অবসর
এ অনেক আধা আঁতেল আলোচনা অনেক দিন ধরে লিখে
চলেছি। ভয় হচ্ছে পাঠকদের ধৈর্য্য শেষ সীমাতে
এসে গেছে। তাই চেষ্টা করছি অন্য কিছু নিয়ে লেখার।
তবে আপনারা জানেন – ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান
ভাঙ্গে। তাই অচিরে আবার মতামত চেয়ে আলোচনাতেই
ফিরে আসব। TV র commercial break এর মত এটাও
একটা আমার প্রলাপের break বলতে পারেন। পাগলও
তো কখনো কখনো স্বাভাবিক থাকে- তাই না কি?
অবসরে আমার প্রথম লেখা (যেটা সুজন দাশগুপ্ত
বাংলাতে অনুবাদ করেছিল) লাদাক আর অমরনাথ ভ্রমণ
নিয়ে। এবার হিমচালের কিছু বিশেষ মুহূর্ত নিয়ে
কিছু লেখার চেষ্টা করছি। আমি একটু বেশী কথা
বলি আর লিখি । চেষ্টা করছি কম লিখে একবার অন্তত
ছবিকে কথা বলতে সুযোগ দেবার। আমার লেখাটা ভ্রমণ
সঙ্গী বা কোন ভ্রমণ পত্রিকার লেখার মত পাঠকদের
হিমাচল বেড়াতে সাহায্য করবে না। বেড়াবার সময়ের
যে বিশেষ মুহূর্তগুলো মনের বিশেষ কোঠাতে ভরে
রেখেছি আমরা দুজনে – তারই কিছু আভাস এখানে দেবার
চেষ্টা করছি।
বলে রাখতে চাই কি কি জায়গা দেখলাম, কোথা থেকে
কোথাতে গেলাম, কি ভাবে গেলাম , কোন হোটেলে থাকলাম
- সে সব এই লেখাতে নেই - আগেই বলে দিলাম যাতে
পাঠকরা ঠিক করতে পারেন আর এগোবেন কিনা।
এবার শুরু করছি আমার আর আমার স্ত্রীর হিমাচল
বেড়াতে গিয়ে পাওয়া কিছু বিশেষ মুহূর্তগুলো নিয়ে
কিছু বলতে। এগুলো কোন বিশেষ order এ নেই। যে
কথা যখন মনে আসছে- লিখে ফেলছি।বেশী বাড়াবাড়ি
যাতে না করে ফেলি – তাই লেখাটা ৫-৬ টার না ভোলা
মুহূর্তের মধ্যে লেখাটা সীমাবদ্ধ রাখছি।
১) ছিটকুলের খরস্রোতা নদীর গান আর পেছনে বরফ
ছেটানো পাহাড়ের মাথার কথা প্রথমে মনে আসছে।শুনেছি
মার্চ বা এপ্রিল এ এলে নদীর পাশ অবধি বরফ থাকে।
পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীর পাহাড়ি
সুর আমাদের অন্য সব কিছু ভুলিয়ে দিল।জলে একটু
পা ডুবিয়ে আমারা দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেক অনেক্ষন।
এখানে পর্যটকদের ভীড় নেই একেবারেই – আমারা দুজন
ছাড়া বেশ কিছু দূরে আর ৪ জন। তারাও তখন বিভোর
।
ছিটকুলের স্বর্গে
পাথরের ওপর দিয়ে বহমান নদীর রাগিণী
এত
একান্ত করে এই নিসর্গ সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ
কোন জনপ্রিয় পর্যটন স্থানে পাওয়া দুস্কর।আমাদের
কোন তাড়া ছিল না – তাই মন ভরে অনেক সময় ধরে
অনিমেষে তাকিয়ে রইলাম – সেই লাইন দুটো কানে
বাজতে লাগল “হৃদয় বলে তোমার দিকে, রইবে চেয়ে
অনিমেখে”
২) কেলং
এর একেবারে ভোরের সূর্যের প্রথম রক্তিম আলোতে
lady kellong শৃঙ্গের লজ্জা রাঙ্গা রূপ এর দিকে
তাকিয়ে তাকিয়ে সময়কে হারিয়ে ফেলা কোন দিন ভুলবো
না।প্রথমে অল্প গোলাপী, তার পর যত ভোরের আলো
lady kellong কে আলিঙ্গন করতে লাগলো – তত লজ্জাতে
লাল হতে লাগল শৃঙ্গের বরফ। শেষে সূর্যালোকের
আলিঙ্গনের উত্তাপ আগুন লাগিয়ে দিল পাহাড়ে। সে
এক অপরূপ প্রেম লীলা। সময় থেমে গেছিল সেদিন
– একেই কি বলে অনন্ত মুহূর্ত?
