পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
[জলধর সেনের বিখ্যাত
বই "হিমালয়" ইতিপূর্বেই অবসরে প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমান ধারাবাহিকে প্রথমেই যে রচনাটি দেওয়া হয়েছে ,
সেটি জলধর সেনের বন্ধু অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের
"হিমালয়" সম্বন্ধে মতামত ; সমালোচনাও বলা
যেতে পারে। এক শ্রেণীর লেখক সে যুগে তাদের রচনায় যে
ভাষা ব্যবহার করতেন , সেটা বর্তমান যুগে প্রায় অচল।
সংকলনের এই প্রথম লেখাটিতে সেই ধরণের শব্দ চয়ন , বাক্য
বন্ধন ও ভাষাশৈলীর কিছুটা পরিচয় পাওয়া যাবে।]
১. হিমালয়
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়
[লেখক
পরিচিতি : ১৮৬১ সালের ১লা মার্চ নদীয়ায় জন্ম। পিতার নাম মথুরানাথ।
রাজসাহী কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং বি. এল ডিগ্রি লাভ
করে সেখানেই ওকালতি শুরু করেন। তিনি সমস্ত জীবন আইন নিয়ে ব্যস্ত
থাকলেও বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল।
'সিরাজউদৌল্লা' (১৮৯৮) এবং 'মীরকাশিম' (১৯০৬) নামক দু'খানি
ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন।
ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর কৌতূহল ছিল সমধিক। তিনি উত্তরবঙ্গ-সাহিত্য-সম্মিলনের
এবং বঙ্গীয়-সাহিত্য-সম্মিলনের ইতিহাস শাখার সভাপতি হন। তিনি
'ভারতী' , 'সাহিত্য' , 'প্রবাসী' ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত
লিখতেন। তাঁর বা±মীতা ও স্বদেশানুরাগ প্রশংসনীয় ছিল। ১৯৩০
সালের ১০ই ফেব্রুয়ারী তিনি পরলোক গমন করেন। আলোচ্য রচনাটি
তিনি জলধর সেনের বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী ( যা ইতিপূর্বেই অবসরে
প্রকাশিত হয়েছে ) সম্বন্ধে তাঁর মতামত ব্যক্ত করে লিখেছেন।
মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।]
হিমালয়-লেখক শ্রীযুক্ত
জলধর সেন বঙ্গসাহিত্য সমাজে সর্ব্বত্র সুপরিচিত। তিনি নিতান্ত
সহজ উপায়ে পাঠক পাঠিকার হৃদয় স্পর্শ করিতে সিদ্ধ হস্ত বলিয়া
হিমালয় ভ্রমণ কাহিনী বিবৃত করিতে গিয়া প্রসঙ্গক্রমে নানা কথার
অবতারণায় পাঠকগণকে তাঁহার সুদীর্ঘ ভ্রমণ পথের মন্ত্রবিমুগ্ধ
সহযাত্রীর ন্যায় বহুবার "চড়াই উৎরাই" পার করাইয়া অবশেষে
একেবার হিমাচলের সমুচ্চ-শিখরসংলগ্ন চিরতুষার শোভার সমুজ্জ্বল
সৌভাগ্যের সম্মুখে সংস্থাপিত করিয়া স্বয়ং অলক্ষিত পদে স্বকার্যে
প্রত্যাবর্ত্তন করিতে সক্ষম হইয়াছেন। এই ভ্রমণকাহিনী যখন ধারাবাহিকরূপে
"ভারতীতে" প্রকাশিত হইতে আরম্ভ করে , তখন বঙ্গসাহিত্যের
এক নতুন দ্বার উন্মুক্ত হইয়াছিল ;-এখন সে পথে বহুলোকে সগর্ব্বে
অগ্রসর হইলেও জলধরকেই প্রথম পাণ্ডা বা পথপ্রদর্শক বলিয়া নির্দ্দেশ
করিতে হইবে। ইহাই তাঁহার একমাত্র বিশেষত্ব নহে। তিনি আড়ম্বরশূণ্য
সরল হৃদয়ের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাসে সে কথা যেরূপভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া
গিয়াছেন , অনুযাত্রিগণ বহবাসেও তাহার অনুকরণ করিতে পারিতেছে
না। ভাষার বিশেষত্ব আছে , -তাহা পুস্তকের ভাষা নহে , অথচ আদ্যন্ত
মাধুর্য্যে ও গাম্ভীর্য্যে সুসংবদ্ধ ; ভাবে বিশেষত্ব আছে ,-তাহা
সাম্প্রদায়িক মতামতের ক্ষীণগণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নহে , অথচ সর্বত্র
সদ্ভাবে সুসংবৃত ; বিষয়বিন্যাসেও বিশেষত্ব আছে ,-তাহা শুষ্ক
কঠোর কঙ্কর বা পাষণস্তুপের ন্যায় দুরধিগম্য নহে , অথচ নানা তত্বকথায়
সুসংযত। এরূপ সুলিখিত সুললিত ভ্রমণকাহিনীর কে না সমাদর করিবে
?
