প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

রহস্যঘন মোহময় লাদাক ও স্বর্গীয় অমরনাথ

মাত্র ৬৭ বছরের যুবা আমি, ৬১ বছরের যুবতী বৌকে নিয়ে লাদাক আর অমরনাথ যেতে একটু চিন্তাই ছিল । এই যাত্রায় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মাউন্টেন পাস খরদুমলা (১৮,৩৮০ ফুট) পার হতে হয় । সেখানে অক্সিজেনের অভাবে কারো কারো বুকে ব্যথা হয় শুনেছি । শেষে কত্তা-গিন্নী ঠিক করলাম, কম দিন তো বাঁচি নি, দুগ্গা বলে ঝুলে পড়ি । ঠিক করলাম কোনো গ্রুপের সঙ্গে যাবো না । তাতে ঝুঁকিটা আরও একটু বাড়ল ঠিকই, কিন্তু গ্রুপের সঙ্গে যাবার হ্যাপা আছে, ইচ্ছেমত চলা যায় না । জীবনে সব সময়ে অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হয়। তাই এই কটা দিন আমরা দুজনে সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে চাইলাম । এখন লিখতে বসে মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস, সেটা করেছিলাম! বহু হিল স্টেশনে আগে ঘুরেছি - সিকিম, ভুটান, উত্তরখণ্ড (কেদারনাথ বদ্রীনাথও বাদ নেই), নৈনিতাল, সিমলা, শিলং, দার্জিলিং ইত্যাদি, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন জীবনের খাতায় বড় হরফে লিখে রাখার মত অভিজ্ঞতা । আমার কলম ভাল চলে না, তাই লেখার চেষ্টা না করে ছবি দিয়ে বর্ণনার অভাব পূরণ করছি ।

লাদাক, যেটি ছোট তিব্বত বলেও পরিচিত, ভারতের একটি প্রান্তিক অঞ্চল । এর অবস্থান হিমালয়ের উত্তরে কারাকরামের দক্ষিণে তিব্বতী মালভূমিতে । লাদাক কথাটার অর্থ 'পাস-এর দেশ' । 'লা' হল মাউন্টেন পাস (যেমন, নাথ লা, খারদুম লা, চ্যাং লা, ফটো লা, ইত্যাদি) । বহু পাস যেমন আছে, তেমন আছে বরফ ঢাকা পাহাড় ঘেঁসে বহু মনেস্টারি (বৌদ্ধবিহার) এবং লেক (হ্রদ) । এখানে চোখে পড়বে তিন ধরণের স্থানীয় লোক - মন, দর্দ এবং মোঙ্গল । মনরা এসেছিল প্রথমে কাশ্মীরের উত্তরাঞ্চল থেকে । এরপরে আসে দর্দ এবং মোঙ্গল ।

জুন মাসের শেষাশেষি কলকাতা থেকে প্রথমে গেলাম দিল্লী - সেখান থেকে লেহ-তে । আমাদের ভাগ্য, আকাশে মেঘ ছিল না । নীচে বরফ ঢালা পাহাড়গুলো তাই চমৎকার দেখা যাচ্ছিল - হিল স্টেশন থেকে দেখা সাইড ভিউ নয়, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ যাকে বলা হয় 'টপ ভিউ' । লেহ-তে একদিনের জন্যে বিশ্রাম - কম অক্সিজেনের আবহাওয়ায় শরীরকে সইয়ে নেবার জন্যে । পরের দুদিন লেহ-র প্রাসাদ, থিকসে মনেস্টারি, স্টক প্যালেস, শান্তি স্তুপা, স্পিতুক মনাস্টেরি, হেমিস মনাস্টেরি এবং হল অফ ফেম দেখে নেওয়া গেল । এই থিকসে মনস্টেরিতেই ছিল তিনতলা উঁচু বিখ্যাত মৈত্রেয় বুদ্ধ ।

