আকবর বাদশাহর সমাধি, সিকান্দ্রা

আগ্রা তাজমহলের
জন্য বিখ্যাত। কিন্তু তাজমহলের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে
এখানকার দুটি পুরনো শিল্প – কাঁচের চুড়ি আর ঢালাই
লোহা। আগ্রাতে কাঁচ সাধারণত ছোট উনুনে কয়লা পুড়িয়ে
গলান হয়। আর ঢালাই লোহা গলাবার জন্য কয়লা বা কোক
চালিত কিওপোলা ব্যাবহার করা হয়। কোক বা কয়লাতে
প্রচুর ধোঁয়া হয় যাতে থাকে গন্ধক (সালফার)। এই
গন্ধক তাজমহলকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাজমহলের
শ্বেত পাথর আর সাদা নেই – হলদেটে হয়ে গেছে। (ছবি
নং ১)। মহা মান্য সুপ্রিম কোর্ট আদেশ জারি করেছিলেন
যে আগ্রাতে কোক বা কয়লা ব্যবহার করা যাবেনা। কোক
বা কয়লার বদলে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করতে হবে।
এর জন্য কাছেই মথুরা রিফাইনারি থেকে কম দামে প্রাকৃতিক
গ্যাস সরবরাহ করার ব্যবস্থা হয়।

ছবি
নং ০১ – শ্বেত পাথরের তাজমহল - একটু লক্ষ্য করলে
দেখা যাবে শ্বেত পাথর হলদেটে হয়ে গেছে।
ঢালাই লোহার
সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যবসায়ি ও শ্রমিক খুব মুশকিলে
পরে যান, কারণ কিওপোলা কোকের বদলে প্রাকৃতিক গ্যাস
দিয়ে চালান সহজ ব্যাপার নয়। পৃথিবীতে খুব কম জায়গাতেই
প্রাকৃতিক গ্যাসের কিওপোলা চালু আছে। যাহোক এই
কাজেই আমাকে অনেক অনেক বার আগ্রা আসতে হয়েছে।
কোলকাতা থেকে আগ্রা যেতে হলে দিল্লী হয়েই আসতে
হত। দিল্লী থেকে এন এইচ ২ বা জিটি রোড ধরে এসে
বাঁদিকে মথুরা পেরিয়ে বেশির ভাগই আগ্রার ৮ – ১০
কিঃ মিঃ আগেই সিকান্দ্রার কাছে ডান দিকে বেঁকে
বিজপুর রোডের দিকে চলে যেতাম। কিন্তু সময়ের অভাবে
একবারও সিকান্দ্রায় ঢোকা হয়নি। শেষে একবার ফেরার
পথে হাতে কিছু সময় পেয়ে প্রধান রাস্তার ধারেই
সিকান্দ্রার আকবর বাদশাহর সমাধি ক্ষেত্রে ঢুকে
পড়লাম।
তৃতীয় মোঘল
সম্রাট আকবর বাদশাহ (১৫৫৫ – ১৬০৫) নিজেই সিকান্দ্রায়
নিজের সমাধি ক্ষেত্রের জায়গা বেছে নেন। এমনকি
কিছু কিছু প্রস্তুত পর্বের কাজও তিনি ১৬০০ সনে
শুরু করে দেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র চতুর্থ
মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১১৯ একর জমির উপর সমাধি
সৌধের কাজ ১৬০৫ সালে শুরু করে ১৬১৩ সালের মধ্যে
শেষ করেন।
রাস্তার
থেকে প্রধান প্রবেশ পথ (দক্ষিণ দ্বার) সব থেকে
বড় ও সুন্দর। চার দিকে চারটি শ্বেত পাথরের তৈরি
মিনার আছে, অনেকটা তাজমহলের মত। মিনারের উপরটা
অনেকটা ছাতার মত। (ছবি নং ২)।