এই রচনাশক্তি যখন লোকলোচনের
অজ্ঞাতসারে ধীরে ধীরে বিকশিত হইতেছিল , তখন জলধরকে কেহ চিনিত
না। তিনি তখন কাঙ্গাল হরিনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নীরবে সাহিত্যসেবায়
দীক্ষিত হইবার জন্য "গ্রামবার্ত্তার" সম্পাদনভার বহন
করিতেছিলেন। তখন সবেমাত্র জীবনের প্রথম উন্মেষ - তাহার পর কত
সুখ কত দুঃখ , কত আশা কত নৈরাশ্য , কত সম্পৎ কত বিপদ পর্য্যায়ক্রমে
জীবনপথের সম্মুখীন হইয়াছে , আজ তাহা স্মরণ করিয়া ফল নাই। আজ
'হিমালয়' হাতে করিয়া যাঁহারা নিরতিশয় আনন্দ লাভ করিতেন তাঁহারা
আর ইহলোকে বর্ত্তমান নাই। আজ 'হিমালয়' হাতে করিয়া যাঁহারা স্নেহবিজড়িত
অস্ফুট অভ্যর্থনার বিনা ধন্যবাদে গ্রন্থপাঠে নিযুক্ত হইবেন ,
তেমন শৈশব সুহৃদও বড় দেখিতে পাওয়া যায় না। তাই নিতান্ত অযোগ্য
হইয়াও আমাকেই বাল্যবন্ধুর গ্রন্থসমালোচনায় অগ্রসর হইতে হইল।
আমি ইহা সমালোচনা করিবার
অধিকারী নহি - তজ্জন্য যতটুকু সাহিত্য শক্তির প্রয়োজন তাহাতেও
আমি নিঃসম্বল। সুতরাং সমালোচনা হিসাবে আমার ক্ষীণ উদ্যম নিতান্তই
নিäফল। তবে , লেখা বুঝিতে হইলে লেখককে বুঝিতে হয় বলিয়া আমি হিমালয়
লেখকের যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় দিবার পক্ষে নিতান্ত অপাত্র বলিয়া তিরস্কৃত
হইব না। জলধর কুমারখালীর সম্ভ্রান্ত কায়স্থ কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।
নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ করা পর্য্যন্ত বিদ্যালয়ে
অধ্যয়ন করা ঘটিয়া না উঠিলেও জলধর সর্ব্বাংশেই সুশিক্ষিত এবং
দীর্ঘকাল শিক্ষকের পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া বহু ছাত্রের সুশিক্ষালাভের
সহায়তা করিয়া এক্ষণে 'বসুমতী'র সম্পাদনা কার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছেন।
জলধর স্বগ্রামে চরিত্র গুণে সকলের কাছেই প্রিয়জনের ন্যায় সমাদৃত
- ইহা অল্প প্রশংসার কথা নহে। জলধর বঙ্গ-সাহিত্য সমাজে সকলের
কাছেই সুলেখক বলিয়া পরিচিত - ইহা অল্প সৌভাগ্যের কথা নহে।
কাঙ্গাল হরিনাথের নির্ভীক
স্বদেশসেবা তাঁহার স্বগ্রামবাসিগণের মধ্যে বহুলোকের হৃদয় আকর্ষণ
করিয়াছিল ,- সকলেই তাঁহাকে যথেষ্ট সমাদর করিতেন , অনেক ভক্তি
শ্রদ্ধা করিতেন , এবং কেহ কেহ তাঁহার আদর্শে চালিত হইতেন। জলধর
আশৈশব সেই আদর্শের সম্মুখে পরিবর্দ্ধিত হইয়া আবাল্য স্বদেশ সেবার