আমাদের আসল রোমাঞ্চকর যাত্রা শুরু হল তার পরের দিন থেকে । গাড়ি চেপে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ১৫০ কিলোমিটার দূরে নুব্রা ভ্যালির দিকে । নুব্রা উপত্যকা ১০০০০ ফুট উঁচুতে, খুব ঠাণ্ডা নয় - জলের প্রাচুর্য থাকায় জায়গাটা উর্বর । ১৮৩৮০ ফুট উঁচুতে খরদুমলা মাউন্টেন পাস দিয়ে বরফের মধ্যে যাওয়াটা একটা অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা । সৈন্যবাহিনীর লোকেরা আমাদের সতর্ক করল বেশীক্ষণ পাহাড়ের এই উচ্চতায় না থাকতে । একটা মেডিক্যাল সেন্টার ওখানে আছে উচ্চতা-জনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে । গাড়িতে একটা অক্সিজেন সিলিনডার আমাদেরও ছিল - তবে ব্যবহার করতে হয় নি ।

নুব্রা উপত্যকায় প্রথম দিনই পানামিকে (প্রাচীন ইয়ারকাণ্ডি সিল্ক রুটের শেষ গ্রাম) পৌঁছে আমরা উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করে পথের ক্লান্তি দূর করলাম। পরের দিন লেহ-তে ফেরার পথে আমরা ডিস্কিট আর হুণ্ডারে থামলাম । এ দুটিও নুব্রা উপত্যকায় । ডিস্কিটে একটা বিখ্যাত মনেস্টারি আছে, যার দেয়ালে চমৎকার সব ছবি আঁকা । এছাড়া কয়েকটা প্রস্তরমূর্তিও সেখানে আছে । হুণ্ডারে দেখতে পেলাম একটা সাদা মরুভূমি - সেখানে দু-কুঁজের উটের পিঠে চড়া যায়! একদিকে মরুভূমি, অন্যদিকে বরফাচ্ছাদিত পাহাড় - সত্যিই দেখার মত দৃশ্য!

পরের দিন লেহ-তে কাটিয়ে আমরা ১৪২৭০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত বিহ্বলকারী সুন্দর প্যানগং লেক দেখতে গেলাম । ১৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ৫ কিলোমিটার প্রস্থের এই দর্শনীয় লেকটির ২/৩ ভাগই তিব্বতে, বাকিটা ভারতে । লেকে যাওয়ার ৫ ঘণ্টার পথের দুদিকের দৃশ্যও দেখার মত । উচ্চতার জন্যে পাহাড়গুলোতে কোন গাছপালা নেই, কিন্তু পাথরের রঙে অনেক বৈচিত্র্য আছে । যাত্রার পথে পড়ল ছাংলা পাস (১৭৫৮৬ ফুট) - পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম মাউন্টেন পাস । এবার উচ্চতার সঙ্গে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে গেছি । ছাংলা পাসে দুজনে নেমে একটু হাঁটাচলা করলাম । সৈন্যবাহিনীর লোকেরা পর্যটকদের চা বিতরণ করছিল - তাও খেলাম ।

দূর থেকে প্যানগং হ্রদকে প্রথম দেখে মনে হয় একটা ক্যানভাসে আঁকা ছবি । হ্রদের সব থেকে কাছে একটা হোটেলে উঠে মালপত্র রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম । হ্রদের পাশে বসলে দেখা যায় সূর্যের আলোয় জলে নীল সবুজ ফিকে গাঢ় কত রকম রঙের খেলা - আমাদের নির্বাক করে দিল! আশেপাশে কোন লোক নেই - কেবল আমরা দুজনে । শব্দ বলতে শুধু নুড়ির ওপর বয়ে যাওয়া জলের ঝিরঝির ঝিরঝির গান । এরকম জায়গাতেই মানুষ ধ্যানে বসতে পারে । খালি একটা কথাই ঘুরে ফিরে মনে আসছিল , 'প্যানগং - তুমি আমাকে দিলে আত্মার প্রশান্তি'। মানস সরোবর দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি, শুধু ছবিতেই দেখেছি । সেই ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মনে হল প্যানগং প্রায় সেরকমই । বসে বসে কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়ালও করি নি । লেক থেকে যখন হোটেলে ফিরছি তখন দেখি পাঁচ ঘণ্টা কখন পার হয়ে গেছে!

