প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বাংলাদেশের সিনেমা - 'টেলিভিশন'

কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র 'টেলিভিশন' দেখলাম। ছবিটা বোধহয় বছর দেড়েক আগে মুক্তি পেয়েছে। পরিচালক মহম্মদ সারয়ার ফারুকি-র নাম আমি আগে এক বাংলাদেশী বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতকে যাঁরা নতুন দিশা দেবার চেষ্টা করছেন , তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। প্রথমেই স্বীকার করি, এই ছবির সব সংলাপ আমি ধরতে পারি নি। কথাগুলি সম্ভবত নোয়াখালী (?) বা কাছাকাছি কোনও অঞ্চলের ডায়ালেক্ট। তাতে অবশ্য ছবির মূল বিষয়বস্তু বুঝতে অসুবিধা হয় নি।

ছবির শুরু গ্রামের বয়স্ক চেয়ারম্যান আমিন সাহেবের ইণ্টারভিউ দিয়ে। একজন মহিলা সাংবাদিক চেয়ারম্যানের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। দুজনের মাঝখানে বিশাল সাদা পর্দা রাখা যাতে ধর্ম-পরায়ণ চেয়ারম্যানকে ক্যামেরার সামনে আসতে না হয়। চেয়ারম্যানের হুকুমে গ্রামে কেউ টেলিভিশন রাখতে পারে না, প্রাণীর ছবি তোলা বা প্রতিচ্ছবি দেখা কোরানে বারণ। কেন সবার ওপর এই বিধিনিষেধ - সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিক। [প্রসঙ্গত, পুরুষের বদলে একজন মহিলা সাংবাদিককে এনে পরিচালক আরেকটা মাত্রা যোগ করেছেন। ক্যামেরা না থাকলেও কি মুখোমুখি বসে সভাপতি একজন বে-আব্রু মহিলাকে ইণ্টারভিউ দিতেন! ]

চেয়ারম্যানের পুত্র সোলায়মান আব্বাকে ভয় ও শ্রদ্ধা করে, কারোর মুখে তাঁর সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। আবার মনে হয় তাঁর অনুশাসন থেকে মনে মনে মুক্তিও চায়। সোলায়মানের প্রেম কোহিনূরের সঙ্গে। প্রথমে দেখা হত লুকিয়ে চুরিয়ে। পরে তাদের প্রেমালাপ মোবাইল থেকে স্কাইপে পৌঁছয় সোলায়মানের বাল্যবন্ধু এবং অ্যাসিস্টেণ্ট মজনুর চেষ্টায়। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে। একজন হিন্দু শিক্ষক গ্রামে একটা টেলিভিশন সেট নিয়ে আসেন। হিন্দু বলে চেয়ারম্যান আপত্তি করেন না। কিন্তু সেই টেলিভিশন মুসলমান ছেলেমেয়েরা (যাদের মধ্যে কোহিনূরও একজন) দেখছে বলে চেয়ারম্যানের নির্দেশে সেটা ফেলে দেওয়া হয়। এটাকে কেন্দ্র করে জল আরও গড়ায়। ছেলে সোলায়মানের বিদ্রোহ ঘোষণা এবং চেয়ারম্যানের পিছু হঠা। ছবির নাটকীয় সমাপ্তি চেয়ারম্যানের হজ-যাত্রা দিয়ে।

দুটো জেনারেশনের দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত এবং তার ফলে অন্তর্দ্বন্দ্ব - বহু-ব্যবহৃত প্লট। সংঘাতটা শুধু সামাজিক/সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ থেকে নয় - অনেক সময় জড়িয়ে থাকে ধর্মীয় অনুশাসন। যুগের সঙ্গে তাল রেখে অনুমান করা যায় কোনদিকে গল্পটা এগোবে। তবে ধর্মের ব্যাপার থাকলেই লেখক বা পরিচালককে সতর্ক থাকতে হয়। এমনিতেই বিতর্ক পিছু ছাড়ে না, তার ওপর দেশেবিদেশে কট্টরপন্থীদের অভাব নেই। সেই ঝুঁকিটা পরিচালককে নিতে হয় শিল্প-স্বাধীনতার খাতিরে। সব সামলিয়ে কাহিনীটির উপস্থাপনায় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন পরিচালক ফারুকি। এটা ওঁর কত নম্বর ছবি জানি না। যদি প্রথম দিকের হয়, তাহলে ওঁর কাছে অনেক প্রত্যাশা রইলো। এক আধ সময়ে ছবির গতি শ্লথ লেগেছে, আরেকটু কাটছাঁট করলে বোধহয় ভালো হত। আবহসংগীতে গানের ব্যবহার সুন্দর। ক্যামেরার কিছু কিছু শট চমৎকার।।

ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র গ্রামের চেয়ারম্যান, আমিন সাহেব। রাশভারি চেয়ারম্যান নিজের ধর্ম নিষ্ঠা-ভরে পালন করেন। গ্রামের কেউ যেন ধর্ম থেকে বিচ্যুত না হয় – সেদিকে তাঁর সদা-সতর্ক দৃষ্টি। মানুষের ক্ষতি করতে চান না। হিন্দু শিক্ষকের টেলিভিশন ফেলে দেন ঠিকই, কিন্তু তার দাম দিয়ে দেন। Gender-এর ব্যাপারটা বাদ দিলে, তিনি তফাৎ করেন না - সবাইকে সমান ভাবে দেখেন। নিজের ছেলেকে যখন মোবাইল ব্যবহার করতে দেন, তখন অন্য ছেলেরাও অনুমতি পায়। মেয়েরা অবশ্য পায় না। শাহীর হুদা রুমী এই চরিত্রটিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়েছেন।

পুত্র সোলায়মানের বুদ্ধিশুদ্ধি দেখে দুর্ভাবনা হয়। অ্যাসিস্টেন্ট মজনু না থাকলে বেচারার পক্ষে পারিবারিক মাছের ব্যবসাটা চালানো মনে হয় সম্ভব হত না! প্রেম করতেও মজনুর সাহায্য লেগেছে! শেষে যে বিরাট কাণ্ডটা সে করে ফেলল, অর্থাৎ বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ – তার পেছনেও রয়েছে কোহিনূর আর মজনু। তবে নিশ্চয় সোলায়মানের চরিত্রের মধ্যে একটা কিছু ছিল, যেটা আমি ধরতে পারি নি - নইলে কোহিনূর প্রেমে পড়বে কেন! কে জানে, হয়ত একটা নির্বোধকে গড়েপিটে নেওয়া সহজ কাজ হবে বলে! চঞ্চল চৌধুরীকে ধন্যবাদ যে সোলায়মানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে তিনি প্রাণপাত করেছেন।

সোলায়মানের ছেলেবেলার সাথী এবং বর্তমানে বেতন-ভুক কর্মচারী হল মজনু । সোলায়মানের প্রতি আনুগত্য এবং কোহিনূরকে ভালোবাসা - দুটো মিলিয়ে মজনু হল ছবিটির ট্র্যাজিক চরিত্র।। তার আচরণের মধ্যে দর্শকরা আবার হাস্যরসের খোরাকও পাবেন - যেহেতু তিনি ছবির নায়ক নন। মোশাররফ করিম চরিত্রটিকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়েছেন। কোহিনূরকে ছেলেবেলা থেকেই ভালোবাসত মজনু, কিন্তু সাড়া পাবে না জেনে সাহস ভরে মনের কথা প্রকাশ করতে পারে নি। সে গরীব ও অশিক্ষিত। লেখাপড়া জানা কোহিনূর গ্রামের বিত্তবান চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলের প্রেমিকা। বাধা অতিক্রম করে একবার ভালোবাসার কথা বলে ফেলার পরে - তাড়া খেয়েও কাজে অকাজে নানান ছুতোয় তাকে দেখি কোহিনূরের সঙ্গে কথোপকথনের চেষ্টা করতে। সবচেয়ে যে দৃশ্য মনে দাগ কাটে - সেখানে অবশ্য কথা নেই।। যখন মজনু শোনে কোহিনূর এক পরিচিতকে বলছে সে গোঁফ-অলা লোক পছন্দ করে না - তড়িঘড়ি গোঁফ ছেঁটে ফেলে জানলা দিয়ে কোহিনূরকে ডেকে তাকাতে তাকাতে নৌকো বেয়ে তার নীরবে চলে যাওয়াটা।