জন্য লালায়িত। যৌবনোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার সুকোমল হৃদয়ের
সকল বৃত্তিই সময়োচিত চাপল্য পরিহার করিয়া মাতৃ সেবার জন্য শক্তি
সঞ্চয় করিতেছিল। হরিনাথ আজন্ম দুঃখ দারির্দ্যে আকণ্ঠ নিমগ্ন
থাকিয়াও বীরের ন্যায় স্বদেশের কল্যাণ সাধনে নিযুক্ত ছিলেন ,
- কেহ বুঝিত না যে সাংসারিক দুঃখ ক্লেশ সৎকার্য্যের অন্তরায়
হইতে পারে। জলধরও সেই শিক্ষায় সমুন্নত হইতেছিলেন। তিনি উদরান্নের
জন্য বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করিয়া অবসরকাল সর্ব্বপ্রকার সৎকার্য্যের
আন্দোলনে অতিবাহিত করিতেন। তখন স্নেহময়ী জননী ভগিনী ও সহোদর
তাঁহাকে সংসারী করিবার আশায় উদ্বাহশৃঙ্খলে আবদ্ধ করিবার জন্য
কত না নিষ্ফল প্রয়াস স্বীকার করিয়াছিলেন। কালে বিবাহ হইয়াছিল
- একটি মাত্র কন্যা প্রসব করিয়া - প্রথমে কন্যা ও পরে প্রসূতি
অকালে কালগ্রাসে পতিত ও অল্পদিন পরেই জননী স্বর্গারূঢ় হইলেন।
ইহাতে প্রাণের মধ্যে যে অশান্ত অতৃপ্তি জাগিয়া উঠিয়াছিল , তাহাকেই
জলধরের ভ্রমণ ও বঙ্গসাহিত্যে হিমালয়ের ন্যায় ভ্রমণ কাহিনী রচনার
প্রবর্ত্তক বলিতে হইবে। ইহাকে বৈরাগ্য বলিতে পারি না , ইহা অনুরাগেরই
নামান্তর। "হিমালয়ের" ছত্রে ছত্রে তাহার পরিচয় ফুটিয়া
উঠিয়াছে ; যথা -" এখন ঘরে মা নেই , বাপ নেই , স্ত্রী নেই
, পুত্র নেই ; গৃহ অরণ্যের ন্যায় বিজন ; তবু সেই প্রাচীন স্মৃতির
সমাধি মন্দিরে ফিরে যেতে মন অস্থির।"
এই অস্থিরতা কালে ঘনীভূত
হইয়া সন্ন্যাসীকে আবার সংসারী সাজাইয়াছে। এখনও " ঘরে মা
নেই " বটে , কিন্তু স্ত্রী আছে , পুত্র আছে - গৃহ আর অরণ্যের
ন্যয় বিজন নহে ; তাহা তোমার আমার দশজনের গৃহের মতই অভাব আকাঙ্খা
, বাসনা ও অতৃপ্তির সহস্র কলরবে নিয়ত কলকলায়মান। সেই গৃহে বসিয়া
" হিমালয় " লিখিতে হইয়াছে বলিয়া ইহাতে কিছুমাত্র আন্তরিকতার
অভাব ঘটে নাই।
স্বামীজী আর বৈদান্তিক
নামধেয় দুই জন সহযাত্রী এই হিমালয় ভ্রমণ সাধনা উত্তর সাধক। ইঁহারা
উভয়েই সশরীরে বর্ত্তমান ; - কেহই কাল্পনিক জীব বলিয়া সন্দেহ
করিবার কারণ নাই। কিন্তু জলধর তাঁহাদের নাম-গোত্রের উল্লেখ না
করায় তাঁহাদের পরিচয় দিতে সাহস পাইলাম না। স্বামীজী ও বৈদান্তিক
উভয়েই বাঙ্গালী। বাঙ্গালী এখন পরিবর্ত্তনের যুগে দণ্ডায়মান ,
কেহ সম্মুখে কেহবা পশ্চাতের দিকে ছুটিয়া চলিবার জন্য ব্যাকুল।
স্বামীজীর দৃষ্টি সম্মুখে , তিনি বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া স্বেচ্ছালব্ধ