আবার এক রাত কাটালাম লেহ-তে । এবার আমাদের গন্তব্য-স্থল সোমোরিরি হ্রদ । হিমালয় পার্বত্যাঞ্চলের এটিই সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত হ্রদ । সাত ঘণ্টার পথ - প্রায় সবটাই সিন্ধু নদের ধার দিয়ে ।

সোমোরিরি ১৫০৭৫ ফুট উঁচুতে, দৈর্ঘ্যে ১৯ কিলোমিটার প্রস্থে ৩ । প্যানগং-এর থেকে ছোট আয়তনের হিসেবে, কিন্তু কে মাপতে যাচ্ছে ? আমাদের চোখে একই সাইজ । এটিও অপূর্ব সুন্দর । এখানে পাখির সমাবেশে বেশী বৈচির্ত্য আর বরফে ঢাকা পাহাড়গুলো দেখলে মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে । চন্দ্রালোকিত রাতেও হ্রদটি দেখলাম - সারাজীবন মনে রাখার মত দৃশ্য । হাতছানি দিয়ে আমাদের অন্য এক জগতে নিয়ে যাচ্ছিল।

ফিরে এসে লেহতে এক রাত বিশ্রাম, তারপর বিদায় নেবার পালা। যাবো আলচি-তে । যাবার পথে দেখে নিলাম লিকির মনাস্টেরি আর বসগো দুর্গ । দুর্গ বলার থেকে দুর্গের ধবংসাবশেষ বলাই ঠিক । অল্প একটু অংশ পর্যটকদের জন্যে খোলা আছে । আলচিতে আমরা একটা রাত কাটালাম । আলচি মনাস্টেরি দেখলাম । এখানে যেসব ছবি আছে - সেগুলো আগের মনাস্টেরিগুলোর ছবি থেকে ভিন্ন ।

পরদিন যাত্রা করলাম কার্গিলের পথে । ফোটোলা পাস (১৩৪০০ ফুট) পার হবার পরে মুলবেকে দেখলাম বিশাল পাথর কুঁদে বানানো মৈত্রেয় বুদ্ধের মূর্তি । পথে লামাযুরু মনাস্টেরি দেখে নিলাম । তখনই চোখে পড়ল দূরে পাহাড়ের একাংশ থেকে যেন হলুদ আভা বেরোচ্ছে । আমাদের ড্রাইভার জানালো ওটা পুরোপুরি 'মুলতানী মাটিতে' তৈরী, ওকে স্থানীয়রা চাঁদের পাহাড় বলে । কার্গিলে পৌঁছে এক রাত বিশ্রাম করে রওনা দিলাম সোনামার্গের দিকে । পথে পড়ল দ্রাসের ওয়ার মেমোরিয়াল - কার্গিলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জয়ের স্মৃতিতে বানানো । সেনাবাহিনীর লোকেরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ - ঘুরে ঘুরে আমদের পাহাড়ের বিভিন্ন চুড়া চিনিয়ে দিলেন যেখানে পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল ।

পথে আরেকটা পাস জোজিলা (১১৫৭৫ ফুট) । পাসের কাছে রাস্তার দুধারে নিরেট বরফের দেয়াল । সোনামার্গে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল । বিশাল উপত্যকা সবুজে মোড়া । এইখানেই লাদাকের সঙ্গে কাশ্মীরের তফাৎ । লাদাকের পাহাড়ে গাছপালা দেখা যাবে না । কাশ্মীরের পাহাড় সবুজে ভরা ।

সোনামার্গ থেকে বেরোলাম অমরনাথ দর্শনে। অমরনাথের গুহা ১২৭৫৬ ফু উঁচুতে । সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়লাম হেলিকপ্টার ধরতে - যাতে সেই দিনই ফিরে আসতে পারি । বালতাল থেকে হেলিকপ্টার ছাড়ে । ভাগ্য সহায়, প্যাসেঞ্জার লিস্টে আমাদের নামই প্রথমে । পবন হংসে চেপে পঞ্জতারিণী পৌঁছনো গেল । ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার দূরেই অমরনাথ । এই বয়সে আর সাহসে কাজ নেই, বাকি পথটা হাঁটার চেষ্টা না করে পালকিতে চাপলাম । পালকি মানে চেয়ারের দুদিকে দুটো বাঁশ লাগানো - চারজন লোক সেই বাঁশ কাঁধে নিয়ে হাঁটবে । এতে দুটো সুবিধা । প্রথম সুবিধাটা বুঝতে অসুবিধা নেই - অন্যের ঘাড় ভেঙ্গে নিজের পথ কষ্ট বাঁচানো । দ্বিতীয় সুবিধাটা ঐতিহ্যগত । এক কালে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে গেলে মৃত ব্যক্তিকে লোকে খাটিয়ায় তুলে কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করত । সে যুগ চলে গেছে - সে সুখ এখন প্রায় অন্তর্হিত; এখন গাড়িতে চাপিয়ে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় । সেই পুরনো সুখের কিছুটা অন্তত জীবিত অবস্থায় এই পালকি-ব্যবস্থায় ভোগ করা যায় । শুধু খাটিয়াতে শুয়ে নয়, চেয়ারে বসে ।

