পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
(
১৮৫১ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতায় 'ভার্নাকুলর এডুকেশন সোসাইটি'
প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিবিধ বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টায়
'বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ' নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ঐ
বছরেই অক্টোবর মাসে| বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম সচিত্র
মাসিক পত্রিকা| লেখকের নাম তখন প্রকাশিত হত না। মূল রচনার সঙ্গে
মুদ্রিত ছবিটি এখানে সংযোজিত হল। রচনাটির মূল বানান অপরিবর্তিত
রাখা হয়েছে। বিষয়বস্তু ছাড়াও আজ থেকে ১৫০ বছর আগে সাধু ভাষার
ব্যবহার ও পত্রিকায় ব্যবহৃত ছবি সম্বন্ধে কিছুটা হয় ত ধারনা
হবে রচনাটি থেকে। )
দীপক সেনগুপ্ত
এতৎ পত্রের দ্বিতীয় সঙ্খ্যা প্রকাশানন্তর
আমরা কোন বন্ধু প্রমুখাৎ শ্রুত হইয়াছি যে কোন ২ বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহানুরাগিণী
ধীমতীরা রাজপুত্র-ইতিহাস প্রসঙ্গে ব্যবহৃত ভীল শব্দে কোন্ জাতিকে
কহে? তাহাদের আবাস স্থান কোথায়? তাহারা কোন ধর্ম্মবলম্বী? ইত্যাদি
বিষয়ক ইতিহাস জানিতে ইচ্ছা করেন| এই অনুরোধ বশতঃ আমারা পরমাহ্লাদ
পূর্ব্বক এই সঙ্ক্ষেপ প্রস্তাব চিত্র সম্বলিত প্রকাশ করিলাম|
শাস্ত্র প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদি বর্ণ-সকল ব্যতীত
এই ভাতরবর্ষের নানা স্থানে বেদ-শাস্ত্র-বিমুখ নানা অসভ্য
জাতি সকল বহুকালাবধি বর্ত্তমান আছে; এবং ইহাদের অনেকের
নাম পুরাণাদিতেও প্রাপ্ত হওয়া যায়| এতদ্দেশের প্রায়
সমস্ত পার্ব্বত্য ভূমি এই অসভ্য জাতিতে পরিপূর্ণা| আসাম
দেশে "গারো", "নাগা" এবং "ডোফলা"
নামে প্রসিদ্ধ অসভ্য জাতিরা তদ্দেশের সবুদয় বন ও পর্ব্বতকে
প্রজায় পূর্ণ করে| বঙ্গ দেশের উত্তরস্থ পর্ব্বত-সকল
"কোচ", "বোদো" এবং "ঢিমাল"
জাতিরা সংকীর্ণ হয়| রাজমহল নগরের দক্ষিণে "সোন্তাল"
দিগের বাস; তদ্দক্ষিণ-পশ্চিমে "পার্ব্বতীয়া"
জাতি; তদ্দক্ষিণে মেদিনীপুর অবধি "ধাঙ্গড়"
জাতি; তদ্দক্ষিণ-পশ্চিমে "গোঁড়" বা "গোণ্ড"
জাতি; তৎপরে "কোল" জাতি সকল বাস করে| ভারতবর্ষের
পশ্চিম প্রদেশে সৌরাষ্ট্র দেশের পূর্ব্বভাগে বন্দেল-খণ্ড
দেশস্থ বিন্ধ্য পর্ব্বত পর্য্যন্ত সমস্ত পার্ব্বত্য
ভূমি "ভীল" নামা ধাঙ্গড়বৎ-জাতি বিশেষের বাসস্থান|
এই জাতি অতি প্রাচীন; পূরাণাদিতে "ভিল্ল"
নামে ইহাদের উল্লেখ আছে; এবং কোন সময়ে যে ইহারা ক্ষমতাপন্ন
ছিল পুরাণে ও রাজপুত্র-ইতিহাসে তাহার যথেষ্ট প্রমাণ
দৃষ্ট হইতেছে| ইহাদের জাত্যভিমান নাই; সকলেই এক বর্ণ;
কিন্তু বংশ ভেদ আছে, এবং তদ্বংশের উত্তম মধ্যম কণিষ্ট
নিরূপণ হয়| ঈশ্বর জ্ঞান ইহাদের কিছু মাত্র নাই; কেবল
আপৎকালে তম্নোচনার্থে জ্বরাদি রোগের কল্পিত অধিষ্টাত্রী
দেবতার পূজা করার প্রথা আছে| গোরক্ষনাথ ঋষিকেও ইহারা
মান্য করিয়া থাকে| খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে ইহারা সর্ব্বভুক্;