কঠোর সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া কর্ম্মক্ষেত্র হইতে সরিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
বৈদান্তিকের দৃষ্টি কেবল পশ্চাদ্ভাগে - তিনিও বাধা বিঘ্ন অতিক্রম
করিয়া স্বেচ্ছালব্ধ কঠোর নিষ্ঠায় জীবনকে কোনরূপে ক্ষয় করিতে
দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়াছেন। এতদুভয়ের কাহারও সঙ্গে জলধরের সামঞ্জস্য
ঘটে নাই ; অথচ তিন জনের একত্রাবস্থানঘটিত প্রীতি সম্মিলনের জন্য
ভ্রমণ ব্যাপার সহজ ও সুখকর হইয়াছিল। বৈদান্তিক ও জলধর উভয়েই
বৈরাগী - বৈদান্তিক ভায়া বিরাগে ভরপুর , জলধর অনুরাগে আপ্লুত।
তাই জলধর যখন তখন বৈদান্তিককে পরিহাসচ্ছলে বলিয়া আসিয়াছেন -
" জীবনটা পরিপূর্ণ মাত্রায় অপব্যয় করাই আমাদের বৈরাগ্যের
প্রধান লক্ষণ।"
স্বয়ং বক্তাও যে সম্পূর্ণরূপে
ইহার হাত এড়াইতে পারিয়াছিলেন তাহা সাহস করিয়া বলা যায় না। সাহিত্যের
হিসাবে জলধরের জীবনের কয়েক বৎসরের সন্ন্যাসব্রত নিäফল না হইলেও
, অন্য্যন্য হিসাবে তাহাকে অপব্যয় ভিন্ন আর কি বলিব ? ইহাতে
জীবনস্রোত আশৈশবাভ্যস্ত সুপরিচিত প্রণালী হইতে বহুদূরে সরিয়া
পড়িয়াছে ; সরলতার সঙ্গে সাংসারিকতা মিলিত হইয়াছে। তথাপি জলধরের
ন্যায় সত্যপ্রিয় লেখক বড়ই দুর্ল্লভ। কবি আপনাকে ঢাকিয়া রাখিয়া
একটি কৃত্রিম মুখস পরিয়া সাহিত্য সমাজে পদার্পণ করেন , জলধর
আপনাকে সকল সময়েই ইহার ঠিক বিপরীতভাবে প্রদর্শিত করিয়াছেন। তজ্জনই
তাঁহার লেখা সরস সুন্দর ও স্বাভাবিক হইয়াছে।
বাঙ্গালীর ভ্রমণকাহিনী
কাব্য সৌন্দর্য্যেই পরিপূর্ণ হইবার কথা ; জলধর নিজেও তাহা বহুবার
বহুভাবে স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। ইংরাজ ভ্রমণকারী ধরিত্রীকে বীরভোগ্যা
বলিয়া বিবেচনা করেন ; তাই তিনি যেখানে পদার্পণ করেন , সেখানকার
খড় কুটা ধূলা বালি কিছুই তাঁহার সূক্ষ্ম দৃষ্টিকে অতিক্রম করিতে
পারে না। তাঁহার ভ্রমণ কাহিনী পড়িয়া তাঁহার স্বদেশের লোকে বহু
অভিনব তথ্যের সন্ধান লাভ করে ; মৃদগর্ভে কত ধাতু আছে , ভূপঞ্জরে
কত স্তর বিভাগ আছে , বনভাগে কোন্ জাতীয় কত তরু গুল্ম আছে , জীবজগতের
কত জলচর স্থলচর ও খেচর দেখিতে পাওয়া যায় , কোন্ স্থান হইতে কোন্
স্থানে ঠিক কত দূর , কত উচ্চ বা কত নিম্ন ইহার বিস্তৃত বিবরণ
প্রাপ্ত হওয়া যায়। বাঙ্গালীর ভ্রমণ কাহিনীতে এ সকল কথার স্থান
