ সময় (২ বছর অবধি) মুখ দিয়ে সব
জিনিষ চিনতে শেখে।
৭ থেকে
৯ মাস
দেহগত ও ভাষাগত:
বসতে শেখে। নিজের বাহু নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। হামাগুড়ি
দেওয়ার আরম্ভ করে।
আবেগগত:
মায়ের সঙ্গে (বা যে 'প্রাইমারি কেয়ার টেকার') একটা
গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মায়ের কাছে সরিয়ে কোথাও
নিয়ে যেতে চাইলে আপত্তি প্রকাশ করে।
সামাজিক:
বাচ্চারা এইসময়ে টুকি (মুখ লুকিয়ে মুখ দেখানোর খেলা)
পছন্দ করে। অনেক শব্দ বলতে শেখে।
১০ থেকে
১২ মাস
দেহগত ও ভাষাগত:
পায়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আসে। শিশুরা এই বয়সে দাঁড়াতে
শেখে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু এগোতে পারে।
বুড়ো আঙুল ও তর্জনী একত্র করতে পারে। দুয়েকটা শব্দ
বলতে শেখে। শব্দ শুনলে তার অনুকরণ করতে পারে। ছোটখাটো
নির্দেশ বুঝতে শেখে। এই সময়ে শিশুদের তিনটে বড় খাবার
ও দুবার অল্প কিছু খাওয়ানোই যথেষ্ঠ।
আবেগগত:
রাগ ও ভালোবাসার প্রকাশ শেখে। অচেনা লোক দেখলে ভয়
পায়। প্রবল ঔত্সুক্য নিয়ে নানান জিনিসে হাত দিতে দেয়,
মুখে দেয়।
সামাজিক:
নাম ধরে ডাকলে বুঝতে পারে। হাত নেড়ে টা টা করতে শেখে।
'না' বললে বুঝতে পারে। জিনিস নিতে বা দিতে শেখে।
১ বছর থেকে ১ ১/২ বছর
দেহগত ও ভাষাগত:
সিঁড়ি বাইতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে পারে (১০ মিনিটের
মত)। দেখিয়ে দিলে কাগজে পেন্সিল বা রঙিন ক্রেয়ন দিয়ে
অাঁকিবুকি কাটতে পারে।
আবেগগত:
মার (বা প্রাইমারি কেয়ার টেকারের) কাছ থেকে সরিয়ে
নিলে অত্যন্ত দুঃখ পায়। স্নান করতে ভয় পেতে পারে।
সামাজিক:
ছোটখাটো নির্দেশ মানতে শেখে। অনেক কথা শুনে সেগুলি
আবার উচ্চারণ করতে পারে। আগ্রহ নিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব
দেখে। নিজে নিজে খেতে শেখে।
১ ১/২ থেকে ২ বছর
দেহগত ও ভাষাগত:
দৌড়তে শেখে; বলে লাথি দিতে পারে। দুইয়ের কাছাকাছি
বয়সে ৫ - ৬টি Âবক বা কিউব একের পর এক সাজিয়ে চুড়ো
বানাতে পারে। পায়খানা ও পেচ্ছাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা
আসে। প্রায় ২০০-র মত শব্দ বলতে পারে। রাতে ১২ ঘণ্টার
মত ঘুমোয়। দিনে ১ - ২ ঘণ্টার মত ঘুমোনর দরকার হয়।
আবেগগত:
মাঝে মাঝেই অবুঝ হয়ে চঁzাচামেচি করে। নতুন শিশুর আগমনে
অত্যন্ত অখুশি হয়।
সামাজিক:
যা বলা যায় তার উল্টো করতে পছন্দ করে। নিজে নিজে সব
কিছু করে স্বাধীনতা প্রকাশ করতে চায়।
২ থেকে ৩ বছর
দেহগত ও ভাষাগত:
সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে নামতে ভালোবাসে। ট্রাই-সাইকেল চড়তে