Lady Kellong
গিরি শিখর প্রথম ওঠা সূর্যের আলোর পরশে লজ্জায়ে
রক্তিম
৩) আমরা
দুজন, আমি আর আমার স্ত্রী – আর কেউ কোথাও নেই
– নাকো লেকের পারে দুজন দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে
ছিলাম – কখন যে আমাদের হাত দুটো মিলেছিল - আমারা
জানতেও পারি নি। কলকাতার সেই কাজের ভিড়ে এ রকম
একটা একান্ত অনুভূতির পরশ শেষ কবে পেয়েছি বা
কোন দিন পেয়েছি কিনা মনে পড়ে না।
আমাদের চোখ তখন লেকের নীল জল আর অপর পাড়ের সবুজ
গাছ আর সামনের ঝুলে থাকা ডালের দিকের স্থির
হয়ে তাকিয়ে আছে।আমার বন্ধু কে লেখাতে বলেছিলাম
“কোন নির্জন সমুদ্রের পাশে বা পাহাড়ের শেষ মাথাতে
বসে চুপ করে প্রকৃতিকে অনুভব করার সময় যে পাশে
চুপ করে বসে থাকলে আরও আরও ভাল লাগে – তাকেই
কি বন্ধু বলব না?” নাকো লেকের ধারে সেদিন সেই
বন্ধু আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।
নাকো লেকের
নীল জল, পাড়ের সবুজ গাছ আর মেঘ হীন আকাশের মন
কাড়া মিলন
৪)ট্রেন
বা গাড়ি করে পাহাড়ি tunnel এর মধ্যে দিকে বহুবার
গেছি। হিমাচলের রাস্তাতে দেখতে পেলাম নতুন এক
রূপ । cantilever এর মত ঝুলে থাকা পাহাড়ের ছাদ
– পাশে এক মন্দির। এই মন্দিরে মাথা না ঠেকিয়ে
কোন গাড়ির চালক আগে যায়ে না।দেখে মনে হয়, কেউ
আশীর্বাদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই আশীর্বাদ
গাড়ির চালকদের নিরাপদে দুর্গম রাস্তা পার হবার
ভরসা।
মাথার ওপর হাত
বাড়িয়ে গিরিরাজের নিরাপদ যাত্রার আশীর্বাদ
৫)যাচ্ছিলাম
স্পিতির কমিকে। উচ্চতা ৪৫৯০ মিটার । চারিদিকে
আমাদের চোখ ঘুরছে আর অবাক হয়ে প্রকৃতির অপরূপ
শোভা দেখছে। হঠাৎ দেখলাম এক freeze shot – পাহাড়ের
পাশ থেকে ঝোরে পরা জল মাঝ পথে থমকে দাঁড়িয়েছে
– বোধহয় চারিদিকে অপরূপকে দেখে জলও থমকে গেছে
– তাই জল বরফের তীক্ষ্ণ ফলাকা হয়ে পাহাড় থেকে
ঝুলে থেকে আর এক রূপ যোগ করেছে।
পাহাড়ের গায়ে
ঝুলন্ত বরফের ফলা
৬)অনেক
ছোটবেলাতে অনেক দিন স্বপ্ন দেখতাম চকোলেট গাছের
নীচে দাঁড়িয়ে আছি আর নাগালের মধ্যে অনেক অনেক
চকোলেট । যখনই পারতে যেতাম – ঘুম ভেঙ্গে যেত
। খুব কষ্ট পেতাম এতো ভাল সুযোগ হারাবার জন্যে।
এই ৭০ এ ছুঁয়ে আবার সেই ছবি চোখের সামনে দেখলাম
ছিটকুল যাবার পথে – শুধু চকোলেটের বদলে আপেল
। কিন্তু tragedy টা এখনও একই । জেগে ছিলাম
তাই ঘুম ভাঙ্গার প্রশ্ন নেই – কিন্তু এবার আপেল
গাছেই রইল – পেলাম না। বড় করে লেখা “গাছে হাত
দেওয়া নিষেধ” । এই জন্যেই কি একে নিষিদ্ধ ফল
বলে – বলুন তো ?
হাত বাড়ালেই
নিষিদ্ধ ফল – পাশে ইভ – কিন্তু ফল ছোঁয়া বারণ
বুজতে
পারছি লেখাটা নিজেদের স্বগতোক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা ছাড়া কেউ পড়ে আনন্দ পাবে কিনা জানি না
। তবু মনের তাগিদে লিখতে বাধ্য হলাম। অত্যাচারটা
সীমা ছাড়িয়ে গেল কিনা বুজতে পারছি না।
বিজন
বন্দ্যোপাধ্যায়
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)