নাই, - থাকিতেও পারে না ; তাহা হইলে গ্রন্থখানি বাঙ্গালীর পক্ষে
নিতান্ত অপাঠ্য হওয়া উচিত। তবে একখানি মানচিত্র থাকিলে নিতান্ত
অসঙ্গত হইত না ; "হিমালয়ে" যে সকল স্থানের বর্ণনা
আছে তাহা মানচিত্রের অজ্ঞাত নহে। সাধারণ তীর্থযাত্রীর পক্ষে
হরিদ্বার পর্য্যন্তই সীমা ; তথায় গঙ্গা লোকালয় পথবর্ত্তিনী।
তদূর্দ্ধে যত যাও , গঙ্গা ক্রমশঃ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতরা , বিজনবাসিনী
নির্ঝরিণীর ন্যায় স্বল্পতোয়া। পর্ব্বতবাসিনী স্রোতস্বিনীর নিকটে
ও দূরে যে বিশ্বশোভা বিরাজ করিতেছে , তাহা নিয়ত কাব্যসৌন্দর্য্যে
পরিপূর্ণ - কেহই দেখিয়া দেখিয়া পরিশ্রান্ত হয় না। কারণ , তাহা
সমতল ক্ষেত্রের সুপরিচিত চিত্রের ন্যায় বৈষম্যবিহীন নহে। এই
সূর্য্যকরোজ্জ্বল , এই আবার মেঘাচ্ছন্ন ; এই সমুচ্চশিখর দেশ
, এই আবার নিম্নভূমির অবনত মস্তক ; এই বৃক্ষলতা , এই তৃণ পাদপ
পরিশূণ্য মসৃণ শিলাতট ! বৈচিত্র্যে গাম্ভীর্য্যে মাধুর্য্যে
নূতনত্বে হিমালয় নিতান্তই বিস্ময়ের ব্যাপার , সুতরাং সৌন্দর্যে্যর
আগার। হিমালয়ের ভ্রমণ কাহিনীও তদনুরূপ সুন্দর হইয়াছে। পড়িতে
পড়িতে 'হিমালয়' যেন প্রত্যক্ষ প্রতীয়মান হয়। সুতরাং ইহাকে একখানি
গদ্য কাব্য বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। আর ইহাকে যদি নিতান্ত
উপন্যাসের হিসাবেই দেখিতে চাও , তাহা হইলেও এরূপ নির্দ্দোষ উপন্য্যাস
কোথায় পাইবে ? ইহাতে কাব্যের সৌন্দর্য্যের সঙ্গে উপন্যাসের উপদেশ
মিলিত হইয়াছে বলিয়া পুস্তকখানি বঙ্গ সাহিত্যে সমাদর লাভ করিতে
সক্ষম হইবে।
উত্তরে স্ত্রীরাজ্য , দক্ষিণে
কুরুজাঙ্গল , পূর্ব্বে ধর্ম্মারণ্য ও পশ্চিমে বাহলিক - এই চতুঃসীমাবচ্ছিন্ন
পার্ব্বত্যপ্রদেশ একদা "ব্রহ্মপুর" নামে পরিচিত ছিল
; - ইহা উত্তরাখণ্ডের অন্তর্গত। বর্ত্তমান হরিদ্বার পুরাকালে
"মায়াপুরী" নামে কথিত হইত। মায়াপুরী হইতেই উত্তরাখণ্ডে
প্রবেশ করিতে হইত ; কিন্তু সে দুর্গম পথ সকলের জন্য উন্মুক্ত
ছিল না। সাধু সন্ন্যাসী ভিন্ন গৃহস্থ সে পথে সচরাচর পদার্পণ
করিত না। শৈলের পর শৈলমালা দুরারোহ দুর্গ প্রাচীরের ন্যায় পথরোধ
করিয়া দণ্ডায়মান ; অনশন ও অনিদ্রা , পর্য্যটন ও পরিশ্রান্তি
পথিকের পদানুসরণ করিতে ত্রুটি করে না ; - এত ক্লেশে এত দীর্ঘ
পথের "চড়াই উৎরাই" অতিক্রম করিয়াও তুষারাচ্ছাদিত কেদার
মন্দির দর্শন করিবার জন্য যাঁহাদের নিরতিশয় আগ্রহ , কেবল তাঁহারাই