কোন বস্তুই পরিত্যাগ করে না; গোমাংসাদি সকল বস্তু ভোজন
করে; এবং অহরহ মৌয়া-ফল-নিঃসৃত মদে প্রমত্ত থাকে| সকল
উৎসবে-বরং আত্মীয় স্বজন বিয়োগান্তেও-এই মাদকে বিহ্বল
হওয়া ইহাদের এক প্রবল রীতি| চৌর্য্য বৃত্তিতে ইহারা
প্রসিদ্ধ; এবং পশ্চিম অঞ্চলে "ভীল" শব্দ চোর
শব্দের প্রতিবাক্য হইয়াছে| কিন্তু এই দুষ্কর্ম্মে ভীল
মাত্রই সম রূপে অগ্রগণ্য নহে| গ্রামবাসি অনেক ভীল ব্যক্তিও
প্রহরি এবং দাসত্ব কর্ম্মে সাধুতাদ্বারা প্রশংসা ভাজন
হইয়া কালযাপন করিতেছে| অপর অনেকে ক্ষেত্র কর্ষণে নিযুক্ত
আছে; তাহারাও চৌর্য্য ব্যবসায়ে রত নহে| কিন্তু যে সকল
ভীলেরা অদ্যাপি বনে বাস করিয়া মৃগয়ায় কালযাপন করে, তাহারা
স্বভাবতই শস্যাদির উৎপাদনে অক্ষম, সুতরাং অনায়াস-সাধ্য
চৌর্য্য কর্ম্মে নিযুক্ত হয়|
ভীলদিগের শরীর স্থূল ও খর্ব্ব; এবং তাহাদের স্বভাব চঞ্চল এবং শ্রম
সহনে তৎপর| উদ্বাহ বিষয়ে ইহাদের এক আশ্চর্য্য রীতি আছে| প্রথমতঃ
কন্যা পাত্র নির্ণয় হইলে পর উভয় পক্ষের জ্ঞাতি কুটুম্ব উভয়ের বাটীতে
একত্র হইয়া ক্রমাগত দুই দিবস পান ভোজনে মত্ত থাকে| পরে তৃতীয় দিবসে
বরযাত্রী স্ত্রী পুরুষ-সকলে কন্যার বাটীতে আসিয়া কন্যাপহরণ করে;
এবং নির্ব্বিঘ্নে কন্যাপহরণ হইলে ঐ বিবাহ মঙ্গলদায়ক নচেৎ অমঙ্গলজনক
জ্ঞান করে|
ভীলদিগকে পুং-শবকে দাহ করে; এবং স্ত্রী ও বালকদিগকে সমাধি অর্থাৎ
গোর দেয়|
ইয়রোপীয় পুরাবৃত্তনুসন্ধায়িরা কহেন, যে এই অসভ্যজাতি সকলেই ভারতবর্ষের
আদি প্রজা| ফলতঃ বেদানুগামি হিন্দুরা কোন সময়ে ভারতবর্ষের উত্তর
পশ্চিমস্থ অত্যল্পস্থান মাত্র অবলম্বন করিয়াছিল, এবং ক্রমশ এতদ্দেশের
অধিকাংশ ব্যাপ্ত হইতেছে; তথা ঐ বেদানুগামিদিগের বিস্তৃত হওনের
পূর্ব্বে ভারতবর্ষে কোন প্রজার অবস্থিতি ছিল, ও পরে তাহারা বৈদিক
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদিদ্বারা তাড়িত হইয়া ক্ষেত্রাদি পরিত্যাগ পূর্ব্বক
বনে ও পর্ব্বতে বাস করিয়াছে ইহাও অসম্ভব কি অসংল্গ্ন কথা নহে|
বরং অমরিকা, অফরিকা, অস্ত্রেলীয়া ইত্যাদি দেশে ইউরোপীয় সভ্যব্যক্তিদেগের
অবস্থিতি হওয়াতে তদ্দেশীয় প্রাচীন প্রজাদিগের যে অবস্থা হইয়াছে
তদ্দৃষ্টে স্পষ্টই বোধ হয় যে অতদ্দেশে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দিগের
রাজ্য বিস্তার হওয়াতে অত্রত্য পূর্ব্বতন প্রজারা ঐ রাজ্যে পরাধীন
হইয়া বাস করা অপেক্ষায় বনে ও পর্ব্বতে বাস শ্রেয়ো বোধে তদ্রূপ
করিয়াছে; এবং বহুকালাবধি তথায় আপনাদিগের প্রাচীন রীতি, নীতি, ব্যবহার
ও ভাষা রক্ষা করিয়া বাস করিতেছে| বর্ত্তমান অসভ্য জাতিরাই ব্রাহ্মণ
ভয়ে পলাতক আদিম জাতির অপত্য কি না, এবং সেই জাতি এক কি অনেক তাহার
প্রমাণ এই সকল জাতির ইতিহাসের উত্তম সমন্বয় না করিলে নিশ্চয় হয়
না|
(
‘বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ’ মাসিক পত্রিকা, শকাব্দ ১৭৭৩ [১৮৫১ খ্রিঃ],
পৌষ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।