শুধু মজনু নয়, সুন্দরী কোহিনূরকে দেখে সবারই ভালো লাগবে! বিদেশে চাকুরিরত বাবার চপলা কন্যা কোহিনূরের ভূমিকায় নুসরাত ইমরোজ তিশা অনায়াস দক্ষতায় অভিনয় করেছেন! সুদূর গ্রামে বড় হয়েও কোহিনূর সপ্রতিভ। সে পড়াশনো করে, জগত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, বুদ্ধিও ধরে যথেষ্ট। তার ওপর মানুষকে কি করে চালাতে হয় জানে। ওর সঙ্গে বিয়ে হলে সোলায়মানকে নিয়ে দুর্ভাবনার করার আর কারণ থাকবে না - দর্শকরা স্বস্তি পাবে!

বাঙলাদেশের দূর দূর গ্রামেও যে কিয়স্ক রয়েছে এবং সেখানে নিয়মিত ভিডিও চ্যাট চলে – জানা ছিল না। যেখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই - থাকলেও অনিয়মিত, হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়াশুনো করতে হয়, স্যানিটারি ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়, সেখানে টেকনোলজির এই অনুপ্রবেশ কি করে ঘটল! ছবির প্রথম দিকে কোহিনূরকে দেখে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। বহু বাংলাদেশী এখন গ্রাম ছেড়ে বিদেশে কাজ করছেন - বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে। প্রিয়জনকে দেখার তাগিদ এবং নবলব্ধ আর্থিক সঙ্গতিই এর মূলে। তবু বলব, বাড়িতে ল্যাপটপ এনে মোবাইল ইন্টারনেটে সোলায়মান আর কোহিনূরের প্রেমালাপ একটু যেন অবাস্তব। কি ভাবে টাকার জোগাড় হল, ‘অশিক্ষিত’ মজনুর কম্পিউটার-জ্ঞান, ইন্টারনেট কানেকশন সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কোত্থেকে এল- সব মিলিয়ে একটু বোধহয় বাড়াবাড়ি। এর কি প্রয়োজন ছিল? কম্পিউটার এপিসোড পুরোপুরি বাদ দিয়েও তো টেলিভিশন ছবিটি করা যেত এবং সেটি আরও বাস্তবোচিতও হত! কিন্তু ফারুকি কি এটিকে নিখাদ বাস্তব-চিত্র করতে চেয়েছিলেন? বিজ্ঞাপনে টেলিভিশনের নামের সঙ্গে পক্ষিরাজ ঘোড়া্টা কি কোনও বিশেষ বার্তা দিচ্ছে! না হয় বাস্তবের ওপর একটু রঙ চড়ানোই হল! থাকলো কিছু কল্পনা। কল্পনা আর বাস্তব – সত্যি আর মিথ্যে – এই নিয়েই তো জগৎ। তাই তো মনে হয় শুনি...

"সত্য কি তেতো
সেকি জীবনের মত...
মিথ্যা কি ভুল
নাকি নীল নোনা জল...
কানামাছি মিথ্যা কানামাছি সত্য কানামাছি তুমি আমি যে যার মতো।..."

শেষে বলি, পরিচালক ফারুকি বাংলাদেশের ছবি সম্পর্কে আমার আগ্রহ বাড়িয়েছেন। শুনেছি এটি অনেক জায়গায় পুরস্কৃত হয়েছে - এটা অবশ্যই সুখবর।। দেশের কথা জানি না, আমেরিকায় ভারতীয় বাঙালীদের কাছে এটি পরিচিতি পায় নি - পাওয়া উচিত ছিল। আমেরিকার কোনও হলে ছবিটি মনে হয় না আসবে বলে। ধরে নিচ্ছি dvd-তে পাওয়া যাবে। ইউ টিউব-এ ছবির যে প্রিণ্টটা রয়েছে, তাতে সাব-টাইটেল নেই। থাকলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা এটা ভালোভাবে উপভোগ করতেন। অনেক কথার অর্থ না বোঝার ফলে ছবির পুরো রসটা আমি পাই নি – তার জন্যে আমার একটা ক্ষোভ রয়ে গেল।

সুজন দাশগুপ্ত

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।