যেতে যেতে একবার তো হৃদ্‌স্পন্দন থেমে যাবার উপক্রম । তিন দল তীর্থযাত্রী - কেউ আমাদের মত পালকি চড়ে , কেউ বা হেঁটে কেউ ঘোড়াতে একে অন্যকে পাশ কাটাবার চেষ্টা করছিল । ধাক্কাধাক্কিতে কয়েক বার দেখলাম পালকিবাহকদের কেউ পা পিছলে পাহাড় থেকে উলটে পড়তে পড়তে কোনও মতে রক্ষা পেল । তবে সেনাবাহিনীর লোক বিপদজনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য নজরদারী করছিল - তাই রক্ষা । অনেক সময়েই লোকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করাচ্ছিল যাতে বরফ পিচ্ছিল পথে হুড়োহুড়ি না হয় । যেতে যেতেই আমরা অমর গঙ্গা দর্শন করলাম - বরফের চাঁইয়ের নীচ দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে । প্রায় তিন ঘণ্টা লাগলো উপরে উঠতে ।

গুহাটা আরাও ৫ - ৬ তলা উপরে । সিঁড়িগুলো পিচ্ছিল বরফের জন্যে । দুয়েকবার পড়তে পড়তে কোনও মতে গুহাতে গিয়ে পৌঁছলাম । এখানে কোন গুঁতোগুঁতি নেই - সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে । সেনাবাহিনীর লোকেরা সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে বরফের সেই শিব-লিঙ্গ দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে - যার জন্যে তীর্থ যাত্রীদের এত সময় ব্যয় ও কষ্ট স্বীকার করে এত দূরে আসা । কেউই বঞ্চিত হচ্ছে না । আমরা অবশ্য তীর্থের পুণ্য আর প্রকৃতির সৌন্দর্য্য - দুটোই পেতে গিয়েছিলাম ।

আবার পালকি চড়ে ফেরা । তবে এবার সময় লাগল অনেক কম । সোনামার্গ থেকে ফিরলাম শ্রীনগর হয়ে । ইচ্ছে ছিল গুলমার্গ, মুঘল গার্ডেনস ইত্যাদিতে যাবার । কিন্তু শ্রীনগরে কারফিউ । অগত্যা নাগিন হ্রদে হাউসবোট । সবকিছুরই ভালো দিক আছে । চমৎকার তিন বেডরুমের হাউসবোটে আমরা দুটি মাত্র প্রাণী । দুদিন ধরে সিকারা চেপে ডাল আর নাগিন হ্রদের ছোট ছোট জলপথে ৭ - ৮ ঘণ্টা ঘুরে বেড়ালাম । হাউসবোটের সংলগ্ন জমিতে একদিকে বাগান । সেখানে নানান ফুলের গাছের সম্ভার । ফলের গাছও আছে - আপেল, ন্যাসপাতি আর বেদানা গাছ দেখলাম । আর আছে ছোট্ট সুন্দর ঘাস বিছানো একটা মাঠ ।

অবশেষে ফিরলাম কলকাতায় নিজেদের আস্তনায় । আমাদের দুজনেরই জীবন-দর্শন - জীবনের ইনিংস শেষ করব কোনও আক্ষেপ না রেখে । তাই কি পাই নি তার হিসেব না করে - যা পেয়েছি তাই পুরোপুরি উপভোগ করে ফিরলাম ।

মূল রচনা : বিজন বন্দ্যোপাধ্যায়

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।