কায়ক্লেশে হিমালয় ভ্রমণ করিতেন। বদরী নারায়ণ এখন সুবিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র
- ইংরাজের কল্যাণে অপেক্ষাকৃত অল্পায়াসেই সেখানে উপনীত হওয়া
যায় , সুতরাং জলধরের "হিমালয়" কোন অজ্ঞাত রাজ্যের
ভ্রমণ কাহিনী বলিয়া পরিচিত হইবার দাবি রাখে না। যাহারা ইহাকে
সে হিসাবে গ্রহণ করিবেন , তাঁহারা লেখক ও পুস্তক উভয়কেই বুঝিতে
পারিবেন না। "হিমালয়ে" যাহা কিছু ভ্রমণ কাহিনী লিখিত
হইয়াছে , তাহা যেন উপলক্ষ মাত্র ; লেখক তাহাকে অবলম্বন করিয়া
পাঠক সমাজকে জড়ের আবরণ ভেদ করিয়া হিমালয়ের সৌন্দর্য্যের সম্মুখে
অগ্রসর হইবার পথ দেখাইয়া দিয়াছেন। এই গুণে "হিমালয়"
বঙ্গসাহিত্যে চিরদিন সমাদর লাভ করিবে।
জলধরের লিপি কৌশল কোথায়
, তাহা সহসা স্থির করা কঠিন। কখন তাঁহার ভাষা , কখন বা তাঁহার
ভাব প্রকাশ কোশলকেই লিপি চাতুর্যে্যর মূল বলিয়া বোধ হয়। আজ কাল
বঙ্গসাহিত্য সেবার জন্য অনেকে সাহিত্যক্ষেত্রে অগ্রসর হইয়াছেন
; আমি তাঁহাদের কানে কানে বলিতে পারি - জলধরের সমগ্র লিপি কৌশল
তাঁহার হৃদয়ে। তিনি যাহা লেখেন , হৃদয় ঢালিয়া দিয়া লেখেন ; পাঠকের
নিকট তাহা কোন স্থানে লুকাইয়া রাখিতে চাহেন না। সেই আন্তরিকতার
গুণেই তাঁহার গ্রন্থ আদ্যন্ত পাঠ না করিয়া নিরস্ত হইতে ইচ্ছা
করেনা।
সাহিত্যে একটু সাহসে প্রয়োজন আছে ; - জলধর সেই সাহসে নির্ভর
করিয়া তাঁহার ভাষা , তাঁহার ভাব ও মত অবলীলা ক্রমে ব্যক্ত করিয়া
গিয়াছেন। আমার সকল ভাব বা সকল মতের সঙ্গেই যে সকলের সহানুভূতি
থাকিবে , তাহার সম্ভাবনা নাই। তথাপি অনেকে অন্যের মত কি হইবে
, তাহার দিকে চাহিয়া গ্রন্থ লিখিয়া বিড়ম্বিত হন। অন্যের মত ,
অন্যের ভাষা , ও অন্যের ভাবের অনুকরণ করিতে গিয়া বিড়ম্বিত হওয়া
অপেক্ষা নিজের মত , ভাষা ও ভাব ব্যক্ত করিয়া তিরস্কৃত হওয়াও
ভাল। ভাষা ভাল হইলেও ব্যাকরণ দোষে পরিপূর্ণ , ভাবে মোহ থাকিলেও
সর্বত্র সুন্দর নহে , মতের বাহুল্য থাকিলেও সকল মত ন্যায়শাস্ত্রানুমোদিত
নহে - এরূপ ভাবে যাঁহারা "হিমালয়" সমালোচনা করিবেন
, তাহাদের জন্য লেখক যথেষ্ট তৃণ কঙ্কর ও কর্ক্কশ শিলাতল পূঞ্জীভূত
করিয়া রাখিয়াছেন। তাঁহাদিগকে গ্রন্থের বাহ্যবেশের ন্যায় হিমালয়েরও
বাহ্যবেশমাত্র দেখিয়াই প্রত্যাবৃত্ত হইতে হইবে।
(১৩০৭-১৩০৮
সালের 'প্রদীপ' পত্রিকায় প্রকাশিত)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)