পারে। ছোট ছোট বাক্য বলতে শেখে - সেগুলি ব্যবহার করে
জগতকে জানার চেষ্টা করে। এই বয়সে অনেক সময় একটু তোত্লামি
দেখা দিতে পারে, কিন্তু সেটা স্থায়ী হয় না।
আবেগগত:
হারিয়ে যাবার ভয় দেখা দিতে পারে। অনেক সময়ে অবুঝ ভাবে
চঁzাচামেঁচি করে রাগ প্রকাশ করে। কারোর খুশি, দুঃখ
বা রাগ হয়েছে কিনা - সেটা মুখ দেখে বোঝার ক্ষমতা এই
সময়ে জন্মায়। বোকা বানিয়ে মজা পেতে শেখে।
সামাজিক:
বাবা-মাকে নকল করতে চায়। অনেক সময়ে নির্ভরশীল হয়ে
থাকতে চায়। নিজের খেলনা কাউকে দিতে চায় না; তবে অন্য
বাচ্চার পাশে বসে খেলতে ভালোবাসে। বাবা মা কিছু করতে
বললে আপত্তি জানায়। হুকুম দিতে ভালোবাসে। একই রুটিনে
চলতে পছন্দ করে। কি চায় - অনেক সময়ে ঠিক বুঝে উঠতে
পারে না বা বুঝিয়ে বলতে পারে না।
৩ থেকে ৪ বছর
দেহগত ও ভাষাগত:
এক পায়ে দাঁড়াতে শেখে। লাফিয়ে সামনে ও পেছনে যেতে
পারে। গোল অাঁকতে পারে, ক্রস অাঁকতে পারে (৪ বছর বয়সে);
দৈনন্দিন অনেক রুটিন ব্যাপারে স্বনির্ভর হতে শেখে।
আবেগগত:
বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা দেখায়। জননেন্দ্রিয় নিয়ে
খেলা করে খুশি হয়; ছেলে হলে মায়ের প্রতি, মেয়ে হলে
বাবার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে (৩ থেকে ৫ বছর)। মেয়ের
মায়ের প্রতি, ছেলের বাবার প্রতি হিংসা জন্মাতে পারে।
অন্ধকারে ভয় পায়, আঘাত পাবার ভয়ও দেখা দেয় (৩ থেকে
৫ বছর)।
সামাজিক:
দেয়া-নেয়া করতে শেখে। 'আমরা' কথাটা ব্যবহার করে এবং
একসঙ্গে সবার সঙ্গে খেলতে শেখে। বাবা-মাকে অনুকরণ
করতে শেখে। নার্সারি স্কুলে যায়। ছেলেদের বাবার সঙ্গে
এবং মেয়েদের মায়ের সঙ্গে একাত্মতা বোধ শুরু হয়। সমাজে
লিঙ্গবৈষম্যের ব্যপারে অবহিত হতে শুরু করে এবং সেই
অনুযায়ী আচরণ শুরু করে। অন্য ছেলেমেয়েদের শরীর সম্পর্কে
কৌতুহল জন্মায়। কাল্পনিক বন্ধì তৈরি করে খেলা করে।
৪ থেকে ৫ বছর
দেহগত ও ভাষাগত:
লং জাম্প, হপ স্কিপ ইত্যাদি করতে পারে, নিজের জামা
নিজে পড়ে, চতুর্ভুজ ও ত্রিভুজ দেখে দেখে অাঁকতে পারে।
পরিষ্কার কথা বলতে পারে, কথা বলার ধরণ বড়দের মত করার
চেষ্টা করে, কথাগুলো মোটামুটি ব্যকরণ শুদ্ধ হয়। প্রায়
২০০০ শব্দ জানে। গল্প বুঝতে পারে।
আবেগগত:
কর্তব্যবোধ জন্মায়; নিজের কার্যক্ষমতায় আত্মপ্রসাদ
লাভ করে।
সামাজিক:
অন্যদের সঙ্গে খেলতে পছন্দ করে; প্রতিযোগিতা মূলক
খেলার ব্যাপারে উত্সাহী হয়।
*চাইল্ড ডেভালপমেণ্ট ইন্সটিট্যুটের
ডঃ রবার্ট মায়ারের অনুমতি নিয়ে সি.ডি.আই ওয়েবসসইটে
(http://www.cdipage.com/) প্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি
করে এটি লেখা হয়েছে।