ছবি
নং ০২ - আকবর বাদশার সমাধি সৌধে ঢোকার প্রধান
প্রবেশ পথ - দক্ষিণ দিকে।
বাকিটা লাল
পাথরের তৈরি কিন্তু সুন্দর ভাবে কারুকাজ করা।
সূক্ষ্ম কারুকাজ করার জন্য শ্বেত পাথর আর কাল
জেড পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। এই প্রধান প্রবেশ
পথ তৈরি করা হয়েছে অনেকটা ফতেহ-পুর সিক্রির বুলন্দ
দরওয়াজার অনুকরণে। (ছবি নং ৩)।
ছবি
নং ০৩ - প্রধান প্রবেশ পথ অনেকটা ফতেহ-পুর সিক্রির
বুলন্দ দরওয়াজার মত
প্রধান
প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা হেটে সমাধি স্থলে
যেতে হয়। এই রাস্তার দুধারে আছে চোখ জুড়ান বিশাল
সবুজ মাঠ। এই মাঠে অনেক পোষা হরিণ চড়ে বেরায়,
পর্যটকদের দেখে মোটেই ভয় পায়না। (ছবি নং ৪)।

ছবি নং ০৪ - প্রবেশ পথ ধরে এগিয়ে গেলে চোখ জুড়ান
বিশাল সবুজ মাঠ যেখানে অনেক পোষা হরিণ নির্ভয়ে
চড়ে বেরায়
সমাধি সৌধটি
চারতলা এবং বেশ বড়। এক একটা দিক ১০৫ মিঃ লম্বা।
প্রধানত লাল পাথরের তৈরি এই সৌধটি ধাপে ধাপে,
পিরামিডের মত, চার তলা পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনের
দরজার আশে পাশের জায়গা গুলো শ্বেত পাথরের কারুকার্য
করা। ছাতের ওপরের ছোট ছোট মিনার গুলোও শ্বেত পাথরের
ছাতা দিয়ে ঢাকা। (ছবি নং ৫)।

ছবি
নং ০৫ – ঘন লাল পাথর ও শ্বেত পাথর দিয়ে তৈরি সমাধি
সৌধ
সমাধি সৌধে
ঢুকেই দেখা যাবে সুন্দর করে আঁকা বিভিন্ন জ্যামিতিক
আকার, ফুল ও অন্যান্য প্যাটার্ন। কোনটা ঘন নীলের
ওপর সোনালী রঙ বা কোনটা হালকা রঙের ওপর ঘন লাল
দিয়ে ফোটান সুন্দর নকশা। (ছবি নং ৬ ও ৭)। দেওয়ালে
ফাটল ধরার জন্যে নকশা খানিকটা নষ্ট হয়ে গেছে।
ফাটল গুলো সিমেন্ট বালি দিয়ে ভর্তি করলেও নকশা
গুলোর সংস্কার হয়নি।

ছবি নং ০৬ – দরজার উপর থেকে ছাত পর্যন্ত সুন্দর
নকশা দিয়ে মোরা

ছবি নং ০৭ –বাতি ঝোলাবার জায়গা থেকে বৃত্তাকার
নকশা - গোলাকার ছাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে
একটু ভিতরে
ঢুকলে একটা জাফরি কাটা ঘরে (ছবি নং ৮) দেখা যাবে
একটা বেদী।

ছবি নং ০৮ – সুন্দর জাফরি কাটা দেওয়াল। এর কাছেই
আছে সমাধি স্থল
মুসলিম
রীতি অনুযায়ী এই বেদীতে মরদেহ থাকেনা। মরদেহ থাকে
বেদীর ঠিক নীচেই একটু গভীরে। আমি অনেকক্ষণ এখানে
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম আর ভাবলাম দোর্দণ্ড প্রতাপ
তৃতীয় মোঘল সম্রাট আকবর বাদশাহর কথা। তিনি চলে
গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর শরণীয় কীর্তি। বেশ
কিছু সময় আনমনে ঘুরে বেড়ালাম। দেখলাম উত্তর দিকের
প্রবেশ পথের ভগ্ন দশা। (ছবি নং ৯)।

ছবি নং ০৯ - উত্তর দিকের প্রবেশ পথ – ব্যবহার
হয়না। এখন ভগ্ন দশা।
হঠাৎ চমকে
উঠে দেখলাম সময় হয়ে গেছে বেরিয়ে যাওয়ার। ততক্ষণে
আলো কমে এসেছে। ম্লান হয়ে যাওয়া দক্ষিণের দ্বার
দিয়ে (ছবি নং ১০) বেরিয়ে এলাম বাস্তব জগতে আর
রওনা দিলাম দিল্লীর উদ্দেশ্যে।

ছবি
নং ১০ – পড়ন্ত আলোয় প্রধান প্রবেশ পথ - দক্ষিণের
দ্বার দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাস্তব জগতে
বিমল
কুমার বসাক